somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মিনার মাহমুদ

১৬ ই আগস্ট, ২০১২ দুপুর ১:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

View this link

নির্ঘুম স্বপ্নের দেশ থেকে স্বপ্নহীন ঘুমের দেশে একজন মিনার মাহমুদ -লুৎফর রহমান রিটন

মিনার মাহমুদের মতো একজন লড়াকু মানুষ আত্মহত্যা করবেন এটা মানতে এখনো কষ্ট হচ্ছে। তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ‘আত্মহত্যা’ ব্যাপারটা বোঝা যায় না। কী বর্ণাঢ্য একটা জীবন ছিল তাঁর! অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ এ রকম বর্ণিল জীবন আমাদের প্রজন্মের আর কারো তো ছিল না! বিশেষ কোনো একটি অভিধায় বিশেষায়িত করা যায় না তাঁকে। তাঁর চরিত্রের মধ্যে একই সঙ্গে দায়িত্বশীলতা এবং কাণ্ডজ্ঞানহীনতার অপূর্ব মিশেল ছিল। যে কারণে মিনারকে আমার আনপ্রেডিক্টেবল মনে হতো সবসময়। আমাদের প্রজন্মে মিনার মাহমুদ ছিলেন কীর্তিমান এক রহস্যপুরুষ। যে রহস্যের সিংহভাগই চির অনুদ্ঘাটিতই থেকে গেল। আমরা পরস্পরকে জানতাম। মিনার জানতেন আমি তাঁকে পছন্দ করি। আমিও জানতাম মিনার আমাকে পছন্দ করেন। কিন্তু আমরা কখনো একসঙ্গে কাজ করিনি। কেন করিনি সেটাও একটা রহস্যই। মিনারের আলোড়ন সৃষ্টিকারী বিচিন্তা পত্রিকায় একবারও লিখিনি আমি। আমিও নিজের থেকে লিখিনি আবার মিনারও কখনো বলেননি লিখতে। অথচ স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী তুমুল আন্দোলনে আমারও ব্যাপক প্রকাশ্য সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল! কিন্তু মিনার নির্মিত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আমার কিছু করা হয়নি। আমাদের মত ও পথ ভিন্ন ছিল কিন্তু চেতনাগত কিছু দায়-এর ক্ষেত্রে চিন্তাগত একটা ঐক্যও ছিল। সেই ঐক্যই আমাদের বন্ধুত্বের বাঁধনকে অটুট রেখেছিল।
অতীত এবং ভবিষ্যৎকে অবলীলায় ইরেজ করে দিয়ে বর্তমানকে নিয়ে মেতে থাকার একটা বিরল ক্ষমতা ছিল মিনারের। তাঁর চরিত্রে কোনো পিছুটান ছিল না। যে কারণে টানা আঠারোটি বছর তিনি বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ সম্পর্কিত সমস্ত কিছু থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে পেরেছিলেন অনায়াসে। ২০০২ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে মিনারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল নিউইয়র্কে। তখন, কথা বলে বুঝেছিলাম বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশের উত্থান-পতন কোনোকিছুই স্পর্শ করে না তাঁকে। Ñ‘কী করে পারেন আপনি, মিনার?’ জানতে চাইলে মিনার আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি এখানে একজন গুহামানবের জীবনযাপন করছি। এই গুহার বাইরের জগৎ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা বা আগ্রহ নেই।’
মিনারের সেই কথাকে আমি মোটেও কথার কথা হিসেবে নিইনি। নিউইয়র্কে তাঁর জীবনযাপন সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আমার প্রতীতী জন্মেছিল যে মিনার মিথ্যে বলছেন না। ট্যাক্সি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি তিনি তখন ‘এখন সময়’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় পার্টটাইম কাজ করেন। বিনিময়ে বাড়ি ভাড়াটা পরিশোধ করে পত্রিকা কর্তৃপক্ষ। আর ট্যাক্সি চালিয়ে যা আয় হয় তা দিয়ে মদে-ভাতে দিন চলে যায়। বলেছিলেন মিনার মাহমুদ। নিউইয়র্ক থেকে কানাডা চলে আসার আগে পুরো একটা দিন মিনার আমাকে তাঁর জীবনযাপন বা দিনযাপন দেখার আমন্ত্রণ জানালেন। নির্ধারিত তারিখে এস্টোরিয়া এলাকা থেকে তিনি আমাকে সকালে গাড়িতে তুলবেন বললেও তিনি এসে হর্ন বাজালেন দুপুর একটায়। --কিরে ভাই এই নাকি আপনার সকাল?
মিষ্টি হাসিতে আমার রাগ মুছে দিয়ে মিনার বলেছিলেন, ‘সরি, আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আমার সকাল হয় দুপুরেই। প্রচুর মদ্যপান করে ভোরের দিকে ঘুমুতে যাই। ঘুম ভাঙে দুপুর একটার দিকে। আপনি তো আজ থাকবেন আমার সঙ্গে। দেখবেন। আজকে রাতের আসরে আমার একজন বান্ধবীও থাকবে, কলকাতার মেয়ে। আপনার কথা বলেছি তাকে। আপনার সঙ্গে পরিচিত হতে উন্মুখ আমার বান্ধবীটি।’
সেই দুপুরটা আমরা ঘুরে বেড়ালাম এখানে-ওখানে। এক চক্কর পত্রিকা অফিসেও যেতে হবে তাঁকে। বললেন, ‘ঘণ্টাখানেক কাটাতে হবে ওখানে। আপনার বোর লাগবে না তো?’
মিনারের জন্যে টোকিও থেকে কেনা দামি ব্র্যান্ডের ধূসর রঙের একটা শার্ট নিয়ে গিয়েছিলাম। মজা করে বললেন, জাপানের ইয়েনে কেনা? বললাম, জ্বি জনাব।
পত্রিকা অফিসে গিয়ে মজার অভিজ্ঞতা হলো। পত্রিকাটির মালিক-সম্পাদক প্রবীণ ভদ্রলোক (নাম সাম মিস্টার কাজী) আমাকে পেয়ে খুবই খুশি হলেন। আমাকে এটা সেটা খাইয়ে সতেজ রাখলেন। চলল ম্যারাথন গল্প। এখানে দেখা হলো দৈনিক বাংলার সিনিয়র সাংবাদিক আমার পূর্বপরিচিত মঞ্জুর আহমদের সঙ্গে। তিনি পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক। টেবিলের উল্টোদিকে বসে মিনার খসখস করে লিখে চলেছেন।
Ñ‘কী লিখছেন?’
