বুয়েট ও টিউশনি ২টি অঙ্গা অঙ্গি ভাবে জড়িত। তো এসব টিউশনি করানোর সময় একই সাথে যেমন মজার অভিজ্ঞতা হয় তেমনই মাঝে মাঝে কষ্টদায়ক ঘটনাও ঘটে। এখানে তেমনই কিছু ঘটনার বর্ননা করবো। সাথে কিছু উপদেশ মূলক বানী ও উল্লেখ করবো।
১। একবার আমার কাছে ২জন ভদ্র মহিলা এলেন আমি বুয়েটে পড়ি শুনে, তো তাদের মাঝে এক জন অতিশয় স্মার্ট। ২জনের মাঝে ১জনের সাথে যখন আমি কথা বলছিলাম কখন পড়াতে পারবো, কি কি পড়াতে হবে, এই সব নিয়ে তখন অতিশয় স্মার্ট আন্টি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাথ পড়াতে পারবে তো? মানে তোমার হায়ার ম্যাথ পড়াতে সমস্যা হবে না তো? ” আমি ভাবলাম একবার বলি যে আমার তো ম্যাথ ছিলো না আমি তো বায়োলজি নিয়ে পড়েছি। পরে ভাবলাম থাক কি হবে আর বলে। ভদ্রতার খাতিরে বললাম না কোনো সমস্যা হবে না। পরে অবশ্য টিউশনিটা করানো হয় নি, কারন তাদের দাবী ছিলো সপ্তাহে ৬ দিন না পড়ালে ছাত্রদের পড়া হবে না। সপ্তাহে ৭ দিন পড়াতে পারলে আরো ভালো। আর একটি কথা না বললে ঘটনাটি অসম্পুর্ন থেকে যাবে তা হল তারা আমাকে এর জন্য চার হাজার টাকা দিতে পারবে।
শিক্ষাঃ অতিশয় স্মার্ট অভিভাবকের বাসায় পড়াতে না যাওয়াই উত্তম।
২। এবার আমার এক বন্ধুর জীবনের ঘটনা বলবো, একবার আমার এক বন্ধু ছাত্রীর বাসায় পড়াতে গিয়েছে, তো সে কলিং বেল বাজিয়ে গুন গুন করে গান গাওয়া শুরু করলো, “সেই নীল জামা পরে তুই ইচ্ছে করে একটু ছুঁই, ... ” তো সে গান গাচ্ছে আর ঠিক তখনই দরজা খুলে দিলো তার ছাত্রী। মজার ব্যাপার হল ছাত্রীটি সেদিন নীল রঙের জামা পরে ছিলো। এরপর আর কি ছাত্রী পড়ানোর সময় সারাক্ষনই মিটিমিটি করে হাসতে ছিলো আর আমার বন্ধু লজ্জায় লাল, নীল, বেগুনী হচ্ছিলো।
শিক্ষাঃ ছাত্রীর বাসার আশে পাশে গিয়ে গান না গাওয়াই উত্তম।
৩। আমি আমার জীবনে অনেক মানুষকে পড়িয়েছি, তবে আমার জীবনে পড়ানো সবচেয়ে ভয়ংকর ছাত্র একটিই ছিলো যার কাছে আমি হার মেনেছিলাম। তো এখন সেই ঘটনা বলবো, আমি সে ছাত্রকে রসায়ন প্রথম পত্রের “তরল তরল দ্রবন” পড়ানো শুরু করলাম। প্রথমে তাকে পড়ালাম মোল সংখ্যা কি? মোল ভগ্নাংশ কি জিনিস? এভাবে পুরো অধ্যায় ঘন্টা খানেক ধরে পরালাম। প্রতিটা গ্রাফ ভালো করে বুঝালাম। সে চুপ চাপ সব শুনলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,”সব বুঝেছো তো?”। সে জবাবে বললো, “জ্বি স্যার সব বুঝছি, কিন্তু একটা জিনিসে একটু প্রব্লেম আছে।”। আমি বললাম, “কোথায় বলো?”। জবাবে সে যা বললো তা হলো, “স্যার সবই বুঝছি কিন্তু মোল সংখ্যাটা যেনো কি?”। ঘন্টাখানেক এর পরিশ্রম চোখের সামনে বৃথাশ্রমে পরিনত হলো। এরপর পালিয়ে বেঁচেছি সেখান থেকে।
শেষকথাঃ আমি কথায় কথায় EEE’08 এর এক ছেলেকে সেই ছাত্রের কথা বলেছিলাম যে ওকে পড়ানোর পর আমার ২০ তলা থেকে লাফ দিতে ইচ্ছা করছে। জবাবে ছেলেটি বললো,”ভাই আপনারতো ২০ তলা থেকে লাফ দিতে ইচ্ছা করছে আর আমার করছে ৪০ তলা থেকে লাফ দিতে”।
শিক্ষাঃ যার RAM কম, তার কম configuration এর game খেলা উচিত। অভিভাবকদের এটা বোঝা উচিত।
৪। এবারের গল্পের নায়ক খুবই শান্তশিষ্ট, ভদ্র এক বন্ধু, যে সাধারনত টিউশনি করায় না কিন্তু “C programming Language” পড়ানোর লোভ সে ছাড়তে পারলো না। তাই সে “উত্তর দক্ষিন” নামক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে পড়ানো শুরু করলো। একমাস খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ানোর পর একদিন ছাত্রকে একটি program লিখতে দিলো। ছাত্রটি #include লিখে আমার বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো।
বন্ধুঃ কি ব্যাপার লিখছো না ক্যানো?
