[১]
পৃথিবীতে গুরুত্ব সহকারে ক্রিকেট খেলা দেশের সংখ্যা সীমিত। আইসিসির পূর্ণ সদস্য সংখ্যা মাত্র ১০, এছাড়া আরো কয়েকটি সহযোগী দেশ মিলে হয়তো সর্বোচ্চ ২০টি দেশের বলার মত একটি ক্রিকেট দল আছে। একবার এক কোরিয়ান ছেলের সাথে কথা প্রসঙ্গে তাদের দেশে ক্রিকেট খেলা হয় কিনা জানতে চেয়ে ছিলাম। যা জানতে পারলাম তা হল, ঝিঁঝিঁ পোকার নামে যে একটা খেলা আছে, সেটাই সে ছেলে জানত না। সেই ছেলে বোধহয় অতিমাত্রায় আঁতেল ছিল। যাইহোক, যে দেশগুলো ক্রিকেট খেলে তাদের মাঝেও সবাই যে ক্রিকেটকেই সর্বোচ্চ গুরত্ব দেয়, তেমনটাও নয়। যেমনঃ নিউজিল্যান্ডে রাগবি, ক্রিকেট হতে কয়েক গুণ বেশি জনপ্রিয়। ইংল্যান্ডে ক্রিকেটের চাইতে ফুটবলের প্রভাব কোন অংশে কম নয়, বরং বেশি। অস্ট্রেলিয়া এবং সাউথ আফ্রিকাতেও ফুটবল, ক্রিকেটের মতই সমান জনপ্রিয়, তবে হতে পারে তাদের ফুটবল দল আন্তর্জাতিক মানদন্ডে তত শক্তিশালী নয়। সে যাইহোক, আমাদের উপমহাদেশে ক্রিকেট একটি তীব্র আবেগের নাম, মরণব্যাধি নেশার মত সমতুল্য। ক্রিকেটের আগ্রাসী ব্যাপ্তিতে এই উপমহাদেশে অন্য কোন খেলা জমে উঠতে পারেনি, যা ছিল তাও হারিয়ে গেছে। তাই এত বিপুল জনসংখ্যা থাকতেও অলিম্পিকে উপমহাদেশ থেকে হাতে গোনা ৪-৫ জন পদক পায়। এককালের হকি পরাশক্তি ভারত-পাকিস্তান এখন ইউরোপিয়ান টিমগুলোর কাছে নাকানি-চুবানি খায়। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অনেক খেলাই উপমহাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা হবার পথে। এক কথায় উপমহাদেশের ক্রীড়া-বৈচিত্র্য ধংসে ক্রিকেটের অবদান বিশাল।
[২]
আইসিসি'র নিয়ন্ত্রাধীন ক্রিকেট খেলাটিতে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে তিনটি দেশ (অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এবং ভারত)-এর আধিপত্য চোখে পড়ার মত। এই আধিপত্যের পেছনে আমি ব্যক্তিগতভাবে, অন্য আরো দশ-বারো জনের মত কোন জটিল ষড়যন্ত্র তত্ত্বের গন্ধ পাই না। আমি সহজ সরল বাণিজ্যিক লাভ-ক্ষতি দেখতে পাই। এই লাভ-ক্ষতি ক্ষেত্র বিশেষে ব্যক্তি-কেন্দ্রিক অথবা জাতীয় পর্যায়ের হতে পারে। উদাহরণসরূপ, গত দু-এক বছরে অবৈধ বোলিং অ্যাকশন সন্দেহে নারাইন, আজমল, হাফিজ, সোহাগ গাজী, আল-আমিন ও অনেকেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, কিন্তু ওই তিন দেশের কেউই প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। বোলিং অ্যাকশন প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখনই যখন খেলা চলাকালীন অন-ফিল্ড আম্পায়াররা বোলারের অ্যাকশন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। এখন ঠান্ডা মাথায় ভাবলেই বোঝা যায়, কেন আম্পায়াররা ঐ তিন দেশের কোন বোলারের বিপক্ষে কিছু বলে না। আইপিএল, বিগব্যাশ বা কাউন্ট্রি এই টুর্নামেন্টগুলোতে ডাক পেতে হলে, কিছু টাকা-পয়সা ইনকাম করতে চাইলে এই দেশগুলোর ব্ল্যাকলিষ্টে কে নাম লেখাতে যাবে? গত বিশ্বকাপে নো-বল ডেকে রোহিত শর্মাকে বাচিঁয়ে দেয়া আম্পায়ারটি ছিল আলীম দার, একজন পাকিস্তানি। আমি কখনোই বিশ্বাস করতে পারি না যে, আলীম দার ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানের চিরপ্রতিদ্বন্দী ও চিরশত্রু ভারতের পক্ষে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। আমার মতে ঐ তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্তের পেছনে মূল নিয়ামক, একটি প্রভাবশালী দেশের বিপক্ষে একটি ক্লোজ সিদ্ধান্ত দিয়ে সেই দেশের রোষানলে পড়ার ভয়। এই সহজ ব্যাপারটি বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ে ম্যাচেও লক্ষনীয়। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ বনাম জিম্বাবুয়ের খেলাগুলোতে আম্পায়াদের ভুল সিদ্ধান্তগুলোর ৭০-৮০%-ই বাংলাদেশের পক্ষে এসেছে, কারণ হয়তো ক্রিকেট বাণিজ্যে বাংলাদেশের প্রভাব এখন খুব নগন্য নয়।