বললেন, ‘একটা ধারাবাহিক লেখার এবারের কিস্তিটা। এই যে এগুলো দেখেন। ধারণা পাবেন কি লিখছি।’ বলে এখন সময় পত্রিকার একটা ফাইল আমার দিকে ঠেলে দিলেন মিনার।
দেখলাম স্বাদু গদ্যে প্রতি সপ্তাহে মিনার মাহমুদ লিখছেন তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে তাঁর ঘর-সংসার আর জীবনযাপনের আনন্দ-বেদনার আলো-অন্ধকার-বর্ণিল-ধূসর কাব্য। ঝরঝরে স্মার্ট গদ্য। মিনার নতুন পর্বটি লিখে শেষ করতে করতেই আমার পড়া হয়ে গেল ছ-সাতটা কিস্তি। বললাম, ‘ভাইজান আপনার তো উচিত এই জিনিস বাংলাদেশের পত্রিকায় লেখা।’ মিনার বললেন, ‘নাহ্, বাড়ি ভাড়াটা হালাল করতে লেখা। নাথিং সিরিয়াস।’
এই মিনারের সঙ্গে আমার সামনাসামনি পরিচয় সাপ্তাহিক বিচিত্রা অফিসে, আশির দশকে। পরিচয়ের প্রথম দিনেই তিনি আমাকে বলেছিলেন তাঁর চোখে আমি নাকি একজন চৌকস তরুণ। মিনার তখন নিজেই বিচিত্রার নবীন কিন্তু চৌকস তরুণ রিপোর্টার। দু-তিনটে রিপোর্ট লিখেই ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করা তরুণ সাংবাদিক। মিনারের লেখা বিচিত্রার কভার স্টোরি কিংবা প্রতিবেদন পড়ার জন্যে মুখিয়ে থাকতাম। আহা কী অসাধারণ স্মার্ট একটা গদ্যভঙ্গি ছিল মিনারের! একবার, বিচিত্রায় বর্ডারে চোরাচালান বিষয়ে মিনারের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘অপারেশন মংলা’ প্রকাশিত হবার পর সেটা ব্যাপক আলোড়ন তুলল। রাষ্ট্রপতি এরশাদ মিনারকে ডেকে পাঠালেন। তারপর হেলিকপ্টারে করে মিনারকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে গেলেন সরেজমিন দেখতে। এরপর থেকেই নাটকীয়তার শুরু। লোকজন নানা কথা বলে মিনারের নামে। মিনারের লাল চকচকে নতুন হোন্ডা দেখে নিন্দুকেরা গল্প বানায়। দৈনিক বাংলার মূল ফটক লাগোয়া পত্রিকা স্ট্যান্ডের সামনে এক দুপুরে হোন্ডায় বসা মিনার পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করেন, পত্রিকা বিক্রেতাকে টাকা দেবেন বলে। পাশে দাঁড়ানো আমি মিনারের মানিব্যাগে থরে থরে সাজানো একশ টাকার নোট দেখতে পাই। মিনার সেটা লক্ষ্য করে মুচকি হাসেন। আমার সঙ্গে কথা শেষ হলে হোন্ডায় স্টার্ট দেন। দৈনিক বাংলার ছোটদের পাতা সাত ভাই চম্পায় নিয়মিত লেখালেখির সুবাদে আমি তখন প্রায় প্রতিদিনই ওখানে যাই। নিয়মিত ঢুঁ মারি বিচিত্রায়। সবখানেই তরুণ রিপোর্টার মিনার মাহমুদ সম্পর্কে নানান কিসিমের ফিসফাঁস। মিনার নাকি ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাচ্ছেন। বিচিত্রা সম্পাদক শাহাদাত চৌধুরীর সঙ্গে খিটিমিটি লেগে গেল মিনারের। বিচিত্রা ছেড়ে দিলেন মিনার কিংবা তাঁকে ছেড়ে দিল বিচিত্রা। এর কিছুকাল পরেই মিনারের সম্পাদনায় প্রকাশিত হলো সাপ্তাহিক বিচিন্তা। বাংলাদেশের পত্রিকা জগতে ঘটে গেল বিস্ফোরণ।
বিচিন্তার একেকটা সংখ্যা বেরোয় আর পাঠক সেটা কেনে হুড়মুড়িয়ে। নাম না জানা অখ্যাত অজ্ঞাত মেধাবী তরুণদের দুর্ধর্ষ একটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠল বিচিন্তা। একেকটা লিকলিকে ছেলের দুঃসাহসী রিপোর্টিংয়ে দিশেহারা হয়ে উঠল স্বৈরশাসক এরশাদ-সচিবালয়-প্রশাসন-বিভিন্ন সংস্থা এবং সেনাবাহিনী। অবশ্য সেনাবাহিনীর একটা অংশ এবং কোনো কোনো গোয়েন্দা সংস্থা এই পত্রিকাটিকে কৌশলে ব্যবহারও করেছে। মিনার তখন দু’হাতে হ্যান্ডশেক করে চলেছেন অজস্র বন্ধু এবং অজস্র শত্রুর সঙ্গে। একটি ওষুধ কোম্পানির কোটিপটি মালিকের স্ত্রী বিচিন্তার টাকার জোগান দিলেও মিনারকে তখন টাকা দিতে তৈরি ছিল আরো অনেকেই। মিনারকে থামানো কিংবা হাত করার জন্যে কিংবা সমঝোতা করার জন্যে নানান সূত্রের লোকজন তাঁর সঙ্গে মোলাকাত করতেন। মোলাকাতের স্থান হিসেবে শেরাটন ছিল তাঁর প্রিয় ভেন্যু। দু-তিনটে মোলাকাতের খবর আমার পূর্বাহ্নেই জানা ছিল। কিন্তু সহজে মিনারকে হাত করা যেত না। তাক লাগানো অবিশ্বাস্য রকমের শর্ত জুড়ে দিতেন তিনি।
মিনারের মানে বিচিন্তার আক্রমণে সমাজের-রাষ্ট্রের অধিকাংশ সেক্টরই ছিল খানিকটা দুশ্চিন্তায়। বিশেষ করে ব্যক্তির ভাবমূর্তি ভাঙার ক্ষেত্রে মিনারের দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয়। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ধর্মীয় কিংবা প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব থেকে খুদে এবং বৃহৎ আমলা-ব্যবসায়ীরা কিঞ্চিৎ তটস্থই ছিল বলা চলে। সমাজের দুর্নীতিপরায়ণ মানুষ ভালোমানুষী চেহারার আড়ালে কবে কখন কোথায় কী অঘটন ঘটিয়ে রেখেছিল সেটা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়ে কারো কারো মর্যাদাহানি ঘটিয়েছেন বিস্তর। বিষয়গুলোতে পত্রিকা পাঠকরা বিমলানন্দ লাভ করত। মিনারের সোর্স নেটওয়ার্কিং ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে পেতে পেতে এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে কখনো কখনো স্টোরি স্বয়ং এসে উপস্থিত হতো তাঁর কাছে। কভার স্টোরির যাবতীয় মালমসলার প্রামাণিক ফাইল নিখুঁত ব্যবস্থাপনায় পৌঁছে যেত মিনারের হাতে। এইসব ছেপে দিয়ে হুলুস্থুল বাঁধিয়ে দিতেন তিনি প্রায়শই। এক পর্যায়ে রিপোর্টিংয়ের ক্রিজে মিনার হয়ে উঠলেন অতিমাত্রায় দুর্বিনীত এবং ওভার কনফিডেন্ট ব্যাটসম্যান। প্রতিপক্ষের ছুড়ে দেয়া যে কোনো বলেই ছক্কা পেটানো শুরু করলেন। ফলে স্ট্যাম্প উড়ে যাওয়া এবং উইকেট পতনও অনিবার্য হয়ে উঠল। মিনারকে ফাঁদে ফেলে ইনিংসের সমাপ্তি টানতে তৎপর হচ্ছিল দৃশ্যপটে অনুপস্থিত এক বা একাধিক অনুঘটক।
শেষদিকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকেও মেরে বসলেন মিনার। ঋদ্ধি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে এম এ হাসান নামের এক টাউট এসে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে এতটাই বিভ্রান্ত করে ফেলল যে স্যার সেই টাউটের খপ্পরে পড়ে তার সঙ্গে একটা যৌথ প্রজেক্টে চুক্তি স্বাক্ষর করে বসলেন। প্রজেক্টটি ছিল বুক রিলেটেড। সেই টাউট বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং সায়ীদ স্যারের নাম ব্যবহার করে মানুষের কাছ থেকে প্রতারণা করে কিছু টাকা হাতিয়ে নেবার তাল করেছিল। বেশ কিছু মানুষ সেই টাউটের ফাঁদে পা দিয়েছিল। এই বিষয়ে বিচিন্তায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। প্রতিবেদনে সায়ীদ স্যারের সারা জীবনের অর্জন সততা আর নিষ্ঠাকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলো। তিলে তিলে গড়া সায়ীদ স্যারের ইমেজ ধুলোয় মিশিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা। পত্রিকাটি পড়ে স্যারকে দেখলাম মহা উত্তেজিত এবং ক্ষুব্ধ। ক্ষুব্ধ তিনি মিনারের ওপর। বললেন, এ রকম একটা প্রতিবেদন ছাপার আগে আমাকে একবার ফোন করবে না? আমার বক্তব্য নেবে না? একতরফা এবং ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তিল তিল করে গড়ে তোলা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো একটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করতে চাইছে কেন মিনার? স্যার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি আইনের আশ্রয় নেবেন। মামলা করবেন তিনি মিনার এবং বিচিন্তার বিরুদ্ধে। কিন্তু মিনারের মতো একতরফা কিছু করতে যাওয়ার আগে তিনি চাইলেন মিনারের মনোভাব জানতে। মিনারকে সতর্ক করতে। আমাকেই ভার দিলেন স্যার। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে স্যার তখন সম্রাট আর আমি তাঁর ত্রয়োদশ পুত্র। বললেন যাও, ওকে বল দুঃখ প্রকাশ করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে আগামী সংখ্যায় আরেকটা প্রতিবেদন ছাপাতে। নইলে আমি মামলা করব। ওকে জিজ্ঞেস কর মামলা করলে মিনার সেটা ফেস করতে পারবে কিনা। যথেষ্ট প্রমাণ ওর হাতে আছে কিনা।
আহমাদ মাযহারকে পেছনে বসিয়ে বিকেলেই আমি আমার লাল রঙের হোন্ডা ৮০ চালিয়ে পৌঁছে গেলাম মিনারের অফিসে, কাকরাইল রাজমনি সিনেমা হলের মোড় লাগোয়া ফরিদপুর ম্যানসনের পাশে একটা ছোট্ট দোতলা বিল্ডিংয়ে। আমার হোন্ডাটা অফিসের পার্কিং এলাকায় পৌঁছুতেই দেখলাম কয়েকজন সঙ্গীসহ মিনার বেরুচ্ছেন। আমাদের দেখে থামলেন। হাসিমুখে কুশল বিনিময়ের পর ভদ্রতা প্রকাশ করে আবার অফিসে ফিরতে চাইলেন আমাদের সম্মানে। আমি বললাম, নারে ভাই। এখানেই বলি। পত্রিকার চলতি সংখ্যাটা পড়ে সায়ীদ স্যার খুবই কষ্ট পেয়েছেন। স্যারের সারা জীবনের মর্যাদাপূর্ণ ইমেজটা ধূলিসাৎ করে দিয়েছেন।
আমার কথায় মিটিমিটি হেসে মিনার বললেন, আপনার স্যারকে বাঁচাতে এসেছেন? প্রতারণা করার আগে স্যারের কি এটা ভাবা উচিত ছিল না যে তিনি একদিন ধরা পড়ে যাবেন?
Ñকিন্তু স্যার তো বললেন এমন কোনো প্রতারণার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। স্যার আমাকে পাঠিয়েছেন আপনাকে জানাতে যে স্যার মামলা করবেন যদি আপনি দুঃখ প্রকাশ করে এবং ক্ষমা চেয়ে আগামী সংখ্যায় আরেকটি রিপোর্ট না ছাপেন।
অবজ্ঞার হাসি হেসে মিনার বললেন, প্রশ্নই ওঠে না। আপনার স্যারকে বলেন দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাইতে।
Ñআচ্ছা মিনার, আপনার হাতে যথেষ্ট প্রমাণ আছে তো? স্যার মামলা করলে ফেস করতে পারবেন তো?
Ñআমাকে নিয়া ভাইবেন না রিটন, হাতে প্রমাণ আছে বইলাই তো ছাপছি। যতই চেষ্টা করেন আপনার স্যারের ভাবমূর্তি শ্যাষ।
হোন্ডায় স্টার্ট নিতে নিতে আমি বললাম, Ñস্যার তাহলে মামলাটা করুক। তাই তো?
মিনার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন, জ্বি। করুক।
পরের দিনই স্যার আমাকে সঙ্গে নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করে রমনা থানায় গেলেন। মামলা হলো। মামলাটা করার পর থানার বারান্দায় একটু দাঁড়ালেন স্যার। তারপর গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিষণœ কণ্ঠে বললেন, Ñছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা! জীবনে কোনোদিন যা ভাবিনি তা-ই আমাকে করতে হলো! কিন্তু কি করব কেন্দ্রকে তো বাঁচাতে হবে। তাই না?
আমি বললাম, Ñজ্বি স্যার।
আমরা ফিরছি বাংলামোটরের দিকে। স্যারকে মৃদু তিরস্কার করলাম, আপনি স্যার ঋদ্ধির অই বাটপাড়ের সঙ্গে চুক্তিটা করতে গেলেন কেন?
