বাড়ী পৌছনোর পর প্রথম কাজ হল এক দৌঁড়ে সারা বাড়ী ঘুরে দেখে আসা। সব ঠিকঠাক আছে তো? কারণ ছোট থেকে আমি জানতাম এই বাড়ীটা আমাকে দিয়ে দিবে ঠাকুরমা। দ্বিতীয় কাজ ছিল দাদুকে প্রনাম করা এবং আবদার করা যে আমাকে দোলনা লাগিয়ে দাও। কারণ দোলনা লাগানোর আবশ্যকীয় উপাদান দড়ি ছিল উনার কাছে। আমাদের গরু দুটোকে পালতো দাদু। শেষ পর্যন্ত উনি আমাদের জন্য দেবদারু গাছে দোলনা ঝুলিয়ে দিতেন। এরি মধ্যে পাশের শেখ বাড়ীর ওসমান চলে আসত শহর থেকে আগত অতিথিদের দেখতে। শহরের চাকচিক্য পোশাকের মানুষদের সামনে আসতে প্রথমে সংকোচ বোধ করে সে। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে সে আমাকে আপন করে নেয়। আমি ও তাকে দুই একবার দোলনায় চড়তে দেই।
আমাদের বাড়ীটি ছিল যাবার সময় পথের বামে। ডান দিকে আমাদের পুকুর। রাস্তার বামে বাড়ির একপাশ। রাস্তা থেকে নামলে প্রথমে একটা উঠান। তার ডান পাশে কলার বাগান। সামনে এগুলে ডান পাশে বাংলা ঘর। এটা অতিথিদের জন্য বরাদ্দ ছিল। তার সামনে বিশাল উঠান। সারা উঠান জুড়ে একটা বড় বরই গাছ। টিনার দুচালা লম্বা ঘর আমাদের। বছরের অর্ধেক সময় এই ঘরটা ভরা থাকতো পাটে। একপাশে ধানের গোলা, অন্য পাশে পূজার ঠাকুর ঘর। বাড়ীর প্রধান আকর্ষণ ছিল বিভিন্ন প্রকার ফলের গাছ। তার মধ্যে ২০ টার মতো কাঠাঁল গাছ, ১০টার মতো বিভিন্ন প্রজাতির আম গাছ, ১৫ টা নারিকেল গাছ, বরই, চালতা, জাম্বুরা, বেল, পেয়ারা, তেতুল, লটকন ছিল প্রধান। এর মধ্যে কাঠাঁলের ছিল কয়েকটা প্রজাতি। যেমন: বৌ পাগলা, বল গাছ, মধু গাছ ছিল উল্লেখ যোগ্য। বাড়ির পেছন এবং দুই পাশে একরকম ঘন জঙ্গল ছিল। ঐ দিকটা অনেকটা পতিত জায়গার মত ছিল। সচরাচর ঐখানে যাওয়া হত না। আমাদের বাড়ীতে রান্নার জন্য কখনো লাকরি (কাঠ) কিনতে হয় নি। সারাদিন যে পাতা পড়তো তা দিয়ে রান্না হয়ে আরো থেকে যেত। কত মহিলাকে দেখেছি তারা বস্তায় ভরে পাতা নিয়ে যেত।
ঠাকুরমা নিরামিষাশী। তাই আমাদের কে প্রথম দিন টা কোন রকম পাড় করতে হতো ঠাকুরমার রান্না করা বড়ি দিয়ে রান্না কারা ডাল, আর ক্ষেতের সবজি দিয়ে। কাকা বাড়ী আসলে আমরা মাছ খাবার বায়না ধরতাম, কাকা আশ্বাস পেয়ে আমরা শান্ত হতাম যে আজ জেলে খবর দিলে কাল এসে মাছ ধরবে। সন্ধ্যা নেমে আসলেই ঘুটঘুটে অন্ধকার ভর করে চারদিকে। আমরা উঠানে দেখি জোনাকির মিটমিট আলো। আর ঠাকুরমার কোলে বসে গল্প শুনি আর আমাদের কথা বলি। রাজকণ্যা, রাজপুত্রের গল্প শুনতে শুনতে এই নির্জন আর শুনশান পরিবেশে হারিয়ে যাই চেতন আর অবচেতন জগত হতে ঘুমের রাজ্যে। শেষ হয় প্রথম দিন।
....চলবে।