somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিনি উপন্যাসঃ মন পাখী

০৯ ই অক্টোবর, ২০১৩ সকাল ৭:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সমস্যা একটা হচ্ছে জয়নাল হোসেনের।
শুক্রবার সকাল। ইচ্ছা ছিল মিলি উঠার আগেই পত্রিকার প্রথম পাতা থেকে শেষ পাতা পর্যন্ত সব পড়ে ফেলবে। সারা সপ্তাহের না জানা ঘটনাগুলো জানা হয়ে যাবে। ইদানীং অফিসে কাজের খুব চাপ। পত্রিকা খোলার সময় হয় না। তাই সেই ছোট বেলার অভ্যাসটা শুক্রবারে পুষিয়ে নেয়া আর কি।
মিলি উঠে গেলেই আরেক সমস্যা। পত্রিকা নিয়ে সময় কাটান তার একেবারেই পছন্দ না। সে সোজা কথার মানুষ। যা হয়ে গেছে , তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কি আছে? যা হওয়ার তাই হয়েছে। কি হয়ে গেছে তা নিয়ে মাথা গরম না করে, যা হতে যাচ্ছে সেটা নিয়ে কাজ করা দরকার। জয়নালের পত্রিকা পড়া দেখলে, মহা বিরক্ত হয়ে বলবে; যাও এখুনি বাজারে যাও। সকাল সকাল গেলে ফ্রেশ মাছ পাবে।
জয়নালের এই জন্যে শুক্রবারেও অন্য সব দিনের মত সকাল সকাল উঠা। মিলি উঠার আগেই পত্রিকা পড়ে শেষ করতে হবে। তার পরে, দিনের বাকীটুকু সময় প্রিয়তমা স্ত্রী মিলি হোসেনের কথা মত চলতে হবে। মনে যত ধরণের যত ইচ্ছা আসুক না কেন, তা মনের মধ্যেই রাখতে হবে। প্রকাশ পেলে কঠিন কোন কথা শুনতে হতে পারে। ইদানীং মিলির মেজাজ মনে হয় সব সময় তিতিয়ে থাকে। জয়নাল কোন কথা বললেই তেড়ে আসে। জয়নালের যেন কোন ইচ্ছা আর মতামত থাকতে নেই। মিলির কথা মতই সব হতে হবে। কিছু বলতে গেলে বিরাট ঝামেলা। এর থেকে মনের ইচ্ছা মনের মধ্যে অভুক্ত রেখে মেরে ফেলাটাই ভাল।
কিন্তু পত্রিকাটা গেলে কোথায়? শুক্রবারে এই সময়ের মধ্যে পত্রিকা চলে আছে। টেবিলে চা, চোখে চশমা। ঠিক এখানে বসেই তো সে পত্রিকা পড়ে। কিন্তু পত্রিকাটা জয়নাল কোথাও দেখছে না। এইদিক ওইদিক তাকাল, না পত্রিকাটা কোথাও দেখা যাচ্ছে না। জয়নাল একেবারেই নিশ্চিত, সে প্রতি শুক্রবারে পত্রিকা পড়ে, কোন ব্যতিক্রম হয় না। আজকে পত্রিকা গেল কই? বেচারা অসহায় হয়ে করুণ চোখে চারিদিকে তাকাতে লাগল।
সাথে সাথে মাথা কেমন ঝিম ঝিম করে লাগল।

বিলাত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ফিরে আসার তিন দিন পরেই মিলির সাথে বিয়ে হল। বিয়ে ঠিক করাই ছিল। মা ছবি পাঠিয়ে বলেছিল, সারা বাংলাদেশে এর থেকে সুন্দর মেয়ে নাই। তার পরে আবার কয়েক দিন পরে ডাক্তার হয়ে যাবে। পড়ালেখায় তোর মতই ভাল। ম্যাট্রিকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়েছিল। তোরা দুই জনে মিলে আয় করবি। তার পরে দেখবি, তোদের জীবন কি সুন্দর কেটে যায়।
জয়নালের ছোট বোন দিলরুবা তখন মাত্র মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে। মায়ের থেকে শুনে লুকিয়ে লুকিয়ে যেয়ে মিলিকে দেখে আসল। খুবই অবাক হল, এত সুন্দর মেয়ে কোন ছেলের চোখে এখন পড়ে নি। কারোর সাথে নিশ্চয়ই প্রেম আছে। তা যাই হোক, বিয়ে তো হচ্ছে তার বড় ভাইয়ের সাথে। বিলাত ফেরত বলে কথা। তা ছাড়া তার ভাই তো দেখতে কম হ্যান্ড-সাম না। ভাইকে দেখলে, প্রেম প্রীতির কথা; সব এমনিতেই ভুলে যাবে। দিলরুবা ভাইকে জানাল, তোমার ভবিষ্যৎ বউ বিশ্ব সুন্দরী থেকেও সুন্দর। ভাগ্যিস বিশ্ব সুন্দরী কম্পিটিশনে যায় নি।
জয়নাল মা আর বোনের রেফারেন্স পেয়ে একেবারে আহ্লাদে আটকানা হয়ে গেল। সারা রাত ছবি দেখে কাঁটাল। আহা কি সুন্দর! দেখলে বুকটা একেবারে ঠাণ্ডা হয়ে যায়। গরমের মধ্যে থেকে এসে বরফ দেয়া পানি ঢক ঢক করে পান করার মত। শুধু ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। কত কথাই না বলে চলল। এই মেয়েকে পাওয়ার পরে জীবনে পাওয়ার আর কিছু বাকী থাকবে না। মনে মনে পণ করে ফেলল, এই মেয়েকে মাথায় তুলে রাখতে হবে। এক ফোঁটা কষ্টও দেওয়া যাবে না, ফুলের আচর পর্যন্ত না।
তার জন্যে শুধু ভালবাসা আর ভালবাসা।

মিলি হৈ চৈ করতে করতে বাথরুম থেকে বের হল। আমার টুথ ব্রাশ ভেজা কেন? কে আমার টুথ ব্রাশ ব্যাবহার করেছে। আমার বাথরুমে কে ঢুকেছিল। বাসায় চোর আসল না কি?