স্যার বললেন, তোমার কি মনে হয় আমার রক্ত পানি করে গড়ে তোলা একটা প্রতিষ্ঠানকে আমি কারো কাছে বিকিয়ে দেব? কেন্দ্রে চল তোমাকে দেখাই কি লেখা আছে সেই চুক্তিতে! ঋদ্ধির সঙ্গে আমাদের চুক্তি শুধু বই বিক্রির। এখন, ঋদ্ধি নামের একটি প্রতিষ্ঠান দশজনের সঙ্গে দশ রকমের প্রতারণা করতে পারে। তার দায় কেন্দ্র কেন নেবে? আমি কেন নেব? মিনারের মতো একজন মেধাবী ছেলে কী করে একটা বাটপাড়ের প্রতারণার সঙ্গে কেন্দ্রকে জড়াল? আমাকে জড়াল? দেশের সেরা আইনজীবীদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। এই মামলায় মিনারের জয়ী হবার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য।
স্যারের সঙ্গে দেশের নানান ক্ষেত্রের নানান স্তরের বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের প্রায় সবারই আন্তরিক এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, যাঁরা সোসাইটিতে ম্যাটার করেন। কয়েকদিন পর স্যার আমাকে বললেন, Ñ আমি মিনারের নামে মামলা করেছি বলে সবাই দেখি দারুণ খুশি। এত এত মানুষকে ক্ষেপিয়ে রেখেছে ও! সবাই খালি ওকে এইভাবে থাবা মেরে ধরতে চায় বলে স্যার তাঁর ডান হাতটা সামনের দিকে বিস্তার করে মুঠোটা বন্ধ করে দ্রুত সেটা পেছন দিকে টেনে নিয়ে দেখালেন বারকয়।
এই মামলার কিছুদিন পর স্যার এবং কেন্দ্র বিষয়ে তাঁর অনমনীয় অবস্থান থেকে পিছু হটতে শুরু করলেন মিনার। স্যারকে নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টের কারণে দুঃখ প্রকাশ এবং ক্ষমা চাইতে রাজি হলেন। স্যার বললেন, ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে মানুষের চোখে পড়বে না এমন জায়গায় ক্ষমা চাইলে হবে না। ক্ষমা চাইতে হবে প্রচ্ছদে। বড় বড় হরফে। মিনার আমাকে ধরলেন, ভাই স্যারকে একটু বোঝান।
আমি মাযহার আর আমীরুল স্যারকে বোঝানোর চেষ্টা করি। কিন্তু স্যার কিছু বুঝতে বা মানতে রাজি নন। তাঁর ঐ এক কথা কভার পেজে ছাপতে হবে বড় বড় অক্ষরে।
বিভিন্ন পত্রিকায় আমার চাকরির অভিজ্ঞতাকে স্যার মূল্য দিতেন। অনেক বোঝালাম স্যারকে। অবিরাম চেষ্টার এক পর্যায়ে কভার পেজ থেকে সরে এলেন স্যার। তবে শর্ত দিলেন, প্রচ্ছদ ওল্টালেই ডানদিকের যে পৃষ্ঠাটা ওখানে ছাপতে হবে বড় করে।
মিনার রাজি। পরক্ষণেই স্যার জানালেন, মাত্র এক সংখ্যায় ওটা ছাপালে চলবে না। ছাপতে হবে পর পর চার সংখ্যায়। কারণ ড্যামেজিং রিপোর্টটা যারা পড়েছিল তারা এই সংখ্যাটা কোনো কারণে নাও পড়তে পারে। সুতরাং ছাপতে হবে পর পর চার সংখ্যায়।
মিনার রাজি। কিন্তু স্যারের তাতেও মন ভরে না। বললেন, মিনার নিজের ভাষায় চালাকি করে ক্ষমা চাইলে হবে না। বক্তব্যটা আমি লিখে দেবো, ওটাই ছাপতে হবে। বক্স করে।
মিনার রাজি। স্যার একটা ড্রাফট রেডি করলেন। আমি বললাম, করেছেন কী স্যার! এত কথা ছাপাতে গেলে তো স্যার পুরো পৃষ্ঠাই লেগে যাবে। তাতে এটাকে বিজ্ঞাপনের মতো মনে হবে। স্যার বললেন, পারলে কমাও।
আমি মাযহার আর আমীরুল লেগে পড়লাম ড্রাফট মেরামতে। আমরা তিনজন কেন্দ্রের কম্পিউটার সেকশন থেকে বারবার এডিট করা প্রিন্ট বের করি আর এডিট করি মানে বক্তব্য ঠিক রেখে আরেকটু কমাই। আরেকটু কমাই। এভাবে কমাতে কমাতে এক পর্যায়ে আমরা তিনজন একমত হই যেÑ হয়েছে! তারপর স্যারকে দেখাই। আমাদের সম্পাদনা দক্ষতা দেখে স্যার ইম্প্রেসড। বললেন ঠিক আছে।
বিচিন্তার পৃষ্ঠার মাপে প্রায় হাফ পেজ সাইজে মোটা রুলের একটা বক্সে একটা বড়সড় বোল্ড টাইপের শিরোনামসহ বডি টাইপের চেয়ে ঢের বড় টাইপে বক্তব্যটা কম্পোজ করে চারটে ট্রেসিং এবং কয়েকটা এ-ফোর আকারের ঝকঝকে সাদা কাগজে প্রিন্ট করে দিয়ে এলাম মিনারকে। মিনার আমাকে বললেন, এটা তো ছাপবই। তার আগে কেন্দ্রে গিয়ে কেন্দ্রের ছেলেমেয়েদের সামনে সরাসরি স্যারের কাছে একটু ক্ষমা চাইতে চাই। প্লিজ আপনি ব্যবস্থা করেন রিটন।
ইতোমধ্যে স্যারের বাড়িতে গিয়ে স্যারের কাছে একপ্রস্থ ক্ষমা প্রার্থনা করেও এসেছেন মিনার। এটা স্যারই আমাদের বলেছিলেন। স্যারকে বললাম যে মিনার কেন্দ্রে আসতে চায় একদিন। স্যার বললেন, ওর যেদিন খুশি আসতে বল সন্ধ্যায়। মিনারের সঙ্গে কথা বললাম। তারিখ নির্ধারিত হলো। মিনার শুধু বললেন, ওইদিন আপনিও থাইকেন। আমি বললাম, শিওর।
নির্ধারিত তারিখে সন্ধ্যায় মিনার এলেন বাংলামোটরের গলিতে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। সেই সন্ধ্যায় কি একটা কর্মসূচির কারণে কেন্দ্র ছিল একঝাঁক ছেলেমেয়েতে ঠাসা। ছাদের উন্মুক্ত পরিসরে বড়সড় একটা গ্রুপের সঙ্গে স্যারের আলোচনা চলছে।
নিচতলায় আম গাছের নিচেই বসেছিলাম আমি। মিনার এলেন। মুখোমুখি আরেকটি চেয়ারে তাঁকে বসিয়ে আমরা দুজনেই ধূমায়িত চায়ে চুমুক দিচ্ছি। কলেজ কর্মসূচির একটি ছেলে মিনারকে দেখে একটু এগিয়ে এসে উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাত উঁচিয়ে আঙুল নাড়াতে নাড়াতে মিনারের উদ্দেশে অগ্নিবর্ষণ আরম্ভ করল। মিনার মাথা নিচু করে বসে আছেন। হাসিহাসি মুখ। জবাব দিচ্ছেন না। একবার দুবার আমার দিকে তাকালেন শুধু। এক পর্যায়ে ছেলেটা লিমিট ক্রস করে ফেলতেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলাম আমি, এতই যদি মাস্তান তুমি তাহলে বিচিন্তা অফিসে গিয়ে হম্বিতম্বিটা করে এলে না কেন? মিনারকে কেন্দ্রে পেয়েই বিপ্লবী হয়া উঠলা? মিনার মাহমুদ এখন আমার গেস্ট, স্যারের গেস্ট, কেন্দ্রের গেস্ট। তোমার মতোন এক-দেড়শ পোলাপান মিনারের কথায় রোজ উঠে আর বহে। তারে দেখলে কি দুর্বল মনে হয় তোমার থিকা? মিনারের ক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা আছে তোমার? পারলে কেন্দ্রের বাইরে গিয়া মিনারের উপ্রে রোয়াব দেখাইও। কাইলকাই। ঠিক আছে?
