somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমেরিকার পথে পথে ৮

১৩ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পরের দিন এই রোড ট্রিপের চূড়ামণি ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে যাওয়ার প্ল্যান থাকলেও তাতে রদবদল করা হল দলের পঞ্চম পান্ডব কনক আদিত্য দাদা কিছু ঝামেলার কারণে এখনো এসে না পৌঁছানোয়| গাড়ির স্টিরিয়ারিং হালকা ঘুরিয়ে মন্টানার অপূর্ব পাহাড় আর ক্রিকের মাঝের আঁকা-বাঁকা পথ ধরে আমরা রওয়ানা দিলাম পোকাটেল্লো, আইডাহো'র দিকে| সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন ফারজানা রিমি আপু| রিমি আপু আইডাহো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ক্যান্সার সেলের উপর রিসার্চ করছেন| কাছাকাছি আছি শুনে এই মুসাফিরদের নিজের আস্তানায় অথিতি হবার আমন্ত্রণ জানালেন| মুসাফির ধর্মে ভদ্র মুসাফিররা কখনোই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেনা| আর ভদ্র, শান্ত-শিষ্ট, লেজ বিশিষ্ট এই আমাদের ভদ্র এবং আমন্ত্রণ রক্ষা করে ভরপেট খাওয়ার বিশেষ সুনাম আছে| আদিকালের বামুনরা এই ব্যাপারে আমাদের কাছে পাত্তাই পাবে না| তাছাড়া গত কয়েকদিন অপু ভাইয়ের সবজি খিচুড়ি খেয়ে খেয়ে পেটটা কেমন জানি মজে গেছে|

যাওয়ার পথে পড়ল মন্টানা স্টেটের ভাগে পরা ইয়েলোস্টোনের অংশ| বিশাল এই বন জুড়ে আছে ৩টি ষ্টেট- মন্টানা, ওয়াইমিং আর আইডাহো| এর মধ্যে ওয়াইমিং এর ভাগেই পড়েছে সিংহভাগ আর বাকি দুই স্টেট পেয়েছে ছিঁটে ফোঁটা| দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়ে পার্কের নামের পাশে কিছু ছবি তুলে আর ইয়েলোস্টোন রিভারকে দু'চোখ ভরে দেখে আবার চার চাকায় যাত্রা|

আইডাহো আলুর স্টেট নামে বিখ্যাত| আমি আজ পর্যন্ত আমেরিকায় যত আলু কিনেছি সবগুলোর প্যাকেটেই "আইডাহো পটেটোস" লেখা ছিল| আমেরিকার এক-তৃতীয়াংশ আলু এই স্টেটেই উৎপন্ন হয়| অফিসিয়ালি আইডাহো "জেম স্টেট" নামে পরিচিত প্রচুর রত্ন পাথর পাওয়া যাওয়ায় আর এর বন্যতার কারণে| প্রথম বড় শহর পড়লো আইডাহো ফলস| ঢুকতেই চোখে পড়ল স্নেক রিভার আর সেই রিভারে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি ম্যানমেড জলপ্রপাত| রূপ দেখে থামতেই হলো| রিমি আপুর আস্তানায় যখন পৌঁছালাম তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা| ঝটপট মাল-সামান রেখে আমরা চলে গেলাম আমেরিকান ফলস লেকে| লেকটা ঠিক পছন্দ না হলেও সেখানে দেখলাম ট্রিপের সেরা সূর্যাস্ত| সূর্য যেন লেকের পানিতে গলে গলে পড়ছিল| লাল, কমলা, বেগুনি সব রং সেইদিন ধরা পড়েছিল লেকের জলে| আসার পথে রিমি আপু জম্পেশ ডিনার করালেন আইহপে|