ছাত্রঃ এরপর কি লিখবো ভাইয়া?
বন্ধুঃ main function টা লিখে ফেলো। [উল্লেখ্য C তে main function লিখার নিয়ম হল int main(void)]
এরপর ছাত্রটি যা লিখলো তা দেখে আমার বন্ধুবর চেয়ার নিয়ে উলটে পরতে যাচ্ছিলো আর একটু হলে।
সে যা লিখেছিলো, তা হলোঃ main function
শিক্ষাঃ মাঝে মাঝে পড়া না ধরাই উত্তম।
৫। এই ঘটনাটি আমার অপর এক বন্ধুর। সে যেখানে টিউশনি নেয় সেখানে ছাত্র/ছাত্রীর বাবা মা ২ জনই ডাক্তার, বেশ ধনী। কিন্তু আমার ঐ বন্ধুটি ২ মাস পড়ানোর পর তাকে কোনো রকম সম্মানী না দিয়েই পড়াতে মানা করে দেয়।
এরকম শত ঘটনা ঘটে গিয়েছে আমাদের অনেক বুয়েট ছাত্রের জীবনে। যখন আমরা ছোট ছিলাম তখন দেখতাম আমাদের বাবা মা এরা শিক্ষকদের কতটা সম্মান করতো কিন্তু এখন কর্পোরেট যুগের বাবা মা এরা শিক্ষক আর বাসার ড্রাইভারদের মাঝে তেমন পার্থক্য করে না। সে সব অভিভাবকদের জন্য শুধু এটুকুই বলতে চাই, শিক্ষককে কখোনোই বেতন দেয়া হয় না, তাদের দেয়া হয় গুরুদক্ষিণা। এ দুটোর পার্থক্য অনেক সঠিক ভাবে শিক্ষিত মানুষেরাই এর পার্থক্য বুঝে। একবার আমার এক ছাত্রের মা, যিনি সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয়ের সচিব, আমাকে আমার সম্মানী হাতে দিয়ে বললো গুনে নাও। আমি বললাম, “আমাকে খামে করে টাকা দিতে হবে, আমি হাতে টাকা নেই না। খামে করে না দিলে পড়াবো না।“ পরে অবশ্য টিউশনিটা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
যাই হোক, পরিশেষে একটি ছোট ঘটনা দিয়ে শেষ করতে চাই। তা হল, বুয়েটে ভর্তি হবার পর ৬মাস বসে থাকতে হয়েছিলো। তখন খুব মজা করে টিউশনি করাতাম, তো সে সময় মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যার এর “রঙ্গিন চশমা” বইটি পড়ি। ওখানে এক জায়গায় উনি লিখেছেন,”ছাত্র জীবনে বিভিন্ন কাজ করে হাত খরচ চালিয়েছি কিন্তু টিউশনির মতো অসম্মান জনক পেশা কখনো অবলম্বন করতে হয় নি।” লেখাটা পড়ে খুব আত্মসম্মানে লাগে। যে এটা উনি কি বললেন? পরবর্তীতে আমি তাকে সামনা সামনি জিজ্ঞেস করি এটা উনি ক্যানো লিখেছেন? জবাবে উনি শুধু এটুকুই বলেছিলেন সময় হলেই বুঝতে পারবে। আমি আমার এই লেখাটি সেই মানুষটিকে সম্মান জানানোর জন্যই লিখেছি। সত্যি স্যার আমি আপনার সাথে একমত। টিউশনি আসলেই আসম্মান জনক পেশা কিন্তু আমি আপনার মত এতো প্রতিভাধর না হবার কারনে এই অসম্মানের কাজটি করেছি নিতান্ত অনিচ্ছাসত্তে। হাতের পাঁচ আঙ্গুল যেমন সমান না ঠিক তেমনই সব সময় শুধু তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়নি। মাঝে মাঝে কিছু অসাধারন মানুষের দেখাও পেয়েছি এই টিউশনির মাধ্যমে। সে গল্প অন্য কোনো দিন করা যাবে।
এটা আমার প্রথম ব্লগ লেখা।