ব্রান্ডিং এর ক্ষেত্রে আইএস সফল। তারা তাদের "ছহিহ ইসলামি খেলাফাৎ" এর প্রসারে এতই সফল যে এখন যে কেউ যা খুশি তাই নিয়ে যেখানে খুশি হামলে পড়ছে, মানুষ মারছে মধ্যযুগীয় ভাবে, আর আইএস সেটার ক্রেডিট নিজেদের ঝুলিতে পুরছে। ধর্মের নামে এভাবে মানুষ মারতে পারে যারা তারা কখনোই "জানোয়ার" নয় - "জানোয়ার" এত খারাপ না, বিশ্বাস না হলে প্রকৃতিতে নজর বুলিয়ে দেখুন।
কথায় ফিরি, সমস্যাটা তৈরী করছে আইএস সমর্থকদের এই "গেরিলা" টাইপ আক্রমন, "হিট এন্ড রান" পদ্ধতি এখন হয়ে গেছে "হিট এন্ড শাহাদা" - আচমকা কিছু নিরীহ অপ্রস্তুত মানুষের ওপর স্বশস্ত্র হামলা - যারা প্রতিরোধ করবার মতন মনের জোর রাখে না, তারপর উদ্ধারে আসা আইন-শৃংখলা রক্ষীদের সাথে গোলাগুলিতে "শাহাদা" বা শহীদ হওয়া। ওরা কিন্তু বেঁচে ফিরে যাবার জন্য আসে না, আসে লড়াইয়ে মরে শহীদ হতে। তাতে লাভ, এই জনমের সকল কিছু মাফ, (আইএস বা সমর্থক দলের কাছ থেকে হয়তো পরিবার কিছু আর্থিক ভাবে লাভবান হয়, এখনো প্রমানিত নয়) - আর ওপারে বেহেশতে বিনা-হিসাবে চির-যৌবনের নিরোগ জীবন, অট্টালিকা, ৭২ উদ্ভিন্ন এবং চির চৌবনা হুর, কচি বালক গেলমানের দল, অফুরন্ত আহার, বেহেশতি শরাব, যার তুলনা নাকি দুনিয়ায় নেই।
রাসূল বলেছেন, আল্লাহর নিকট শহীদদের জন্যে ছয়টি পুরস্কার রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে :
ক) প্রথম রক্ত বিন্দু ঝরতেই তাকে মাফ করে দেয়া হয় এবং জান্নাত যে তার আবাসস্থল তা চক্ষুস দেখানো হয়।
খ) তাকে কবরের আজাব থেকে রেহাই দেয়া হয়।
গ) সে ভয়ানক আতঙ্ক থেকে নিরাপদ থাকে।
ঘ) তাকে সম্মানের টুপি পরিয়ে দেয়া হবে, যার এক একটি ‘ইয়াকুত’ পৃথিবী এবং পৃথিবীর মধ্যে যা কিছু আছে তা থেকেও উত্তম।
ঙ) তাকে উপঢৌকন স্বরূপ আয়ত নয়না হূর প্রদান করা হবে।
চ) তাকে সত্তর জন আত্মীয় স্বজনের জন্যে সুপারিশ করার মতা প্রদান করা হবে। (মূল আর্টিকেলটি)
এই উন্মাদনার ধর্মীয় ভাইরাস এখন সর্বত্র - আগে দেখা যেত কিছু অশিক্ষিত, দরিদ্র পরিবারের ছেলেরাই এসব জংগীপনা করতো, কিন্তু এখন? ধর্মের হাইক্লাস ফেরীওলা জাকির নাইকের মতন ফেরীওলাদের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনই বাড়ছে উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেদের এই ধর্মীয় জংগীপনার ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়াও। কেনো এবং কি কারনে? - এ প্রশ্ন নিয়ে কোনো গবেষনা হয়েছে বলে জানি না। ঠিক কি কারনে এই সুন্দর পৃথিবীটা হঠাৎ ওদের কাছে পানসে হয়ে যাচ্ছে আর কল্পিত পরকাল এমন ভাবে জীবনের চাইতেও বেশী প্রিয় হয়ে উঠছে - সেটা নিয়ে ফুলস্কেল গবেষনা হওয়াটা খুব প্রয়োজন, বিশেষ করে মানসিক দিকটা।
বাংলাদেশে রোজার সময়ে টিভিতে এবং বিভিন্ন এফএম স্টেশনে সাধারনতঃ বিকেলের দিকে আগে শুনতাম "ইসলামী সাওয়াল-জবাব" টাইপ অনুষ্ঠান, যাতে দর্শক এবং শ্রোতারা ফোন করে প্রশ্ন করে। মাঝে মাঝেই শুনতাম কিছু টেম্প্লেট প্রশ্ন, যেমন, অফিসে সবাই ইফতার করে, সহকর্মীদের মাঝে একজন বা দুজন অন্য ধর্মের, তাই একসাথে বসে ইফতারী করাটা হালাল হবে কি না - এই টাইপ প্রশ্ন। হাসছেন? হাসবেন না, কারন এই টাইপ প্রশ্নকারীরা কেউই অশিক্ষিত নন, পড়াশুনো পারেন, অনেকেই অনেক বড় পদে কর্মরত।
জামাত এর সংগঠন শিবির দেখেছি আমাদের ছোটোবেলায় ট্যালেন্ট হান্ট করতো, হাইস্কুল লাইফের কথা বলছি। ক্লাসের এক থেকে দশ পর্যন্ত ছেলেগুলোর পেছনে হন্যএ হয়ে ঘুরতো মুখে মিষ্টি জবান নিয়ে। কিশোর কন্ঠ, ফুল-কুঁড়ির আসর, ইসলামী গানের দল (সাইমুম টাইপ), প্রতিদিন ভালো কাজ করার ডায়েরী - সর্বশেষ, নিয়মিত ছেলেকেই শুধু নয়, ছেলের বাপকেও তাগাদা দেওয়া, ছেলেকে নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে। বাপ-মা এইসব বড়ভাইদের কথায় গলে যেতেন মোস্টলি, কারন ছেলে সাহিত্য, সাংস্কৃতি, গান এসবতো পাচ্ছেই, বড় ভাইয়ের সাথে নিয়মিত মসজিদে গিয়ে ফ্যামিলির জন্য বেহেশতের জায়গাও পাকা করে রাখছে।
