ছোট বেলায় একটু একটু জ্ঞান অর্জনের সময় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশী অত্যাচার বলে মনে হতো সেটি ছিল মজার খেলা থেকে কান ধরে টেনে এনে পড়তে বসিয়ে দেওয়া। উহ্ সে সময় সুখের ঘরে (খেলার আসরে) বাবা মার আগমন মানেই মূর্তিমান আতঙ্ক বলে মনে হতো
( হায়! সেই স্নেহময় স্নেহময়ী বাবা মা যদি বেঁচে থাকতেন। )
স্কুলে শান্ত সুবোধ পড়ুয়া পোলাপান গুলিকে মেনিমুখো বলদ বলে মনে হতো। স্যারেরা অবশ্য ওদেরকে খুবই আদর করতেন। আর আমরা যারা ব্যাক বেঞ্চার স্যারদের দৃষ্টিতে আমরা এক একজন ছিলাম ইবলিশের চ্যালা । প্রত্যেক স্যারের ক্লাশে পিছনের বেঞ্চে কান ধরে দাড়িয়ে থাকা ছিল আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন । তবে বান্দর জাতীয় প্রানীর গুন থাকায়, কোন ছাত্র আমাদের দুরোবস্থা দেখে হাসাহাসি করার তেমন সাহস পেতনা। মেয়েরা হাসাহাসি করলেও আমরা গা করতাম না। মেয়ে মানে আমাদের দৃষ্টিতে অদ্ভুদ শ্রেনীর প্রানী, এরা কেন যে নিজেদের মধ্যে কানাকানি ফিসফাস করে হাহা হিহি করতো আমরা তার কিছুই বুঝতাম না।
(আমাদের স্কুলে কো এডুকেশন সিস্টেমে ছেলে এবং মেয়েদের পড়াশুনা একসাথে হত। ক্লাশ এইট পর্যন্ত একসাথে এবং নাইন টেন পর্যন্ত আলাদা আলাদা তারপর টেষ্ট পরীক্ষার পর কোচিং আবার একসাথে )
আমাদের প্রিয় ইভেন্ট ছিল স্কুল ফাঁকি দিয়ে দুরের দিঘীতে গিয়ে বড়শিতে কেচোঁ গেথে বেলে মাছ ধরা টাকি মাছ ধরা।
পুকুর পাড়ের আমগাছে উঠে পুকুরের উপর বিছিয়ে থাকা ডাল থেকে ঝাপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটা।
ডুব সাতাঁর দিয়ে কে কত দুর যেতে পারে তার পাল্লা দেওয়া। তারপর স্কুল ছুটির সময় চোখ লাল করে বাসায় ফেরা। মা লালচোখ দেখে জ্বর হয়েছে কিনা কপালে মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে পরখ করে দেখতেন ।
(সরল স্নেহময়ী মা জানতেন না তার বাঁদর ছেলে পড়াশুনার মত অপকর্ম বাদ দিয়ে কি সব মহান কর্ম করে চোখ লাল করেছে)
স্কুল ফাঁকি দিয়ে বনবাদারে ঘুরে ঘুরে পাখীর বাসায় হানা দিয়ে ডিম দেখতাম । কত রকমের ডিম! হালকা সবুজের উপর ছিট ছিট মোজাইকের মত আবার কোন কোন টি হালকা নীল, কোনটি ধূসর ওগুলো নেড়ে চেড়ে রেখে দিতাম কাকের ডিম কিন্তু খুব সুন্দর হালকা নীল । মা পাখীর চিৎকার চেচামেচি আর মাথায় দু চারটা ঠোক্কর খেয়ে তাড়াতাড়ি গাছ থেকে নেমে পড়তাম।
