[ এই লিখাটি সম্পূর্নরুপে মস্তিস্কপ্রসূত... ]
আমি একজন মানুষ, তবে সংখ্যালঘু। আমাদের নিয়ে এই দেশে বিশাল রাজনীতি চলে। এই দেশে যদিও সংখ্যালঘুদের কোন দল নেই, কিন্তু বেশ কয়েকটি ইসলামী দল আছে। থাকবে নাই বা কেন? ইসলামে যদিও গনতন্ত্র কিনবা নারীনেতৃত্ব হারাম, তবুও ইসলামকে পুঁজি করে এই দেশের ধর্মভীরু মানুষের সমর্থন আদায় করা যায়। যদিও কমবেশি সবাই-ই আমাদের বাড়িঘরে আগুন দেয়, সম্পদ লুট করে কিন্তু কেউ কেউ উপরে উপরে মিষ্টি কথা বলে আমাদের সমীহ আদায় করে। আমরা যারা সংখ্যালঘু তারা অধিকাংশই একটি বিশেষ দলের সমর্থন করি। এই সমর্থন কোন লাভের আশায় নয়, হয়তো কিছুটা কম ক্ষতির আশায়...
সেদিন ছিল রাজপথ অবরোধ। আমি আমার কর্মস্থলে যাবার জন্য ঘর থেকে বের হই। পথের মাঝে একটু পর পর টায়ারে আগুন জ্বলতে দেখি, মোড়ে মোড়ে দেখতে পাই শয়ে শয়ে পুলিশ। রিকশা-সিএনজি কিছুই না পেয়ে আমি রাজপথ ধরেই হাঁটা শুরু করি। মনে মনে বেশ কয়েকটা গাল দিলাম বিরোধী দলকে... হঠাৎ করে দূরে দেখতে পাই কিছু পিকেটার বিআরটিসির একটি মহিলা বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। দিকভ্রান্ত অসহায় মহিলাযাত্রীরা প্রানপনে বাস থেকে নামার চেষ্টা করছে। সেদিন আবরোধ থাকায় যাত্রী বেশ কম ছিল, তাই সবাই কোনমতে নেমে গেলো। মন থেকে অবরোধকারী ও পিকেটারদের প্রতি তীব্র ঘৃণা অনুভব করতে থাকি। মানুষ হয়ে কেউ কিভাবে অন্য মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করে?... মাথায় কিছু আসল না, আমি রাজনীতি বুঝি না। যাইহোক, হাটঁতে হাটঁতে পিকেটারদের অনেকটা কাছে চলে আসলাম। আশেপাশে উৎসাহী মানুষ আর সাংবাদিকের কোন অভাব নেই। কেউ মজা দেখছে আর কেউ মহান দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত, যদিও এদের সামনেই পিকেটাররা আগুন দিচ্ছে আর তারা কেউই তাতে বাধা দিচ্ছে না কিংবা যাত্রীদের সাহায্যেও এগিয়ে যাচ্ছে না।
... হঠাৎ কি হল বুঝলাম না। কোন এক দিক থেকে শ-খানেক অবরোধ-বিরোধী হামলা চালালো পিকেটারদের উপর। ভয় পেয়ে গেলাম বেশ। রাজপথ এমন রণক্ষেত্র হতে আমি আগে দেখিনি। কখনোই ভাবিনি, এতো ক্ষোভ ঘৃণা নিয়ে কেউ কারো উপর ঝাপিয়ে পড়তে পারে... আমি চেষ্টা করলাম দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে দূরে সরে যেতে। ...তখনই দূর থেকে কেউ চিৎকার করে বলল, ধর শালারে ধর। আমি ঘুণাক্ষরেও তখন বুঝি নাই, আমার মৃত্যূদন্ডের আদেশ হয়ে গেলো এইমাত্র। হঠাৎ আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ৫-৬ জন এসে আমাকে ঘিরে ফেলল, মারতে শুরু করল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। ভারসাম্য ফিরে পাওয়ার সাথে সাথেই বলতে লাগলাম আমি পিকেটার নই, আমাকে কেনো মারছেন। আমি যত বেশি করে বুঝাবার চেষ্টা করি, তাদের গায়ের জোর যেনো ততই বেড়ে যায়। তাদের হাতের শক্ত রডের আঘাতে আঘাতে