মিলির চিল্লা চিল্লিতে জয়নালের পত্রিকা নিয়ে চিন্তা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। চোর তো বাসায় আসার কথা না। দরজা জানালা বন্ধ ছিল। চোরেরই বা কি ঠ্যাকা পড়েছে, চুরি করে এসে মিলির টুথ ব্রাশ ভিজিয়ে যাবে। আর ওই বাথরুমে তো কারো যাবার কথা না। মিলি ছাড়া, সেই একমাত্র মানুষ, ওই বাথরুম ব্যবহার করে। কিন্তু সেই বা মিলির টুথ ব্রাশ ধরবে কেন? এই সামান্য কারণে মিলি তাকে যা তা বলছে, চোর বলছে।
জয়নালের মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আসলে এখন মনে হচ্ছে এইটা তারই দোষ। কয়েক দিন আগে মিলি নতুন দুটো টুথ ব্রাশ রেখে বলেছিল, তোমারটা নীল, আমারটা লাল। কিন্তু আজকে সকালে কিছুতেই মনে করতে পারল না, কারটা কি রঙ। শেষে, হাতে যেইটা উঠল, সেটা নিয়ে দাঁত মেজে ফেলল। ভাবল ভুল হলেও মিলি বুঝতে পারবে না।
কিন্তু অদৃষ্টের লিখন জয়নালের পক্ষে ছিল না। সামান্য এক টুথ ব্রাশ ব্যাবহার করার জন্যে মিলি, মানে নিজের স্ত্রীর কাছে হেনস্থা হতে হচ্ছে। ছি ছি কি লজ্জা। মানুষে শুনলে কি বলবে?
কিন্তু, এমন হল কেন?
সে কি করে ভুলে গেল, কার ব্রাশের কি রঙ। আবার পত্রিকাই খুঁজে পেল নে কেন?

বিয়ের রাতে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কাটল। জয়নাল বিয়ের ষ্টেজে মুখে রুমাল দিয়ে ঢেকে বসে থাকল। বউ দেখতে খুব ইচ্ছা করছিল। সে তো আশে পাশেই কোথাও আছে। এত লোক জন না থাকলে কিছু হাসি ঠাট্টা করে আসা যেত। যেয়ে জানতে চাইত, খুব তো সাহস। না দেখেই একজনকে জীবন সঙ্গী বানিয়ে ফেলছে। ছেলে যদি ভয়ঙ্কর হয়, যদি দস্যু বনহুর হয়।
স্বপ্নের কনেকে প্রথম দেখল রুসমতের সময়, আয়নায়। মিলি বিশাল ঘোমটা কিছুটা সরিয়ে নিচু হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে জয়নালের উদ্দেশ্যে বড় ধরণের একটা ভেঙচি কাটল। আর কেও না দেখলেও, জয়নাল ঠিকই দেখল। বুঝতে পারল না, এর উত্তরে কি করা উচিৎ। বোকার মত একটা ঢোক গিলল। সাথে আল্লাহকে বলল, ইয়া আল্লাহ নতুন বউ যাতে বুঝতে না পারে, তার মাথায় কোন বুদ্ধি কাজ করছে না। যেই মেয়ে, রুসমতের সময় একেবারে কড়কড়ে নতুন স্বামীর সাথে রসিকতা করে ভেঙচি কাটতে পারে, সে পৃথিবীর এক আর একমাত্র। তার কোন তুলনা নাই।
জয়নালের, বাসর ঘরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত; সারাক্ষণ নতুন বউয়ের ভেংচি কাঁটা মুখ চোখে ভাসতে লাগল। আর অপেক্ষা সহ্য হচ্ছিল না। কখন যে সে বউকে একা পাবে, ওই ভেংচি কাঁটা মুখের লাল টকটকে ঠোটে তার নিজের ঠোট লাগাতে পারবে। পুলকে শরীরে আন্দোলন চলে আসল।
প্রথমেই সে, চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিবে ওই রঙ্গিন মুখ। আহা !!

মিলি ছোট বেলা থেকেই সোজা কথার মানুষ। কাওকে কিছু বলতে কখন দুই বার চিন্তা করে না। আবার যা বলে সেই কাজ। সেটা কোন মুরুব্বী হোক কিংবা পাড়ার কোন মাস্তান হোক। তাকে নিয়ে অনেক ধরণের গল্প প্রচলিত আছে। তাকে ঘাঁটানোর সাহস কারোর ছিল না বললেই চলে।
মায়ের ইচ্ছা ছিল ম্যাট্রিকের পর পরই বিয়ের দিতে দেবার। কিন্তু কারোর সাহস হয় নি ব্যাপারটা বলার। মায়ের হাবে ভাবে বিষয়টা বুঝতে সময় লাগে নি। মিলি বাবার মায়ের উপস্থিতিতে ঘোষণা দিল, সে ডাক্তারি পড়বে। বিয়ের কথা বলে কেও যাতে তাকে বিরক্ত না করে। সময় হলে সেই জানাবে।
কলেজ থেকে ফিরতে, এক দিন বেশ দেরি হয়ে গেল। সন্ধ্যা পার হয়ে অন্ধকার নেমেছে। রিকশা করে বাড়ি ফিরছিল। পাড়ার বখাটে ছেলেরা মুদির দোকানের সামনে সিগারেট আর চা হাতে নিয়ে গল্প গুজব করছিল। রিকশায় মিলিকে দেখে পাড়ার নতুন মাস্তান রুক্কু বেশ জোরেই বলল, কি ব্যবসা করে বাড়ি ফেরা হচ্ছে না কি?
