somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভারতভ্রমণঃ শীমলা

০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৪:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


কোলকাতা-ভ্রমণ এবং দিল্লী-ভ্রমনের পর থেকে......

২১.০৭.১৪

শফিকের ছবি তোলার হাতকে আমি পিকাসা সফটওয়্যারের সাথে তুলনা করি- যার এডিটিং টুল একটাই- ছবি ব্লার করা। সত্যঘটনা অবলম্বনে একটা উদাহরণ দেই, তাহলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। ধরুন আপনি সেন্টমার্টিনের পশ্চিম প্রান্তে অস্তগামী সূর্যকে ফোকাস করে একটি ছবি তুললেন। এরপর ক্যামেরাটি চুলমাত্র না সরিয়ে পরের ক্লিকটি আপনি শফিক ইসলামকে করতে দিলেন। সে হাত না কাঁপিয়েই ক্লিকটি করলো। এখন সম্ভাব্যতার সূত্রের ধার না ধেরে আমি শতভাগ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি যে ওই ছবি দুটির অন্তত একটি ছবি অবশ্যই, অবশ্যই ঝাপসা হবে(এর পেছনের অন্তর্নিহিত কারণ জিজ্ঞেস করে বিপদে ফেলবেন না। আমি জানি না... কেউ জানেনা।)! সেই শফিক কে যখন দেশ থেকে একটা ক্যামেরা বয়ে নিয়ে আসতে দেখেছিলাম তখনই প্রমাদ গোনা শুরু করেছিলাম। শীমলার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার আগে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না, ক্যামেরাটা ওর কাছ থেকে নিজের দখলে নিয়ে নিলাম।


যাইহোক, ভ্রমনকাহিনীতে ফিরে আসি। ট্রেনের নাম শতাব্দী এক্সপ্রেস। এই ট্রেন দিল্লী থেকে কালকা পৌঁছে দিবে আমাদের, যেখান থেকে পরে টয় ট্রেন ধরবো। এটা ওই র‍্যুটের সবচেয়ে ভালো ট্রেন হিসেবে পরিচিত। যুবা এক্সপ্রেসে ভ্রমণের পর এক্সপেক্টেশান এমনিতেই খুব কমিয়ে ফেলেছিলাম, তাই এই ট্রেনের সব কিছুই স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী সন্তুষ্ট করলো। ট্রেনের আকর্ষনীয় ফিচার হল টিকেটের টাকায় সকালের নাস্তাও অন্তর্ভুক্ত। যদিও বুয়েটের হলে সকালের নাস্তায় ছুরি দিয়ে পাউরুটিতে মাখন লাগিয়ে অভ্যস্ত নই আমরা তবু মাঝে মাঝে ইমপোস্টার সাজতে কারই বা খারাপ লাগে! অতি ফরমাল চা-নাস্তা শেষ করে ম্যাগাজিন উল্টিয়ে বা রাতের ঘুমটা ট্রেনে পুষিয়ে সময় কাটাতে থাকলাম একেকজন। কিছুক্ষণ পর আবিষ্কার করলাম ট্রেনের উপরের দিকের কাঁচে আশপাশের খুব ভালো প্রতিফলন হচ্ছে। যারা ধানমন্ডি-২ এর স্টারের দ্বিতীয়তলায় কখনো খেয়েছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে এই ধরনের কাঁচ স্টকিং এর জন্য কতটা সহায়ক! তিন চার সারি পরের খুব সুন্দর একটা মুখকে লক্ষ্য করে শুরু হল পেরিস্কোপিক স্টকিং।.....


আমাদের ট্রেন ছুটে চলেছে পানিপথ, কুরুক্ষেত্র, আম্বালা হয়ে। আশপাশের দৃশ্য বলতে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। সবুজের মাঝেমাঝে দালানকোঠা, কিছুদূর পর পর ছোট টিলার গায়ে ছোট কোন মন্দির। ঘন্টা-তিনেক ভ্রমণের পর ট্রেন চণ্ডীগড়ে প্রবেশ করলো। চণ্ডীগড়ে কি(!) এমন আছে তা দেখার চেষ্টা করলাম। দুপাশে পাকা পাকা দালান ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়লো না। দিল্লীর ঘটি দাদার সেই বাণীটা হঠাৎ কানে বেজে উঠলো- “চণ্ডীগড় নেহী দেখা তো ক্যায়া দেখা!”


