ধরেন, বড় সাইজের এক রকম একটা কাঁঠাঁলের যার একটাই বিচি হয়। এরকম এক ট্রাক বিচি জন্য আপনার কত ট্রাক কাঁঠাল ক্যারি করতে হবে ? অনেক, শতশত ট্রাক! হ্যাঁ এই ফর্মুলাটাই আমাদের ব্যবহার করতে হবে আইসিটি পন্য সামগ্রীর ক্ষেত্রে যদি ডিজিটাল বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে বানাইতে চাই।যেমন ডেক্সটপের ক্যাজিং বাদ দিয়ে শুধু হার্ড ড্রাইভ একট বড় সাইজের ল্যাগেজে কি পরিমান আনা যাবে, কত টেরাবাইট ? ভাবছি চায়নার গুয়ানজিয়ান আইসিটি মার্কেটে গিয়া এক ব্যাগ মেমরি কার্ড/পেনড্রাইভের চীপ কিইনা বিমানবন্দরে কাস্টম্স, কর ফাঁকি দিয়ে দেশে আইনা কুটির শিল্পে বাঁশ দিয়া কভার বানাইয়া বেঁচবো, হাজার হাজার, লাখ লাখ।
এ রকম করে রেম, আম্মবোর্ড, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের ল্যাম্প সব এইটা সেইটা আরও কত কি! একদিন ল্যাপটপের ভিতরের সব লইয়া আসবো। আর বডি এখানে কামাড়ের দোকানে বানাইয়া নিবো। ছয় মাসের মধ্যে দোয়েল না ইস্টিকুটুম ল্যাপটপ কমপ্লিট।লাখ লাখ পিস সেল।দেন আমারে লাইসেন্স দেন, জায়গা দেন, সরকারী আর কিছু মার্কেটিং সুবিধা দেন প্রতি দশ লাখ পিসে প্রয়োজনে আমি তিন মাসের মধ্যে মার্কেট সয়লাব কইরা দিব।
আসলে দেশটারে ডিজিটাল বাংলাদেশ বানাইতে পানির দামে ইউনিভার্সাল ব্রডব্যান্ডের পরে আর যেই একটা মাত্র বস্তু লাগবো তাহলো এরকম কামাড়ের দোকানে বানানো একটা ল্যাপটপ। কারন এই জিনিষ ডিজিটাল বাংলাদেশের নাইল্লাকাডা ফার্স্ট জেনারেশনের ইউজাররা হাটে মাঠে ঘাটে আডার বস্তার উপর রাইখ্খা ইউজ করবো। যার দাম পড়বে দশ থেকে বার হাজার টাকা মাত্র।
অথচ আমাদের নাইল্লাকাডা মন্ত্রী এমপি সচিব আর বাংলার ঈঞ্জিনিয়ারেরা গত প্রায় সাড়ে চার বছরে দেশের তৈরি প্রথম ল্যাপটপ, দোয়েল নামে এটাকি কাউয়া বানাইলো ? দেশের মানুষরে কি আন্ধা পাইলো নাকি ? এরই মধ্যে এক ছোড মেধাবী ভাই দোয়েলের ২৬ হাজার টাকার মডেলটি হুবুহু অনুকরনে চেয়ে আরও ভালো কনফিগারেশনে মেশিন চীনের এক কুটির শিল্পির দোকান থেকে ১৫ হাজার টাকায় করে ৩০০ পিস ৪টা বড় ল্যাগেজে ইমপোর্ট করছে কাস্টম ফিটিং কইরা , ৫০% সোল্ড। অথচ এই দিকে আমাদের দোয়েলের অবস্থা নিচের সমালোচনায় একটু দেখুনঃ
সরকার ক্ষমতায় আসার পরপর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজি উদ্দিন রাজু আয়োজন করে ঘোষনা দেন আগামী ছয় মাসের মধ্যে আসছে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের টেলিফোন শিল্প সংস্থা নামক কারখানার লোহা লক্কর বেইচ্চা খাওয়া কোম্পানী বাংলাদেশী ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ তৈরী করবে। অতপর গত সাড়ে তিন বছর ধরে প্রতি ছয় মাস পরপর ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন রাজু টিভিতে একই ঘোষনা দিয়া আসিতেছেন আমরা শুনিতেছি আগামী ৬ মাসের মধ্যে বাজারে আসছে দেশে তৈরী স্বল্পমূল্যের ল্যাপটপ দোয়েল। আমি গত সপ্তাহেও আইডিবিতে খোজ নিলাম আগামী তিন মাসের মধ্যে মার্কেটে দোয়েল পাবো কিনা ? উত্তর, ছয় মাসের