আমাদের গ্রামের বাড়ি বাজিতপুরে। আমরা ৫-৬ মাসে একবার বাড়ি যেতাম। আমারা মোট ৪ জন। আমি, আমার বোন, মা এবং বাবা। বাড়িতে থাকতো আমার ঠাকুর মা (দাদী) আর আমার ছুট দুই কাকা আর এক দূর সম্পর্কের দাদা। সাধারণত আমাদের প্রথম সাময়িক, দ্বিতীয় সাময়িক আর বার্ষিক পরীক্ষার পর আমরা যেতাম বাড়ী। তাই এই ব্যাপারটা আমাদের কাছে ছিল সবচেয়ে লোভনীয়, অপেক্ষায় থাকতাম কবে আসবে সেই মহেন্দ্র ক্ষণ। আমারা দুই ভাই বোন ব্যাপারটা খুব উপভোগ করতাম। যাবার নির্দিষ্ট তারিখের ৭ দিন আগ থেকে আমরা টের পেয়ে যেতাম যে আমরা বাড়ী যাচ্ছি। কারণ বাবা ঠাকুরমার জন্য নিত্য ব্যাবহার্য্য জিনিষপত্র কেনা শুরু করতেন।
আমারা যেতাম ট্রেনে। তখনো কোনো আন্তঃনগর ট্রেন ছিল না কিশোরগঞ্জ থেকে বাজিতপুর পর্যন্ত। বাস যে ছিলনা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তখনকার সবচেয়ে ভাল ট্রেন হল ঈশাখাঁ মেইল সার্ভিস। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা যায়। সকাল ৮ টায় টাইম। যদিও মনে হয় না কোন দিন ৮ টায় এসে পৌছাতে পেরেছে ইসষ্টিশানে। কোন দিন এমন হয়েছে যে ট্রেনের হূইসেল শুনে বাসা থেকে বের হয়েছি আমরা। বাসা থেকে বের হলে ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে যেতাম। কিন্তু এই ছোট্ট অভিযাত্রীর কাছে তখন এই ১০ মিনিটই মনে হত অনন্তকাল। আবার এমনো হয়েছে যে আমরা তাড়াহুড়া করে গিয়ে দেখি এই মাত্র ট্রেন ছেড়ে গিয়েছে। আমার বাবার মনের হয়তো তখন কিছু্ই হতো না, আমাদের নিয়ে বাসায় চলে আসতো, কিন্তু এই ছোট্ট কিশোরের মনের অবস্থা কেমন হতে পারে তা নিশ্চই অনুমেয়। সম্ভবত এই কারণে এখনো কোন জায়গায় যেতে হলে আমি ১০ মিনিট আগে পৌঁছাবার সময় নিয়ে বের হই। মনে লুকানো ভয়টাকে দূর করতে পারি না।
যাই হোক, ইস্টিশানে এসে ট্রেন পেলেও আরেকটা সমস্যা ছিল আমারা ................... সিটের কথা বলছিনা। আমরা উঠতে পারব কিনা সেটা নিয়েই অনেক জল্পনা কল্পনা চলত। কারণ আমরা ছিলাম ৪ জন, সঙ্গে থাকতো দুই থেকে তিনটা ব্যাগ আর ঠাকুরমার জন্য নেয়া বস্তা ভরা জিনিষ। আর ট্রেন আসতো বাঁদর ঝুলা হয়ে। ভিতরে যত লোক ছাঁদে লোক তার চেয়ে বেশি। আমাদের কে উঠিয়ে দেয়া হত জানলা দিয়ে, তারপর ব্যাগ তারপার মা-বাবা। আমরা উঠতে পারলে শুরু হত ভয়। মা-বাবা উঠতে পারবে তো? শেষ পর্যন্ত মা-বাবা উঠতে পারতো। আমরা দুই ভাই বোন তখন কে জানালার পাশে দাঁড়াব তাই নিয়েই ব্যাস্ত। ট্রেনে উঠার পর আমারা বুঝতে পারতাম না আমাদের যেখানে উঠতে খবর হয়ে যেত সেখানে প্রায় প্রতেকে তাদের ছাগল, মুরগী এমন কি রান্নার চুলাটা ও নিয়ে সংসার পেতে বসতো কিভাবে। আমাদের ট্রেন ধরতো ৩ টা স্টেশান। গচিহাটা, মানিকখালি আর সরারচর। এই ৩০ কিলোমিটার যেতে সময় লাগতো ১ ঘন্টা। ট্রেন ছাড়ার পর আমারা জানালা দিয়ে উকিঁ দিয়ে দেখতাম কৃষক তার দিন শুরু করেছে, তার জমির মাটি আলগা করছে। চারদিকে যত দূর চোখ যায় দিগন্ত জুড়ে ধান ক্ষেত, রেললাইনের দুই ধারে কাশ ফুল আর এই অপার সৌন্দর্য্যের মধ্যে অপ্রাকৃত সোনা রোদ আর গ্রাম্য কোলাহলের মাঝে মিশে গেছে রেলগাড়ির ঝিক ঝিক শব্দ। আমার ভিতরের ছোট্ট জানা পৃথিবী তখন প্রসারিত হতে থাকে হাবলের 'ল' না মেনে।
কখন যে এসে যায় স্টেশান টের পাই না। শুরু হয় নামার জন্য হুড়োহুড়ি। কারণ আমাদের কে যেতে হবে আরে ১০ মাইল রিক্সায়......
.........চলবে।