দুপুর বারোটার দিকে ট্রেন কালকা পৌঁছালো। নেমেই চড়তে হল টয় ট্রেনে। ট্রেনের নাম ‘হিমালয়ান কুইন’। ছোট্ট একটা ট্রেন, ছোট ছোট বগি। বসার সিটগুলোতেও পা রাখার জায়গা কম। টিকেট অনুযায়ী ছয়জন-চারজন করে দুই বগিতে বসলাম সবাই। ট্রেনের লোক এসে জানালো যে রাস্তায় খাবার পাওয়া যাবে না। এখানেই যাতে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে ফেলি। খাবার পিওর ভেজ। বেশী ভাবনাচিন্তা না করে নিয়ে নিলাম। ট্রেন ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে আসলো এক ‘থালি’ খাবার। আইটেম অনেক- মটর-পনির, টম্যাটোর চাটনি, সবজি, ডাল, টক দই, ভাত, পরোটা। কিন্তু খাবারের চেহারা দেখে মনে হলোনা এটা জার্ণির জন্য উপযুক্ত খাবার। প্রতিটা আইটেমের সাথেই আছে বর্ণিল ঝোল। ট্রেনের দুলুনির সাথে সেই টলমলে ঝোল সামলে খাবার শুরু হল। প্রত্যেকটা খাবার একটার চেয়ে আরেকটা বেশী বিস্বাদ! বিশেষ করে দাহি(পানি পানি টক দই) জিনিসটার কাপের গায়ে 'সংবিধিবদ্ধ সতর্কিকরণ' থাকা অতি আবশ্যক ছিল। কোনমতে খাওয়া সারলাম। পথে পেট যাতে বিদ্রোহ না করে সেজন্য দোয়াদরুদ পড়ে বাইরের প্রকৃতিতে মনযোগ দিলাম।


অল্পক্ষণেই আমরা পাহাড়ের রাজ্যে প্রবেশ করলাম। বাইরের দৃশ্য দেখে উত্তেজনা ধীরে ধীরে চড়তে লাগলো। এই ট্রেন ভ্রমণের তুলনা হয়না। আঁকা-বাঁকা পাহাড়ী পথে ধীরে ধীরে উপরে চলেছে ছোট্ট হিমালয়্যান কুইন। আশপাশের দৃশ্যের সৌন্দর্য্য অল্প কথায় বুঝাতে হলে বলবো- অনেকটা বান্দরবানের পিক-৬৯ রাস্তাটার মত। পার্থক্য বলতে এটুকুই- এখানে খাড়া পাহাড়ের গায়ে গায়ে অত্যাধুনিক সব দালানকোঠা। সবুজের কোন কমতি নেই। শুধু গাছগুলাই ভিন্ন। পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে সেগুন-রাবারের সারি থাকে এখানে তার বদলে আছে পাইন আর ক্যাকটাসের প্রাচুর্য। দূরে দেখা যায় গাড়ি চলার রাস্তা স্পাইরাল শেপে উঠে গেছে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে।


টয় ট্রেনের র‍্যুটটা বিখ্যাত এর টানেলগুলার জন্য। মোট ১০৩ টা টানেল আছে এই র‍্যুটে! হঠাৎ হঠাৎ করেই ট্রেন হারিয়ে যাচ্ছিলো ঘুটঘুটে অন্ধকারে। যাত্রীরাও এসময় সোল্লাসে চিৎকার করে উঠে। কিছুক্ষণ পর একটু দূরে গিয়ে বসা গ্রুপের ফতোয়াবাজ রাবা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষন করলো। ওর নির্দেশিত পথে চেয়ে দেখলাম যে টানেলের অন্ধকার পথের পূর্ন সদ্ব্যবহার করে চলেছে আমাদের বগির একমাত্র কমবয়সী জুটিটি। Who are we to complain? আমরাও উপভোগ করতে থাকলাম।