মিলি সাথে সাথে রিকশা থামাল। ডাকল রুক্কুকে, এই, এই দিকে আস। রুক্কু বেশ আগ্রহ নিয়েই আসল। কাছে আসা মাত্রই, পায়ের স্যান্ডেল খুলে রুক্কুর মুখে ছুড়ে মারল। তার পরে রিকশা থেকে নেমে ধীরে সুস্থে স্যান্ডেলটা কুড়িয়ে পায়ে দিল। বলল, আমার সাথে মাস্তানির চেষ্টা না করাই ভাল। এর পরে বেয়াদপি করলে আরও কঠিন শাস্তি হবে। ঘটনার আকস্মিকতায় বখাটে ছেলেগুলো কি করবে বুঝে পেল না। রুক্কু চোখ তুলে তাকাতেই পারল না।
মিলি পায়ে হেঁটে বাসার দিকে রওয়ানা দিল।

চেনা জানা মানুষরা খুব অবাক হল, যখন মিলি বিয়েতে সম্মতি দিল। বিয়ের প্রস্তাবটা বড় খালাই নিয়ে এসেছিলেন। মায়ের সাহস হল না, মিলিকে বিয়ের কথা বলতে। ভয় হল আবার না মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, কত বার না বলেছি, পড়া লেখা শেষ মা করে আমি বিয়ে করব না। কথাটা কি তোমার কান দিয়ে মাথা পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না। বল, কি করলে, কাজটা সম্ভব হবে।
কিন্তু বড় খালা ছেড়ে দেবার মানুষ না। তিনি মিলিকে ডেকে বললেন, এই খামের মধ্যে এক ছেলের তিনটা ছবি আছে। দেখতে যেমন সুন্দর, ফ্যামিলি তেমন ভাল। ম্যাট্রিক, ইন্টারমিডিয়েট দুই পরীক্ষায় ফাস্ট হয়েছে। আগামী মাসে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দেশে ফিরবে। এর মধ্যে একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে ভাল বেতনের চাকরি হয়ে আছে। দেশে ফিরে ছেলে বিয়ে করবে, দেশ বিদেশে মাস খান খানেক হানিমুন করবে। তার পরে নতুন চাকরিতে জয়েন্ট করবে।
বড় খালা বলে চললেন, দেরী করলে ছেলে হাত ছাড়া হয়ে যাবে। পরে হাজার কান্নাকাটি করে এমন ছেলে পাবে না, সেটা এখনই বলে দিচ্ছি। এই ছেলেকে বিয়ে করলে, জীবনের সুখের কোন কমতি হবে না। ছেলের মা বলছে, তোমার পড়া লেখার চালানোর ব্যাপারে ওদের কোন আপত্তি নাই। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, মেয়ে ডাক্তার—সংসারে সুখের কোন কমতি হবে।
দু ঘণ্টা পরে, মিলি খালাকে ফোন করল, খালা আমি রাজী।

শুধু চুমু কেন, জয়নাল প্রথম রাতেই পুরো রাজ্যটাই জয় করল। বাসর ঘরে ঢুকে একেবারে অবাক। মিলি এর মধ্যে শাড়ি বদলিয়ে ফেলেছে। জয়নালের ধারণা ছিল খাটের উপরে মাথায় বিরাট একটা ঘোমটা দিয়ে বসে থাকবে, সে ধীরে ধীরে ঘোমটা সরাবে, রঙ্গিন মুখটা মন ভরে দেখবে। অনেক, অনেক কথা হবে। সব কথা তাকে বলবে, ওর সব কথা শুনবে। কিন্তু সুমির কথা প্রথমে কথা না বলাটাই মনে হয় ভাল।
পাশের বাসার মেয়ে সুমি ছাদে উঠত। প্রথমে চোখা চোখি, তার পরে কিভাবে যেন ভাললাগা। একসাথে লুকিয়ে কয়েকটা সিনেমা পর্যন্ত দেখেছিল। একটু হাত ধরা ধরি, আর অনেক স্বপ্ন নিয়ে কথার বেশী আর আগাতে পারে নি। সুমির মামা ওদেরকে একদিন এক সাথে দেখে ফেলল। সুমির মায়ের কাছে বিস্তারিত বর্ণনা গেল। জয়নালের বাসায় সুমির মামা এসে শাসিয়ে গেল। প্রচুর বকাবকি আর মার-ধর চলল। কিছু দিন পরে সুমিরা বাসা ছেড়ে অন্য শহরে চলে গেল। একটা সম্ভাবনার অকাল মৃত্যু হল।
যাই হোক, ঘোমটা সরানোর পর, কথা বার্তা হাল্কা হয়ে আসলে, বউকে হালকা করে জড়িয়ে ধরবে। না, একটু না হয় জোড়েই ধরল; কি যায় আসে তাতে। প্রথমে অনেক আদর করবে। তার পরে এক এক করে খুব যত্নে ব্লাউস, শাড়ি খুলবে।
না সে রকম কিছু হল না। কিন্তু যা হল, তা জয়নালের কল্পনার বাইরে। মিলি যে পোশাক পড়েছে, তা থেকে নিজের কান লাল হয়ে গেল। একেবারে বিদেশী মডেলদের রাতে পোশাক পড়েছে। লম্ব, লম্বা পা দুটো দেখা যাচ্ছে। উপরের দিকে যা পড়েছে, তা দিয়ে ভিতরের সব দেখা যাচ্ছে। কেমন যেন একটা পারফিউম দিয়েছে। নাকে আসা মাত্র নেশা নেশা লাগছে।
বেচারা জয়নাল মাথা নিচু করে যেয়ে খাটের এক কোণায় যেয়ে বসল। কি বলবে আর কি করবে, মাথার মধ্যে খেলল না। চোখ তুলে দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল, কিন্তু লজ্জায় সে কাজ করতে সাহস হল না।