আমার আচমকা মৌখিক আক্রমণে ঢাকাইয়া আঞ্চলিক ভাষা ও শব্দের তীব্রতায় ছেলেটার উত্তেজনা ‘লেভেল জিরোতে’ নেমে এলো মুহূর্তেই। আর সেটা অবলোকন করে আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কতিপয় অপেক্ষমাণ বিপ্লবীও লেজ গুটিয়ে নিল। আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন মিনার চায়ে চুমুক দিতে দিতে। চোখে তাঁর কৃতজ্ঞতার উদ্ভাস।
এর আগেই মাযহার ছাদে চলে গেছে স্যারকে মিনারের আগমন সংবাদটা দিতে। একটু পরেই ফিরে এসে মাযহার বলল, চল। স্যার যেতে বলেছেন। মিনারকে নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। ছাদে প্রচুর ছেলেমেয়ে। স্যার বক্তৃতা করছিলেন। আমাদের দেখে স্যার তাঁর চলমান বক্তব্যের মধ্যিখানেই প্রিয় ছাত্র মিনার মাহমুদকে খুব সুন্দর ভাষা ও ভঙ্গিতে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এরপর মিনার খুব সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রতিবেদনটি ছাপার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। আগামী চার সংখ্যায় নাগাড়ে ক্ষমা চাওয়ার ব্যাপারটিও জানালেন খুবই স্মার্ট ভঙ্গিতে।
সেই ‘ক্ষমা বিজ্ঞপ্তি’সহ বিচিন্তার একেকটা সংখ্যা বেরোয় আর আমি দুর্দান্ত প্রতাপশালী একজন মিনার মাহমুদকে ক্রমশ বিলীয়মান হতে দেখি। একেকটা সংখ্যা মিনারের সাম্রাজ্যের পতন ধ্বনি নিয়ে আমার সামনে উপস্থিত হয়। আমার জেনারেশনের একজন তুমুল শক্তিমান তরুণের এ রকম পরাজয় আমাকে ব্যথিত করে।
এরপর খুব দ্রুত পালটে যেতে থাকে দৃশ্যপট। সময় গড়াতে থাকে। ১৯৯১-এর ডিসেম্বরের ৩ তারিখে কাউকে কিছু না বলে রণাঙ্গনের ময়দানে যুদ্ধ অসম্পূর্ণ এবং সহযোদ্ধাদের অরক্ষিত রেখেই তাদের সাহসী জেনারেল মিনার মাহমুদ দেশ ছেড়েছেন আশ্চর্য গোপনীয়তায়।
মিনারের এই চলে যাওয়াটা আমাকে একটা গভীর মনোকষ্টের অন্ধকার কূপের ভেতরে নিক্ষেপ করল। একটা গিলটি ফিলিংস আমাকে বারবার গ্রাস করতে উদ্যত হলো। আমার কেবলই মনে হতে লাগল যে তাঁর এই দেশান্তরী হবার পেছনে অন্যতম অনুঘটক আমিও। সায়ীদ স্যারকে একদিন বলেও ফেললাম আমার মানসিক বিপর্যয়ের বিষয়টা। আমি স্যারকে সরাসরি দায়ীও করলাম। খুব ঠা-া মাথায় স্যার আমাকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধার প্রচেষ্টা চালালেন। বললেন, আমি নিজেও কিন্তু দায়ী নই রিটন। আজ হোক, কাল হোক পালাতে তাকে হতোই। তোমাকে তো বলেছি এত এত মানুষকে সে ক্ষেপিয়ে রেখেছে। এদের অনেকেই পারলে মিনারকে খুন করে ফেলে। পালানোর জন্যে পথ খুঁজছিল সে। চলে গিয়ে ভালোই করেছে মিনার। নইলে হয়ত এর চেয়েও খারাপ পরিণতি ওকে ভোগ করতে হতো। তুমি নিজেকে খামোখা অপরাধী ভাবছ কেন? সরাসরি শিক্ষক হয়েও ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা তো করেছিলাম আমি। আমার যে কী রকম কষ্ট হয়েছে ওর জন্যে সেটা তো তুমি বুঝবে না।
স্যারের কথায় সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছিলাম কিন্তু মুক্তি পাচ্ছিলাম না। তবে স্যারের কথার মধ্যে তাঁর কণ্ঠস্বরে মিনারের জন্যে একজন ব্যথিত পিতার আর্তনাদ প্রত্যক্ষ করেছিলাম সেদিন।
দীর্ঘদিন পর ২০০২-এর মার্চে নিউইয়র্কে দেখা হবার দিনটাতে একটি কফি শপে কফি পান করতে করতে সদ্য জাপান ফেরত আমি আমার গিলটি ফিলিংসের বিষয়টা মিনারকে বলেছিলাম। মিনার হাসতে হাসতে আমার কাঁধে হাত রেখেছিলেন, আরে ধুর! আপনার কেন অপরাধী লাগবে নিজেকে! আপনি মোটেও দায়ী নন। আপনি তো এসেছিলেন আমাকে সতর্ক করতে। আর আমার দেশান্তরি হবার পেছনে সায়ীদ স্যারও দায়ী না।
দশ-বারো বছর ধরে আমার কাঁধে চেপে থাকা খুব ভারী একটা পাথর অপসারিত হলো মিনারের এই উচ্চারণে। দাঁড়িয়ে একটা কোলাকুলি টাইপ ঘটনা ঘটিয়ে ফেললাম, আসেন ভাই। বুকটা একটু হালকা করি।
সন্ধ্যায় নিউইয়র্কের জ্যামাইকা এলাকায় একজন টিভি অভিনেত্রীর বাড়িতে আমাকে নামিয়ে দিয়ে মিনার এক ঘণ্টার একটা ট্যাক্সি খ্যাপ মারতে গেলেন। সময়মতো ফিরে এসে আমাকে ফের তুলে নিলেন গাড়িতে। ম্যানহাটনের উজ্জ্বল আলোর ঝকমকির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মিনার অজস্র কথা বলছিলেন। বলছিলেন তাঁর ছাহাবাদের কথা। নাম ধরে ধরে কে কোথায় কি করছেন জানতে চাইছিলেন আমার কাছে। সাধ্য অনুযায়ী তথ্য দিচ্ছিলাম তাঁকে। বললাম, আপনার একজন ছাহাবা তো এই নিউইয়র্কেই থাকে। বললেন, হ্যাঁ। সে ফিল্ম নিয়ে আছে। ভেরি ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। একই শহরে থাকলেও আমাদের দেখা হয় খুব কম। কালেভদ্রে। টেলিফোনেও কথা হয় না। তারে দেখলে মজা পাইবেন। আগের গেটাপে নাই। ক্যাপ আর হ্যাটের তলায় ওর বিচিত্রা আর বিচিন্তার বরিশাইল্লা গোবেচারা ভাবটা পালাইছে!
