দ্বিতীয় পর্ব- Click This Link
তৃতীয় পর্ব- Click This Link
এই অধ্যায় চিরন্তন না হতে পেরেও বেশ গভীর ছাপ রেখেছিল এই দ্বীপের মানুষের মনে। রাজ্যের উন্নয়ন সবাইকে রানীর সহায়তা করতে বাধ্য করল। তবে রাজ-পরিবারের সাথে শত্রুতা তো কিছু ব্যক্তির চিরকালই থাকে। তাদের কিছু প্রচরনার ফলেই কিন্তু রানী শক্তিশালী রাজ্য তৈরিতে মন দেন।" ইনোসা বলল।
"তোমাদের কেউ কি কিছু খাবে? আমার খুব খেতে ইচ্ছা করছে।" অড্রি বলল মুখ-বাকিয়ে। তাকে সত্যিই ক্ষুধার্ত দেখাচ্ছিল। "আমি পিজ্জা ওর্ডার করেছিলাম, জেইন গরম করে আনবি? ততক্ষনে আমি ড্রিংকস নিয়ে আসি।" রিন্স উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল। জেইন সম্মতিসূচক মাথা নাড়িয়ে রিন্সের সাথে চলল ভেতরে।
ওরা সবাই খেতে লাগলো একসাথে; ইনোসা তার ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করল। "এখন তোমাদেরকে খাওয়াব দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী এক ডেসার্ট; এর নাম হল সিনসিমা, যার অর্থ হল ভালোবাসা ও সম্মানের সমষ্টি! এই ডেসার্ট তৈরি হত বিশেষ কোন পর্বন থাকলে।" বলল ইনোসা।
"তাই? আমি কখন এরকম কিছু টেস্ট করিনি। বেশ মিষ্টি না, কিন্তু স্বাদটা ভালো!" মিরা বলল খেতে খেতে।
"এবং রানী ইরা একে অন্য সব প্রথার মত পরিবর্তন করে দিলেন তার শাসনকালে। একে তৈরি করা হত প্রোবিন্স ডেয় তে, যেদিন বাড়ির পুরুষদের সম্মানে রান্না করা হত তাদের প্রিয় খাবার। রানী প্রোবিন্স ডে ছিনিয়ে না নিলেও বছরের অন্যান্য সময় এই ডেসার্ট রান্নার ভার দিলেন পুরুষদের; কেননা এই সময়ে কোন মেয়েকে ঘরে বা বাইরে, এক দিকের কাজ জানা থাকলেই হত, কিন্ত প্রতিটি পুরুষের জন্য উভয়ের কাজ করতে সমর্থ হওয়া জরুরি হয়ে উঠল। এবং অন্যান্য যেসব কাজ আগে পুরুষ-সাধিত ভাবা হত, তাদের দ্বায়িত্বে এখন নারীরা বহাল হলেন। " ইনোসা যোগ করে দিলো।
"আচ্ছা, রানীরতো পাঁচ স্বামী ছিলেন, তো তিনি কিভাবে বুঝলেন কোন সন্তানটি তার কোন স্বামীর? আফটার অল তাদের কাছে নিশ্চয়ই ডিএনএ পরীক্ষার উপায় ছিলনা?" জেইন অনুযোগ করল ইরার কথায়। "হ্যা, এর সহজ উপায় রানী বের করেছিল; দ্বীপের পরিভাষায় সিনেদ্রা হল এক বছর, প্রতিটি স্বামীর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এক সিনেদ্রা থাকত, প্রথম, দ্বিতীয় যাকে ভালো লাগত তার সাথেই এক সিনেদ্রা পর্যন্ত রানী নিজে ও রাজ্যের নারীগনদের জন্য নিয়ম ছিল। এর পরে অন্য কেউ। তাতে সন্তান ভুমিষ্ট হবার সময় থাকল, স্বামীর সাথে আন্তরিকতা থাকত। আর স্বামী সন্তান দানে অক্ষম পরিচিত হলে বহু নারী তাদের স্বামী তালাক দিতেন, কিন্তু এরপরে সেই-সকল পুরুষের রাজ-সৈন্য এর পদে কাজ করা ছাড়া কিছু করার থাকত না, কেননা তারা অশুভ বলে