মহাসঙ্কটের দিকে ধাপিত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ঋণ করে চলছে সরকার। সরকারের প্রতি আস্থাহীনতায় পাওয়া যাচ্ছে না বিদেশি ঋণ। দেশীয় ব্যাংক থেকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নেয়ায় সংকোচিত হয়ে পড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগ। সরকারের ঋণের জোগান দিতে গিয়ে ব্যাংকের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। সরকার এখন সার্বভৌমত্ব বন্ড ছেড়ে অর্থের সংস্থান করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের স্বল্পতায় অনেকটা বন্ধ হয়ে গেছে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ। স্থবিরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে জনশক্তি রফতানি। আমদানি কমে যাচ্ছে, রফতানিও আশাব্যঞ্জক নয়। রাজস্ব আদায়ের গতিও শ্লথ হয়ে পরেছে। সরকারের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ কর্মসূচি এডিপি বাস্তবায়ন অবস্থা তো ‘লেজে গোবরে’। শেয়ার বাজারে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীর হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে। ওদিকে, মূল্যস্ফীতির অবস্থা এখন আকাশছোঁয়ার উপক্রম, ফলে বেড়ে যাচ্ছে জীবন যাত্রার ব্যয়। এই ব্যয় আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে তেল ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি। সরকারের ভ্রান্তনীতির কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সামগ্রিক ভর্তুকি বেড়ে গেছে। জনগণের ভর্তুকির অর্থ মুষ্টিমেয় কয়েক জনের পকেটে গেলেও দফায় দফায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকির দায় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে জনসাধারণের ঘাড়ে। সবমিলে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের দিকে চলে যাচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায় প্রবৃদ্ধি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। চলতি ২০১১-২০১২ অর্থবছরে এনবিআর অংশে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৬ শতাংশ। কিন্তু এর আগের অর্থবছরে একই সময়ে এই প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২৭ শতাংশ। রাজস্ব আদায় না বাড়ার কারণে ভবিষ্যতে উন্নয়ন কর্মসূচিতে দেশীয় অর্থায়ন জোগাড় করা বেশ কষ্টকর হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ২০১০-২০১১ অর্থবছরে জুলাই-ডিসেম্বর সময়কালে দেশে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪০ শতাংশ। কিন্তু চলতি ২০১১-২০১২ অর্থবছরে একই সময়ে এই প্রবৃদ্ধি কমে এসে দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশে। ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসেও ২০১১ সালে জানুয়ারি মাসের চেয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধি ব্যাপকহারে হ্রাস পেয়েছে। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে রফতানি খাতে যেখানে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৪ শতাংশ, সেখানে ২০১২ সালে জানুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ। এ বিষয়ে বিজিএমইএর সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুস সালাম মুর্শেদী জানিয়েছেন, ইউরো জোনে মন্দার কারণে দেশ থেকে পোশাক রফতানি অনেকাংশে কমে গেছে। তারই প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে সামগ্রিক রফতানি খাতের ওপর। একই সাথে অবকাঠামোগত সমস্যা তো রয়েছেই। ফলে চলতি অর্থবছরে রফতানি আয়ের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন করা প্রায় অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে।
সরকারের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে বিদেশি সংস্থাগুলো সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ঋণ অবমুক্ত করছে না। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০১১-১২ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে দেশে বিদেশি ঋণ সহায়তা এসেছে মোট ৮০ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। এর মধ্যে ৪১ কোটি ৫৩ লাখ ডলারই চলে গেছে আগের নেয়া ঋণ ও সুদ পরিশোধে। ফলে ছয় মাসে নিট বিদেশি সহায়তা পাওয়া গেছে মাত্র ৩৯ কোটি ২০ লাখ ডলার। এর আগের অর্থবছরে এই সময়ে (জুলাই-ডিসেম্বর) বিদেশি ঋণ-সাহায্য বাবদ এসেছিল মোট ৯৮ কোটি ৪৫ লাখ ডলার, যার মধ্যে আগের ঋণ ও সুদ পরিশোধে সরকারের ব্যয় হয়েছিল ৩৮ কোটি ৮ লাখ ডলার। ফলে সরকারের হাতে মোট ঋণ সহায়তা ছিল ৬০ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এই হিসেবে চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে নিট বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ কমেছে ৩৫ শতাংশের বেশি।