আরেক ছাহাবার কথা বললেন খানিকটা গৌরব এবং ততধিক ক্ষোভের সঙ্গে। গৌরব, কারণ সাংবাদিক হিসেবে তিনি বেশ নাম করেছেন। ক্ষোভ, কারণ সেই ছাহাবা নাকি অবিরাম তাঁর চরিত্র হনন করছেন। স্মৃতিকথা লিখবার ছলে নাকি মিনারের চরিত্রে কালিমা লেপন হয় এ রকম ঘটনারই বয়ান করে চলেছেন। দুঃখ করে বললেন,Ñ আমাকে নিয়ে লিখুক অসুবিধা নাই কিন্তু আমার পার্সোনাল লাইফ নিয়ে এত বেশি মাতামাতি করেছে যে আমি কষ্ট পেয়েছি। ওর কাছ থেকে এটা অপ্রত্যাশিত। ওর ঢাকায় থাকার সমস্ত দায়-দায়িত্ব কিন্তু আমিই নিয়েছিলাম।
একটা দীর্ঘশ্বাস মিশ্রিত হাসিতে গভীর গোপন বেদনাকে আড়াল করে মিনার বললেন,Ñ আমাকে ভিলেন বানিয়ে নিজে হিরো হচ্ছে, হোক। তাও তো কেউ একজন আমার কথা মনে রেখেছে!
বেশ অহঙ্কারী কণ্ঠে খুব প্রশংসা করলেন আনিসুল হকের। মাসুক হেলালের অদ্ভুত অদ্ভুত পাগলামোর কাহিনী বলতে বলতে হাসিতে ফেটে পড়লেন। মাসুকের কাছ থেকে শোনা আমার একটি দুটি হাস্যকর ঘটনারও বয়ান করলেন। মাসুক আর আমি একবার দুপুরে শান্তিনগরের এক রেস্টুরেন্টে পাঙাশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়েছিলাম। খাওয়ার পর দেখা গেল আমাদের দুজনার কারো পকেটেই টাকা নেই! মাসুককে ম্যানেজারের কাছে জমা রেখে সেই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি আমি কীভাবে সামাল দিয়েছিলাম সেই কাহিনীও বিস্তারিত বললেন হাসতে হাসতে। ময়মনসিংহে সরকার জসীমদের আবাসিক হোটেলে সারারাত না ঘুমিয়ে আমার ও আমীরুল ইসলামের যৌথ পাগলামির ঘটনাও দেখলাম মিনারের জানা! মাসুকের প্রতি মিনারের গভীর মমতা প্রকাশ পাচ্ছিল এইসব কাহিনীর নিখুঁত বয়ানে।
‘বিচিন্তার জন্যে আমি কোনো লেখা দিইনি কিন্তু রক্ত দিয়েছিলাম।’ আচমকা আমার এ রকম উচ্চারণে ম্যানহাটনের আলো উপচানো রাস্তায় সহসা থমকে দাঁড়ালেন মিনার, Ñবলেন কী!
Ñজ্বি স্যার। এরশাদের পতনের পর আপনাদের কাকরাইল অফিসে বিটিভির ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছিলাম ‘সৌরভে গৌরভে’ নামের অনুষ্ঠানে আপনার ইন্টারভিউ নেবার জন্যে। সেদিন আপনার অফিসে বিচিন্তার রক্তদান কর্মসূচি চলছিল। আমি ঢোকামাত্রই আমাকে ধরে শুইয়ে দেয়া হয়েছিল আপনার নেতৃত্বে। তারপর একব্যাগ রক্ত দিলাম না?
আমার কথায় হাসতে হাসতে দুহাতে পেট চেপে ধরে ম্যানহাটনের রাস্তায় প্রায় বসে পড়লেন মিনার, ওহ্ ম্যান...।
এর কয়েকদিন পরেই আমি কানাডা চলে এলাম। মিনার থেকে গেলেন নিউইয়র্কে, তাঁর গুহামানবের জীবনে। আমাদের আর দেখা হয় না। আমি নিজেও সাত বছর আটকে থাকলাম কানাডায়। দেশে ফিরতে পারি না। বাংলাদেশ সরকার আমার পাসপোর্ট আটকে রাখে। ২০০৭-এ এক/এগারোয় তত্ত্বাবধায়ক আমলে পাসপোর্টটি ফিরে পেলাম নভেম্বরে। দেশে ফিরলাম। আহা স্বদেশ! প্রিয় স্বদেশ!
২০০৯-এ দেশে ফিরে এলেন মিনার মাহমুদ। ১৮ বছর পর তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। সবার সঙ্গে দেখা করছেন। চ্যানেল আইয়ের সিদ্ধেশ্বরী অফিসে এলেন সাগর ভাইয়ের কাছে। অনেক আড্ডা হয়েছিল সেদিন। অনেক পরিকল্পনার কথা বললেন টিভি অনুষ্ঠান নিয়ে। সাগর ভাই আমীরুলকে ট্যাগ করে দিয়েছিলেন মিনারের আইডিয়াগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্যে।
‘নির্ঘুম স্বপ্নের দেশে’ নামে একটি বই লিখেছিলেন মিনার। ২০১০ সালের একুশের বইমেলায় এক বিকেলে মিনারের লাইভ ইন্টারভিউ নিলাম চ্যানেল আইয়ের ‘বইমেলা সরাসরি’ অনুষ্ঠানে। আমার কণ্ঠে একজন বিখ্যাত সম্পাদক মিনার মাহমুদের লেখালেখি তাঁর কলাম উপন্যাস গদ্যভঙ্গির অকুণ্ঠ প্রশংসা শুনে খুবই লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসছিলেন তিনি। তাঁর আরও বই প্রকাশিত হওয়া উচিত, আমার এ রকম কথার বিপরীতে মিনার বলেছিলেন, আমার কাছে আমার নিজের অকিঞ্চিৎকর এইসব লেখালেখি নিয়ে বই বের করাকে কাগজের অপচয় বলে মনে হয়। এ রকম রিমকে রিম কাগজ নষ্ট করার কোনো মানে হয় না!