পরে ছানা জন্মালে নিয়মিত দেখে আসতাম। প্রথমে চোখ ফুটতোনা আমরা এলে কচি কচি ঠোট (গোড়ায় হলুদ রং) হা করে খাবার চাইতো (জানতো নাতো এগুলো আসলে মানুষের পোনা বান্দর প্রজাতির প্রানী) আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম কচি চামড়ার নিচে পেট, পালক বিহীন পাখার ঝাপটা ঝাপটি । তারপর নিয়মিত উঁকি দিয়ে এগুলোর বেড়ে উঠা দেখতাম । চোখ ফোটার পর আমাদের দেখে ভয়ে সরু কচি কচি কন্ঠে কিচির মিচির শুরু করে দিত। আমরাও দেখা বাদ দিয়ে অপেক্ষায় থাকতাম কবে উড়তে শুরু করবে । একদিন দেখি ডালে বাচ্চা গুলি বসে আছে মা পাখী পোকা ধরে এনে দিচ্ছে আর ওরা ডানা ঝাপটে ঝাপটে খাচ্ছে (কিইই জানি ওদের ডানা ঝাপটানিটা মনে হয় মায়ের কাছে আহ্লাদ প্রকাশ।)
একদিন ভুল করে কাকের বাসায় হানা দিয়েছিলাম তার ফল হয়েছিল মারাত্মক । মা আর বাবা কাকের হামলার সাথে জুড়ে গিয়ে পুরো কাক সমাজ আমাদের উপর হামলে পড়লো। সারাক্ষণ মাথার পিছনে ঠোক্কর আর খামচি খেতে খেতে পালিয়ে বাঁচলাম। তারপরও বাজার বা রাস্তাঘাটে আমাদের দেখলে কা কা করে এসে মাথায় ঠোকর দিত। ওরা আমাদের চিনতো কি করে ? আমরাতো একটা কাক থেকে আরেকটা কাকের পার্থক্য বুঝিনা সবগুলিকে দেখতে একই রকম লাগে। এদের আক্রমনের কারনে সবাই বুঝে যেত আমরা কিছুনা কিছু দুষ্টুমী করেছি। মহা জ্বালা কি করা যায় ভাবছিলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম এবার ঠোকরাতে এলে কোন না কোন খাবার ছুড়ে দেবো। পরবর্তী আক্রমনের সময় পাউরুটির ছোট ছোট টুকরো দিয়ে ঢিল ছুড়তে থাকলাম । প্রথমে ওরা ভয় পেয়ে আরও ক্ষেপে গিয়ে জোরে জোরে কা কা করে আরও ঘন ঘন ঠোকর দিতে এল, কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলো এগুলো খাবার। তখন হুটোপুটি করে পড়ে থাকা সব পাউরুটি খেয়ে ফেলল, এরপর আমরা রুটির ঢিল ছুড়ে মারলেই শূন্যে খপ করে ধরে উড়ে যেতে লাগলো। আমরাও বেশ মজার খেলা পেয়ে গেলাম। খেলায় খেলায় আমাদের সাথে শত্রুতা ভুলে ওদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এরপর পারতপক্ষে আমরা ওদের নীড়ের ধারে কাছেও আর যেতাম না।
একবার একটা ঘটনা থেকে (যদিও সেটার পরিনতি ছিল ভীষন নির্মম) আমরা পাখীর ছানা ধরা থেকে বিরত থাকতাম। সেবার আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ডানপিটে টা পকেটে করে একটা ছানা নিয়ে গাছ থেকে নেমে পড়ে। আমরা তুলতুলে বাচ্চাটা নিয়ে হাতবদল করতে করতে তার কাঁপুনী আর একটু পর পর খাবারের জন্য হা করা দেখতে থাকলাম। কিছুক্ষণ পর বাচ্চাটা কি করা হবে এটা নিয়ে তর্কবিতর্ক শুরু হলো । আমরা বললাম, ‘ওটা ওর বাসায় দিয়ে আয়, ও’ বললো, ‘না এটা তার বাসায় নিয়ে গিয়ে পালবে।