ধারনা করা হত; তাই এ থেকে পরিত্রান ও ছিলনা। আর, যেহেতু পাঁচ-টি স্বামী থাকা যেত, তাই নারীরা ভিন্ন বংশের পুরুষকেই বিয়ে বকরতে লাগলেন। এতে করে সন্তান এর চেহারা পিতার মত হলেই সন্তানের পিতা কে জানা যেত। মজার কথা হল, রানীর শাসনের পাঁচ বছরের মধ্যে সকল পুরুষ মনে মনে কন্যা সন্তানের জন্ম দেবার জন্য আশা করে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করল, আগে যারা একজন পুরুষের পিতা হওয়াকে গৌরব হিসেবে ভাবতেন। খুব দ্রুত না হলেও পরিবর্তন হয়েছিল সবার মাঝেই। নারীদের মধ্যে যে স্বামী তাদের কন্যার পিতা হত তাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত বলে লিখিত আছে!" ইনোসা একনাগাড়ে বলল।
"হুম, অনেকটা উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতেও প্রচলন বিভিন্ন জাতির ভেতরে কাজ করা একটি প্রথা।তবে এখানে বিপরীত হয়ে থাকে। অনেক সভ্য জাতি এখনও ছেলে সন্তানকে শুভ ভাবে, এবং তাদের পুরুষদের মধ্যে শুধু পুত্র-সন্তান আশা করা কমেনি! আর তাদের পুর্বপুরুষরাও এমনি ছিল।" রিন্স বলল, কঠিন মুখ করে; ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো মিরা, রিন্স সেটা লক্ষ করতেই বলল, "আমার এসব সহ্য হয়না, এরা কিভাবে এত ডিসক্রিমিনেশন করে। তাদের বোধহয় বোধগম্য হয়না যে নারী-পুরুষ একে অন্যের সহযোগী, প্রতিযোগী নয়! ঘৃনা হয় এদের আমার।"
"আমার ও অপছন্দ, কিন্তু আমি তোমার মত হারশ ভাবে চিন্তা করতে চাইনা। ব্যাপারটা হল, কয়েকশ বছরের কৃতকর্মের ফল এসব। চিন্তা করে দেখ, আজ পর্যন্ত যত কাজ হয়ে এসেছে পৃথিবীতে, ঐসব সভ্যতায়, ষেসবে নারীদের আড়াল করে রাখা হয়েছে। এসব এর মুলে আছে এদের বদ্ধ ধারনা নারীরা শুধুই ঘরে থাকবে। একবার এমনি একজনের সাথে কথা বলছিলাম, তো তর্ক উঠলে সে বলল 'মেয়েরা তো মায়ের মত,' আমি বললাম, এভাবে ভাবলে সবাইকেই তো এক লাগবে! হ্যা, মা তো প্রত্যেক মেয়েই হয়, ওয়েল অলমোস্ট সব মেয়ে। কিন্তু চারপাশের সবার জন্য কিন্তু একটা মেয়ে মা হয়ে থাকে না। তাছাড়া হোক মায়ের জাত, তাই বলে কি পিক আপ আফটার করতে হবে সবার? পরিবারের? নাহ, এটা আনফেয়ার। আরো বললাম, পরিবারের ছেলেরা ঠিক ততটাই পরিবারের জন্য রেসপনসিবল যতটা একটা মেয়ে। শুধু কথা হল, মেয়েদের কেন ঘরে বেধে রাখতে হবে? তাহলে ছেলেদের ও বেধে রাখো! সে বলল, তাহলে পরিবারের আয় হবে কিভাবে? আমি বললাম, এইতো পয়েন্ট, প্রয়োজন না থাকলে কেন মেয়েরা ঘরে বসে থাকবে। সে আমাকে বুঝাতে শুরু করল কিভাবে বাইরের পৃথিবী মেয়েদের জন্য হানিকর হতে পারে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কি কখন কোন শত্রু নেই? সে বলল হ্যা। আমি বললাম, তাহলে শত্রু তো সবারই কম-বেশি থাকে, তাই বলে সবাই ঘরে চুপ করে বসে