২০১১ সালে বাংলা একাডেমীর বইমেলায় বিচিন্তার নামে একটি স্টলের জন্যে আবেদন করেছিলেন মিনার। কিন্তু স্টল তাঁকে দেয়া হচ্ছিল না। মিনারের কাছে ব্যাপারটা অসম্মানজনক ঠেকেছিল। আমাকে বলেছিলেন তাঁর বেদনার কথা। এক দুপুরে মিনারকে বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের কাছে নিয়ে গেলাম। জামান ভাইকে নানান যুক্তিতে পরাস্ত করে এলাম। তিনি কথা দিলেন। পরের দিন মিনারকে বা বিচিন্তাকে একটি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। খবরটা জানিয়ে মিনার খুব করে ধন্যবাদ দিয়ে একটা সুন্দর এসএমএস করেছিলেন আমাকে। কিন্তু পরে দেখা গেল বরাদ্দকৃত স্টলটি ছিল রাস্তায়, খুব অগুরুত্বপূর্ণ স্থানে। জামান ভাই খুব চাপের মধ্যে থাকেন এই সময়টায়। তাই তাঁকে আর বিরক্ত করিনি। তবে এটা সত্যি যে মিনারের প্রতি খুব একটা সুবিচার করা হয়নি। অবশ্য নতুন করে বেরুনো বিচিন্তা পত্রিকাটাও ছিল খুবই নড়বড়ে। কোনো স্ট্যান্ডার্ডে পৌঁছুতে পারেনি পত্রিকাটা। পাঠকও গ্রহণ করেনি পত্রিকাটাকে। আসলে সময় আর প্রেক্ষাপট পাল্টে গিয়েছিল। পালটে গিয়েছিল দেশ দেশের মানুষ মধ্যবিত্তের রুচি আর চাহিদা। পালটে গিয়েছিল তারুণ্যের ভাবচক্কর। মিনার ছিলেন আঠারো বছর আগের মিনার। কিন্তু মিনারের রেখে যাওয়া বাংলাদেশ আর আগের বাংলাদেশ ছিল না। থাকবার কথাও না। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলেন না মিনার। ফলে প্রচ- একটা ঝাঁকুনি বা ধাক্কা খেলেন।
নতুন করে বিচিন্তা বের করতে গিয়ে মিনার তেমন ভালো হ্যান্ডস পেলেন না। তাঁর অতীতের এক ছাহাবা এসে যুক্ত হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। এই ছাহাবার ওপর নির্ভর করে মিনার সচলায়তন নামের একটা অনলাইন লেখক ফোরাম থেকে বেশ কিছু লেখা নিয়ে লেখকদের বিনা অনুমতিতেই ছেপে দিচ্ছিলেন। লেখকদের নামসহ ছাপা হলেও তাঁদের কাছ থেকে কোনো রকম অনুমতি নেবার প্রয়োজন মনে করেননি। ব্যাপারটা নিয়ে খুব বাজে ধরনের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়ে গেল। সচলায়তনের লেখকরা মিনারকে ধুয়ে দিলেন। মিনারকে এমনকি ‘লেখা চোর’ও বলা হলো। মিনার খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন সেই তরুণদের আচরণে। তাদের কাউকে কাউকে লেখক সম্মানী দিয়েও রেহাই পাননি মিনার। মিনারের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের দিন, এ বছর, ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে, চ্যানেল আইয়ের ছাদে এবং ছাদ থেকে নেমে পার্কিং লটে আমাদের দীর্ঘ আড্ডায় এই প্রসঙ্গটি তুলেছিলাম আমি। কয়েক মিনিটেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে তাঁর সাবেক ছাহাবা তাঁকে ব্লগ লেখকদের সম্পর্কে আসল বিষয়টিই ক্লিয়ার করেনি। মিনার বললেন, আরে ভাই ব্লগ থেকে আমি তাঁদের লেখা যদি প্রিন্টেড পত্রিকায় তুলে ধরি তাহলে তাঁদের তো রাগ না করে বরং খুশি হওয়ার কথা! মূল ধারার পাঠকের কাছে পৌঁছে দিলাম তাঁদের লেখাগুলো। আমি বললাম, ‘মিনার, আপনি হয়ত জানেন না নতুন প্রজন্মের তরুণরা এবং যাঁরা ব্লগ লেখেন বা অনলাইন লেখক ফোরামে লেখালেখি করেন তাঁরা ছাপানো দৈনিক-সাপ্তাহিক-মাসিক পত্রিকাকে একেবারেই পোছেন না। তাঁরা তাঁদের সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ব্লগেই লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এক্ষেত্রে তারা একেকজন রাজার মতো। সম্রাটের মতো। কাউকে তোয়াক্কা করেন না এবং এরা প্রায় প্রত্যেকেই লেখকের অধিকার বিষয়ে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। কেবলমাত্র লেখার সম্মানীই যথেষ্ট নয়।’ মিনার স্বীকার করলেন এটা তিনি বুঝতে পারেননি। তাঁকে সেভাবে বিষয়টা বোঝানো হয়নি।
মিনারকে আমার মনে হয়েছে রিপভ্যান উইংকেলের গল্পের সেই নায়কের মতো। নাগাড়ে কুড়ি বছরের টানা একটা ঘুম দিয়েছিল রিপভ্যান। কুড়ি বছর পর এক বিকেলে ঘুম থেকে জেগে উঠে রিপভ্যান বন্ধু-স্বজনদের কাছে ফিরে এসে দেখলেন কেউ তাকে আর চিনতে পারছে না। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউ না। পাড়া-প্রতিবেশী কেউ না। সবকিছু কি রকম অচেনা হয়ে গেছে। রিপভ্যান উইংকেলের মতো মিনারও নাগাড়ে আঠারো বছরের দীর্ঘ শেকড়ছিন্ন যোগাযোগছিন্ন গুহাবাসী প্রবাস জীবন কাটিয়ে এক সকালে চলে এসেছিলেন তাঁর অতি চেনাজানা প্রিয় ঢাকা শহরে। এক্ষেত্রে মিনারকে তাঁর বন্ধুরা, সাবেক সহকর্মীরা চিনতে পেরেছিল বটে কিন্তু তাঁকে একটু জায়গা ছেড়ে দিচ্ছিল না কেউ। তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরার বদলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিল তাঁর সহযোদ্ধারা। অথচ দেশে ফেরার আগে মিনার ভেবেছিলেন ভয় কি? আমার সহযোদ্ধারাই এখন দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার হর্তা-কর্তা। ওরা নিশ্চয়ই আমাকে লুফে নেবে। আমি আবার শুরু করব নতুন ইনিংস। কিন্তু তাঁর সৈন্য-সামন্তরা, তাঁর হাতে গড়া শিষ্যরা তাঁকে ফাইনালি ব্যাকহোম করতে দেখে খুশি না হয়ে বরং তাঁকে একটি উটকো ঝামেলা হিসেবেই গণ্য করতে শুরু করেছিল। ভাবখানা এইÑ বেড়াতে আসুন ঠিক আছে কিন্তু স্থায়ীভাবে আবার নতুন করে থাকার পাঁয়তারা কেন হে? বেশ তো আমরা করে কেটে খাচ্ছি, চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি, এর মধ্যে বাগড়া দেয়া কেন? ছাহাবাদের এই রকম অপ্রত্যাশিত আচরণে মিনার ভেতরে ভেতরে ভেঙেই পড়েছিলেন। মিনারের ইচ্ছে ছিল ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করার। সেই আকাক্সক্ষায় একটি স্যাটেলাইট টিভির মালিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথাবার্তা ফাইনাল পর্যায়ে গড়ালেও শেষ মুহূর্তে চ্যানেলটির সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে থাকা কর্তাব্যক্তিটির প্রতিরোধের কারণে সেখানে আর যোগ দেয়া হয়নি তাঁর।