মধ্যেও না। অথচ রাজুর এই বক্তব্যকে দলের কর্মী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত বিভিন্ন মিটিং মিছিলে পুনপুন প্রচার করতে করতে কান ঝালাপালা। সর্বশেষ গত ১১ অক্টোবর ২০১১ নজির বিহীন ঢাক ঢোল পিটিয়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেন অনেক প্রত্যাশিত বাংলাদেশী ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ দোয়েল। আমরা ভাবলাম অনেকবার ঘোষণার পর অবশেষে তা এলো।কিন্তু না এলো এলো বলেও এলো না, দোয়েল ল্যাপটপ সর্বপ্রথম পাবেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীরা, তারপর এগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। যতদূর জানা যায় আজও কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারী বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠনে এই ল্যাপটপ পাওয়ার কোন ঘটনা ঘটে নাই। সাধারন মানুষের হাতে অর্থাৎ আইডিবি, ইসিএস মার্কেটে এই আবিষ্কার আগামী দুই বছরে আগে পৌছানো কল্পনাও টেশিস করে না। সেদিন প্রথমত এত প্রক্রিয়া শেষ করার পর মানুষের হাতে যখন এই মহান বস্তুটা পৌঁছবে ততক্ষণে হয়তো অন্য সব কোম্পানি তাদের পণ্যগুলো দোয়েলের চেয়ে কম দামে অনেক বেশি সুবিধা নিয়ে চলে আসবে।
দোয়েল ল্যাপটপের কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশী মোবাইল অপারেটর টেলিটকের কথা মনে পড়ে গেল। সাধের টেলিটক পাওয়ার জন্য সেদিন বিকেলেই লাইনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন আমজাদ পারভেজ। সারা রাত জেগে থেকে পরদিন সকাল গড়িয়ে দুপুর হলে জানলেন টেলিটকের সিমকার্ড আর বিক্রি হচ্ছে না। মনে প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন। কিছু দিন পর এলো অনলাইনে আবেদনের পদ্ধতি, যথারীতি আবেদনও করলেন। স্থায়ী ঠিকানা ঝিনাইদহ হওয়ার সুবাদে ডাক পড়ল পনেরো দিন পর। তাকে ঝিনইদহ শহরে গিয়ে ব্যাংকে নির্ধারিত তিন হাজার টাকা জমা দিয়ে সিমকার্ডটি সংগ্রহ করতে হবে, যখন অন্যান্য অপারেটরের সিমের মার্কেটে ২০ টাকা থেকে ৩০০ টাকায় মুদির দোকানেও বিক্রি হচ্ছে। পারভেজ অফিসে ছুটির জন্য দরখাস্ত করে তিন দিনের ছুটি নিয়ে বহু কষ্টে বাসের টিকিট কেটে মহা প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সিমকার্ডটি যখন হাতে পেলেন তখন তার আনন্দ আর ধরে না, যেন আলাদীনের প্রদীপটি পেলেন। সিমকার্ডটি ঢাকায় এনে যখন অ্যাকটিভ করলেন তখন দেখেন নেটওয়ার্ক নেই, ছাদের ওপর গিয়ে নেটওয়ার্ক পেলেন না। যখন কল করা শুরু করলেন তখন শুরু হলো সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের পালা, দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো ফোনে সংযোগ করতে পারলেন না, পারভেজের সব স্বপ্ন ফিকে হয়ে যেতে লাগল। টেলিটক আজো তার নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করতে পারেনি, এখনো টেলিটক থেকে বা টেলিটকে একটা ফোন করতে গেলে বহুবার চেষ্টা করতে হয়। আর এত দিনে টেলিটকের প্রতি মানুষের আগ্রহ নেমে গেছে হিমাঙ্কের নিচে। আজ যেখানে দেশে মোট মোবাইল সংযোগ ৮ কোটির উপরে সেখানে টেলিটকের সংযোগ ৭ লাখের কিছু উপরে।