আজকে আমাদের বাড়ি ভর্তি লোকজন। অনেক দিন এই বাড়িতে এতো লোকের সমাগম হয়নি। শুনেছিলাম সেই দাদু যখন মারা গিয়েছিলো তখন বাড়ি ভর্তি লোক এসেছিলো। চেয়ারম্যান ছিল তো হয়তো সেই জন্যই। অনেক দিন পর বাড়ির আনাচে কানাচে মানুষ।
আসলে হয়েছে কি আমাকে দেখতে এসেছে। আমাকে বললে ভুল হবে আমার লাশ দেখতে এসেছে। এখন তো আমি আর আমি নেই। লাশ হয়ে গেছি। আমি আত্মা হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছি আর আমার নিথর দেহটা এদিক থেকে ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে।
আমি মারা গেছি সেই ভোর বেলা। রাতে ঘুমিয়েছিলাম, সেই ঘুমের ঘোরেই শেষ। মরার আগে পানি খেতে খুব ইচ্ছা হয়েছিল কিন্তু কীভাবে কি হয়েছে বুঝিও নি আর পানিও পাই নি। হয়তো অনেক পাপ করেছিলাম বলে মরার সময়েও পানিটা পেলাম না। পানি তেমন বড় ব্যাপার না। আসল ঘটনা শুরু হবে পরে। কবরে নামিয়ে সবাই যখন চল্লিশ কদম সরে আসবে কবর থেকে তার পর শুরু হবে আমার সাথে মাটির খেলা। সারা জীবন যা পাপ করেছিলাম সব এক সাথে বুঝিয়ে দিবে দুই পাশের মাটির একটা চাপ। সেই চাপ কখন খাবো সেটা আপাতত বুঝতে পারছি না। জোহরের পর হবে নাকি আসরের পর সেই সিদ্ধান্ত এখনো কেউ নিতে পারে নি। আসলে নিবেই বা কে? বাবা মায়ের এক মাত্র সন্তান আমি। মা তো সেই সকাল থেকে শোকে পাথর হয়ে আছে। বাবাও মূর্তিমান। কারো সাথে কথাই বলছে না। এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়!
আমি মারা গেছি সেই ভোরে। সকাল পর্যন্ত কেউই জানে না। আসলে দেরি করে ঘুম থেকে উঠি তো তাই সবাই ভাবছে হয়তো ঘুমিয়েই আছি। আম্মুই বুঝতে পারছে আগে।
আম্মুর জন্যই কষ্ট হচ্ছে সব থেকে বেশি। হয়তো নানুর পরে আম্মুর সব থেকে ভালো বন্ধু ছিলাম আমি। নানু তো সেই কবেই না ফেরার দেশে চলে গেছে। আর আজকে আমিও। তবে আমি মাঝে মাঝেই আম্মুর কাছে ফিরে আসবো। স্বপ্নে আম্মুর সাথে ঘুমাব। আমি না আসলে আর কে আসবে? আম্মুর আর কেউ আছে নাকি?
আমাকে গোসল করিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। রাজ্যের লোক আসছে দেখতে। সবার মুখে একই কথা। আহা! মাষ্টার সাহেবের জুয়ান পোলা। আহা রে! আর কেউ কিছু বলতে পারে না। সবাই চুপ চাপ কেটে পরে। আসলে সত্য বলতে কি আমার লাশটা যে বারান্দায় রাখা আছে সেটা দেখে আমারও সহ্য হচ্ছে না। আত্মা সম্ভবত কাঁদতে পারে না। না হলে আমি এতক্ষণে কেঁদে ফেলতাম।
ছোট বেলায় পাশের বাসার আসাদের সাথে আমার সব সময় ঝগড়া হতো। এমনকি বড় হয়েও। সে আজকে অঝোরে কাঁদছে। কি আফসোস! তার ভালোবাসাটা আগে বুঝতে পারিনি।
আজকে অনেক দিন পর সামিহাও আমাকে দেখতে আসছে। আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারিনি। ওর তো আসার কথা না। আমার মৃত্যু তো তাকে শান্তি দিয়েছে। অন্তত সে তো তাই বলেছিল। সে এখনও আমাকে দেখে নি। আম্মুর পাশে বসে বসে কাঁদছে। হয়তো দেখবে না। দুজন দুজনের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম কেউ কারো মুখ দেখব না। কিন্তু এ কি! সে কেন আমার লাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? আমি ছুটেও যেতে পারছি না। যেতে পারলে কিংবা আমার শক্তি থাকলে আমি কাফনটা নিজের মাথায় জড়িয়ে নিতাম।
কিন্তু কি আর কথা সে আমার মুখ দেখেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। প্রতিজ্ঞা ভেঙ্গে যাওয়ায় এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। সে তো অন্তত হাফ ছেড়ে বাঁচল।
সামিহা চলে যাচ্ছে। তার মাথায় ঘোমটা। সেই সেদিনের মতোই। যেদিন সে আমাকে বলেছিল এভাবে ঘোমটা দিয়েই সে আমার বউ হবে।
আম্মু কে দেখে খুব খারাপ লাগছে। কাঁদতেও পারছে না। খুব ইচ্ছা করছে আম্মুর কোলে জটলা পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। সেই ক্লাস ফাইভ, ফোর কিংবা থ্রির মত। কিন্তু পারবো না এখন। পুত্র শোকে ক্লান্ত আম্মু।
আচ্ছা এ কি হচ্ছে। সবাই আমার লাশের পাশে কেন? আমার লাশ উঠিয়ে নিচ্ছে। আম্মু অস্থির হয়ে গেছে। আম্মু এমন করছে কেন? না এই দৃশ্য আমি দেখতে পারবো না। আমাকে দূরে চলে যেতে হবে। অনেক দূরে। সতিই অনেক দূরে......
বিঃদ্রঃ সবটাই কল্পনা। একটু ভেবে দেখলাম আমার আত্মাকে কতোটা কষ্ট সহ্য করতে হবে। লিখতে লিখতে লেখকেরও কান্না আসে। এই কান্নার নাম স্বর্গীয় কান্না।
সত্ত্বঃ লেখক
লেখকঃ রায়হানুল ফেরদৌস রাজ
ঝিনাই-কুঁড়ির পাড়।
পঞ্চগড়।
ছবিঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১০:০৯