মিলি জয়নালের খুব কাছে এসে প্রথম বিয়ের পাগড়িটা খুলল। জয়নালের যেই কাজটা করতে চেয়েছিল, মিলি সেই কাজটা করল। থুতনিতে হাত দিয়ে জয়নালের মুখ উঠাল। আলতো করে জয়নালের ঠোটে ঠোট ছোঁয়াল। তার পরে জয়নালের মুখ তার বুকে দিয়ে জোড়ে জড়িয়ে ধরল।
প্রথম কথা মিলিই আরম্ভ করল, এইটা আমার বহু দিলের প্ল্যান। পোশাকটা এক বান্ধবীর বড় বোনকে দিয়ে আনিয়েছিলাম। তুমি বিদেশ থাকে এসেছ, ভেবেছিলাম তুমি বেশী অবাক হবে না। আমি আসল ব্যাপারটা অন্য রকমভাবে করতে চেয়েছি---just to make you sexy. যদি বল, বিয়ের শাড়িটা আবার পড়তে পারি।
না। মিলিকে বিয়ের শাড়িটা আবার পড়তে হয় নি। জয়নালের এর মধ্যে শরীরে শিহরণ, আন্দোলন, বিপ্লব হয়ে যাচ্ছে। সে এই চায়, এই ভাবেই চায়। টান দিয়ে খুলে ফেলল মিলির ছোট পোশাক। মিলিও তাকে এর মধ্যে বিবস্ত্র করেছে।
হঠাৎ মিলি জয়নাল থেকে সরে গিয়ে শান্ত হয়ে বলল, তোমাকে মনে হয় একটা কথা এখনই বলে রাখা ভাল। তোমার আগে এই শরীর একজন ধরেছে। তোমার যদি এতে কোন সমস্যা থাকে, তুমি বলতে পার। তোমার যে কোন রায় মেনে নেব। কিন্তু, এত টুকু জেনে রাখ তোমার পরে এই শরীর আর কেও ছুঁতে পারবে না।
জয়নাল তখন সুখের আরেক জগতে।
মিলিরে কানের কাছে, মুখ নিয়ে বলল, এখন থেকে তুমি আমার সেটাই বড় কথা।
তোমাকে যদি আগে কেও ছুঁয়ে থাকে, I do not care.
মিলি ফিসফিস করে বলল, আমি কিন্তু ভীষণ সাহসী !

মিলির এখন খুব ব্যস্ততা। প্রথমে ছিল চেম্বার। পরে হল ক্লিনিক। তারপরে রীতিমত হাসপাতাল। প্রায় গোটা বিশেক ডাক্তার কাজ করে। সাথে নার্স আর অন্য কর্মচারীরা তো আছেই। সারাক্ষণ রুগী আর তাদের স্বজনরা আসা যাওয়া আসছে। মিলির কাজের কোন ইয়ত্তা নাই।
খুব জরুরী একটা মিটিং চলছিল। বিদেশী দুটো দূতাবাস প্রস্তাব পাঠিয়েছে তারা হাসপাতালকে তাদের নেটওয়ার্ক ভুক্ত করতে চায়। তাতে বাড়তি অনেক ব্যবসা আসবে। কিন্তু তাদেরও কিছু দাবী আসবে। হাসপাতালের যন্ত্রপাতি আধুনিক করতে হবে এবং কিছু ডাক্তারদের এমেরিকা আর ইউরোপে যেয়ে ট্রেনিং নিতে হবে। মেলা টাকার ব্যাপার। সিনিয়র ম্যানেজমেন্টের এটা নিয়ে আলোচনা চলছিল। ঠিক এ রকম সময়ে, একজন জুনিয়র ডাক্তার এসে মিলির কাছে এসে বলল, এক্সকিউজ মি। আপনার ননদ আপনাকে ফ্রান্স থেকে ফোন করেছে। বললেন, ভীষণ জরুরী। আপনার সাথে কথা না বললেই না।
জয়নালের ছোট বোন দিলরুবা ফ্রান্সে থাকে প্রায় পনের বছর হল। ভাইয়ের চোখের মণি। দিলরুবা যদি কোন সপ্তাহ ফোন না করেছে, জয়নাল বাংলাদেশ থেকে ফোন করে; অভিমানী গলায় বলে, কিরে আপু বড় ভাইকে ভুলে গেলি না-কি। ওইদিক থেকে দিলরুবা বলে, তোমাকে এত খরচ করে ফোন করার দরকার নাই। আমি ফোন করছি।
মিলি জানত, দিলরুবা নিয়মিত বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলে। ভাই বোনের যে কত আলাপ হতে পারে।
কিন্তু , তার কাছে দিলরুবার কি প্রয়োজন হতে পারে? তাও আবার জরুরী।

মেডিকেল কলেজে এনাটমির ক্লাস। করিম শায়েখের ক্লাস। নতুন জয়েন্ট করেছে। লম্বা, সুন্দর, সুঠাম শরীর। বয়সে একেবারে নবীন। বাংলা, ইংরেজি—দু ভাষায় তুখার লেকচার দিতে পারে। এনাটমির মত কঠিন বিষয় ছাত্রদের বুঝতে কোন অসুবিধা হয় না। ছাত্রীরা শায়েখ স্যার বলতে অস্থির। মেয়েদের কমনরুমে স্যারকে নিয়ে কত রকম আলাপ হয়। একবার সুরমা নামে মিলিদের ক্লাসেরই এক মেয়ে বেশ গর্ব করে ঘোষণা করল, সে স্বপ্নে দেখেছে যে তার সাথে শায়েখ স্যারের বিয়ে হচ্ছে। আরেক দিন এসে বাসর ঘরের রসাল বর্ণনা দিল, স্যার যখন শেরওয়ানি খুলল, আমি আর শান্ত থাকতে পারলেম না। ঝাঁপিয়ে পড়লাম স্যারের বুকের মধ্যে। আহা সেখানে কি আরাম। ওই বিশাল বুকে আমার হারিয়ে যাবার দশা। তার পরে স্যার আমাকে বুকের মধ্যে ভীষণ জোরে চেপে ধরল। আমার তখন ভেঙ্গে চুড়ে গলে পড়ার অবস্থা।
সুরমা গল্প বলত, আর অন্য মেয়েদের সব কত না প্রশ্ন। স্যার কি শাড়ির উপর দিয়ে বুকে হাত দিল, না কি তোর কাপড় চাপড় প্রথমে খুলল।
এই সব কথা বেশী দূর আগাতে পারত না। মিলি অনেকটা আসর ভেঙ্গে দিত। যা যা, বানিয়ে আর কথা বলতে হবে না। আমি এখন লাইব্রেরী যাচ্ছি। তোরা কেও কি যাবি আমার সাথে?
