আমি যখন এই লেখাটি লিখছি তখন তাকে জেনারেল করে রাখা হয়েছে। তার লেখা প্রথম পাতায় আসছে না, অন্যের লেখা পড়ে মন্তব্য করার সাধারণ অধিকারও তার নেই এমুহূর্তে । আশ্চর্যের বিষয় এই যে, দিনের পর দিন তাকে এই ব্লগ থেকে ব্যান করা হয়েছে। তিনি নতুন নামে বারবার এখানে ফিরে এসেছেন।
যতদূর মনে পরে প্রথম দিকে ব্লগে তার নাম ছিলো পংবাড়ী, তারপর খেলাঘর, অবশেষে চাঁদগাজী নামটি আর ব্যান করা হয়নি ঠিকই কিন্তু দুদিন পরপরই তাকে জেনারেল করা হয়েছে। তাকে এইসব শাস্তি দেবার কারণ আমাদের জানা - চাঁদগাজী সাধারনত নিম্নমানের পোস্টে অথবা যে পোস্ট তার পছন্দ হয়না সেখানে রূঢ় মন্তব্য করেন। ধরে নিচ্ছি মডারেটররা তাকে এই শাস্তিটা দিচ্ছেন যাতে চাঁদগাজী অন্যের পোস্টে আর এমন মন্তব্য না করেণ সে কারণে।
তবে আমার ধারণা এই যে, আমরা যদি পাঠক হিসেবে একটু মনোযোগী হই তাহলে দেখবো, তার রূঢ় মন্তব্যকে ছাপিয়ে তার লেখা পোস্টগুলো অনেক বেশি বার্তা বহন করে। আপনি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেণ তার এই অসামান্য বার্তাটা সংক্ষেপে ঠিক কি, আমি বলবো সেটা হলো তার দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর তার দৃষ্টিভঙ্গি । আপনি বলবেন, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমারও ঢেড় আছে । আমি বলবো দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা হয়তো আপনার আছে, তবে আপনার সেই দৃষ্টিভঙ্গি নাও থাকতে পারে। জীবনের অনেক ভালোবাসাময় ঘাতপ্রতিঘাত, বহুমাত্রিক পাঠ ও চিন্তার ভেতর দিয়ে গেলেই বোধহয় এই দৃষ্টিভঙ্গি তৈরী হয় যেটা চাঁদগাজীর আছে। আর সত্যি বলতে কি আমাদের তথাকথিত জীবনের সরল মাত্রায় যাপিত ভালোমানুষ বাঙালীদের মধ্যে এই দৃষ্টিভঙ্গি দূর্লভ বলেই আমাদের আজ দূরবস্থা।
এখন বলি চাঁদগাজীর শ্যেণদৃষ্টি আর দৃষ্টিভঙ্গির কথা। সাম্প্রতিক সময়ের কোন একটা পোস্টের মন্তব্যে আমাদের বিপুল সংখ্যক অল্পবয়সী মেয়েদের গার্মেন্টস কারখানায় কাজকরা প্রসংগে চাঁদগাজী লিখেছেন, ঠিক একই বয়সী ভারতীয় মেয়েরা কর্পোরেট আমেরিকায় কম্প্যুটার চালাচ্ছে। এর অন্তর্নিহিত কথাটা হলো, আমরা যদি আমাদের মেয়েদের পড়ালেখা শিখিয়ে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে আমাদের মেয়েরাও ভারতীয় মেয়েদের মত দেশে বিদেশে কাজ করতে পারতো। চাঁদগাজীর বিভিন্ন পোস্টে অনেকবার নারী শিক্ষা প্রসংগ এসেছে, যা তার নিজের জীবন থেকে উপলব্ধি জাত। বহুকাল আগের ফেলে আসা পল্লীগ্রামের বাল্যবেলার খেলার সাথীদের প্রসংগে তিনি লিখেছেন, তারা কেউই ভলো নেই, অসুস্থ, রোগভোগা শরীরে ডাক্তার দেখাবার সামর্থ নেই। তিনি ভালো করেই জানেন যে এই সামর্থহীনতাকে একমাত্র পড়ালেখা দিয়েই পরাস্থ করা সম্ভব।
চাঁদগাজীর সাম্প্রতিক পোস্টগুলোর অনেকগুলো জলবায়ু কেন্দ্রিক। ভাবতে অবাক লাগে, যখন অপেক্ষাকৃত তরুণদের জলবায়ুর পরিবর্তন নিয়ে ভাবার কথা, তখন ষাটোর্ধো একজন মানুয আমাদের হুশিয়ার করেছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনে আগামী ২০ বছরে উপকুলের অনেক মানুষের চাষের জমি, ঘরবাড়ীতে লবনের স্তর পড়বে, লবনাক্ত পানি পানের কারণে নবজাত সন্তান অসুস্হ হবে, গর্ভপাত হবে, মানুষের রক্তচাপ বাড়বে, গবাদি পশু কমে যাবে।
আমার মনে আছে, করোনার অতিমারীর একেবারে শুরুর দিকে সম্ভবত ২০২০ এর জানুয়ারী বা ফেব্রুয়ারী মাসে চাঁদগাজী সিডিসির একটা রিপোর্টের সুত্রধরে আমাদের সাবধান করছিলেন। তার বক্তব্য ছিল যে আমেরিকায় সিডিসি একটা গুরুত্তপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং তাদের রিপোর্ট আমাদের অত্যন্ত গুরুত্তের সাথে নিতে হবে।
এবার বলি চাঁদগাজীর দৃষ্টিভঙ্গির কথা। তার প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি হলো পড়ালেখাই সবচেয়ে বড় সহায়। তাই আমাদের পড়ালেখা করতে হবে। বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজী যা কিছু আমাদের উন্নতির সহায়ক তা আমাদের রপ্ত করতে হবে, দক্ষতা বাড়াতে হবে। দেশের আপামর সবাইকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। যে কাজ ভারতীয়রা পেরেছে, পড়ালেখা করে, কর্মদক্ষ হয়ে আমাদেরকেও তা পারতে হবে, পারতেই হবে।
দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি হলো বিভিন্ন ধারার তালেবানী মত বা চিন্তা কোন মতই নয়। এগুলো আমাদের জীবনে ভালো কিছুই সৃষ্টি করে না। যতদিন পর্যন্ত আমাদের পড়ালেখা, চিন্তা-চেতনায় তালেবানী মত বা ধারা উপধারা থাকবে ততদিন আমরা পিছনের দিকে যাব।
পরিশেষে আমরা জানি চাঁদগাজী একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার এই একটা পরিচয়ই অনেক সম্মানের সন্দেহ নেই, কিন্তু চাঁদগাজীর যে বিষয়টা আমাকে বেশি মুগ্ধ করে তা হলো নতুন দৃষ্টিভঙ্গির ভিতর দিয়ে তার অনেক দীর্ঘ পথের যুদ্ধ যাত্রা, যা আমাদের শিক্ষায় অনুপ্রেরণা জোগাতে পারে যদি আমরা তার দ্রুতগতির, হয়তো কিছুটা সীমিত ভাষা বা ব্যাকরণের বৈচিত্রময় লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ি।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২১ সকাল ১১:৩৩