
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান যেমন আমাদের দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যাগুলো উন্মোচিত করেছে, তেমনি এটি ভারতের বাংলাদেশ সংক্রান্ত কূটকৌশল, সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং এর ষড়যন্ত্রগুলোকে সম্পূর্ণ প্রকাশ্যে এনেছে। শত্রু যখন তার চেহারা উন্মোচন করে, তখন তা একদিকে উপকারী - কারণ এতে তাকে চেনা এবং মোকাবিলা করার পথ স্পষ্ট হয়। এই প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূস ইতিমধ্যে তাঁর দূরদৃষ্টি ও কৌশলগত সফলতার পরিচয় দিয়েছেন।
বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানের পরে ভারতের সরকার শুধুমাত্র পলাতক স্বৈরাচারী হাসিনাকে আশ্রয় এবং নিরাপত্তা দেওয়ার মধ্যেই থেমে থাকেনি, বরং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তারা ধারাবাহিকভাবে তথ্যসন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রথমে তাদের ভুয়া প্রচারণা ছিল সংখ্যালঘুদের নির্যাতন ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মিথ্যা খবর নির্ভর। কিন্তু যখন দেখা গেল এই বানোয়াট গল্পগুলো খুব বেশি কার্যকর এবং বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না এবং এগুলো দিয়ে সাম্পদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করা গেল না তখন তারা অন্য ধরনের বয়ান তৈরি শুরু করলো। তাদের সাম্প্রতিক প্রপাগান্ডাগুলো হলো বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটছে, শেখ হাসিনা শিগগিরই ফিরে আসছেন - এ জাতীয় দুর্বল কিছু গল্পের উপর ভিত্তি করে।
ভারতীয় মিডিয়ায় সেনা অভ্যুত্থান সংক্রান্ত গুজব প্রথম প্রকাশিত হয় ২৬ জানুয়ারি ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে, শিরোনাম ছিল "বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান নিয়ে জল্পনা চলছে"। এরপর, ৩০ জানুয়ারি আনন্দবাজার পত্রিকা "সেনা অভ্যুত্থান ঢাকায়, নজর দিল্লির" শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই সেই পুরোনো গুজব নতুন করে এখন আবার ভারতীয় মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে টাইমস অব ইন্ডিয়া একটি খবরের শিরোনাম দিয়েছে: "শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিগগিরই ফিরে আসবেন"। এই সংবাদে আমেরিকা প্রবাসী এক আওয়ামী সন্ত্রাসী রাব্বি আলমের উদ্ধৃতি ব্যবহার করে প্রচার করা হচ্ছে যে - "আমরা বাংলাদেশের উপদেষ্টাকে পদত্যাগ করতে এবং যেখান থেকে এসেছেন সেখানে ফিরে যেতে বলতে চাই। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ফিরে আসছেন। তরুণ প্রজন্ম ভুল করেছে, কিন্তু এটা তাদের দোষ নয়; তাদের কারসাজি করা হয়েছে।"
এই একই খবর টাইম গ্রুপের অন্যান্য পত্রিকা ও ইন্ডিয়া টুডেতেও প্রকাশিত হয়েছে। এই ঘটনাগুলো থেকে স্পষ্ট যে ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত তথ্যসন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে এবং তাদের প্রপাগান্ডা মেশিন নিরলসভাবে বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমের এই অবনতি এবং দেশটির বর্তমান গণতান্ত্রিক সংকটের মধ্যে একটি কার্যকারণ সম্পর্ক রয়েছে। অমর্ত্য সেনের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, ভারতের বর্তমান সরকার কট্টর হিন্দুত্ববাদী আদর্শ দ্বারা পরিচালিত। তিনি উল্লেখ করেন, "আজকের বিজেপির মধ্যে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য আরএসএসের যারা মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল। সে সময়ের উগ্রপন্থী আরএসএস ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করে সর্বশেষ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছে। তাদের বিজয়ের অন্যতম ভিত্তি ছিল হিন্দুত্ববাদের রাজনৈতিক প্রয়োগ।" তিনি বলেন "বহু জাতি ও ধর্মভিত্তিক ভারতকে ধারণ করার মতো দূরদৃষ্টি মোদির নেই। কারণ, ছোটবেলা থেকেই তিনি আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত, ফলে তার দৃষ্টিভঙ্গি সেই আদলেই গড়ে উঠেছে।"
অমর্ত্য সেন আরও বলেন, "ভারতের জনসংখ্যা ১০০ কোটির বেশি। এর মধ্যে ২০ কোটি মুসলমান, ২০ কোটি দলিত বা অস্পৃশ্য সম্প্রদায় এবং ১০ কোটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন, যাদের অবস্থা দলিতদের চেয়েও খারাপ। এছাড়া, হিন্দু জনগোষ্ঠীরও একটি বড় অংশ মোদিকে সমর্থন করে না। তাঁদের অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মোদিকে সমর্থন করে, এটি বলা কঠিন।"
ভারতে বর্তমানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চরমভাবে সংকুচিত। তিনি ব্যাখ্যা করেন, "সরকারবিরোধী সংবাদমাধ্যম সরকারি বিজ্ঞাপন পায় না, এমনকি বেসরকারি বিজ্ঞাপনও কমিয়ে দেওয়া হয়। সরকারি বিধিনিষেধের কারণে টিভি চ্যানেল বা সংবাদপত্রের স্বাধীনভাবে কাজ করা অত্যন্ত কঠিন।"
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মার্চ, ২০২৫ সকাল ১০:৫৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


