

“হেনা ভাই” একটি নাম একটি ব্যাক্তিত্ব এবং আমাদের কাছে ছিলেন ধ্রুবতারার মত জাজ্বল্যমান এক নক্ষত্র। আমরা ছিলাম হেনাভাইয়ের মহাভক্ত ।
আবুহেনা আশরাফুল ইসলাম নামে আমরা কাউকে চিনতাম না। একদিন, সামু পাগলা ০০৭ এর পাগলদের আড্ডা ঘর মাত্র চালু হয়েছে একদিন একজন ব্লগার ভদ্রলোক মন্তব্য করলেন, "আমি একজন বুড়ো মানুষ, আপনাদের আড্ডায় কি আমি সামিল হতে পারি ?"
আমরা সানন্দেই তাকে বরন করে নিলাম বলেছিলাম আমাদের মধ্যে তরুন বুড়োর কোন ভেদাভেদ নেই। তারপর দিনে দিনে আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি কি-ই রত্ন আমরা হাতে পেয়েছি। অচিরেই আমরা বৃদ্ধের খোলসে আমাদের চেয়েও তরুন একজন আড্ডা পাগল মানুষকে আবিষ্কার করেছিলাম।
সেই থেকে শুরু তারপর নিজ গুনেই তিনি কখনো গুরুজী, কখনো ওস্তাদ, কখনো পাগল সর্দার সম্ভাষনে অভিষিক্ত হয়েছিলেন।
ওনার মত এত উদার এত রসবোধ সম্পন্ন এবং দিলদরিয়া মানুষ আগে কখনো দেখিনি।
মাঝে মাঝে ওনাকে তীর্যক আক্রমনাত্বক মন্তব্য করে আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতাম, এবার মরেছি ! কিন্তু কোথায় কি ! তিনি আরো উৎসাহ দিয়ে বলতেন আমি হলাম নেভার মাইন্ড ফ্যামেলীর ছেলে, আপনাদের মন্তব্য আঘাত নয় আমাকে কাতুকুতু দেয় মাত্র, শুনে আমরা হাসতে হাসতে শেষ এই হলো আমাদের ওস্তাদ আমাদের গুরু জনাব আবু হেনা মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম।
ওনার মন ছিল স্বচ্ছ আয়নার মত, কোন কিছুতেই যেন দাগ পড়েনা, আমরা বিভিন্ন সময় এমন এমন কিছু কথা বলেছি যা শুনে তিনি সয়ে নিয়ে ধীর স্থির ভাবে ব্যাখ্যা করে দীর্ঘ উত্তর দিয়ে আমাদের সন্তুস্ট করেছেন অথচ অন্য কেউ হলে আমরা হয়তো সৌজন্যের খাতিরে কিছুই বলতাম না বা বলার সাহস করতাম না অথবা বললেও হয়তো তিনি ভীষণ প্রতিক্রিয়া দেখাতেন।
এখানেই ছিলো হেনাভাইয়ের সাথে আমাদের ভালবাসার দাবী,এবং অধিকার এর প্রশ্ন, মনে হতো আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য এবং উনি সবার মুরুব্বী, আমাদের বড়ভাই।
হেনাভাই আমাদের কয়েকজনকে অটোগ্রাফ সহ ওনার রচিত আত্মজৈবনিক উপন্যাস স্বপ্ন বাসর পাঠিয়েছিলেন।
উপন্যাসটি চুম্বকের মত আমাদের মনযোগ আকর্ষণ করে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে বাধ্য করে।
উপন্যাস পাঠের সময় শুরুর দিকে খুবই মজা এবং সুখোবোধে আমরা আপ্লুত হচ্ছিলাম, তখনও জানিনা আমাদের মাথায় কেমন বজ্রাঘাত বা খড়গাঘাত অপেক্ষায় রয়েছে।
শেষাংশে সেই আঘাত আমাদেরকে বিপর্যস্ত করে দেয়, চোখের পানিতে আমরা সবাই ভেসে যাই ।
যেহেতু ঘটনা সত্য ছিলো, সেহেতু হেনাভাই এর প্রতি সমবেদনায় আমাদের মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে তিনি আমাদের সবার হৃদয়ে স্থান করে নিলেন।
এদিকে আমাদেরও মনে হল আমরাও যেন ওনাকে বরন করে নেওয়ার জন্য হৃদয় দ্বার উন্মুক্ত করে অপেক্ষায় ছিলাম।
হেনা ভাই ব্যাতিক্রমধর্মী সৃজনশীল লেখক ছিলেন। ব্যাতিক্রমধর্মী এইজন্য যে ওনার ছোট গল্পগুলি পড়ার সময় মনে হয় যেন পাঠক ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সবকিছু অবলোকন করছেন বা কল্পনায় যেন সিনেমাটিক ভিউ দেখছেন।
কর্মজীবনের শুরুতে তিনি পোষ্টাল সার্ভিসে যোগদান করেছিলেন জয়পুরহাটে তিনি বেশ কিছুদিন কর্মরত ছিলেন।
হেনাভাই রাজশাহী থেকে প্রকাশিত পত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখতেন পরবর্তিতে স্ট্রোক করার কারনে ওনার লেখালেখিতে বিঘ্ন ঘটে ওনার হাত অবশ হয়ে গেলে বেশ কষ্ট করেই একহাতে এক আঙ্গুলে লিখে লিখে ব্লগিং করতেন। আমরা যখন পরিচিত হই তখন তিনি একহাতেই লিখতেন।