হিমলয়্যান কুইন


এদিকে ট্রেন চলছে কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে। ট্রেনের গতি শম্বুক প্রকৃতির। মাত্র ৯৬ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে সময় নেয় ঘন্টা পাঁচেক। অবশ্য দুপাশের দৃশ্য এতো মনোহর হলে কে তাতে আপত্তি করবে! মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্টেশনে খুব অল্প সময়ের জন্য থামছিলো। তাড়াহুড়ো করে চা-কফি খেয়ে নেয়া যায়। ধূমপায়ী বন্ধুরা এদিকে অস্থির হয়ে উঠেছে। কিন্তু ওদের কপাল খারাপ, সব স্টেশনই ধূমপান-মুক্ত। ভাল্লাগলো ব্যাপারটা। প্রতিটা ষ্টেশন ছবির মত সুন্দর। মানুষের ভীড় নেই, কোন কোলাহল বা ব্যাস্ততা নেই। হরেক রঙের ফুলের গাছ আশপাশের সবুজের মাঝে চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের হাজার দুয়েক উচ্চতার কালকা থেকে শুরু হয়েছিল যে রেলট্রেক তা এঁকেবেঁকে উপরে উঠে চলেছে। একের পর এক ষ্টেশন পার হচ্ছি আর বোর্ডে স্টেশনের উচ্চতার সংখ্যাটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে,... চার হাজার, সাড়ে চার হাজার, পাঁচ হাজার......


আশপাশে মেঘের আনাগোনা আগে থেকেই ছিল। শীমলার কাছাকাছি পৌঁছানোর পর ঝুম বৃষ্টি নামলো। প্রকৃতি তার আরেক খেল দেখানো শুরু করলো। পাহাড়ের যে পাশে মেঘ আটকে আছে সে-পাশে তুমুল বৃষ্টি। আর অপরপাশে উজ্জ্বল নীল আকাশ! ট্রেন একেকটা বাঁক ঘুরে আর আমরা একেকটা ল্যান্ডস্কেপ দেখে বিস্ময়ধ্বনি করে উঠি।




বিকেল পাঁচটার দিকে শীমলা স্টেশনে নামলাম। ট্রেন থেকে নেমে কিছুক্ষণ বোবা হয়ে তাকিয়ে থাকলাম হীমচলের রাজধানীর দিকে। নিঃসন্দেহে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর ট্রেন ষ্টেশন। প্ল্যাটফর্মের বিপরীত দিকে রেলিং এর সামনে খোলা পাহাড়। দৃষ্টির সামনে বিশাল এক শূন্য আকাশ। অনেক দূরে পাহাড়ের গায়ে আণুবীক্ষণিক সব বাড়িঘর। থোকা থোকা মেঘকে দেখে মনে হয় চিমনীর ধোয়া। কয়েকদিন ধরেই what a wonderful world গানটা খুব বেশীই শুনছিলাম। মাথায় লাইনগুলো ঘুরছিলো,


Where trouble melts like lemon drops
High above the chimney tops, that's where you'll find me...


শীমলা ষ্টেশন


স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কুলিরা ঘিরে ধরলো। সব কুলিই কোন না কোন হোটেলের দালাল। এদের সম্পর্কে আগেই সাবধান করা হয়েছিল আমাদের। কুলি-দালালদের মাধ্যমে কোন হোটেলে উঠলে ভাড়া বেড়ে যায় কয়েকগুন। কারণ এই কুলিরা হোটেলওয়ালাদের কাছ থেকে বেশ ভালো একটা পার্সেন্টেজ পায়। অতএব তাদেরকে পাত্তা না দিয়ে বের হয়ে গেলাম ষ্টেশন থেকে। রিজের পাশে একটা হোটেলে কথা বলে রেখেছিলাম; হোটেল ডিপ্লোম্যাট। তাদের পাঠানো গাড়ি স্টেশনের বাইরেই অপেক্ষা করছিল। তাতে চড়ে রওনা দিলাম রিজের উদ্দেশ্যে। গাড়ি সরাসরি রিজে না গিয়ে বেশ ঘুরে যাচ্ছিলো। ড্রাইভারকে কারণ জিজ্ঞেস করা হলে সে জানালো যে মল রোড আর রিজে কোন গাড়ি ঢুকতে পারে না। শুধু ইমার্জেন্সি বাহনই ঢুকতে পারে। শুনে মনটাই ভালো হয়েগেল। কোলাহলবিহীন এমন শীমলাই তো এতদিন কল্পনাতে আঁকা ছিল! একটু পরেই অবশ্য এই হাসি উবে গেল। হোটেলের বেশ নীচে পাহাড়ের মাঝামাঝি গাড়ি নামিয়ে দিল আমাদের, এর উপরে যাওয়া যাবেনা। পীঠের নিরেট পাথরের মত ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে পাহাড়ে বাকিটুকু বাইতে আমাদের ত্রাহী অবস্থা। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে পৌঁছুলাম হোটেলে। তিনটা রুম নেয়া হল।


