রাত গড়ায়। চাঁদটা একটু একটু করে মাথার ওপরে উঠতে থাকে। একলা ঘরে একলা আমি একলাই রাত জাগি। রুমে হাটতে হাটতে এক সময় জানলার পাশে এসে দাড়াই। বহুদুরে চাঁদটা আমার একাকিত্তের সঙ্গি হতে তার সবটুকু স্নিগ্ধতা নিয়ে আমার দিকে তাকায়। একলা আমি মুচকি হাসি। চাঁদ আমার হাসি দেখে না। জড় পদার্থের সব ধর্ম অনুসরন করে সে নিঃশব্দে আমার উপর তার আলো ফেলে।এতো আলো সব সময় সহ্য হয় না। আমি চাঁদ থেকে আমার দৃষ্টি নামাই। দেখি বেশির ভাগ ঘরের আলো নিভে গেছে। খুব পড়ুয়া কারো ঘরে তখনও বাতি জ্বলে। একটা বাড়ির ছেলেকে প্রায়ই দেখি বই হাতে মুখস্ত করে যেতে। এখনো কলেজের পাট চুকেনি হয়তো।কোন কোন দিন কাঠগোলাপ গাছে আড়াল হয়ে যাওয়া বারান্দাটায় প্রায় রবিন্দ্রনাথের মত দেখতে বুড়ো মানুষটাকে দেখি। সাদা পাঞ্জাবির লম্বা মানুষটা এতো রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কি করে কে জানে। চাদের এতো ক্ষীণ আলোয় যদিও তার দাড়ি দেখা যায় না। কিন্তু আমি জানি তার সাদা দাড়ির ভেতর দিয়ে বাতাস তার আঙুল চালিয়ে নেয় ঠিক ই।মাঝে মাঝে ছোট্ট চিলতে উঠোনআলা বাড়িটার দিকেও চোখ চলে যায়। মাঝ বয়েসি কেয়ারটেকার গোছের কেউ একজন গভীর মনোযোগে প্রার্থনারত থাকেন সারা রাত।
আমি জানলা থেকে সরে আসি। সারা ঘরে এক পাক ঘুরি। মার ঘরে মা গভীর ঘুমে অচেতন।ক্লান্তি না অবসাদের ঘুম কে জানে! মাকে জিজ্ঞেস করবার সাহস ও হয় না। ভাই বোনগুলো ও যে যার যার ঘরে ঘুমে। আমি এসে বাবার চেয়ারটায় বসি। গভীর রাতে এি চেয়ারটায় বসলে এখনো মনে হয় বাবা বুঝি আছেন। চারপাশে চোখ বুলাই, হয়তো একটু অপেক্ষাও করি। বাবা এসে ডাকবেন। একটু পর নিজেই বুঝি এসব পাগলামি হচ্ছে। চুপ চাপ নিজেই সরে আসি। খুব সুখের স্মৃতিও এক সময় মানুষকে শোকাহত করে তোলে।
আস্তে করে বারান্দায় এসে দাড়াই। হথাত হথাত ট্রাক যেতে দেখি, কখনো কোন আম্বুলেন্স।ইতস্তত ভাবে দু একটা মাতাল ও দেখি।কখনো সাইলেন্সার ছুটিয়ে কর্কশ ভাবে উদ্ধত ভঙ্গিতে ছুটে চলা অভিজাত তরুনের শকটেরও দেখা মেলে।
দু একটা পাখি ডাকে। দিনের বেলায় তো কাক ছাড়া কারো গান শোনা যায় না। এই ভোরের আগে আগে সব যেন কত্থেকে বের হয়। চোখ বন্ধ করে আর কান পেতে পাখির গান শুনি। পাখি বলতে চড়ুইই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি। বারান্দার ঠাণ্ডা বাতাস একটু একটু করে আসতে থাকে। শহরের কার্বন এখন একটু কম। বাতাসে শান্তি টের পাওয়া এই অল্প একটু সময় ই। মাঝে মাঝে বারান্দায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ি। সামনের নারিকেল গাছের পাতাটা সযত্নে আমাকে ঢেকে রাখে। অবশ্য এতো রাতে কেউ আমাকে দেখারও নেই। এক সময় নৈঃশব্দ্য ভেঙ্গে আজানের সুর ভেসে আসে।
'নামাজের দিকে এসো,
কল্যাণের দিকে এসো'
দু একটা বাড়িতে আলো জ্বলে।আর এতক্ষন যাদের ঘরে আলো জ্বলছিল তাদেরটা নিভে আসে।তাকিয়ে তাকিয়ে আকাশের রঙ বদল দেখি। একটু একটু করে কখন যে আধারটা কেটে যায় টের ও পাওয়া যায় না।
রাত এভাবেই শেষ হয়ে যায়!রাত গড়ায়।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০১২ রাত ২:১৫