বাংলাদেশে না ফিরে শহীদ মুনীর চৌধুরী, কবীর চৌধুরী ও ফেরদৌসী মজুমদারের ভাই কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী থেকে গিয়েছিলেন পাকিস্তানে:::
‘ আমি পাকিস্তানের পক্ষেই থাকবো, এমনকি শুধুমাত্র যদি পতাকাটা থাকে তাও। আমি ওই পতাকা টাঙ্গানোর খাম্বাটা ধরে হলেও পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকবো’। ১৯৭১ সালে পাক সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছোট ভাই ক্যাপ্টেন মেহবুব যখন বড় ভাই কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরীকে বাংলাদেশে চলে আসার জন্য অনুরোধ করেন তখন এই কথাটাই বলেছিলেন ঢাকার সম্ভ্রান্ত ও সুপরিচিত এক পরিবারের সন্তান কাইয়ুম চৌধুরী। অথচ তার আপন বড় ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ওই একাত্তর সালের ১৪ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর হাতে শহীদ হয়েছিলেন।
তিনি ছোট ভাই মেহবুবকে আরো বলেছিলেন, ‘ আমি ও আমার পিতা পাকিস্তানের স্বপ্নের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিয়েছি।সেই স্বপ্ন যতোই পঁচে যাক, আমি কখনো পাকিস্তান ছেড়ে যাবো না।’
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ষষ্ঠ দীর্ঘমেয়াদী কোর্স থেকে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী শুধু একটি নাম নন, তার পরিবার বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ ও পরিচিত একটি পরিবার। বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাবেক সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, প্রখ্যাত অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার তার আপন ভাই-বোন। সংযুক্ত পাকিস্তানে যতোজন বাঙ্গালি সামরিক বাহিনীতে কমিশন পেয়েছেন তাদের মধ্যে তাকে গন্য করা হয় সবচেয়ে মেধাবী হিসাবে। তিনি ১৯৫২ সালের অগাস্টে কাকুলস্থ পাক মিলিটারি একাডেমি থেকে সার্বিকভাবে সবদিকে শ্রেষ্ঠ ক্যাডেট হিসাবে সোর্ড অফ অনার ও একইসাথে একাডেমিক খাতে প্রথম হয়ে নর্মান গোল্ড মেডাল অর্জন করেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে শহীদ নিশান ই হায়দার মেজর রাজা আজিজ ভাট্টি ‘র পর এই বিরল মর্য়াদার অধিকারী হিসাবে ইতিহাসে নাম লেখান একমাত্র কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী। কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন হিসাবে পরিচিত হওয়ায় একসময় তার অফিসার হওয়াই প্রশ্নের মুখে পরে। তবে সেসময় পিএমএ’র কমান্ডান্ট যখন তাকে ডেকে এব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন তখন তিনি দৃঢ়ভাবে বলেন, আমার আদর্শ কি সেটা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে পাকিস্তানের প্রতি আমার আনুগত্য প্রশ্নাতীত। আমৃত্যু তিনি তার আনুগত্য বজায় রেখেছেন। যদিও ২০১৩ সালে তার মৃত্যু হয় সুদূর আমেরিকায় ও সেখানেই তাকে কবরস্থ করা হয়।
২০০৬ সালের নভেম্বরে সাংবাদিক ও অধ্যাপকদের একটি দল পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রনে সেদেশ সফরে যায়। সেই দলে আমিও ছিলাম। আমাদের দলনেতা ছিলেন দি ডেইলি স্টারের এসোসিয়েট এডিটর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শাহেদুল আনাম খান। তিনিও কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরীর ঘনিষ্ট আত্মীয়, তার স্ত্রী কর্নেল কাইয়ুমের ছোট বোন। সেই হিসাবে কর্নেল চৌধুরী ব্রিগেডিয়ার আনামের সমন্ধি।