এত কিছুর পরও গত তিন বছরে ২.৫ শতাংশ সুদে চীন থেকে ১৫০০ কোটি টাকা ঋন নিয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে আর প্রতিদিন ইউজার আরও কমছে।আবার বলা হচ্ছে আগামী বছর শুধু টেলিটককে থ্রীজি অনুমোদন দেয়া হবে ও আরও নতুন বিনিয়োগ করা হবে যতদিন না এর ব্যবহারকারী শূন্যতে নেমে আসবে।
দোয়েলের অবস্থাও তথৈবচ তার বলতে জতিষি হতে হবে না।
কারন সমগ্র পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে উইন্ডোজকে চেনে। আর দোয়েল ল্যাপটপ আমাদের হাতে এলো হাজারে একজনও চেনে না এমন জটিল অপারেটিং সিস্টেম লিনাক্স ও এনড্রয়েড দিয়ে। যেগুলোতে আপনার পছন্দের উইন্ডোজ বেইজড ও পরিচিত প্রয়োজনীয় কোনো সফটওয়্যারই ইনস্টল দিতে পারবেন না। এই অপারেটিং সিস্টেম দিয়ে কাজ করতে আমাদের বড় ধরনের অসুবিধার মুখোমুখি হতে হবে। এনড্রয়েড হলো মোবাইল ফোন ও ট্যাবলেট পিসির জন্য তৈরি অপারেটিং সিস্টেম। এনড্রয়েড ও লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেমসমৃদ্ধ ল্যাপটপ দিয়ে বহুল প্রচলিত মাইক্রোসফট অফিস ওয়ার্ডও ব্যবহার করা যায় না। আমাদের টুজি, এজ বা জিপিআরএস মোবাইল নেটওয়ার্কে ইন্টারনেট ব্যবহার করা যাবে না। থ্রীজিতেও যাবে না, ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট ব্যবহার করা সম্ভব নয়। কারণ এই অপারেটিং সিস্টেম এনাবলড সফটওয়্যার ড্রাইভার আমাদের কোনো মোবাইল মডেম বা ওয়াইম্যাক্স মডেমে নেই। অথচ যদি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা সঠিক প্রক্রিয়ায় মাইক্রোসফটের কাছে ব্যপক জনগণের হাতে পৌছে দেয়ার উদ্দেশ্য কমমূল্যে শিক্ষা বিষয়ক ল্যাপটপ তৈরির জন্য উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম চেয়ে আবেদন করত, তাহলে অতি অল্প পয়সায় বা বিনা পয়সায় আমরা উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম পেতে পারতাম। যে সেবামূলক কাজগুলো মাইক্রোসফট তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করেছে।যেমন ভারত ২০০৯ সালেই তার দেশের সস্তা ল্যাপটপ করে ফেলেছে মাত্র ৫০০০ রুপির ভেতরে।অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ।থাইল্যান্ড করেছে, আফ্রিকার কয়েকটি দেশও করেছে সস্তার ল্যাপটপ। অনেক দেশ পার স্টুডেন্ট ওয়ান ল্যাপটপ প্রগরামে আরও কম দামে ল্যাপটপ তৈরি করে ফেলেছে।
তবে দোয়েল ল্যাপটপে বিল্টইন ওয়াইফাইয়ে শুধু ওয়াইফাই নেটওয়ার্কে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন টিএসসি এলাকায় বা অন্য কোথাও যদি থাকে। বাসায় ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক দিয়ে আপনাকে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হলে কী করতে হবে? প্রথমে কমবেশি তিন হাজার টাকা দিয়ে মডেম কিনতে হবে, অতঃপর মডেমটাকে ওয়াইফাই রাউটারের সাথে সংযোগ দিতে হবে। এর দাম আড়াই হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত, তারপর দোয়েল ল্যাপটপে ওয়াইফাই কানেক্টিভিটির মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাবে।