রাতে বাসায় ভুঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে সিদ্ধান্ত হলো কপালের ফেরে আইডাহো যখন এসেই পরেছি দেখে যাব "ক্রেটারস অফ দ্যা মুন ন্যাশনাল মনুমেন্ট এন্ড প্রিজার্ভ"| চাঁদের ক্রেটারসের সাথে মিল থাকায় এই নামকরণ| তিনজন নভোচারী প্রশিক্ষণও নিয়েছেন এখানে| পরে দেখা গেল চাঁদের জ্বালামুখগুলোর সৃষ্টি হয়েছে উল্কাপাতের কারণে আর এখানকারগুলোর ভূমিকম্পের লাভায়| সকালে সেখানে পৌঁছানোর পর মনে হল এটি এই পৃথিবীর কোন অংশ নয়, ভুতুড়ে কোন প্রাণহীন দুনিয়া| যে দিকেই চোখ যায় শুধু জমাট বাঁধা কালো লাভার সমুদ্র| ভিজিটর সেন্টার থেকে জানা গেল আজ থেকে ১৫০০০-২০০০ বছরের মধ্যে ৮টা বড় বড় ভূমিকম্পে গ্রেট রিফ থেকে লাভা উঠে এই এলাকার জন্ম| এখানেই পেয়ে গেলাম লরা ইঙ্গলস ওয়াইল্ডারের অটোবায়োগ্রাফি "পাইওনিয়ার গার্লস" এর সুন্দর বাঁধানো এক কপি। কাজীদা'র জন্য উপহার হিসাবে নিয়ে নিলাম সেটা। অণু'দা কথা দিলেন পৌঁছে দেবেন কাজীদা'র হাতে। লাভার পাহাড়ের মাঝে পাশাপাশি দুইজন চলার মতো রাস্তা করা| তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে পুরো এলাকা ঘুরে দেখা যায়| প্রথমে "ইনফার্নো কোন" নামে গুড়ি গুড়ি কালো পাথরের এক পাহাড়ে চরলাম| বেশ উঁচু| ওখান থেকে চলে গেলাম "ইন্ডিয়ান টানেল" নামের এক গুহায়| বেশ খানিকটা নিচে ছোট বড় ধারালো পাথর ডিঙিয়ে নামতে হয়| জুতো পরা না থাকলে নামা বিপদজনক| গুহার ভিতরে হিমশীতল ঠান্ডা| মনের কারণে হতে পারে কিন্তু আমার মনে হল এই ঠান্ডাটা অন্য ঠান্ডার থেকে আলাদা| কেমন যেন প্রাচীন যুগের একটা স্পর্শ লাগে শরীরে| সময় যেন থেমে আছে এখানে| দেয়ালে জন্মানো নানা রঙের লাইকেন গুহাটাকে করে তুলেছে অনেক বেশি আকর্ষণীয়| একটু ভিতরে গেলেই খালি চোখে আর কিছু দেখা যায়না| আলো ছাড়া পথ চলা মুশকিল| পার্কের কর্তৃপক্ষ গুহার বাদুড়দের নিয়ে বেশ চিন্তিত| পৃথিবীর অন্য গুহার বাদুড়দের মধ্যে সংক্রামিত এক ভাইরাস যেন এখানকার বাদুড়দের কোন ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য একই জামাকাপড় পরে যদি পৃথিবীর অন্য যে কোন গুহায় একবারও ঢোকা হয় তাহলে এখানে ঢোকা যাবেনা| এই ভাইরাস নাকি এতই ভয়ংকর যে জামাকাপড় পোড়ালেও ভাইরাস মরে না !!!!! সৌভাগ্যক্রমে আমাদের কেউই পরনের জামাকাপড় পরে আগে কোন গুহায় ঢুকিনি|

এই কয়েকদিনে অনেক প্রাকৃতিক বিস্ময় দেখা হলেও এই জায়গাটা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা| সবচেয়ে ভালো লাগলো এটা দেখে যে এই কঠিন লাভার মধ্যেও জন্ম নিচ্ছে গাছ| কালো শক্ত লাভার বিরান ভূমিতেও প্রকৃতি তার উদার হাতে জীবন ছড়িয়ে দিচ্ছে| তথ্য কেন্দ্র থেকে জানা গেল শিয়াল, খরগোশ এবং পাখিও রয়েছে এখানে|

বাসার দিকে যাওয়ার পথে লাঞ্চের জন্য থামলাম "মাউন্টেন ম্যান ট্রেডিং পোস্ট" নামের ছোট একটা লোকাল রেস্টুরেন্টে| দারুন এই ছোট জায়গাটা| ঢোকার পর মনে হল কারো বাসায় চলে এসেছি| ভিতরের ডেকোরেশন ওভাবেই করা| অনেক খাবার টেবিলের পাশেই রাখা| চাইলেই বসে থেকে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নেয়া যায় ঠিক ঘরের মতো| এক কোনায় অনেক বই রাখা, বিক্রির জন্য নয়, অদল-বদল করার জন্য| রেস্টুরেন্টটা চালান দুই দিদিমা| মেইন ডিশ অর্ডার করলে তারাই কিচেন থেকে বানিয়ে দেন| ঘরোয়া পরিবেশের অন্যরকম এই রেস্টুরেন্টে আয়েশ করে দুপুরের পেটপূঁজো হয়ে গেল|

বাসায় এসে রাতের আর পরদিন খাবারের জন্য রাজকীয় আয়োজন করা হল| রিমি আপু করলেন পালং শাক ভাজি, অপু ভাই ঘন ডাল, আমি বেগুন ভাঁজা আর ঝাল মুরগি| গলা পর্যন্ত খেয়ে গভীর রাত পর্যন্ত চলল আড্ডা বাইরের মৃদুমন্দ বাতাসে সিঁড়িতে বসে|

কাল যেতে হবে বহুদূর, আবার মন্টানায়, গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্কে|
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১:৫৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৮




আমাদের কার কি করা উচিৎ আর কি করা উচিৎ না সেটাই আমারা জানি না। আমাদের দেশে মানুষ জন্ম নেয়ার সাথেই একটি গাছ লাগানো উচিৎ । আর... ...বাকিটুকু পড়ুন

মানবতার কাজে বিশ্বাসে বড় ধাক্কা মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৭


মানুষ মানুষের জন্যে, যুগে যুগে মানুষ মাজুর হয়েছে, মানুষই পাশে দাঁড়িয়েছে। অনেকে কাজের ব্যস্ততায় এবং নিজের সময়ের সীমাবদ্ধতায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে না। তখন তারা সাহায্যের হাত বাড়ান আর্থিক ভাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×