[৩]
কোন খেলায় কে কোন দলকে সমর্থন করবে, এটি শুধুমাত্র কে ভাল খেলে তার উপর নির্ভর করে না। সমর্থনের পেছনে সমর্থকের রাজনৈতিক, সামাজিক, পারিবারিক এবং ধর্মীয় অনেক ধরনের মূল্যবোধ এবং চিন্তাভাবনা জড়িত থাকে। আমাদের দেশে ক্রিকেটে কে কোন দলকে সমর্থন করে, কতটা করে ইত্যাদি মেপে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ পরিমাপ করা হয়। একথা মিথ্যা নয় যে, জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে সমর্থন নির্ধারিত হতে পারে, কিন্তু যখন একটি খেলার সাথে দেশপ্রেমকে এত শক্তভাবে সংযুক্ত করা হয় তখন দেশপ্রেম ব্যাপারটিকেই ছোট করা হয়। মাশরাফির ভাষায় বলতে গেলে, "এই যারা ক্রিকেটে দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে চিৎকার করে, এরা সবাই যদি একদিন রাস্তায় কলার খোসা ফেলা বন্ধ করত, একটা দিন রাস্তায় থুথু না ফেলত বা একটা দিন ট্রাফিক আইন মানত, দেশ বদলে যেত। এই প্রবল এনার্জি ক্রিকেটের পেছনে ব্যয় না করে নিজের কাজটা যদি সততার সঙ্গে একটা দিনও সবাই মানে, সেটাই হয় দেশপ্রেম দেখানো। আমি তো এই মানুষদের দেশপ্রেমের সংজ্ঞাটাই বুঝি না!"
[৪]
বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তান দলের বিশাল সমর্থক গোষ্ঠী আছে। এর পেছনে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণগুলো ব্যাখ্যা না করলেও চলে। অতীতে এবং বর্তমানে নানা ঘটনায় এই সমর্থকরা নিজ নিজ ভাললাগার জায়গা হতে নির্দিষ্ট দেশের সমালোচনা করে গিয়েছে এবং করছে। কিন্তু আমরা আসলে কতটা যুক্তিবাদী ও নিরপেক্ষ? রমিজ রাজার নানাকথায় আমরা আঘাত পাই, কিন্তু আতাহার আলীর শব্দচয়ন আমরা কতটা খেয়াল করেছি? বাইরের দেশের সমর্থকদের নানা আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ হই, কিন্তু আমাদের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় যখন বিদেশি খেলোয়াড়দের ন্যাড়া ছবি ছাপা হয়, যখন আমাদের কেউ কেউ বিদেশি খেলোয়াড়ের কাটামুন্ডু সংবলিত ছবি শেয়ার দেয়, সেটা অন্যদের কেমন লাগে? সম্প্রতি কিছু ঘটনায় আমরা আইসিসিকে ভারতের অংগসংস্থা বলছি। হ্যাঁ, ক্রিকেট বাণিজ্যে ভারতের যে অবদান তাতে আইসিসি'র উপর ভারতের পরোক্ষ প্রভাব কোনভাবেই অস্বীকার করা যায় না, কিন্তু যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে অতীব বিশ্বাসী তাদের ভুলে যাওয়া উচিত না অলংকারিক পদ হলেও আইসিসি'র বর্তমান প্রেসিডেন্ট একজন পাকিস্তানি, তার অগোচরে ভারত নিজ স্বার্থ নির্ভেজাল্ভাবে কায়েম করবে এমন ভাবার কিছু নেই। আইসিসি'র সিইও একজন সাউথ আফ্রিকান, তিনি চেয়ারম্যানের সকল সিদ্ধান্ত মেনে নেবার কারণ নেই। অনেকেই বলছে, বাংলাদেশের উত্থান ভারত মেনে নিতে পারছে না? বাংলাদেশের সাথে শেষ দুইটি টি২০ ম্যাচে ভারত অনায়াসে জয় লাভ করেছে। কেউ যদি বাংলাদেশের উত্থানে ইর্ষাণ্বিত হয় তাহলে তাদের হওয়া উচিত যারা বাংলাদেশের কাছে হেরে কাংক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের উত্থানে কেউই অখুশি নয়, কিন্তু আমাদের সমর্থকদের লজ্জাজনক কান্ড-কারখানায় আমাদের সম্পর্কে বহির্বিশ্বে একটি ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে। যাইহোক, আমি কি ভারতকে ডিফেন্ড করছি? না, আমি তা মনে করি না। আমি শুধু ক্রিকেট, ক্রিকেট বাণিজ্য ও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পেছনে বাস্তবতা খোঁজার চেষ্টা করছি। আমি একটি বা কয়েকটি দেশের নজিরবিহীন আধিপত্যের পেছনে যৌক্তিক কারণ খুঁজতে চাইছি। আবেগাপ্লুত হয়ে কোন জাতি বা কোন দেশকে নিয়ে বাজে মন্তব্য সমর্থনযোগ্য নয়। আমি মাঝে মাঝেই ভাবি, আমাদের যা স্বভাব চরিত্র, কখনো যদি কোন খেলায় আমরা ভারতের মত বাণিজ্যিক আধিপত্য অর্জন করি, আমরা কি ওদের চাইতে ভাল হব?