থাকে? তুমি থাকো? সে আমাকে পর্যবেক্ষন করল কিছুক্ষন এরপর। পরে বলল, আসলে আমাদের সমাজে পুরুষরা না জানে নিজে নিজেদের অবস্থান, না পারে নারীর সম্মান। আমি বললাম আমি তার সাথে সহমত, এসব মিথ্যা নয়। কিন্তু তার জন্য নারিকে ঘরে বেধে রাখায় যৌক্তিকতা তো নেই! নারী পুরুষে ভিন্নতা ছেড়েও বাচা যায় পৃথিবীতে, অন্তত একে অন্যকে হেয় না করে। কিন্তু এটাই পারে না অনেক মানুষ। আর অতীত ও দায়ী এর জন্য; আর আছে ধর্ম, যাকে ঘিরে সকল সমাজ গড়ে উঠেছে আদিকাল হতে! আজ পর্যন্ত অধিকাংশ ধর্মে কোন নারীকে দেখিনি আমি তেমন গুরুত্বপুর্ন অবস্থানে। তোমাদের কি মনে হয়, ঈশ্বর শুধুই পুরুষদের ভালোবাসে, নারীদের না?" মিরা বলল একনাগাড়ে।
"আমি তোমার সাথে একমত মিরা। ঈশ্বর কেন ভালোবাসবেন না সবাইকে? আমি যেমন ছোটবেলা থেকে প্রার্থনা করি, তেমন আমার ভাইও আমার সাথে করত এবং এখন করে। আমরা কেউই কারো-চেয়ে বেশি ঈশ্বর-বিশ্বাসী নই; তাহলে কেন গড আমাদের আলাদা ভাববেন? বরং আমি তো মনে করি আমরা একিরকম প্রিয় ঈশ্বরের কাছে, আসলে ওসব মানুষের বানানো অংশ ধর্মে!" অড্রি বলল।
"দেখ মিরা, আমার ঈশ্বর-বিশ্বাস নেই, কেননা আমি কনফিউস হয়ে যাই এই একটা দিকে এসে। কিন্তু হ্যা, যদি ঈশ্বর থাকেন তবে তিনি নারী-পুরুষকে একি দৃষ্টিতেই দেখতেন। তিনি ডিস্ক্রিমিনেশন করতেন না। কেননা উভয়েই তার সৃষ্টি। কিন্তু দেখো, অধিকাংশ ধর্মেই বিশেষ অবস্থানগুলো পুরুষদের জন্য যেন রিজার্ভ করা। অনেকে বলে, ধর্ম মানুষের তৈরি, কেন বলে জানিস? এইজন্যই! ঈশ্বর কেন আলাদা করে দেখবে। কেন পাদ্রী হতে শুরু করে মুয়াজ্জিন সকলেই পুরুষ? কেন মেয়েদের তিনি দাবিয়ে রাখতে চাইবেন, ছেলেদের মত তারাওতো তার সৃষ্টি। এটাই অনেক সময় ধর্মকে ফেক বানিয়ে দেয়। হ্যা, এটা ঠিক, ধর্ম হয়ত আসলেই পবিত্র ও সত্য, এইজন্যই আমি কোন ধর্মতে বিশ্বাসী না হলেও সকল ধর্মকে সম্মান করার পক্ষে! আর হতে পারে, ধর্মকে ব্যবহার করে পুরুরষরা ঐ সব জাতিতে একটা বিভেদ জাগিয়ে রেখেছে এখন পর্যন্ত। সেক্ষেত্রে ধর্মের দোষ নেই, ধার্মিকের দোষ সেটা। এবং অবিশ্বাস্য হলেও অধিকাংশ স্থলে এটা হয়।" রিন্স বলল উৎসুক হয়ে।
"আর শুধু ধর্ম না, সাইন্স থেকে শুরু করে সামাজিক ফরমেশন, শিক্ষাব্যবস্থা সবকিছুতে মেয়েদেরকে কেনো জেনো পিছিয়ে দেখানো হয়, হয়ত সবকিছুতে ছেলেরা এগিয়ে গিয়েছিল বলে! অবশ্য অন্যের গতি-পথরোধ করলে তো সবাই এ এগিয়ে যাবে! প্রকৃতি ও কেমন আমাদের, প্রপোরশন বানিয়েছে যখন, এক:এক বানায়নি; একটু ঝামেলা বাধিয়ে দিয়েছে, তাই তো এমন!" জেইন একটু রাগান্বিত স্বরে বলল। "তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে ইদুর বিড়াল সব মানুষের পর্যায়ে হলে ভালো হত?" মিরা হেসে বলল জেইনকে উদ্দেশ্য করে!
