কানাডার জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, নারীর মার্যাদা ও স্বাধীনতা আর সকল বিষয়ে মানুষের বিচার-বিশ্লেষণ এবং যুক্তিশীল আলাপ আলোচনা করার দক্ষতা দেখে পাশ্চাত্য সমাজ সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হয়েছিলাম। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে গাজায় ইসরাইলের বোমাবর্ষণ, নির্বিচারে গনহত্যা আর পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সেই রাষ্ট্রীয় দুষ্কর্মে সহযোগীতা ও সমর্থন দেখে এত হতাশ হলাম যে এই ধারণাগুলোকে নতুন করে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন অনুভব করলাম।
কানাডার সংবাদ মাধ্যমে তীক্ষ্ণ ভাষায় প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা হয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি সকল বিষয়ে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও যুক্তি-তর্কের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবার প্রবনতা দেখে এদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং উদারনৈতিক গণতন্ত্রের উচ্চ মানদণ্ড সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। কিন্তু গত দুই সপ্তাহে এদের নেতৃত্ব ও প্রচার মাধ্যমের একেবারে ভিন্ন একটি রূপ দেখে নিদারুণ আশাহত হলাম।
প্রচার মাধ্যমগুলো শুধু যে একদেশদর্শী খবর প্রচার করছে তা নয়, মনে হল এরা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে উস্কে দিচ্ছে। কিছু গণমাধ্যমের খবর পরিবেশনের ধরণ এমন ছিলো যে শুধু হামাসই নয়, গাজাবাসী মাত্রই জঙ্গি। অতএব এদের গনহত্যা অনুমোদন যোগ্য। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প যে স্ফুলিংগের মত প্রচণ্ড দাহ্য এবং গনমাধ্যমের দেউলিয়াপনা বা বিক্রি হয়ে যাওয়া যে এটাকে জঘন্যভাবে উস্কে দিতে পারে সেটা অনুভব করলাম।
আমার জীবনের মূল্য আরেকজন মানুষের জীবনের মূল্যের চেয়ে কম বা বেশি নয়। একজন ইসরাইলীর জীবনের মূল্যও একজন গাজাবাসীর জীবনের মূল্যের চেয়ে কম বা বেশি হতে পারে না। জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই এবং মানুষ হত্যার মত বড় অপরাধ আর নেই। গাজায় ইসরাইলের গণহত্যার অনুমোদন বা নীরবতা প্রমাণ করে যে উন্নত বিশ্বের নেতৃত্ব ঠিক তদবধি উন্নত বা সভ্য নয়। পাশ্চাত্যের নেতাগোষ্ঠি বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবার মত যোগ্য নয়। বিশেষ দেশ বা অঞ্চলের এই নেতারা মূলত ক্ষমতাবান একটি গোষ্ঠির প্রতিনিধিত্ব করে। মানবিকতার বিবেচনায় এই নেতারা বরং বিগত শতকের সেই সকল নিষ্ঠুর দাস ব্যাবসায়ীর প্রতিনিধিত্ব করে যারা ধর্ম-বর্ণ-জাতীয়তার মিথ্যা মানদণ্ডে মানুষের মনুষ্যত্বকে বহু শতাব্দী শৃঙ্খলিত করে রেখেছিল, একজন মানুষের চেয়ে আরেকজন মানুষ শ্রেষ্ঠ এই মিথ্যা বিশ্বাসে। আজ মানুষ ইতিহাসের সেইসব দাস ব্যবসায়ীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছে। আমার মনে কোন সন্দেহই নেই যে, এই মানবতা বিরোধীদের বিচারও একদিন মানুষ করবে।
প্রবল হতাশার মধ্যেও, প্রচার মাধ্যমের একদেশদর্শীতার মাঝেও কিছু কিছু ঘটনা আশার সঞ্চার করে। আজ সকালে রেডিওতে শুনলাম টরন্টো ডাউনটাউনে একদল লোক রাস্তা আটকে গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য মিছিল করছে। এরা মুসলিমদের কোন দল নয় বরং ইহুদী সম্পদায়েরই একটি দল। সে দলের একজন প্রতিনিধির ছোট একটি সাক্ষাতকারও রেডিও প্রচার করলো। তাদের প্রতিনিধি বললেন যে, এই নরহত্যা, শিশুহত্যার মত পাশবিকতা আর মানা যায়না। অচিরেই এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে।
এই ঘটনাটি থেকে এটা স্পষ্ট যে গাজাবাসী বা মুসলমান মানেই জঙ্গি নয় এটা যেমন সত্য, তেমনি ইহুদীমাত্রেই মানুষ হত্যার অনুমোদনকারী বা সমর্থক নয় - এটিও সত্য। গাজাবাসীর অমানবীকরণ (dehumanization) যেমন একটি ঘৃণ্য কাজ, তেমনি অতি ধর্মান্ধদের ইহুদীবিদ্বেষ এবং সাম্প্রদায়িক কথোপকথনও ঘৃণ্য।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ৮:১১