আমি প্রথম কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী সম্পর্কে জানতে পারি ১৯৮৮ সালে আমার কমান্ডিং অফিসার ও পরবর্তিতে মেজর জেনারেল মনজুরুল আলমের কাছ থেকে। তার পিতা মুক্তিযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন। মেজর হিসাবে তাকে পাকিস্তানের স্টাফ কলেজে দ্বিতীয় বারের মতো স্টাফ কোর্স করতে পাঠানো হয়। সেখানে ক্লাস নিতে এসেছিলেন কর্নেল কাইয়ুম। এক পর্য়ায়ে মেজর মনজুর তাকে তার পাকিস্তানে থেকে যাওয়া নিয়ে কঠিন স্বরে প্রশ্ন করেন। কর্নেল কাইয়ুম তার যুক্তি হিসাবে পাকিস্তানের প্রতি শপথের কথা তখনও উল্লেখ করেছিলেন।
এদিকে পাকিস্তান সফরের কোন একসমফ ব্রিগেডিয়ার আনাম বলেছিলেন যে কর্নেল কাইয়ুমের সাথে আমাদের দেখা হবে, তবে কখন তা জানাননি। ২৮ নভেম্বর আমাদের দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত ছিল পাক সশস্ত্রবাহিনীর সাবেক জয়েন্টস চীফস অফ স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল আজিজ খানের পিন্ডি ডিওেএইচএস-এর বাসায়। সেখানে গিয়ে দেখি কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী উপস্থিত। পাকিস্তানী ট্রাডিশনাল কাবুলি ড্রেসে তাকে একজন ইন্টেলেকচুয়াল হিসাবে বেশ মানিয়েছে। আরো উপস্থিত ছিলেন ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ও পাকিস্তানে থেকে যাওয়া দু’জন উর্ধতন সামরিক কর্মকর্তা।আমরা আসবো বলে তাদেরও দাওয়াত দিয়েছেন জেনারেল আজিজ খান।
কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী ছাড়া অপর দু’জন সেনা কর্মকর্তা হলেন মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান ও কর্নেল কামাল। মে.জে. খলিল পাঞ্জাবী নারী বিয়ে করে পাকিস্তানেই থেকে গেছেন। দীর্ঘদিন চাকুরি করে অবসরে গেছেন। কর্নেল কামাল আবার ব্রিগেডিয়ার শাহেদুল আনামের কলেজমেট-ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র। তখন তিনি ফৌজি ফাউন্ডেশনে কাজ করছেন সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর। দু’জনই বাংলা বলতে পারেন।
এমন পরিবেশে সঙ্গতকারনেই আমাদের আগ্রহ বেড়ে গেল পাকিস্তানে থেকে যাওয়া তিন জন বাঙালি বাঙালি সেনা কর্মকর্তার উপস্থিতিতে। আড্ডা জমে উঠলো যুতসইভাবে। মাঝে চললো ফটো সেশন। আমি লক্ষ্য করলাম কর্নেল কাইয়ুমের সাথে খুবই সম্মানের সাথে কথা বলছেন জেনারেল আজিজসহ পাকিস্তানী সবাই। তিনি মৃদু স্বরে কম কথা বলেন। ব্রিগেডিয়ার আনামকে কাছে পেয়ে পারিবারিক অনেক কথা তাদের মধ্যে শুরু হয়ে গেল। ঢাকায় ফেরদৌসী মজুমদার কেমন আছেন,রামেন্দু মজুমদারের খবর কি ইত্যাদি ইত্যাদি।
ওখানেই জানতে পারলাম যে, কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী ১৯৫২ সালে সাজোয়া কোরের ১১ ক্যাভালরি রেজিমেন্টে কমিশন পান। সেই ইউনিটের অধিনায়ক ছিলেন আরেক প্রবাদ প্রতিম সেনা কর্মকর্তা সাহাবজাদা ইয়াকুব খান। দু’জনের ইন্টেলেকচুয়াল লেবেল ছিল প্রায় একই ধাঁচের। তাই উভয়ের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠে দৃঢ়ভাবে। কর্নেল কাইয়ুম সাহাবজাদার অধীনে ব্যাটালিয়নের এডজুটেন্টের দায়িত্বও পালন করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পাক সেনাবাহিনীতে নাম করে ফেলেন কর্নেল