আমার হাড়-মাংশ এক হয়ে যেতে লাগল... আমিতো কোন রাজনীতি করি না, আমিতো অবরোধকেও সমর্থন করি নাই, আমিতো গতবার বিরোধীদলকে ভোটও দেইনি। আচ্ছা,এরা কোন দলের? আরেহ, এরাতো তারাই যাদের আমি ভোট দিয়েছি, তবুও এরা আমাকে মারছে কেন? আমি বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলছিলাম। ... ... হঠাৎ কেউ ধারালো কিছু দিয়ে আমাকে আঘাত করল। দেখলাম আমার শার্টটা রক্তে ভিজে গেছে। শরীরে এতো ব্যাথা যে কোথা থেকে রক্ত পড়ছে বুঝতে পারলাম না। আমার শরীরের রক্ত যেনো তাদের উন্মাদনা আরো বাড়িয়ে দিল। আমার মনে হতে লাগল, আমি নিশ্চয় মানুষ নই... আর আমি যদি মানুষ হই তাহলে এরা নিশ্চয় পশু...
বাঁচার আশায়, হঠাৎ আমি শরীরের সব শক্তি এক করে কোনমতে দৌড় লাগালাম। লাঠি আর ধারালো অস্ত্রের আঘাত উপেক্ষা করে আমি বেশ খানিকটা দূরে এসে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লাম। ভাবলাম হয়তো এযাত্রা বেঁচে গেলাম, কেউ অবশ্যই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আমার রক্তে রাজপথ ভেসে যেতে লাগলো, আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। আশেপাশে এতো পুলিশ, এতো সাধারন মানুষ, কেউ না কেউ অবশ্যই আসবে... কিন্তু কেউ আসল না... আমি আরো একবার শরীরের সব শক্তি জড় করে উঠে দাড়ঁলাম। আমার ভাগ্য ভাল বলতে হবে, আমার বেশ কাছে দিয়েই এক রিকশাওয়ালা তার রিকশা নিয়ে যাচ্ছিল, আসলে পালাচ্ছিল। আমি দৌড়ে উঠে বসলাম সেই রিকশায়। বললাম আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে... এই প্রথম আমার প্রতি কারো দয়া হল। আমাকে সে কাছের কোন এক হাসপাতালে নিয়ে গেল, নিজের কাঁধে তুলে আমায় স্ট্রেচারে তুলে দিল... সেদিন হাসপাতালে তেমন রোগীর চাপ ছিল না। ডাক্তার অল্পক্ষনেই চলে আসলেন, আমাকে দেখলেন... আমার শরীরটা ততক্ষনে নিস্তেজ হয়ে আসছিল... কেমন যেনো একটা ঘুম ঘুম ভাব লাগছিল, সারা শরীরে এত ব্যাথা তবে আমি কিছু যেনো অনুভব করতে পারছিলাম না... আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম... জ্ঞান হারানো আগে শুনলাম, ডাক্তার আমার চিকিৎসা করতে আপারগতা জানালেন...কেন করলেন ঠিক বুঝলাম না, আমার তখন এতো কঠিন কিছু বুঝার ক্ষমতা অবশিষ্ঠ ছিল না... ... ..
আমি এখন মৃত... আমার মৃত্যু নিয়েও রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে... কিন্তু আসলে আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? শুধুই কি একটি বিশেষ দল?... নাকি সবাই? যারা অবরোধ ডাকে তারা, যারা আমায় রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেও কিছু করে না সেই সাধারন মানুষেরা, নাকি সেই নীতিপরায়ণ সাংবাদিকরা, যারা দূর থেকে সুনিপন দক্ষতায় আমার মৃত্যূদৃশ্য ধারন করে কিন্তু এগিয়ে আসে না... কিংবা সেই ডাক্তার যে আমার জীবন বাচাঁতে বিন্দুমাত্র ঝুঁকি নিতে চাইল না???