কিন্তু মিলি তখন জানত না, এই শায়েখ স্যারের সাথে তার জীবনের একটা অধ্যায় রচিত হয়ে আছে।
১০
দিলরুবা ফোনের ওইদিক থেকে অস্থির হয়ে জানতে চাইল, ভাবী ভাবী ভাইয়ার কি হয়েছে? সে আমাকে চিনতে পারছে না। প্রথমে অফিসে ফোন করলাম—বলল অফিসে আসে নি। পরে বাসায় ফোন করলাম। ভাইয়া ধরল। বলে কিনা বলে আপনি কে বলছেন। আমি বললাম ভাইয়া আমি দিলরুবা, তোমার ছোট বোন।
উত্তরে ভাইয়া বলে, আমার আবার বোন আসল কোথা থেকে?
আমি এই পর্যন্ত তিন বার ফোন করেছি। প্রতিবারই বলে, আপনাকে আমি চিনতে পারছি না।
মিলি, তোমার ভাই মনে হয় রসিকতা করছে,
মিলি বলেই বুঝল, জয়নাল ছোট বোনের সাথে রসিকতা করার মানুষ। ইদানীং, না বেশ অনেক দিন হল, জয়নাল হাসি, ঠাট্টা, রসিকতা তেমন একটা করে না। শুধু ছোট বোনের সাথে বেশ সময় নিয়ে কথা বলে। মিলি অবশ্য কখন চেষ্টা করে নি, কি কথা বলে জানার। সে নিজে মহা ব্যস্ত মানুষ। মানুষের কথা শোনার অবসর নাই।
মিলি ফোন রেখে চিন্তা করতে আরম্ভ করল। এইটা কি করে সম্ভব জয়নাল ছোট বোনকে চিনতে পারছে না। ও কোনভাবেই ছোট বোনকে চিনতে পারছে না বলে রসিকতা করার মানুষ না।
আসলে বিষয়টা কি?
১১
বছরের শেষে পুরো ক্লাস পিকনিকে গেল কক্সবাজার। সাথে তিন জন টিচার। এদের মধ্যে এক জন শায়েখ স্যার। বাসে করে অনেক লম্বা রাস্তা পার হতে হল। সেই চিটাগাং হয়ে কক্সবাজার। পাক্কা দশ ঘণ্টা। প্রথম কয়েক ঘণ্টা ছেলে মেয়েরা হৈ হুল্লোড় নাচ গান করে, ক্লান্ত হয়ে যে যার সিটে যেয়ে বসল। কেও কেও ভেজা মুরগির মত ঝিমাতে লাগল, আবার কয়েক জন রীতিমত ঘুমিয়ে পড়ল।
মিলি যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তা সে নিজেও জানে না। চোখ খুলে বুঝল, এতক্ষণ শায়েখ স্যারের ঘাড়ে তার মাথা ছিল। কি লজ্জা ক্লাসের ছেলে মেয়েরা দেখলে কি বলবে। চারিদিকে চোখ ঘুড়িয়ে দেখল। না কেও তার দিকে তাকিয়ে নাই। যাক বাঁচা গেল। কিন্তু স্যারের তো পাশের সিটে বসার কথা না। উনি তো নাজমা ম্যাডামের পাসে বসেছিলেন।
নাজমা ম্যাডাম বেশীক্ষণ পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে পারেন। তার পা ফুলে যাওয়ার একটা সমস্যা আছে। কথাটা শুনে শায়েখ স্যার উঠে বললেন, আপনি সিটে পা উঠিয়ে বসেন। আমি অন্য কোথাও যেয়ে বসি। প্রথমেই তার চোখ পড়ল, মিলির পাশের খালি সিটে। কোন সংকোচ ছাড়াই যেয়ে বসলেন।
এই দৃশ্য শুধু ক্লাসের সবাই দেখল না।
দুষ্টু রুবেল এসে স্যারের অগোচরে ছবি তুলে নিয়ে গেল।
১২
বিয়ের পর থেকে কয়েক বছর জয়নাল আর মিলির জীবনে আনন্দের বন্যা বইতে লাগল। বিয়ের এক দিনের মাথায় মিলি জয়নালকে নতুন নাম দিল জয়। দু জন যেন এক জনকে ছেড়ে থাকতে পারে না। মিলির যতক্ষণ পড়ালেখা করে, জয়নাল ততক্ষণ পাশে বসে থাকে। মিলি চেয়ার থেকে উঠলেই জয়নাল গান ধরে –one for sorrow, two for joy। একা থাকলেই কষ্ট, দু জন হলেই আনন্দ।
এর পরে জয়নালের আর তর সয় না। দুটো জোড়া ঠোট একেবারে আঠার মত লেগে যায়। তার পরে এক জন আরেক জনের শরীরের সাথে মিশে যেতে চায়। দু জনেরই প্রতিটা অঙ্গ, অন্য জনের প্রতিটা অঙ্গের জন্যে অস্থির হয়ে কাঁদতে থাকে। এক পর্যায়ে কান্না পরিণত হয় সুখের ধ্বনিতে: চরম সুখের।