কাইয়ুম। তার ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা ও সব বিষয়ে লেখাপড়া নিয়ে সবাই তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা শুরু করেন। কোয়েটার পদাতিক বাহিনীর স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি এন্ড ট্যাকটিকস-এ অনুষ্ঠিত কোর্সে তিনি সাজোয়া কোরের অফিসার হয়েও প্রথম স্থান লাভ করেন। সব কোর্সেই তিনি প্রথম হতেন। মেজর হওয়ার পর তাকে জার্মানী পাঠানো হয় স্টাফ কলেজ করার জন্য। সেসময় ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ শুরু হলে তিনি দ্রুত দেশে ফিরে আসেন। পুরো যুদ্ধে অংশ নিতে না পারলেও তার দক্ষতার জন্য যুদ্ধের ঠিক পরপর তাকে তৃতীয় সাজোয়া ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। যে ডিভিশনের অধীনে ওই ব্রিগেড ছিল সেটির ডিভিশন সদর দপ্তরে জিএসও-১ ছিলেন লে.কর্নেল জিয়াউল হক। সেসময়ই দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয় যা জিয়ার মৃত্যু পর্য়ন্ত অব্যাহত ছিল।
এরপর অল্প সময়ের জন্য তদানীন্তন মেজর কাইয়ুম চৌধুরী জিএইচকিউ অর্থাৎ জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে মিলিটারি অপারেশন্স পরিদপ্তরে জিএসও-২ হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে পদোন্নতি পাওয়ার পর খারিয়া ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত ১১ ক্যাভালরির অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয় তাকে। সেসময় ওই ব্যাটালিয়ন যে তৃতীয় সাজোয়া ব্রিগেডের অধীনে ছিল সেটার কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল হক। এভাবে দ্বিতীয়বারের মতো জিয়ার সাথে তার যোগাযোগ গাড় হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
তার অধিনায়কত্ব ছিল ভিন্ন ধাঁচের। তিনি সৈনিকদের দরবার নেয়ার সময় শুরুতে ইউনিটের ধর্মীয় শিক্ষক বা মৌলবী যে কোরআন তেলাওয়াত করতেন সেই রীতি পাল্টিয়ে নিজেই কোরআনের আয়াত পাঠ করতেন আরবীতে। তারপর অফিসারদের বোঝার জন্য ইংরেজিতে ও সৈনিকদের বোঝার জন্য উর্দু ও বাংলায় তার তরজমা করতেন।
আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কাহিনী শুনছিলাম। একপর্য়ায়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, স্যার, আপনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে গেলন না কেন? মৃদু স্বরে তিনি বললেন, দেখো, আমি পাকিস্তান রাষ্ট্র যে আদর্শের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল তার প্রতি বরাবর অনুগত, সেই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি যে শপথ নিয়েছি সেই শপথ আমি ভাঙ্গতে চাইনি। আমি একজন পাকিস্তানী হিসাবেই থাকতে চেয়েছি ও এখনো সেই পাকিস্তানীই আছি। তবে তিনি জোর দিয়ে জানান যে তিনি কখনো কোন মানবাধিকার বিরোধি কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন না। তিনি আরো জানালেন যে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান তাকে কয়েকবার বাংলাদেশে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তিনি যাননি। আমি প্রশ্ন করলাম- আপনার ভাই তো মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন বুদ্ধিজীবী হিসাবে, অপর ভাই বোনরাও বাঙালি জাতীয়তাবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক, এক ভাই তো বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ছিলেন এসব কি আপনাকে নাড়া দেয় না? তার সুস্পষ্ট উত্তর- তারা তাদের ব্যক্তিগত চিন্তা ও আদর্শের মধ্যে থেকেছেন, আমি থেকেছি আমার আদর্শের মধ্যে। তবে মাঝে মাঝে তিনি বাংলাদেশে যান ও পরিবারের সবার সাথে সময় কাটান। আমাদের সাথে দেখা হওয়ার পরও একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন মৃত্যুর আগে। বড় ভাই শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন যে, লে. জেনারেল সাহাবজাদা ইয়াকুব খান যখন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর ছিলেন তখন মুনীর চৌধুরী জেনারেল ইয়াকুবকে বাংলা ভাষা শিখিয়েছিলেন। যাহোক, তিনি কখনোই পাকিস্তানের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে বাংলাদেশি বনে যাননি। তার স্ত্রী ছিলেন পাকিস্তানী, সেটাও হয়তো একটা কারন হতে পারে বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। সাংবাদিক হিসাবে আমার কাজ কাউকে প্রভাবিত করা নয়, তথ্য ও পর্দার আড়ালের বিষয়াদির উপর জোর দেয়া। তাই তাকে আর বিব্রত করতে চাইনি।
তবে পরবর্তিতে বিভিন্ন সূত্রে ও সিনিয়রদের কাছ থেকে যতোটুকু জানতে পেরেছি তাতে কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী তার জীবনের প্রথম ধাপে অনেকটা কমিউনিস্ট ধাঁচের ছিলেন। কোন কোন সময় তিনি ধর্ম বিশ্বাস থেকেও সরে যেতেন। তবে এক পর্য়ায়ে পুরোপুরি ধার্মিকে পরিণত হন।
১৯৭০ সালে কর্নেল কাইয়ুমকে জার্মানীর প্রেস্টিজিয়াস সেনা প্রতিষ্ঠানে জেনারেল স্টাফ কোর্স করার জন্য প্রেরণ করা হয়। যেসব অফিসার শীর্ষ পর্য়ায়ে কমান্ড করার যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন তাদেরই কেবল এজাতীয় প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর প্রশিক্ষনের জন্য পাঠানো হতো। সেখানে তিনি অবিশ্বাস্য রেজাল্ট করেন। তাকে জার্মান জেনারেল স্টাফের অনরারী সদস্য হিসাবে মনোনয়েনের মাধ্যমে জার্মান সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান প্রদান করা হয়।
এদিকে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কোর্স শেষ না করেই পাকিস্তানে ফিরে আসার জন্য কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবেন বলে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার পুরনো বন্ধু মেজর জেনারেল শওকত রেজা যিনি সেসময় পূর্ব পাকিস্তানে একটি ডিভিশনের জিওসি ছিলেন তিনি তাকে সেসময়কার জটিল পরিস্থিতি থেকে যতোদূরে সম্ভব থাকার জন্য উপদেশ প্রদান করেন। তিনি কর্নেল কাইয়ুমকে লেখা চিঠিতে বলেন, ‘ ডোন্ট কাম কাইয়ুম। কিপ এওয়ে ফ্রম ইট এস ফার এস ইউ ক্যান’। এদিকে মে.জেনারেল শওকত রেজাকেও ‘ বাঙালিদের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে কাজ না করার’ অপরাধে জেনারেল নিয়াজী কমান্ড থেকে সরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
জার্মানী থেকে ফিরে আসার পর কর্নেল কাইয়ুমকে কোয়েটার অভিজাত কমান্ড ও স্টাফ কলেজে প্রশিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। যুদ্ধের পর তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় কোয়েটার বন্দী শিবিরে। লে.জেনারেল গুল হাসান খান কমান্ডার ইন চীফ নিযুক্ত হওয়ার পর আদেশ জারী করেন যে ‘কাইয়ুমকে বন্দী শিবির থেকে নিয়ে আসো। যখন ওর ইচ্ছে হবে তখন সে বাংলাদেশে ফিরে যাবে।’
