সরারচর স্টেশান থেকে আমাদের বাড়ী ১০ মাইলের মতো হব। গ্রামের নাম ওসমানপুর। যেতে হয় রিক্সা করে। গুটি কয়েক রিক্সা দাঁড়ানো থাকতো স্টেশানে। ভাড়া ২০ টাকা। আমরা ৪ জন, আমি বাবার কোলে, আমার বোন মার কোলে। পথের দু পাশে পড়ত আগুন লাল শিমুল ফুল গাছ, ধান ক্ষেত, একটা শ্মশান ( যেটাকে নিয়ে বাবার একটা কাহিনী ছিল )। চার ভাগের ১ ভাগ ছিল কাঁচা রাস্তা। কাঁচা রাস্তা শুরু হওয়া মানে বাবার পরিচিত গন্ডি শুরু হওয়া। অনেকেই কুশলাদি জানতে চাইতো। গ্রামের অধিকাংশ বাড়ীগুলোতে বাঁশ ঝাড় ছিল। দিনের বেলাতেই কেমন যেন ভুতুড়ে অন্ধকার জমাট বেধে থাকে। রাতের বেলাতে জরুরী প্রয়োজন না থাকলে বের হত না কেউ। আমাদের গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ ছিল না। আজো যাকে আমরা বলি অজো পাড়া গা। সপ্তাহে ২ দিন হাট বসতো। আর তা না হলে আমাদের যেতে হত ৪ কি.মি. দূরের বাজিতপুর বাজারে।
আমাদের বাড়িতে থাকতো আমার ঠাকুরমা, দুই কাকা, আর এক দুর সম্পর্কের দাদু ( ঠাকুরমার ভাই )। আমারা যখন বাড়ীর কাছাকাছি চলে আসতাম তখন আমাদের দুই ভাই বোনের মধ্যে শুরু হত প্রস্তুতি, কে আগে ঠাকুরমার কোলে উঠতে পারবে। আমি বড় ছিলাম। স্বভাবিক ভাবেই আমার বোন আমার সাথে কুলেয়ে উঠতে পারতো না। আমি সবার আগে ঠাকুরমার কোলে উঠে পরতাম। প্রতিবার ই উনি আমাকে চুমু খেয়ে বলতো " আমার মানিক অনেক বড় হয়ে গেছে "। অমিও বড়দের আচরণ দেখাতে গিয়ে কোল থেকে নেমে পড়তাম।
সারা রাস্তার ক্লান্তি এক নিমিষে উড়ে চলে যেতো তখন। প্রথম কাজ ছিল এক দৌড়ে সারা বাড়ী ঘুরে দেখে আসা। সব ঠিকঠাক আছে কিনা। কারন এই বাড়ীটা আমার ই জানতাম, আমি ছিলাম ঠাকুরমার বড় ছেলের এক মাত্র ছেলে। দ্বিতীয় কাজ ছিল দাদুকে গিয়ে প্রনাম করা। সাথে সাথেই বায়না আমাকে দোলনা বেধেঁ দিতে হবে। কারণ দোলনা বাধার প্রধান উপকরন দড়ি ছিল তার দপ্তরে। আমাদের ২টা গরু দাদু পালতেন। শেষ পর্যন্ত উনি রাজি হতেন কারণ আমাদের খুব আদর করতেন।
আমার ঠাকুরমা ছিলেন বিধবা। আমার দাদু মারা গিয়েছিলেন আমার বাবার বয়স তখন ১৮। তখন বাবাকের সংসারের দায়িত্ব নিতে হল। দাদুর চাকরিতে জয়েন করলেন (টেক্সটাইল মিলে)। সবে বাবা মেট্রিক পাশ করেছে। ঠাকুরমা নিরামিষ খেতেন। তাই আমরা সবাই ক্ষিধা পেটে ঠাকুরমার রান্না করা বড়ি দিয়ে ডাল আর ভাজি দিয়ে শেষ দুপুরের খাবার শেষ করতাম। এই বাড়ীটা ছিল আমার ঠাকুরমার। দাদুর বাড়ি ছিল নারায়নগঞ্জে। তাই আমাদের পূর্ব পুরুষ ধরা যায় ঢাকার আশেপাশের। আমার বাবা প্রায় সময়ই দুই জায়গায় থেকে পড়াশুনা করেছে। এর মধ্যে নারায়নগঞ্জের তুলারাম কলেজের কথা প্রায়ই বলেন। বাবার পূর্ব পুরুষদের কে দেখি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করে। আমাকে বলতো তার বাবা উনাকে ৪ পুরুষের নাম বলে গেছেন। আমিও আগ্রহ ভরে শুনি। সেই হিসাবে আমি জানি ৬ পুরুষের নাম। স্মৃতির পাতা থেকে নামগুলো লিপিবদ্ধ করাটাই মনে হয় ভাল। আমাকে নিয়ে শুরু করলে নাম গুলো এমন হয় :
৭-পুরুষ
১। রাজীব মিত্র
২। অসিত মিত্র
৩। হেরম্ব মোহন মিত্র
৪। পিয়ারি মোহন মিত্র
৫। দেবপ্রসাদ মিত্র
৬। মহেশ মিত্র
৭। রামকানাই মিত্র
নাম গুলো শুধু নামই না আমার কাছে, এ গুলো এক একটা পরিবার, ইতিহাস, সময়। তাই এগুলো আমাকে না