হোটেলের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই মনটা ভরে গেল! কেউ একজন বলে উঠলো- “ওরে, লাদাখ গিয়ে কি হবে?! এখানেই কাটিয়ে দেই দিন দশেক!” কথাটা যা মোটেই অত্যুক্তি ছিল না তা নীচের ছবিটা দেখলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। হ্যাঁ, এই দৃশ্যই ছিল আমাদের রুমের জানালার বাইরে। বাড়তি পাওনা হিসেবে ছিল পাশের হোটেলের ছাদে চেয়ারে বসে থাকা নারীকুল। অবশ্য এই সুখ বেশীক্ষণ কপালে সইলো না। আমাদের দৃষ্টিতে বোধহয় এমন কিছু ছিল যা দেখে একে একে সবাই ছাদ থেকে বিদায় নিল। কি আর করা, বাধ্য হয়ে আবার প্রকৃতিতে মনযোগ দিতে হল। সন্ধ্যা নামলো শীমলায়। একে একে দূর পাহাড়ের গায়ে বাড়ি-ঘরে আলো জ্বলে উঠতে থাকলো। দেখে মনে হল তারাখচিত একটা আকাশ সামনে পড়ে আছে। যার তারা গুলো স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশীই উজ্জ্বল, এই যা!


হোটেলের জানালা দিয়ে শীমলা শহর


হোটেলে মালিকের নাম নাভিন পাল। লোকটার সাথে অল্পক্ষণের মধ্যেই বেশ খাতির হয়ে গেল। আমাদের বাকি ট্যুরটার প্ল্যানিংও তার সাথে বসেই করে ফেললাম। লোকটা পাকা ব্যাবসায়ী। He made us an offer we couldn’t refuge. কোন এজেন্সির প্যাকেজ ট্যুর নেবো না তা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। নাভিন পালের সাথে তাই একটা ডিল করে ফেললাম। শর্ত দিলাম একটাই-আমাদের ট্যুরের র‍্যুট কোনভাবেই চেঞ্জ করা যাবেনা। আর ডিলের মধ্যে নিলাম দশদিনের জন্য চৌদ্দ সিটের একটা ট্রাভেলার্স কার, পাঁচটা শহরে হোটেল বুকিং আর দশদিনের খাবারের বন্দোবস্ত। তার কাছে আরেকটা আবদার করলাম- গাড়ীর ড্রাইভারটা যাতে বন্ধুসুলভ হয়। সে হেসে আশ্বস্ত করলো, "এমন একজনকে দিবো যাকে আপনারা ভুলতে পারবেন না।”।


এদিকে গ্রুপের সবাই বেশ হিংস্র হয়ে উঠেছে। রাতের খাবারে মাংস চাই ই চাই! নাভিন পালকেই জিজ্ঞেস করলাম হালাল মাংস কোথায় পাবো(?)। সে তার হোটেলের কর্মচারী বেলাল ভাইকে ডেকে দিলো। বললো বেলাল ভাইকে সাথে নিয়ে নিজেই যাতে দেখেশুনে কিনে আনি হালাল মাংস। মাংস কোনটা ভালো তার আমি কি চিনি! তবু এমন উৎসাহ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম যেনো হালাল পশু শিকারে বের হচ্ছি!