এই অবস্থায় কর্নেল কাইয়ুম আবারো স্টাফ কলেজের সিনিয়র প্রশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন। কিন্তু ইতোমধ্যে তিনি আর সেনাবাহিনীর চাকুরি করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেন ও পদত্যাগ পত্র জমা দেন। কিন্তু তার পদত্যাগ পত্র গৃহিত হয়নি। জেনারেল টিক্কা খান সেনাপ্রধান হওয়ার পর স্টাফ কলেজে সফরে গেলে কর্নেল কাইয়ুমের সাথে আলাপের পর তার পদত্যাগ পত্র গ্রহনে রাজী হন, কিন্তু তাকে স্টাফ কলেজে পড়ানোর কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
১৯৭৪ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়ার পর কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী পরবর্তি তিন বছরের জন্য স্টাফ কলেজে জিও পলিটিক্স, অংক, লজিক ও বিজ্ঞান পড়ানো অব্যাহত রাখেন। ১৯৭৫ সালে জেনারেল জিয়াউল হক যখন মুলতানে একটি কোরের অধিনায়ক তখন কর্নেল কাইয়ুমকে সৈনিকদের উদ্দেশ্যে একটি প্রণোদনামূলক লেকচার দেয়ার আমন্ত্রন জানান। সেখানে তিনি ‘ ঈমান,তাকওয়া ও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ’ এই তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করেন। পরবর্তিতে সেনাপ্রধান হওয়ার পর জেনারেল জিয়াউল হক ওই তিনটিকেই পাক সেনাবাহিনীর মূলমন্ত্র বলে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৭৭ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর জেনারেল জিয়াউল হক কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরীকে তথ্য মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে নিয়োগ করেন যেখানে পরবর্তি দশ বছর তিনি বিভিন্ন বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পলিসি পেপার লিখতে থাকেন। জিয়া নিহত হওয়ার পর কর্নেল কাইয়ুম বিশ্বখ্যাত থিংক ট্যাংক ইন্সটিটিউটি অফ রিজিওনাল স্টাডিজ-আই আর এস প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামাবাদে যা আজো টিকে আছে। এছাড়া ১৯৯০-৯৪ সময়কালে তিনি করাচীর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেন।
স্ত্রী মারা যাওয়ার পর কর্নেল কাইয়ুম মেয়ে নায়লার কাছে আমেরিকায় চলে যান। সেখানে দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভোগার পর ২০১৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে সেখানেই কবরস্থ করা হয়।
পৃথিবীতে কতো আশ্চর্য় ঘটনাই না ঘটে? কর্নেল কাইয়ুম চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিষয়াবলী তেমন আশ্চর্য় ঘটনার একটি । তার বোন ফেরদৌসী মজুমদার, ভাই ব্রিগেডিয়ার মেহবুব এখনো বাংলাদেশে বেঁচে আছেন।বাংলাদেশে তার সকল ভাই বোন বাঙালি জাতীয়তাবাদের
একনিষ্ঠ সমর্থক, অন্যদিকে কর্নেল কাইয়ুম আমৃত্যু ছিলেন পাকিস্তান অনুগত!
[ ব্রিগেডিয়ার শাহেদুল আনামের কোর্সমেট পাক মেজর জেনারেল সৈয়দ আলী হামিদের একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা থেকে বেশকিছু তথ্য নেয়া হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তান ডিফেন্স জার্নালে কর্নেল কাইয়ুমের নিজের লেখা থেকেও কিছু তথ্য সংযোজিত হয়েছে।সদা কালো ছবিগুলো মে.জেনারেল আলী হামিদের সৌজন্যে
লেখাটি আবু রূসদ এর লেখা থেকে সংগৃহীত।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০২১ রাত ১১:২৪