রাজস্ব আদায় কম, কাক্সিক্ষত হারে রফতানি আয় না আসায় ও বিদেশি ঋণ না পাওয়ায় সরকার তার ব্যয় ঠিক রাখতে বাধ্য হয়ে দেশীয় ব্যাংক থেকে দুই হাত দিয়ে ঋণ নিচ্ছে। গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ব্যাংক ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। অথচ পুরো অর্থবছরের জন্য ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। সরকারের ব্যয় ঠিক রাখার জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে এ ঋণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমছে : শুধু রফতানিই কমছে না, কমে যাচ্ছে শিল্প উৎপাদনের সাথে সরাসরি জড়িত মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির পরিমাণ। এতে কমছে সামগ্রিক আমদানিও। ইতোমধ্যে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলার হার প্রায় ৩৫ ভাগ কমে গেছে। ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ছয়মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) আমদানি খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৭ শতাংশ। কিন্তু চলতি ২০১১-২০১২ অর্থবছরে একই সময়কালে তা কমে হয়েছে ১৭ শতাংশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিলাস সামগ্রি আমদানি কমলে কোনো কথা নেই। কিন্তু শিল্পায়নের জন্য প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি যদি কমে যায় সেটায়ই রয়েছে বিপত্তি। কারণ মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমে গেলে দেশে শিল্পায়ন ব্যাহত হবে। আর শিল্পায়ন না হলে দেশে বেকারত্ব বাড়বে। দেখা দেবে এক ধরণের সামাজিক অস্থিরতা।
মূল্যস্ফীতি : গত বছরই সরকার ‘গুণে গুণে’ চারবার তেলের দাম বাড়িয়েছে। চলতি বা আগামী মাসে তেলে দাম বাড়ানো হবে আরো একবার। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে দু’বার। ডলারের সাথে টাকার মান ভীষণ পতনের কারণে আমদানি করা শিশুখাদ্য থেকে শুরু করে ওষুধের দামও বেড়ে যাচ্ছে হু হু করে। জনগণের সবচেয়ে বড় মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন মূল্যস্ফীতি। গরিব ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষের শুত্রু বলে চিহ্নিত মূল্যস্ফীতিকে কোনোভাবে বাগে আনা সম্ভব হচ্ছে না। গেল জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি এর আগের মাসের চেয়ে আরো বেড়ে গেছে। পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। ডিসেম্বরে তা ছিল ১০ দশমিক ৬৩ শতাংশ। তবে শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনও গ্রামের চেয়ে বেশি এবং তা সাড়ে ১২ শতাংশের ওপরে রয়েছে। আর খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি তো শহরে ১৩ শতাংশের ঘর ছুঁই ছুঁই করছে। গত এক বছরে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৯১ শতাংশ। সহসা মূল্যস্ফীতি কমছে বলে পূর্বাভাষ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবন যাত্রা ব্যয় এখন সর্বোচ্চ অবস্থায় রয়েছে। একশ টাকার জিনিস এখন তাকে ১১২ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে। কিন্তু এক বছরে তাদের আয় তেমন বাড়েনি বললেই চলে।
টাকার বিনিময় হার : গত বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অ্বমূল্যায়নই হয়েছে একুশ শতাংশ। দেশের ইতিহাসে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন এতো বেশি আর কখনো হয়নি। ২০১১ সালে জানুয়ারি মাসেও প্রতি ডলারে বিনিময় মূল্য ছিল ৭০ টাকা। কিন্তু ২০১২ সালে সেই ডলারই কিনতে হয়েছে ৮৫ টাকা করে।
চলতি অর্থবছরে অনেক ঢোল পিটিয়ে ৪৬ হাজার কোটি টাকার একটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন কাজ হাতে নেয় সরকার। কিন্তু অর্থবছরে সাত মাস পার হয়ে গেলেও এর অর্ধেকটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। জুলাই-জানুয়ারি সময়কালে এডিপির ৪৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে আবার দেশীয় অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হয়েছে ১১ হাজার ২৭৯ কোটি টাকা। যা বাস্তবায়নকৃত এডিপি ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে, বিদেশি অর্থ ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। মোট বাস্তবায়নকৃত এডিপি’র মাত্র ২৪ শতাংশ ব্যয় করা গেছে। মোট এডিপি বাস্তবায়ন হার হচ্ছে ৩৪ শতাংশ। পুরো এডিপি অর্থ খরচ করতে হলে এখন এখন বাকি পাঁচ মাসে বাস্তবায়ন করতে হবে এডিপি’র ৬৬ শতাংশ অর্থ। যা কখনো সম্ভব নয় বলে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা মনে করছেন। আর এডিপি বাস্তবায়ন না হবার কারণে গ্রামে গঞ্জে এখন অনেকটা কর্মহীন অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে।
অতীতে অর্থনীতির অবস্থা এরচেয়ে খারাপ ছিল মনে হয় না। সরকারের পুরো অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা এখানে ‘ফেল মেরেছে’(ব্যর্থ)। পরিস্থিতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে আগামীতে এই অবস্থার পরিবর্তনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ফলে দেশে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি হবে না, হবে না শিল্পায়ন, বেড়ে যাবে বেকারত্ব। বেকারত্বের হার বেড়ে গেলে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাবে। পুরো সমাজ ও দেশে সৃষ্টি হতে পারে একটি অরাজক পরিস্থিতির।
ব্যাংক থেকে অধিক মাত্রায় ঋণ নেয়ার নীতি পরিহার করা উচিত। অন্যথায় বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাবে, যার প্রভাব পড়বে কর্মসংস্থানের ওপর। অপরদিকে সার্বভৌমত্ব বন্ড ছাড়ার পরিকল্পার বিষয়ে জানান, যে কোনো প্রকার সিদ্ধান্ত অধিকতর ভেবে চিন্তে করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, সরকারের বাজেটের একটি বড় অংশ ঋণ দেশি-বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়। সরকারের দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ নেয়ায় নিসন্দেহে এর দায় পরবর্তী সরকার তথা গোঠা জাতিকে বহন করতে হবে। নতুন সরকারের এসব দায় পরিশোধেই ব্যস্ত থাকতে হবে। উন্নয়নমূলক কাজ তেমন একটা করতে পারবে না। সার্বভৌমত্ব বন্ড ছাড়ার আগে আরো সতর্কতার সাথে পা বাড়ানোর দরকার। কারণ এর সাথে দেশের সার্বভৌমত্ব জড়িত থাকে। এ দায় পরিশোধ করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায় এবং এর ব্যয়ও বেশি।
Share