ছোটবেলা হতেই আমি স্কুল পছন্দ করতাম না। যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন সবাইকে বলেছিলাম, আমি পড়ালেখা পছন্দ করিনা। অষ্টম শ্রেণীর বছরটা খুব মনে পড়ে। প্রথম চশমা ওই বছরেই লেগেছিল নাকের ডগায়। প্রথমবার বুঝতে পেরেছিলাম আমি পড়ালেখা পছন্দ করিনা। কেবল তিনগোয়েন্দায় মুখ গুঁজে বসে থাকতে ভালো লাগতো। মানুষ ব্যতিক্রম কে ভয় পায়। ভয় থেকে ঘৃণা করা শুরু করে। আমি সবার মতো মিশুক ছিলাম না।বন্ধু বানাতে আমাকে খুব বেগ পেতে হয়েছিল। আমি যতোটুকু জানতাম কোন বন্ধু আরেক বন্ধুকে শিক্ষকের হাতে মার খেতে দেবে না। কিন্তু আমার ক্লাসের পরিবেশ ছিলো উল্টো। কিছু সংকীর্ণমনা সহপাঠীর কারণে ওই সময়টা মনে হলে নিজেকে দুর্ভাগা লাগে। যেহেতু মেধার সাথে বিনয়ের কোন সম্পর্ক নেই। ওই সময়টায় আমার মেধাবী সহপাঠী ছিল কিন্তু বিন্দুমাত্র বন্ধুত্ব ছিল না কারো সাথে। হিউম্যান নেচারের ক্ষুদ্রতম দিকের সাথে আমার পরিচয় ঘটে ঐ সময়েই।
সংগত কারনেই আমি স্কুলে যেতে চাইতাম না। নিজ গৃহে ও আমার সময় ভালো কাটতো না। কাজের লোকের হাতে মার খেতে হত। তিনি আমাকে পছন্দ করতেন না। কারন আমার প্রাইভেট টিউটরের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। একদিন দুপুরে আমি তা দেখে ফেলেছিলাম। এ আদিম ঋপুর ব্যাপারে ঐ বয়েসেও আমি ওয়াকিবহাল ছিলাম না। কিন্তু তিনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারলেন না। এখনকার যুগে হলে ভয়াবহ কি ঘটতে পারতো তা ভাবতেই আমি শিউরে উঠি । যতদিন ছিলেন আমার উপর উনার আক্রোশ সবসময়ের মতোই বহাল ছিল। বাবা-মা যার যার কর্মস্থল থেকে ফিরে এলেও আমার অবস্থার পরিবর্তন হত না। বদমেজাজি বাবা কারণ ছাড়াই ধমক দিতেন এবং মারধোর করতেন। অফিস থেকে ফিরে মায়ের আমার ভালো রেজাল্ট ছাড়া অন্য কিছু শোনার সময় হতো না।
আমি ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। সংখ্যালঘুর সংখ্যালঘু। আমার এলাকার হিন্দুপাড়ার ছেলেরা আমাকে খেলায় নিত না। কারণ ওই পাড়াতে আমরা একটি ব্রাহ্মণ পরিবার ছিলাম। হিন্দু ধর্মে জাতভেদ একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখনো নিম্নবর্ণের হিন্দুরা অত্যাচারিত হচ্ছে। বহু আগে থেকেই এই বর্বর প্রথা চালু ছিল। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা নিম্নবর্ণের হিন্দুদের উপর অত্যাচার করতো। এই ব্যাপারটা অনেক নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অনেকের মনে গেথে আছে এখনো। আমি তা কখনই মানতাম না। সবার সাথেই বসতে চাইতাম। কিন্তু কোন অনুষ্ঠানে খেতে গেলে আমাকে আলাদা বসতে হতো। যার ফলে অন্যান্যরা কিছুটা ঘৃণার চোখেই আমাকে দেখতো।সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো আমি আমার জুনিয়র দের হাতে বুলিংয়ের স্বীকার হয়েছি। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে মুখে বলতে পারতাম না বিধায় খেলা হতো না। যদি কেউ ভুল ক্রমে জিজ্ঞেস করতেন খেলব কিনা তখন মাথা নেড়ে সায় দিয়ে খেলতে যেতাম। না-হয় বসে খেলা দেখতে হতো। আবার বাজি ধরা পছন্দ ছিল না বিধায় খেলতে দেয়া হতো না। কারণ আমার কাছে টাকা থাকতো না।কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার সত্য কথা বড়রা পছন্দ করতেন না। ঘরে ফিরে আসাটাই আমার জন্য যুক্তিযুক্ত মনে হতো।
ঐ সময়কার একমাত্র শান্তির পরশ ছিলেন আমার দিদিমা। শর্তহীন শেষ ভালোবাসার প্রতীক। মামার বাড়িতে যখন প্রত্যেক গাছের তেতুল আমি টিপে টিপে দেখছি, মমতাময়ী দিদিমা তার নাতীকে তখন ব্যাকুল হয়ে নামতে বলতেন। একবার কামরাঙ্গা গাছের ডাল ভেঙে পড়ে গিয়েছিলাম। এক খালামণি একটি গাভীকে জল খাওয়াতে এসে দেখেন জলের জায়গায় আমি ব্যাঙের মতো চিৎপটাং হয়ে পড়ে রয়েছি ওখানে। মুখে হাসি। হাত আর পায়ের মাঝখানে বাঁশের খুঁটি গুলো। দৈবক্রমে অত উঁচু থেকে পড়েও বেশি ব্যাথা পাইনি। গাভীটার অবাক মুখ এখনো মনে পড়ে। এতোটুকুই ছিলো আমার শৈশবের সুখময় স্মৃতি।
ছোটবেলা থেকেই মনুষ্য সম্প্রদায়ের ক্ষুদ্রতা, নীচুতা, হীনতা,কাপুরুষতার সম্পর্কে জানতে পেরে গিয়েছিলাম। এতোটুকুন বাচ্চার ভেতরে ঘৃণার কালো মেঘ দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল সবাই। ভালো বই যদি না থাকতো তাহলে আলো দিয়ে ওই কালো মেঘ সরাতে অনেক সময় লাগতো।