খুব আক্ষেপ করে মিনার আমাকে বললেন সেই প্রাইভেট চ্যানেলের সংবাদ বিভাগের প্রধান, মিনারের সাবেক শিষ্য নাকি সামনাসামনি তাঁকে স্বাগত জানালেও আড়ালে মালিক-কর্তৃপক্ষকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছিল যে, মিনার মাহমুদ যদি জয়েন করেন তাহলে সে তার পুরো সেটআপ অর্থাৎ সমস্ত লোকবল নিয়ে চলে যাবে। প্রাইভেট চ্যানেলের মালিক-কর্তৃপক্ষ অতঃপর সরি বলেছিল মিনারকে। এই ঘটনা মিনারের জন্যে খুব বড় ধরনের একটা ধাক্কা ছিল। সেই ধাক্কা সামলে নিয়ে মিনার চেয়েছিলেন নতুন করে দাঁড়াতে। বিচিন্তাকে অবলম্বন করে। কিন্তু মিনার ছিলেন আঠারো বছর আগের মিনার। এই আঠারো বছরে বাংলাদেশ কতটা পালটে গেছে মিনার সেটা বুঝতে পারেননি। এই আঠারো বছরে পালটে গেছে মধ্যবিত্তের চরিত্র ও চারিত্র্য। পালটে গেছে তরুণ ও তারুণ্যের যাবতীয় অভিব্যক্তি। পালটে গেছে বন্ধুত্ব আর সহযোদ্ধার সংজ্ঞা। পালটে গেছে পত্রিকা পাঠকের রুচি ও সংস্কৃতি। নব্বইয়ের দশকের বিচিন্তার চাহিদা এই সময়ের বাংলাদেশের ছিল না। যে বিচিন্তা এককালে বেরুনো মাত্র হইচই পড়ে যেত সেই বিচিন্তা বর্তমান বাংলাদেশের পাঠকরা ছুঁয়েও দেখল না। সাম্প্রতিক বিচিন্তার কয়েকটি সংখ্যা আমি পেয়েছিলাম বিচিন্তা পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্য আমেরিকা প্রবাসী মানিক রহমানের কল্যাণে। বলতে দ্বিধা নেই, এই বিচিন্তার পাঠকপ্রিয়তা পাওয়ার কোনো কারণও ছিল না। মিনার পিছিয়ে পড়েছিলেন। মিনার ভীষণ স্মার্ট ছিলেন সত্যি কিন্তু মিনারের চিন্তা-চেতনা, মনন ও মেধা বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ আঠারো বছরের গ্যাপ কিছুতেই পূরণ করতে পারেনি। ফলে মিনারকে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল খুবই সীমাবদ্ধ জল আর সীমিত সবুজের নির্দিষ্ট একটা ঘেরাটোপের ভেতরে। অথচ মিনারের প্রয়োজন ছিল বিস্তীর্ণ এলাকা। পুরো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলই তাঁর আরাধ্য ছিল। এককালে দাপিয়ে বেড়ানো পুরো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল। কিন্তু মিনারের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে বিগত দুই দশকে সেই এলাকার দখল নিয়ে নিয়েছে তাঁরই হাতে গড়া সৈনিকরা, যারা তাঁকে দাঁড়াবার জন্যে এক ইঞ্চি জায়গাও ছেড়ে দিতে রাজি নয়!
কিন্তু তারপরেও, যাবতীয় প্রতিকূলতার কাছে পরাজিত মিনার আত্মহত্যা করে জয়ী হতে চাইবেন কেন? মিনারের আত্মহত্যা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। মিনারের মৃত্যুর পর দেখলাম, কেউ কেউ তাঁর এই আত্মহত্যাকে গ্লোরিফাই করেছেন। কলাম লিখেছেন তাঁর আত্মহত্যাকে মহিমান্বিত করে। কিন্তু আত্মহত্যা তো একটি মানসিক ব্যাধির চরমতম বহিঃপ্রকাশ!
মৃত্যুর পরেও কি মিনার তাঁর যথাযোগ্য সম্মান বা মর্যাদা পেয়েছেন? পাননি। দেশের প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিরোধী দলের নেত্রী দু’লাইনের একটি শোকবার্তাও দেননি। প্রেসক্লাবেও কিছুক্ষণের জন্যে রাখা হয়নি তাঁর মরদেহের কফিন। অবিচুয়ারি লিখবার ক্ষেত্রে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া তাঁর সিংহভাগ বন্ধুই থেকেছেন আশ্চর্য রকমের নির্লিপ্ত। যে দু-একজনের প্রতি মিনার সামান্য ক্ষুব্ধ ছিলেন তারাই তাঁকে স্মরণ করেছেন বেশি।
মিনারকে নিয়ে আমার শেষ উপলব্ধিটা এরকম যে, মিনার ছিলেন সময়ের সন্তান। সময়ই তার প্রয়োজনে একজন মিনার মাহমুদের জন্ম দিয়েছিল। সময় মিনারকে সাহসী করেছিল। সময়ের পিতা হবার কোনো যোগ্যতা মিনারের ছিল না। যে কারণে ২০০৯ থেকে ২০১২ এই কয়েকটি বছর প্রবল প্রতিকূলতার স্রোতে হাবুডুবু খাওয়া মিনারকে আর সময়ের সাহসী সন্তান রূপে আমরা দেখতে পাই না। এই সময়টায় আমরা দেখি এমন একজন মিনার মাহমুদকে যে মিনার মাহমুদের প্রয়োজন এই সময়ের কাছে নেই।
কিন্তু আমি এই মিনারকে নয়, আমার স্মৃতির মধ্যে বাঁচিয়ে রাখব সেই মিনারকে, যে মিনার আমার তারুণ্যকে খানিকটা গৌরব দিয়েছিলেন। সেই মিনারকে যে মিনার ছিলেন চৌকস। নিজের অফুরন্ত যৌবনকে দুহাতে বেহিসেবির মতো খরচ করতেন যে মিনার। আমি আমার স্মৃতির মধ্যে বাঁচিয়ে রাখব সেই মিনারকে, যে মিনারের তারুণ্য-খচিত স্পর্ধা একদা আকাশ ছুঁয়েছিল।
Print
©2009. All rights reserved.



৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×