প্রতিদিন বাবা অফিস থেকে ফিরলেই সে খুলে বসে তার নালিশের খাতা।কতো নখরা,বাহানা,আবদার ,নালিশ..উহ...
কেনইবা নালিশ করবেনা শুনি??বুঝলাম তিতুন ওর একমাত্র ভাই,ছোট ভাই,তাই বলে সে কি তার বোনকে খামচি দেবে,তার শখের ডলস্ হাউজ ভেংগে দিবে,তার রং পেন্সিল দিয়ে মেঝেতে আকিবুকি খেলবে,কিংবা বোনের চুলের ঝুটি ধরে টানবে!!
সত্যিইতো তিতুন ভারী দুষ্টু, সবার আদর পেয়ে পেয়ে খুব পাজী হয়ে গেছে ছেলেটা,বাবার কথা এখন সে থোরাই কেয়ার করে!!
কিন্তু আজ পিচ্চি তিতলী তার গুল্টু গুল্টু চোখগুলো জল ছলছলে করে গালে হাত দিয়ে জানালার পাশে বসে আছে।তিতুন ওকে এভাবে বসে থাকতে দেখে আরো জ্বালাতন করছে।দাদুমনি কয়েকবার খাইয়ে দিতে এসেছে,ও খায়নি।ওভাবেই চুপচাপ বসে আছে।কি যে হলো মেয়েটার আজ কে জানে......।
চিলেকোঠায় তিতলীদের ছোট্ট একটা বাসা,ঠিক যেন ছোট্ট একটা বাবুই পাখির বাসা,যেখানে থাকে পিচ্চি তিতলী বুড়ি,মহাদুষ্টু একটা ছেলে তিতুন যে কিনা তিতলীর ভাই,ওদের দাদুমনি,আর বাবা।তিতলীটা জানে ওদের মামনি অনেক দুরে থাকে ওদের থেকে।বাবা বলেছে মামনি থাকে আকাশে পরীর দেশে,ঐ যে লালপরী-নীলপরী যে দেশে থাকে আর অনেক তারা থাকে।
প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বাবা তাদের দু'জনকে কোলে নিয়ে ছাদে বসে গল্প শোনায়-বাঘের গল্প,জুজুবুড়ির গল্প,দৈত্যের গল্প,আর মামনির গল্প।
বাবা বলে,আকাশের যতগুলো তারা আছে, তার মাঝে যেটা সবচেয়ে বড় সেটাই মামনি।ছোটবেলায় তিতলী আর তিতুন মামনিকে খুব জ্বালাতো জন্যে মামনি রাগ করে ওখানে চলে গেছে,কিন্তু সবসময় দেখে দুষ্টু দুটা কি করে।যেদিন থেকে তিতলীবুড়ি আর দুষ্টু তিতুন খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করবে না,ঝগড়া মারামারি করবেনা সেদিন মামনি আবার ওদের কাছে ফিরে আসবে।একটা বিষয় তিতলী বুঝে পায়না মামনির কথা বলতে গেলেই বাবার চোখে কেন বারবার ময়লা যায় আর বাবা চোখ মুছে।
""টিংটং""
বাবা এসেছে।দাদুমনি দরজা খুলে দিতেই তিতলী দৌড়ে গিয়ে ওর বাবার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।হঠাৎ অঝোরে কাদতে শুরু করে মেয়েটা।ঘাবড়ে যায় বাবা,দাদুমনি সবাই।
"কি হলো আমার মামনিটার,কাদছো কেনো বোকা মেয়ে?"
তিতলী কিছু না বলে কেদেই চলে।বাবার আদর,পাপ্পি,চকোলেট কোনো কিছুতেই থামছেনা মেয়েটা।বাবা তিতুনের দিকে তাকাতেই সে ঘাড় নাড়িয়ে না সূচক ভংগি করে,সে যে আজ কিছু করেনি সেটাই হয়তো বোঝাতে চাইছে।
কি যে হলো মেয়েটার কে জানে?তিতুনটাও বোনের কান্না ডেখে একদম চুপসে যায়,ঘুরঘুর করতে থাকে বোনের চারপাশে।
বাবা ফ্রেশ না হয়েই ডলটাকে নিয়ে ছাদে চলে যায়,তখনো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেদে চলেছে তিতলী।উইকএন্ডে ঘুরতে নিয়ে যাবো,কালই তোমাকে বার্বি কিনে দিবো,অনেকগুলো কালার পেন্সিন কিনে দিবো,চকলেট ও দিবো...বাবার এইটাইপ এর প্রমিজ শুনে কিছুটা শান্ত হয় সে।কান্না থামালেও বাবার গলা জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে থাকে ও।
মেয়েকে কিছুটা শান্ত দেখে বাবা জিজ্ঞেস করে-"কি হয়েছে বলোতো আমার ছোট্ট পরীটার?তিতুন পচাটা কি তোমায় চিমটি দিয়েছে,পুতুল ফেলে দিয়েছে,দাদুমনি বকেছে?বলো মামনি কি হয়েছে?বাবাকে বলবেনা?"
ছোট্ট তিতলী তার কান্না কান্না মুখটা তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,"জানো বাবা, আজ স্কুলে মিস সবাইকে বলেছিলো সবার মামনিকে নিয়ে লিখতে।আমি লিখেছি আমার মামনি আকাশে থাকে,তারা আর লাল-নীল পরীদের সাথে।আমার বন্ধুরা আমার লেখা পড়ে খুব হেসেছে,আমি নাকি মিথ্যা লিখেছি,পরীর দেশে নাকি শুধু পরীরাই থাকে।বলো বাবা আমি কি মিথ্যা বলেছি?তুমিই তো বলেছো মামনি পরীর দেশে থাকে,বলো আমি কি ভুল বলেছি?ওরা কেন এভাবে হাসলো,ওরা আমাকে কেনো লায়ার বললো?তুমি ওদের খুব করে বকে দিও আচ্ছা বাবা।বলো বকবেনা?আর মামনিকে বলো যেনো খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে,বলে দাও আমরা দুজন লক্ষী হয়ে যাবো,আর দুষ্টুমি করবোনা,প্লিজ বাবা মামনিকে বলো,প্লিজ"
কথাগুলো বলে আবার কান্নায় ভেংগে পড়ে তিতলী,বোনের কান্না দেখে তিতুনও কান্না শুরু করে দেয়।
বাবা ভেবে পায়না কি বলবে ওদের?কি করে বোঝাবে এই অবুঝ শিশু দুটিকে,কোন ভাষায় তাদের বোঝাবে তাদের মামনি ফিরে গেছে না ফেরার দেশে,যেখান থেকে আর কখনো ফিরে আসবেনা তাদের কাছে।মা হারা পাঁচ বছরের তিতলী আর তিন বছরের তিতুন,এই বাচ্চা দুটোকে কি করে আগলে রাখবে সে?সে কি করে ফিরিয়ে দেবে তাদের মায়ের মমতা,সে ক্ষমতা যে তার নেই।
দুটি দেবশিশু বুকে আগলে ধরে চোখভরা জলে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে শূন্য আকাশের দিকে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০১২ সকাল ১১:৪১