somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

“অসমাপ্ত ও এলোমেলো”

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তারিখঃ ১৮ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৬ সময় বিকেল ৫টা


ইঞ্জিনরুম থেকে সব ইঞ্জিনিয়াররা একে একে উপরে উঠে আসছে। সবার সাথে চীফ ইঞ্জিনিয়ার ফেরদৌসও উঠে আসে। উপরে এসে সাগরের দিকে তাকিয়েই কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। জাহাজের এক পাশের রেলিং এর সামনে দাঁড়িয়ে হারিয়ে যায় কোথায় যেন। চোখের সামনে ভেসে ওঠে প্রায় দুই বছর আগের কিছু স্মৃতি।



২০১৩ সালের ঠিক এই দিনেই সে তার স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছিল কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে নয়। ইচ্ছা মতন যেদিকে দু চোখ যায়। কিছুক্ষণ সময় দেয়া। দুদিনের মাঝেই আবার তাকে চলে যেতে হবে সাগরে। সাগরের ডাক শুনতে পাচ্ছে। শেষ সময়টা যাতে আনন্দে কাতে সেই উদ্দেশ্যে। সবাই মিলে ঘোরাফেরা খাওয়া দাওয়া শেষে মাঝরাতে বাড়ি ফেরে। ফেশ হয়ে সবাই ঘুমোতে যায়। ফেরদৌসের চোখে ঘুম আসে না তখনো। আসলে সবসময়েই এই একই রকমের অনুভূতি হয়। সাগরে চলে যাবার আগে বেশ কয়েকদিন সবাইকে নিয়ে চিন্তিত থাকে। পরের চার মাস সবাই ঠিক ঠাক মতন থাকতে পারবে কিনা। তার স্ত্রী ঠিক মতন পিচ্চি দুটোকে সামলাতে পারবে কিনা এমন নানান চিন্তা। এই বিষয়টা স্বাভাবিক ভাবেই ঘটে। প্রায় ভোর রাতে ঘুম আসে।

সকাল সকাল উঠে সব গোছগাছ করতে করতেই দিন শেষ। আগামী চার মাসের জন্যে বাসায় শেষ রাত। এইবার শুধু তার চোখেই যে ঘুম নেই তা নয়। ঘুম নেই তার স্ত্রী মায়ার চোখেও। দুজনে কুটকুট করে কিছু গল্প করে তারপর এক জন আরেকজনের দিকে শুধুই তাকিয়ে থাকে নিস্তব্ধ নীরব রাতে শুধুই নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।

নীরবতা ভাঙ্গে মায়া। বলে, “তুমি এমন করে না গেলে হয় না? আর কতদিন এভাবে চলবে?”
মুচকি হেসে ওঠে ফেরদৌস। কিছুই বলে না। সাধারণত এইসকল ব্যাপারে চুপ চাপ থাকাই ভাল। যার কোন উত্তর নেই সেই ধরণের প্রশ্ন গুলো চুপচাপ পাশ কাটিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কি ই বা করার আছে। আবারও দুজন নীরব। একে অপরের দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই রাত পার করে দেয়। সকালে ফ্লাইট থাকায় সকাল সকাল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে। এইবার তার জাহাজের পথ আগেরবারের চেয়ে বেশ খানিকটা ভিন্ন। আগের বার পুরো ইয়োরোপ জুরে থাকায় প্রতিদিনই কোননা কোন পোর্ট থাকতো। তাই সবসময়েই বাসায় যোগাযোগ করা হত। এমনকি প্রতিদিনই প্রায়। কিন্তু এবার বোধহয় সেই সুযোগ হবে না। ইমিগ্রেশনের কাছে এসে সবার থেকে বিদায় নিয়ে স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে মুচকি হেসেই উলটো ঘুরে হাটতে থাকে। দুঃখী মানুষের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। নিজেই বিষাদগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সামনে এগিয়ে যায় পেছনে রয়ে যায় তার সকল ভালবাসা আর স্নেহ।

লং বিচ, ইউএসের লসএঞ্জেলেসের পোর্ট। পৌছেই বাসায় সবাইকে জানিয়ে দিল ফেরদৌস ঠিক ঠাক মতন পৌছেছে। এখ শুধুই জাহাজ পোর্ট ছাড়ার অপেক্ষা। এখান থেকে জাপান যাওয়ার কথা। প্রায় ১৫ দিন কারো সাথে কোন যোগাযোগের সুযোগ নেই। যেটুকু আছে তাও না থাকার মতই। মন্দের মাঝে ভাল জাহাজে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট এর সংযোগ আছে। তাতেই কোনমতে যোগাযোগ করা যায়।