এরপর হিজবুত-তাহরীর - এখানের যতগুলো কর্মী দেখেছি, সব গুলোই তুখোড়, আসলেই তুখোড়, অন্ততঃ পড়াশুনোর দিক থেকে। সেটা একডেমিক পড়াশুনো নয়, সবকিছুতেই। শিবিরের ছেলেগুলোর জ্ঞান শুধু কুরান-হাদিস আর নেতাদের গৎ বাঁধা ওহাবী বুলিতেই সীমাবদ্ধ থাকে, হিজবুত-তাহরীর কর্মী ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ চালিয়ে যেতে পারে ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য-রাজনীতি-পৃথিবী - সবকিছু নিয়েই।
না, হিজবুত-তাহরীর এর প্রশংসা করছি না, যাষ্ট বলছি, জামাত-শিবিরের অনেক পরে সংগঠিত এই দলটা জমাত-শিবির থেকেও কৌশলী, শিক্ষিত এবং চৌকষ। আর আইএস তো আরো মারাত্মক - আপনার ঘরের লাজুক মুখচোরা ছেলেটা কখন যে পার্সোনালিটি বদলে নৃশংস হত্যাকারী হয়ে উঠবে, বুঝতেও পারবেন না। আপনার কিশোরী লাজুক মেয়েটি কখন যে যৌন জেহাদে রওনা হবে - জানতে পারবেন সে আপনার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবার পরে।
ধর্মীয় উন্মাদনা এবং ধর্মীয় জংগীপনার এই ভাইরাস এখন তার পার্ফমেন্সের তুংগে, ঠেকাবার মতন এন্টিবায়োটিক না পেয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করছেন “তারা এখন বেহেস্তের হুর পরী পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, এর কী যৌক্তিকতা? কারা তাদের পেছন থেকে উসকাচ্ছে?” র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ঘোষনা দিচ্ছেন, "জঙ্গিজীবন থেকে ফিরে এসে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করলে ১০ লাখ টাকা দেওয়া হবে", স্বরাস্ট্র মন্ত্রীর কথা আর বলতে যাচ্ছি না, তিনি এখন একজন মুর্তিমান বিনোদন।
মধ্যযুগে খ্রিস্টান ধর্মের বিরোধীদের ওপর জিজ্ঞাসাবাদের নামে ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হত। এই ভয়াবহ পদ্ধতিটিকে বলা হয় "ইনকুইজিশন"(এ বিষয়ে প্রয়াত ব্লগার ইমন জুবায়ের এর লেখাটির লিংক)। আইএস যা করছে, আর তার পরিনামে যা হতে চলছে, আইএস পন্থীদের হাত ধরে দেশে শরীয়া আইন আসলে তার পরিনাম "ইনকুইজিশন" এর চাইতেও ভয়াবহ হতে পারে।
আশংকা করছি, দেশে হয়তো "ছহিহ মুসলিম" আর "জালি বা সন্ত্রাসী মুসলিম" ভাগ করতে গিয়ে ক্ষমতাবানেরা "উইচ-হান্ট" শুরু করে দেবে অচিরেই। তখন দেখবেন আপনার হাঁটা-চলার ভাব পছন্দ হয় নাই কোনো নেতার- আপনি প্যাঁচে পড়ে যাবেন, নিজের একমাত্র জমিটুকু বেঁচতে চাইছেন না ডেভলপারের কাছে, ডেভলপারের পার্টনার কোনো নেতা আপনাকে ফাঁসিয়ে দেবে, মন্ত্রীর ডান হাতের তালতো ভাইয়ের মেজ শালীর প্রাক্তন বয়ফ্রেন্ডের উড়নচন্ডী মাস্তান ছেলে আপনার মেয়ে কে বিয়ে করতে আগ্রহী - আপনি মত না দিলে ফেঁসে যাবেন, আরো কত কি! অদূর ভবিষ্যতে কি হতে পারে সে নিয়ে আর বাড়তি বলে ৫৭ ধারায় জেলে পঁচে মরতে চইছিনা - সেটা আন্দাজ করার মতন বুদ্ধিমত্তা পাঠকের আছে বলে জানি।
খুবসম্ভবতঃ আর কিছুদিন পরে অন্য ধর্মের নাগরিকেরাতো বটেই, একজন সাধারন শান্তিপ্রীয় ধর্মভীরু মুসলিমও হার্ট এটাকের শিকার হবেন আশেপাশে হটাৎ করে "আল্লাহু আকবার" শ্লোগান শুনলে - আইএস হামলার ভয়ে।
এই অন্ধকার আমাদের সুন্দর সবুজ দেশটাকে ঢেকে ফেলবার আগেই থামানো দরকার, খুব দরকার।
রাতমজুরের খেরোখাতাঃ জংগী এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস) বিষয়ক আবজাবনামা ১৯-০৭-২০১৬
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:৩১