‘ বললাম, ‘তুই সারাক্ষণ পোকা ধরে ধরে খাওয়াবি ? তাহলে তো! আমাদের সাথে ঘোরাঘুরি আর খেলাধুলা সব বাদ দিয়ে তুই খালি পোকার পিছনে দৌড়াবি। তার চেয়ে বাচ্চাটা রেখে আয় আরও একটু বড় হোক তখন ভাবা যাবে।‘ যেই কথা সেই কাজ বাচ্চাটা পাখীর নীড়েই রেখে আসা হলো। পরদিন আবার আমরা আমাদের রুটিন অনুসারে পাখীর ছানাদের দেখার জন্য সেই গাছের নীচে গেলাম। দেখলাম একটা ছানা নীচে পড়ে আছে। শুকনো পাতার জাজিমের উপর পড়ায় তেমন কোন ক্ষতি হয়নি, কিন্তু তেমন একটা নড়াচড়া করতে পারছিল না। গলার কাছে যে খাবারের থলিটা সবসময় টইটম্বুর থাকতো সেটা একদম খালি। বুঝতে পারলাম খাওয়া জোটেনি, আমাদের হাতে মৃতপ্রায় অবস্থায় কোনরকমে নড়াচড়া করছে। আমরা আবার বাচ্চাটিকে বাসায় ফিরিয়ে দিয়ে চলে গেলাম। পরদিন কৌতুহল নিয়ে আবার ফিরে এলাম ফলাফল দেখতে। দেখলাম গাছের নীচে ছানাটি মৃত অবস্থায় পড়ে আছে।
আমরা ছোট্ট পোলাপানরা এর কোন কারনই খুঁজে পেলাম না। সেই থেকে পাখীর ছানা আমরা আর ধরি না। ( আমার মনে হয় মা পাখী তার অপর একটি ছানাকেই পোকা খাওয়াচ্ছিল । আর নীড় থেকে সরিয়ে আনা ছানাটিকে নিজের ছানা হিসেবে রিকগনাইজ করতে পারছিল না । ওদিকে সবল ছানাটি প্রতিদ্বন্দীতা দূর করার জন্য দুর্বল ছানাটিকে সম্ভবত ঠেলে বাসা থেকে ফেলে দেয় )
একবার একটা ঘটনা ঘটিয়ে দিয়েছিলাম ক্লাশে । স্যার ক্লাশে কি একটা প্রশ্ন যেন করেছিলেন এখন ঠিক মনে নেই কিন্তু ঘটনা চক্রে উত্তরটা আমার জানা ছিল। অভ্যাস বশত: হাত উঠালেও তেমন গা করিনি, কারন ফার্ষ্ট বেঞ্চওয়ালারা তো আছেই। কিন্তু একটু পরেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে খেয়াল করলাম, আমি ছাড়া আর কারো হাত তোলা নেই। স্যার রক্ত চোখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ব্যাক বেঞ্চারখ্যাত আমার দিকে তাকালেন, ‘ভাবখানা আইজ তোরে আমি খাইছি ! সবুজ কঞ্চির বারি মিস হওয়ার কোন চান্সই নাই।‘
স্যার বললেন, ‘উঠে দাড়ান মহাশয় ! উত্তরটা দেন দয়া করে !’
স্যারের সম্ভাষন শুনে ভীষন ভয় পেয়ে গেলাম, কাঁপা হাটু সামলাতে সামলাতে দুরু দুরু বক্ষে উঠে দাড়ালাম
( ভাবনায় কম্পমান হয়ে আকুল হয়ে ভাবছি আমার উত্তরটা সঠিক তো! ) মরি আর বাঁচি যা আছে কপালে !