দেখতে দেখতে ৩ মাস কেটে গেল জাহাজে। শেষ মাসে সব গোছ গাছের চিন্তায় ফেরদৌস নিজের কেবিন আস্তে আস্তে সাজাতে থাকে। সাধারণত এই কাজটা নিজেই করে। নিজের জিনিষ পত্রের অন্য কেউ হাত দেবে এইটা সহ্য হয়না তার। আজ রবিবার তাই হাতে কিছুটা সময় আছে। হাতের কাজ গুলো শেষ করে একটু ঢু মারতেই ফেসবুক খোলে। মেসেজ ২ টা চোখে পরে। মেসেজ খুলেই যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরে। তার স্ত্রীর ছোট ভাইয়ের মেসেজ। স্ত্রী মায়া হাসপাতালে। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরায় তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। রক্তের শ্বেত রক্ত কণিকার অভাব। কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না ফেরদৌস। এখন সে চাইলেও ফিরে যাওয়া প্রায় অসম্ভব তার পক্ষে। মাঝ প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিচ্ছে। এখনো প্রায় ৭-৮ দিন বাকী পরের ডাঙ্গার দেখা পেতে। ফেসবুকেই রক্তের জন্যে পোস্ট করে। সারাও পায়। যারা যে ভাবে সম্ভব এগিয়ে আসে। কিছুটা হলেও নিশ্চন্ত হয়।

দ্রুত ক্যাপ্টেনের সাথে দেখা করে ফেরদৌস। পরের পোর্ট থেকেই তার সাইন অফ এর জন্যে মেসেজ পাঠায়। স্ত্রীর অসুস্থতার কথা শুনে সবাই বেশ সান্তনা আর সাহস দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু অবুঝ মনরে বোঝায় কে? যাওয়ার জন্যে গোছগাছটা কাজেই লেগে গেল শেষমেশ।

পরের দুইদিন ইঞ্জিনের কি একটা সমস্যা হওয়ায় খুব ব্যাস্ত থাকতে হল তাকে, সাথে জাহাজের স্যাটেলাইটেরও কি এক সমস্যা তার কারণে ঠিক করে খোজ করতেও পারলো না। কিন্তু কাজের মাঝেও মনের মাঝে এক ভয় ঘুরঘুর করছে। কে কি করছে এখন?? ছোট বাচ্চা দুটোরই বা দেখাশোনা কে করছে? তারপরেও কাজ ফেলে বসে থাকা সম্ভব নয়। তৃতীয় দিন হাতে কিছুটা সময় পেয়ে স্যাটেলাইট ফোন দিয়ে ফোন দিল বাসায়। তার ফোন রিসিভ করেই কান্নায় ভেঙ্গে পরে তার স্ত্রীর ছোট ভাই। আজ সকালেই তার স্ত্রীর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়। ডাক্তারের পরামর্শে ইনিটেনসিভ কেয়ারে নেয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। তার মুখ দিয়ে আর কিছুই বের হয় না। ওভাবেই ফোনটা রেখে দেয়। মনেহচ্ছে ঠিক মতন দাড়াতেও পারছে না সে।

পরের পোর্টেই সে বাড়ি ফিরে যায়। শেষবারের মতন স্ত্রীর মুখটা দেখার জন্যেই তাকে শীতল করে রাখা হয়েছিল। শীতলতা তাকেও স্পর্শ করে যেন।



হঠাত করে ব্রীজ থেকে ক্যাপ্টেনের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায় ফেরদৌস। “Chief Already Dinner Time, Let’s Hav together” বর্তমানে ফিরে আসে সে। উত্তর দেয় “Yeh, Comming...”




উৎসর্গঃ মেরিণ একাডেমীর ৩২ ব্যাচের ফেরদৌস জামান স্যার আর ভাবী
(যাদের কাউকেই আমি কোনদিন দেখিনি, পরিচয়ও নেই। যখন ভাবী অসুস্থ ছিলেন তখন দুইবার স্যারকে ফেসবুকে নক করেছিলাম ঠিকানার জন্যে। তার প্রায় ৩ সপ্তাহ পরে আমার নতুন ক্যাপ্টেনের কাছে জানতে পাই ভাবীর সেই অসুস্থতার হাত থেকে আর রেহাই হয় নি। গল্প লেখার সৌভাগ্য আমার নাই। মাঝে মাঝে রংচঙ লাগিয়ে উপস্থাপন করি কিছু ঘটনা। এইখানে যাদের কথা বলেছি এবং তুলে ধরেছি পুরোটাই আমার মন গড়া। শুধু সম্পর্ক আর মানুষগুলো সত্যি। কাউকে কষ্ট দেবার উদ্দেশ্যে লেখা হয় নি।)
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ রাত ৮:৫৪
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সিকান্দার রাজার চেয়ে একজন পতিতাও ভালো।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৭

সিকান্দার রাজা কোকের বোতল সামনে থেকে সরিয়ে রাতারাতি হিরো বনে গেছেন! কিন্তু তাকে যারা হিরো বানিয়েছেন, তারা কেউ দেখছেন না তিনি কত বড় নেমকহারামি করেছেন। তারা নিজেদেরকে ধার্মিক বলে দাবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×