স্বপ্নের বুনন চলতে থাকে। মিলির চেম্বার,ক্লিনিক, হাসপাতাল। জয়নাল বলে, তোমাকে আমি সব করে দিব, শুধু আমাকে তুমি একটা ছোট হাত পা ওয়ালা মানুষ উপহার দিও।
দু জনের স্বপ্নই পূরণ হল।
মিলিই ওদের মেয়ের নাম রাখল জয়া। বলল, আমার ভালবাসা সৃষ্টি করেছে আরেক ভালবাসা, জয় আর জয়া। জয়নাল দেশের জমি বিক্রি করে মিলিকে ক্লিনিক বানিয়ে দিল।
১৩
মেয়েদের যে দুটোর বেশী চোখ থাকতে পারে, মিলি সেটা আগে তেমন বুঝে উঠতে পারে নি। এনাটমি ক্লাসের লেকচারের ফাঁকে ফাঁকে শায়েখ স্যারের চোখ তার সারা শরীর চষে বেড়ায়। কখন পায়ের দিকে, কখন হাতের আঙ্গুলের দিকে, কখন চট করে বুকের উপরে যেয়ে থামে। সেটা পিকনিকের থেকে ফিরে আসার কিছু দিনের মধ্যে জানা হয়ে গেল।
এই দিকের কলেজে এমন কেও বাকী থাকল না, যে রুবেলের তোলা শায়েখ স্যার আর মিলির ছবি দেখল না। ছাত্রছাত্রীরা তো দেখলই, সব টিচারদেরও দেখা হয়ে গেল। একেক জনের একের ধরণের মন্তব্য। কেও বলল স্যার একটু বেশী বাড়াবাড়ি করেছে, কেও বলল স্যার ওকে ঘুম পারাল কি করে, আরও কত কি? কিন্তু মিলির মন জুড়িয়ে দিল রুবেলের কথায়, ওদের দু জনকে পাশাপাশি দারুণ মানায়।
ছবি নিয়ে কানা ঘুষা শায়েখ স্যারের কানেও গেল। ছবিটা দেখা হল। কেমন যেন একটা টান আর মোহ সৃষ্টি হল। পুরুষ মানুষের মেয়েদের নিয়ে মোহের বেশীর ভাগটাই তো, কাছে পাওয়া আর শরীরটাকে চেখে দেখার। এর জন্যে বেশী দিন অপেক্ষা করতে হল না।
মিলিই একদিন এলো স্যারের রুমে এনাটমির কিছু কঠিন প্রশ্ন নিয়ে।
১৪
বিয়ের তিন দিনের মাথায় জয়নাল, মিলি গেল নেপালে হানিমুন করতে। পাহাড়, নদী, আর আকাশের এক নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। মানুষ আর প্রকৃতি মিলে যেন একাকার হয়ে যায়। ভিতরের সব কিছু অবলীলায় বের হয়ে আসে। সব সত্য, সব স্বপ্ন কেমন আবেগের মত বের হয়ে আসে।
মিলি বলল, তার আর শায়েখ স্যারের উপাখ্যানের কথা। জয়নাল অবাক হয়ে শুনল সব কথা। কেমন একটা স্বগক্তি করার মত করে বলল, ব্যাটা টিচারকে তুমি তোমার শরীর ধরতে দিলে? আমি কিন্তু আমার মন,শরীর—দুই তোমার জন্যে অনেক যত্নে save করে রেখেছি। তার পরে জয়নাল কেমন যেন শান্ত হয়ে গেল। বাইরের জানালা দিয়ে দূরের আকাশ আর পাহাড় দেখতে লাগল। মুখটা যে ভারাক্রান্ত, মিলি সেইটা সহজেই বুঝল। মনে হল, জয়নাল যেন বিড়বিড় করে নিজেকেই নিজে বলছে, না এ হতে পারে না।
যৌবনের প্রচণ্ড চাহিদায় জয়নালের বিষয়টা ভুলে যেতে বেশী সময় লাগল না। মিলি এসে পেছন দিক থেকে জয়নালকে জড়িয়ে ধরল। সারা শরীর হাত বুলিয়ে দিল, তার পরে ঘাড়ে ঠোটের ছোঁয়া দিল। কানের লতিতে ছোট একটা কামড় দিয়ে বলল, আমাকে মাফ করে দাও। এখন থেকে আমার মন, শরীর, ভালবাসা সব তোমার। ওই ব্যাটাকে আমি ঘেন্না করি। ও আমাকে ঠকিয়েছে।
ওরা দুজন শরীরের সুখ পেতে লাগল। মাত্রা বাড়তে বাড়তে সব চেয়ে উঁচুতে পোঁছাল। শেষে ক্লান্ত হল দু জন। মনে হল এক জনের সব সুখ বুঝি সব টুকুই অন্য জনের মধ্যে। এত দিন যে তারা কিভাবে ছিল? মিলি কানে কানে বলল , আমি তোমার জন্যে সব কিছু করতে পারি।
জয়নাল রসিকতা করে বলল, যদি আমি আরেকটা মেয়েকে.........