উত্তরটা কাঁপা কাঁপা গলায় প্রায় কান্নার সুরে ঝেড়ে দিলাম।
সাহস করে স্যারের দিকে তাকালাম, দেখলাম, স্যারের চেহারা থেকে রাগ বিদায় নিয়ে সেখানে নরম স্নেহের ছায়া ফুটিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন । আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো ! কিন্তু ঘটনা এখানে শেষ হয়নি হলে ভাল হতো।
স্যার আমাকে ডেকে সামনে নিয়ে এলেন। আমি লজ্জাবনত চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে আছি। স্যার ঘোষনা করলেন আমি সবার কান টেনে টেনে যেন শাস্তি দেই । আমি পড়ে গেলাম মহা বিপদে এরা সবাই আমার সহপাঠী আমার বন্ধু,বান্ধবী আমি কি করে সবার কান টেনে টেনে শাস্তি দিয়ে শত্রু হই ? দুশ্চিন্তায় সামনে তাকিয়ে দেখলাম সবার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে আছে।
আমি এক কাজ করলাম স্যার সামনে তাকানো অবস্থায় সবাইকে চোখ মেরে দিয়ে আশ্বাস দিলাম না ঘাবড়াতে । এতে ঐ অবস্থায় কয়েকজন হেসে ফেললো । স্যার হাসির কারন খুঁজতে গিয় অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। আমি তখন শান্ত সুবোধ বালকের মত মুখ করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছি ।
স্যার ভাবলেন, ওরা কান টানার কথা শুনে হেসেছে। তাই যারা হেসেছে তাদের শাস্তি দ্বিগুন করে দিলেন দু হাত দিয়ে তাদের দুকান ধরে ঝাকাতে হবে।
যথারীতি শাস্তি দেওয়া শুরু করলাম। আমি ওদের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে স্যারকে আড়াল করে ফেললাম তারপর কানের কাছে হাত নেওয়ার ভান করে সবার গাল ছুয়ে ছুয়ে আদর করে করে শাস্তি দিলাম।
মেয়েদের গাল ছুঁয়ে আদর করে দেওয়ার পরও দেখলাম লাল হয়ে আছে । (কোন শাস্তি না দিয়ে বরঞ্চ আদর করে গাল ছুঁয়ে দিলাম তারপরও মেয়েদের গাল লাল কেন?? বোকা আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।)
আমাদের নিয়মিত ডানপিটেমির মধ্যে আরও ছিল মার্বেল খেলা, সূতায় মাঞ্জা দিয়ে ঘুড়ীর প্যাচ খেলা। (ইস্! কাঁচ গুড়ো করে বাটতে গিয়ে কতবার যে হাত কেঁটেছি তার ইয়ত্তা নেই।) টেনিস বল দিয়ে পিংপং খেলা, ডাংগুলি খেলা, দাড়িয়া বাঁধা খেলা, ক্যারম খেলা আরেকটু বড় হয়ে ক্রিকেট খেলা, হকি খেলা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এগুলো করতে করতে এবং টিটিপি (টেনেটুনে পাশ) দিয়ে কবে যে বড় হয়ে গেলাম বুঝতেই পারলাম না। সেদিন বুঝলাম যেদিন টেষ্ট পরীক্ষা দেওয়ার পর ফুলের মালা গলায় দিয়ে স্যারেরা কাঁদলেন।
আমরাও কেঁদে কেঁটে বুক ভাসিয়ে উপলব্ধি করলাম স্যারেরা আমাদের মানুষ করার জন্যই শাস্তি দিতেন কিন্তু স্যারদের হৃদয় পূর্ন ছিল আমাদের প্রতি অকৃত্রীম ভালবাসায় ।
আমরাও সেই ভালবাসার প্রতিদান দিলাম কাঁদতে কাঁদতে চোখের জলে স্যারদের চরন ধুইয়ে দিয়ে।
(ভাবছিলাম ১০০তম পোষ্টে কি লিখবো ভাবলাম শৈশব নিয়েই লিখি, কিন্তু তখন জানতাম না যে, ‘শেষে এসে চোখের পানি ধরে রাখতে পারবোনা।‘ সেই স্যারেরা কেউই আর জীবিত নেই । মহান সৃষ্টি কর্তা স্যারদের আত্মা চিরশান্তির ভূমে রাখুন এই প্রার্থনা করি)
মাছ ধরার কিছু গল্প আছে কখনো মন চাইলে লিখবো।
ছবি সূত্র : গুগল ।