তিনি পূর্বে প্রকাশিত লেখা সমুহ ব্লগে প্রকাশ করে আমাদের পাঠের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
হেনাভাই বুদ্ধিমান এবং প্রজ্ঞাবান ব্লগার ছিলেন। যেখানে যা যেটুকু প্রয়োজন শুধু সেটুকুই বলতেন। তিনি কোন ক্যাচালে জড়াতেন না নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন। ওনার মত প্রজ্ঞাবান রসিক মানুষের সংস্পর্শে এসে নিজেকে ভাগ্যবান মনে হত।
আমাদের প্রীয় ব্লগার আরাফআহনাফ ওরফে ফয়সাল ভাই এবং ফাহিম সাদি (বর্তমানে জার্মান প্রবাসী) রাজশাহীতে হেনা ভাইয়ের বাড়ীতে সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়ে হেনা ভাইকে চমকে দিয়েছিলেন ।
সেখানে এক অম্লমধুর পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিলো। হেনাভাই বারান্দার গ্রীলের ভিতর থেকে বিষয় আশয় জিজ্ঞাসা করছিলেন অর্থাৎ ওনারা কে কি চাই কেন এসেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু অপরিচিত মানুষ দেখে কিছুতেই দরজা খুলছিলেন না।
শেষে ওরা উপায়ন্তর না পেয়ে রাগ দেখিয়ে বললো আমরা আপনার কাছে আসিনি! এসেছি নয়নতারাকে দেখতে আপনি দরজা খুলছেন না কেন ?
ব্যাস আর যায় কোথায়! এরা যে আড্ডাঘরের পাগল সদস্য তা বুঝতে হেনা ভাইয়ের আর এক সেকেন্ডও ব্যয় করতে হয়নি। তাড়াতাড়ী বেরিয়ে এসে প্রথমে ওদের দুজনকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তারপর পরিচয় পর্ব। পরিচয় পর্ব শেষ হতে না হতেই আপ্যায়নের নহর বইয়ে দিলেন যেন সদ্য পরিচিত নয় বহুদিনের পুরনো বন্ধুরা বেড়াতে এসেছেন (আসলেও ভারচুয়ালি তাই)।
হেনাভাবীকে আমরা বুড়ীভাবী বলে সম্বোধন করতাম, তিনিও খুবই উদার মনের মানুষ (দোয়া করি ওনাকে যেন আল্লাহ্ এই শোক সইবার এবং কাটিয়ে ওঠার শক্তি দেন) শুনেছিলাম আদর আপ্যায়নে তিনি হেনা ভাইয়ের তুলনায় এককাঠি সরেস।
ওনার দুই ছেলের মধ্যে বড়ছেলের ঘরে জন্ম নেয় নাতনী তানিশা। হেনা ভাইয়ের সাথে আমাদের এত হৃদ্যতা ছিলো যে হেনা ভাইয়ের বৌমা আমাদেরও বৌমা, হেনাভাইয়ের নাতনী আমাদেরও নাতনী অথচ আমাদের আড্ডায় অনেকেই তখনও কুমার, কুমারী। মজা করে অনেকেই বলতো বিয়ের আগেই “নানা” হয়ে গেলাম। হেনা ভাই প্রথম নাতনীকে (তানিশা) ডাকতেন নয়নতারা বলে সেটা আড্ডাঘরে না গেলে কারো পক্ষেই জানা সম্ভব ছিলনা, সেজন্যই নয়নতারা নামটি দরজা খোলার কী ওয়ার্ড হিসাবে কাজ করেছে।
হেনা ভাইয়ের সাথে আমার ভার্চুয়াল পরিচয়/বন্ধুত্ব ছিলো কিন্তু মনে হয় যেন তা আসলের চেয়েও অধিক কিছু ছিলো।
একবার এক গ্রুপ সহ ঝটিকা সফরে রাজশাহী গিয়েছিলাম সকালে গিয়ে বিকেলে চলে আসা।
পরে সেই ভ্রমন কাহিনী নিয়ে ব্লগে পোস্ট দেই সেই পোষ্ট দেখে হেনাভাই খুব মনোক্ষুন্ন হয়েছিলেন, আমি রাজশাহী গেলাম অথচ ওনার সাথে দেখা করলাম না!? পরে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ওনাকে বোঝাতে হয়েছিলো।
এমনই বন্ধুবৎসল ছিলেন আমাদের প্রিয় হেনাভাই।
মন্তব্য প্রতিমন্তব্যে যে সকল স্মৃতি ছড়িয়ে আছে তা সব উল্লেখ করা সম্ভব নয়,মনের দরজায় ভীড় করে আসা স্মৃতিগুলো শুধু যেন রোমন্থনই করাই সম্ভব।
স্বপ্ন বাসর পড়ে হেনাভাইকে একটা ক্রেস্ট উপহার দিয়েছিলাম। হেনাভাই ভীষন খুশী হয়েছিলেন। হেনাভাইয়ের অনন্ত যাত্রার বেদনা এবং দুঃখের মধ্যেও হেনা ভাইয়ের খুশীটুকু হৃদয়ে ধারন করি সান্তনা স্বরূপ।

স্বপ্ন বাসর উপন্যাসে হেনাভাইয়ের স্বহস্তে লেখা অটোগ্রাফ।

আমাদের প্রিয় হেনাভাই জান্নাতবাসী হোন এই দোয়া রইলো।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০২১ বিকাল ৪:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