মিলি বলল, আমি বিনা প্রতিবাদে স্বামীর মর্জিতে রাজী। জয়নাল লজ্জা পেল, ছি তাই কি হয়? মিলি হাসতে হাসতে বলল, তোমার জন্যে আমি সব কিছু করতে পারি।
আমি তো বলেছি, আমার অনেক সাহস।
১৫
দিলরুবার সাথে ফোন রেখে মিলি ফোন রেখে মহা চিন্তায় পড়ল। এইটা কি করে সম্ভব, জয়নাল তার প্রিয় বোনকে চিনতে পারছে না। সে একেবারে নিশ্চিত জয়নাল বোনের সাথে রসিকতা করবে না। জয়নাল টুথ ব্রাশের রঙ মনে রাখতে পারছে না। সেদিন শুক্রবারে টেবিলে বসে ছিল---নিশ্চয়ই হকার যে দরজার নীচে পত্রিকা রেখে যায়, সেটা ভুলে গিয়েছিল।
ঘর থেকে বের হবার সময় তার দিকেও কেমন করে তাকিয়েছিল। নিজের বউকেও চিনতে পারে নি, না কি। ডাক্তারি আরম্ভ করার পর থেকে আসলে জয়নালকে তেমন একটা এ্যাটেনশান দেওয়া হয় নি। মেয়ে জয়া আর চাকরি নিয়ে তুমুল ব্যস্ততা। অবশ্য গত তিন বছর ধরে জয়া এমেরিকায় আছে। পড়ালেখা করছে, হেলথ ম্যানেজমেন্টে এমবিএ। দেশের থেকে বিবিএ করে গেছে। ফিরে এসে মায়ের হাসপাতালের হাল ধরবে। তার পরে জয়নালকে দেশে আর বিদেশে প্রচুর ট্যুর করতে হয়েছে। দু জনের এক সাথে তেমন সময় কাটান হত না। একই ছাদের নীচে বসবাস। তার পরেও দু জনের দু ভুবন। কারোরই জানা নাই, আরেক জনের জগতে কি হচ্ছে।
মাঝে একবার বছর দুয়েক জয়নালের চাকরি ছিল না। সেই প্রথম মিলি দেখল, জয়নাল বেশীর ভাগ সময় মন খারাপ করে বসে। তার সাথে কারণে,অকারণে কথা বলার চেষ্টা করে না, কাছে এসে ছোঁয়ার, ধরার চেষ্টা করে না। মিলি বুঝল, তার এখন উচিৎ স্বামীর পাশে যেয়ে দাঁড়ান, তাকে সাহস দেয়ার। কিন্তু তার সময় কোথায়, বাসায় থাকলে মেয়ে জয়ার সেবা যত্নের তদারকি করতে হয়। রুগীদের ফোন আসতে থাকে। কখন কখন রুগী দেখতে ছুটতে হয়।
বেচারা স্বামীকে সময় দেয়ার সময় কোথায়?
১৬
শায়েখ স্যার খুব সহজেই সাহসী মিলিকে স্বপ্ন দেখাল। দু জনেরই একই পেশার হবে; অনেক ভবিষ্যতের কথা বলল। মিলিও বিগলিত হল। ধরা দিল স্যারের কাছে। স্যার গোপনে যে সব অঙ্গে চোখ বুলাত, সেখান হাত দিয়ে ছুল। উত্তেজনা হল দু পক্ষেই। মিলনের বাজনা শোনা গেল।
সম্পর্ক হওয়ার তিন মাসের মধ্যে মিলি একদিন একদিন কলেজে এসে শুনল। স্যার দু সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেশে গেছে। মিলি অবাক, তাকে না বলে দেশে গেছে। নিশ্চয়ই গ্রামের বাড়িতে কোন বড় সমস্যা হয়েছে। মিলির কানে খবর আসল, শায়েখ স্যার মায়ের পছন্দমত একটা বিয়ে করেছে। মিলি ভেবেই পেল না, এইটা কি করে হতে পারে।
শায়েখ স্যার এসে বলল। বিয়ে করেছি তো কি হয়েছে? ও গ্রামের মেয়ে, ঘর সংসার দেখবে। আর তুমি হবে আমার আউট সাইড ডার্লিং। চাও তো তুমিও আরেকটা বিয়ে করে হাসবেন্ড বানাতে পার। আমার কোন যায় আসে না। মিলি উত্তর দিল, কি কি বললে, তুমি আমাকে রক্ষিতা বানাতে চাও? স্যার মীন মীন করে বলল, ও রকম না ভাবলেই হয়।
পরের দিন ক্লাসে সবার সামনে মিলি আবার একটা সাহসী কাজ।
মিলি শায়েখ স্যারকে থু থু ছুড়ে মারল। তার পরে গালে এক থাপ্পড়।
১৭
মিলি হাসপাতালের মিটিং ক্যান্সেল করে দিল। মন বসল না কোন কিছুতেই। ফোন করল দেশের এক জন বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর ফজলুল রশিদকে। তার সাথে বিভিন্ন মিটিং, ফাংশনে দেখা হয়। বেশ অন্তরঙ্গতাও আছে। তিনি মনোযোগ দিয়ে মিলির কথা শুনলেন।
প্রফেসর ফজলুল রশিদ একটা দম নিয়ে বলতে লাগলেন, মনে হচ্ছে আপনার হাসবেন্ড সম্ভবত ডিমেনশিয়া (Dimentia) রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এতে প্রথমে স্মৃতি শক্তি এলোমেলো হয়; ফিরে আসে, আবার হারিয়ে যায়, কথা বার্তা, চিন্তা ভাবনার ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। ভাল, মন্দ, ন্যায়, অন্যায়ের বাচ বিচার ক্ষমতা লোপ পেতে থাকে। আবার অনেক সময় পার্মানেন্ট মেমোরি লস পর্যন্ত হয়।
মিলি জানতে চাইল, কেন এ রকম হয়? প্রফেসর বললেন, এই ভাবে তো বলা মুশকিল। কারো হয় জেনেটিক কারণে, আবার অনেক মানুষের ডিপ্রেশান - হতাশার কারণে হচ্ছে। মস্তিষ্কের কোন জায়গা, কতটুকু আক্রান্ত হয়েছে তার উপরে নির্ভর করে, মস্তিস্ক, স্মৃতিকে কতটুকু প্রয়োজনের সময় রিট্রিভ, ব্যাবহার করতে পারবে। তবে আসার কথা হল, রোগটার কিছু চিকিৎসা আছে। আপনি আপনার হাসবেন্ডকে নিয়ে আসেন। দেখি তার জন্যে কি করা যায়।
মিলি ইন্টারনেট ঘেঁটে রোগটা সম্পর্কে আরও অনেক কিছু জানল। কিন্তু জয়নালের তো এত তাড়াতাড়ি এই সমস্যা হওয়ার কথা না। সে তো মাত্র পঞ্চান্ন হবে।
তার মানে জয়নাল, তার জয়, তাকে, এখন নাও মনে করতে পারে !!