এনড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের মডেলটিতে কোনো হার্ডডিস্ক পাবেন না, তথ্য জমা হবে মেমোরি কার্ডে। যার সর্বোচ্চ ক্ষমতা ৩২ গিগাবাইট। একটি কম্পিউটার শুধু একটি কম্পিউটারই নয়, এটা যখন শিক্ষা, ইন্টারনেট, তথ্য সংগ্রহ আর বিনোদনের হাতিয়ার হয় তখন এটা বিশাল ডাটা স্টোরে পরিণত হয়। আপনি এই বিশাল ডাটা স্টোরকে সামান্য ৩২ গিগাবাইটের মধ্যে কী করে বেঁধে রাখবেন? দোয়েল ১৬১২ ছাড়া সব ল্যাপটপের আছে তিন সেলের ব্যাটারি, যা এক থেকে দুই ঘণ্টার কম ব্যাকআপ দেবে। আমাদের দেশের বিদ্যুতের যে লোডশেডিং তাতে এই সামান্য ব্যাটারি ব্যাকআপে কিভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে ল্যাপটপ ব্যবহারের সুযোগ পাবেন? এটা কিভাবে ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থার হাতিয়ার হবে।
সরকার দোয়েলকে ল্যাপটপ বলে ঘোষণা দিচ্ছে, তার সাথে এ-ও ঘোষণা দিচ্ছে এটা দেশীয় পণ্য। কিন' দোয়েল কি দেশীয় পণ্য? দোয়েলের হার্ডডিস্ক, মনিটর, মাদারবোর্ড, র্যাম কি বাংলাদেশে তৈরি? ভায়া আর ইন্টেল কি আমাদের দোয়েলের জন্য প্রসেসর তৈরি করেছে? যে পণ্য তৈরিতে ৯৫ শতাংশ যন্ত্রাংশ আমরা বাইরে থেকে কিনে এনে সংযোজন করছি সেই পণ্যটিকে আমরা কী দেশীয় পণ্য বলব নাকি অ্যাসেম্বল ইন বাংলাদেশ বলব।যদি আইডিবির কোন দোকানকে এই রকম ল্যাপটপ সংযোজনের লাইসেন্স দেয়া হতো তাহলে তারাও সর্বচ্চ ৬ মাসে এরচেয়ে কম দামে ল্যাপটপ তৈরীকরে ফেলতে পারতো। দোয়েল উৎপাদনের ঘোষণার শুরুতে বলা হয়েছিল এর দাম সাত হাজার টাকা থেকে শুরু হবে। কিন' সবচেয়ে কম দামি দোয়েলের দাম ১০ হাজার টাকা। একই কনফিগারেশনের চায়নার ট্যাবলেট টাচ ৫০ ডলার থেকে ৭০ ডলারে পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশী টাকায় তিন হাজার ৬০০ থেকে পাঁচ হাজার ৪০ টাকা। তাহলে কিভাবে দোয়েল কম দামে আমরা পেলাম, দোয়েলের প্রকৃত যে মূল্য হওয়া প্রয়োজন বর্তমান মূল্য তার চেয়ে অনেক বেশি নয় কি?
শুরুতেই পিছিয়ে পরা বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তিতে আজ যেখানে বিশ্বে গড় মানের যেকোন দেশের চেয়ে অন্তত দশ বছর পেছনে পরে আছে সেখানে রাজি উদ্দিন রাজু, জিয়া আহম্মেদ -বিটিআরসি চ্যায়ারম্যান-, ইয়াফেজ ওসমান, আবুল, সুনিল কান্তির মত লোকদের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মানের অন্যতম কারিগরদের পদে বসিয়ে আমরা শুধু ডিজিটাল বাংলাদেশ স্লোগানটিকেই প্রতারনা করিনি, বরং গত তিন বছরের তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষিপ্র গতির সময়টুকুতে দেশকে অনেক অনেক পিছিয়ে দিয়েছি।
সম্পাদিত। অসমাপ্ত
মূল লেখা আমজাদ পারভেজ। লেখকের ইমেইল : [email protected]
দোয়েলরে ওরা কাউয়া বানাইয়া দিলরে
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০১১ বিকাল ৩:২৮