বৈশাখ মাস।
দুপুরে ভাত খেতে বসে দেখি, সুরভি রুই মাছ রান্না করেছে পটল দিয়ে। আমার প্রচন্ড রাগ লাগল। রুই মাছ কেউ পটল দিয়ে রান্না করে?
সুরভি হাই তুলে বলল, পটল খেতে ইচ্ছে না করলে শুধু মাছ দিয়ে খাও। খেতে বসে ভদ্রলোকরা চিৎকার- চেচামেচি করে না।
আমি বললাম, এই তরকারি তো আমি মরে গেলেও খাবো না।
সুরভি বলল, তাহলে শুধু ডাল দিয়ে খাও।
আমি বললাম, শুধু ডাল দিয়ে খাবো?
সুরভি বলল- এটা তো হোটেল না যে অনেক পদের খাবার থাকবে।
আমার ইচ্ছা করছে তরকারির বাটি মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দেই। এই কাজটা করতে পারলে মনটা শান্ত হতো। তবে সাহসে কুলাচ্ছে না। আমি তরকারির বাটি সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সুরভি বলল- কি হলো? খাবে না?
আমি কিছু না বলে হাত ধুয়ে ফেললাম।
সুরভি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাবার গুলো তুলে রাখলো। যেন কিছুই হয়নি। আমি প্রচন্ড অবাক হলাম পরিবারের প্রধান ব্যাক্তি রাগ করে বলেছে- ভাত খাবো না, তাকে সাধাসাধি করার একটা ব্যাপার আছে না। সুরভি কি বলতে পারত না- ভুল হয়েছে, আর কখনও পটল দিয়ে রুই মাছ রান্না করবো না। কিংবা বলতে পারত- দু'মিনিট বসো, চট করে একটা ডিম ভাজি করে দিচ্ছি। একটা ডিম বাজতে কতক্ষন লাগে! তা-না, ভাত তরকারি তুলে রাখল!
রাগে আমার ইচ্ছা করছে গৌতম বুদ্ধের মতো ঘর-বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাই। এই রকম ইচ্ছা আমার প্রায়ই করে। ঘর থেকে বেরও হই। কমলাপুর রেলস্টেশনে চলে যাই। ঘন্টাখানেক বসে থাকি, তারপর বাসায় ফিরে আসি। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত আর আমার দৌড় কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত।
রাগ টা কিছুতেই কমছে না। বরং চক্র বৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে।
আমি জামা গায় দিয়ে বের হলাম। সুরভি বলল, যাচ্ছো কোথায়? আমি কঠিন চোখে তার দিকে তাকালাম। সে ঝপাং করে দরজা লাগিয়ে দিল। আমি ধুম করে দরজায় একটা লাথি দিলাম এবং পায়ের বুড়ো আঙুলে ব্যাথা পেলাম।
মধ্যদুপুরে রেলস্টেশনে বসে আছি।
রাগের মাথায় ওয়ালেট ভুলে ফেলে রেখে আসছি বাসায়। কিছু যে কিনে খাবো সেই উপায়ও নেই। এক কাপ চা খেতে পারলেও হতো। ইচ্ছে করছে চালের আটার রুটি দিয়ে গরুর মাংস খাই। আমার এমন'ই ভাগ্য দেখা যাবে সুরভি গরুর মাংস রান্না করলেও এমন ঝাল দিবে যে মুখে তোলা যাবে না।
শান্তিতে বসে চিন্তা ভাবনাও করতে পারলাম না। সবুজ শাড়ি পরা একটা মেয়ে আমার পাশে এসে বসল। মেয়েটা খুব সুন্দর। চোখে মোটা করে কাজল দিয়েছে। মাথা ভরতি চুল। দুই হাত ভরতি কাঁচের চুরি। আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনার পরিচয়?
মেয়েটি বলল, আমার নাম বেলা। কিন্তু 'সুরভি' কে? অনেকক্ষন ধরে দেখলাম আপনি বিড় বিড় করে এই নামটি বলছেন।
আমি বললাম- আমার স্ত্রীর নাম।
বেলা এক আকাশ অবাক হয়ে বলল- কী আশ্চর্য, আপনার স্ত্রী আছে!
এতে এত্ত অবাক হওয়ার কি আছে বুঝলাম না। রাস্তায় ভিক্ষা করে যে ফকির তারও একটা ফকিরনী থাকে।
বেলা বলল, সুরভি'র উপর রাগ করে স্টেশনে এসে বসে আছেন? কেন রাগ করেছেন জানতে পারি?
পলট দিয়ে রুই মাছ রান্না করেছে বলে।
বেলা বলল, এটি কি বড় ধরনের কোনো অন্যায়? পটল দিয়ে রুই মাছ রান্না করলে কি ফুড পয়জনিং হয়?
বেলা মুখটা বিষন্ন করে বলল, আপনার স্ত্রীর সাথে কি আপনার সম্পর্ক ভালো না?
আমি বললাম, ঘরের কাহিনি বাইরে বলা ঠিক না। তবু আপনি জানতে চাইলেন তাই বলছি- এই বৈশাখে খুব শখ করে, খুব পছন্দ করে একটা শাড়ি কিনলাম। সাদার মধ্যে নীল নীল ফুল আঁকা। সুরভি শাড়ি দেখে বলল, তোমাকে শাড়ি কে কিনতে বলেছে? জাকাতের একটা শাড়ি কিনে এনেছো।
বেলা আমাকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে প্রায় জোর করেই খাওয়ালো। তারপর তার গাড়িতে করে বাসার সামনে নামিয়ে দিল। স্ত্রীর সঙ্গে রাগ করে বের হয়ে এসে আবার ফিরে যাওয়াটাও অত্যন্ত অপমান কর। কিন্তু কি আর করা। মানুষ হয়ে জন্ম নিলে বারবার অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বাসায় ফিরে রাতে খাবো না। তাতে কিছুটা রাগ দেখানো হবে।
রাতে সুরভি রান্না শেষ করে খেতে ডাকলো।
আমি খেতে বসলাম। ইলিশ মাছ রান্না করেছে। রান্না খুব স্বাদ হয়েছে। ইচ্ছা করছে সুরভিকে বলি- রান্না খুব ভালো হয়েছে। বেচারি খুশি হবে। কিন্তু আমি কিছু বললাম না। কারণ, সুরভি'র চোখ লাল এবং ফোলা। সে মনে হয় খুব কেঁদেছে। আমি রাগ করে ঘরের বাইরে গেলেই সুরভি কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলে। এই কথাটা আমার মনেই থাকে না।
আমি নরম গলায় বললাম, তুমি খেয়েছো?
না।
আমি ভাত মাখিয়ে নলা করে বললাম- দেখি হা করো তো।
সুরভি বলল ঢং করবা না, তোমার ঢং অসহ্য লাগে।
আকাশে খুব মেঘ জমেছে।
ঘন ঘন বিদ্যুত চমকাচ্ছে। আজ খুব বৃষ্টি হবে। বেলা নামের মেয়েটিকে বলা হয়নি- সুরভি নামের এই মেয়েটিকে আমি কতখানি ভালোবাসি।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৪:১১