১৮
বাবার অসুস্থতার কথা শুনে মেয়ে জানাল, আমি এই সেমেষ্টার শেষ করেই করেই দেশে ফিরব। বাবা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না। আমি দেশে থাকলে, বাবার এত ডিপ্রেশান হত না, এ রকম অসুখ হত না। মাকে কঠিন করে বলল, তুমি পাশে থেকেও বাবাকে সময় দাও নি। শুধু নিজের প্রফেশন নিয়ে লেগে থেকেছ।
আসলে মিলির কাছে কোন উত্তর ছিল না। লোকটা তো তার সব কিছু মেনে নিয়েছিল। তার আগের জীবন নিয়ে কখন একটা কথা বলে নি। সে তো আর পাঁচ জনের মত কিছু ভালবাসা চেয়েছিল। এক সাথে কিছুটা ভাল লাগার সময় কাঁটাতে চেয়েছিল। এটা মানুষের ন্যুনতম চাওয়া, হয়ত অধিকারও। কিন্তু বাইরের জগত তাকে জয়নালের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল। এখন মনে হয়, ভালবাসার গোলাপ কিভাবে যেন শুকিয়ে ঝরে গেল। আর তার কি না বুঝতে এত দিন লাগল।
এই দিকে জয়নালের রোগটা জটিল হতে লাগল। কিছু কিছু দিন সে বর্তমানের বেশীর ভাগ মানুষকে চিনতে পারে না। কোন দিন শুধু অতীতের ঘটনা মনে করতে পারে, কখন আবার সেই ছোট বেলায় পৌঁছে যায়। সারা বাড়ি ধরে মাকে খুঁজতে থাকে। বলে, মা স্কুলে যাব, তাড়াতাড়ি ভাত দাও। কিন্তু জয়নালের মা মারা গেছে সেই কবে; আজ প্রায় দশ বছর হয়ে গেছে।
মিলি ফোন করল মেয়ে জয়াকে। মা আমার জন্যে একটা জিনিস আনতে হবে। কিন্তু খবরদার কাওকে বলবি না। তুই আমার জন্যে একটা.........।
জয়া অবাক হয়ে ফোনের ওই দিক বলল, মা এইটা তুমি কি বললে, ওই জিনিষ দিয়ে তুমি কি করবে?
মিলি জয়াকে কিছু বলল না।
ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজেকে নিজে বলল, মিলি এখনও সাহসী।
১৯
মিলি তেমন একটা হাসপাতালে যায় না। ফোনে কাজ চালিয়ে নেয়। জয়নালকে মনে হয় ছোট একটা শিশু। বেশীর ভাগ কাজ ধরে ধরে করাতে হয়। জয়াকে দেখেই বলল, তুমি কোথায় ছিলে মা? সারা বাড়ি খুঁজে পাই না। তাড়াতাড়ি ভাত দাও। আজকে স্কুলে দেরী হয়ে যাবে।
অনেকেই বলে জয়ার চেহারা অনেকটা তার দাদীর মত। হয়ত জয়নাল মনেই করতে পারে না, তার একটা মেয়ে আছে। তার নাম জয়া। মেয়েকে মা বলে ভুল করছে।
তবে মেয়ে তো মা হতেই পারে!
২০
মিলি ভীষণ একটা দুঃসাহসিক কাজ করল। জীবনে কাজটা সে আরেক বার করেছে। এইটা দ্বিতীয়বার। বিদেশী সংক্ষিপ্ত ঘুমের পোশাক পড়ে জয়নালকে আদর করে করে ঘুম থেকে উঠাল। জয়নালের মুখ বুকের মধ্যে চেপে ধরল।
আজ বহু বহু বছর পরে দুটো শরীর এক হল। উন্মাদের মত এক জন আরেক জনের মধ্যে হারিয়ে গেল। মিলি আনন্দের আতিশয্যে বলল, জয় আমার জয়।
কথাটা শুনে জয়নাল একেবারে জড়সড় হয়ে বসল। মিলি বলল, কি কি ব্যাপার?
জয়নাল নিচু লজ্জিত গলায় বলল, আমার যে বউ মিলি, সে খুব সাহসী। আমাকে বলেছিল, আমার একটা গোপন ইচ্ছা সে পূরণ করে দিবে। আপনি যেই পোশাক পড়েছিলেন, সেও বিয়ের রাতে এই পোশাক পড়েছিল। তা ছাড়া ও আমাকে জয় বলে ডাকত।
মিলি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি ও খুব সাহসী।

সেপ্টেম্বর ২৮, ২০১৩
http://www.lekhalekhi.net

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×