"ঠিক তা নয়, এক ধরনের সবার ভেতরে এত ভিন্নতা না দিলেও তো পৃথিবী থেমে যেত না!" জেইন প্রতিউত্তর দিলো মিরাকে। "না, তা হত না, কেননা এটাই তো ইভলিউশন এর মুলকথা, সবাই আলাদা এবং দিনদিন একেকজন হতে ভিন্ন হবে," রিন্স উত্তর দিল জেইনকে। "হ্যা, আমিও একমত রিন্সের সাথে," ইনোসা বলল। "আফটার অল, সবকিছুই মাঝে মাঝে একটা ম্যাস লাগে। যাইহোক, এবার ইনোসা তুমি বল, এরপর কি হয়েচিল দ্বীপে?" অড্রি জিজ্ঞেস করল ইনোসাকে!
"ওয়েল, মহারানী ইরা সফলভাবে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন, তার রাজ্যে সবকিছু পরিবর্তিত ও মার্জিত ছিল, শুধু প্রচলিত নিয়মের বাইরে; তেমনি তোমাদের জানামতে সভ্য-পৃথিবী যেমন অসভ্যতা করে নারীর সাথে, তেমনটা এখানে না হলেও ডিসক্রিমিনেশন বেশ হয়েছে, এবং তা কয়েক যুগ ধরে রানী ইরার আবির্ভাবের পর। কথিত আছে তার নিজের চার পুত্র ও সাতটি কন্যা ছিল। রানী নিজের হাতে তার নিজের সন্তানদের শিক্ষা দিয়েছিলেন। তার কারন হিসেবে ইতিহাসবিদরা বলেন সেটা তিনি করেছিলেন কেননা তিনি চিন্তিত ছিলেন তার পুত্ররা তার সাথে প্রতারনা করতে পারে পিতাদের কাছথেকে শিক্ষা পেলে। তাই তার নিজের দ্বায়িত্বে রাজ-কুমার ও রাজকুমারীদের পড়ালেখা শেষ হয়। তার উত্তরাধীকারী হয় তার তৃতীয় কন্যা ইরানা দ্যি থার্ড এর দ্বিতীয় কন্য রেনমিয়া! রেনমিয়াকে সবচেয়ে বেশি স্নেহ করতেন রানী, তবে সেটা রেনমিয়ার নিজের গুনবলির জন্য। বেশ সাহসি রেনমিয়া কেই রাজ-সিংহাসনে বসাবেন বলে বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তিনি রাজ-সিংহাশন হাতছাড়া করেন নি।আরো বলা হয়েছে বই জেনো-রেন এ যে কুমারী রেনমিয়াকে রাজ-সিংহাসনে বসিয়ে দেবার পর-পর মহারানী ইরা গুপ্তঘাতকের দেয়া বিষাক্ত পানীয় পান করে মৃত্যু করেন, যদিও তা চেপে যায় রাজ-পরিবারের সবাই প্রথমে। কেননা সেটা ছিল রেন-মিয়ার কৃতকর্ম! সেই রেন-মিয়া যাকে রানী নিজে সিংহাসন ছেড়ে দিয়েছিলেন, যার জন্য নিজের কন্যাদের কে দমিয়েছিলেন, সেই রেন-মিয়া তাকে হত্যা করার প্ল্যান করে নিজে রানী হিসেবে অভিষেক হবার পরদিনের অনুষ্ঠানেই!" ইনোসা জেনো-রেন বইটা খুলে দেখানো একটা ছবি, যা একজন রাজ-আকিয়ে একেছিলেন, মহারানী এরার মৃতুর সত্যতা জানার পর, এবং তাকে রেনমিয়া মৃত্যুদন্ড দেয় বলে জানা যায়, হিন্টস ওব রেনমিয়াস প্ল্যান বইতে আছে তা লেখা।" ইনোসা বলল, এবং ওর হাত থেকে বই নিয়ে ওরা সবাই বই পড়তে লাগল!
"যার জন্য এত করল, সেই এই করল! এতো দেখি আমাদের দেখা পৃথিবীর রুপ!" রিন্স বলল কৌতুক করে। "রিন্স, মেয়েরা আর ছেলেরা কিছু দিকে একেবারেই এক, সেটা হল এরা দুজনেই ক্ষমতা পেলে দাতার বিনাশ চায়!" ইনোসা প্রতিউ্ত্তর করল।
------------------------------------(চলবে)
ভালো থাকুন!
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ৯:২৮