বেলাল ভাই কাশ্মীরের লোক। পেহেলগাঁও তে বাড়ি। বিশালদেহী লোকটা মারাত্মক সুদর্শন। এবং স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশীই চুপচাপ। হিন্দি প্র্যাকটিসের স্বার্থে নিজেই প্রশ্ন করছিলাম। আমরাও মুসলিম জানতে পেরে বেশ খুশি হয়ে উঠলেন। একটু পরে নিজ থেকেই কথা বলে উঠলেন। রীতিমত ট্যুরিস্ট গাইডের ভূমিকায় অবতীর্ন হলেন। রিজ পার হওয়ার সময় বলতে থাকলেন রিজ তাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ন। ওনার কাছেই জানতে পারলাম এই খোলা চত্বরের নীচে আছে পুরো শীমলার জন্য পানির রেজারভয়ার। বড় বড় পানির ট্যাংক পুরো শীমলার প্রান বাঁচিয়ে রেখেছে। শিমলার সকল উৎসব উদযাপনও এই রিজকে কেন্দ্র করেই হয়। খুব ভালো লাগছিলো লোকটার সঙ্গ। একটু পরেই অবশ্য আত্মা শুকিয়ে গেল যখন দেখলাম বেলাল ভাই মোটামুটি খাড়া একটা সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে পাহাড়ের নীচে নেমে চলেছেন। কিছুক্ষণ নেমে উপরে তাকিয়ে যখন দেখলেন ভূঁড়ি এলিয়ে তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছি তখন আশ্বাস দিলেন যে ফেরার সময় আরো কম ঢালু একটা রাস্তা দিয়ে ফিরবেন।


কসাইয়ের দোকান পাহাড়ের মাঝামাঝি। লোকটার গোঁফের বাহার আছে, মানতেই হবে। জানলাম উনি এখানের বিজেপির নেতা। খাসি বানাতে বানাতে এই ‘মুসলিম ভাই’ এর সাথে গল্প জুটলেন। জানলাম তার বাড়ি শ্রীনগর। আমরা সেদিকেও যাবো শুনে খুশি হয়ে বললেন- "এরচেয়ে সুন্দর জায়গা আর কোথাও খুঁজে পাবেন না"! একই দাবি বেলাল ভাইও তার বাড়ি পেহেলগাঁও কে নিয়ে করলেন। মাংস বানানো শেষে কসাই-ভাই জিজ্ঞেস করলেন আমরা কেমন খেতে পারি। আমার সলজ্জ্ব জবাব শুনে বেলাল ভাইকে আরো মাংস নিতে জোরাজুরি শুরু করলেন। এবং ফেরার সময় বারবার মনে করিয়ে দিতে থাকলেন যে এটা কচি খাসির মাংস। বেশিক্ষন যাতে রান্না না করা হয়।


রাতের খাবারের চিন্তা দূর করে প্রথমবারের মত আয়োজন করে বের হলাম সবাই শীমলায় ঘুরতে। মানুষের অভাব নেই, অথচ অদ্ভুত শান্ত একটা শহর। কোন যানবাহনের প্রবেশ নেই বলে মনে হয় এই নিস্তব্ধতা। মানুষজন আইনের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। শীমলার যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে দারুণ লেগেছে তা হল এই শহরে ধূমপান এবং থুথু নিক্ষেপের জন্য সমান জরিমানা রাখা হয়েছে। এই ফ্যাক্টটা অবশ্য ধূমপায়ী বন্ধুগণ বিশেষ ভালো চোখে দেখলো না।


হীমালয়ের দক্ষিন-পশ্চিম রেঞ্জে পড়েছে শীমলা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা আট হাজার ফুটের কাছাকাছি। পর্যটনকে কেন্দ্র করেই সবকিছু। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার গ্রীষ্মকালীন রাজধানী ছিল এই শীমলা। বাড়িঘর গুলোতেও তাই ব্রিটিশ আর্কিটেকচারের ছাপ স্পষ্ট। স্থানীয় লোকজন এবং পর্যটকদের সময় কাটানোর প্রিয় জায়গা মল রোড এবং রিজ। রিজ হচ্ছে শীমলার একেবারে কেন্দ্রস্থলে একটা খোলা চত্বর। চারপাশের রেলিং এর বাইরে যদ্দুর চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। থ্রি-ইডিয়টস মুভির বেশ কিছু দৃশ্য শ্যুট করা হয়েছিল মল আর রিজে। রিজে আছে ভারতের প্রাচীনতম চার্চগুলোর একটি- ক্রাইস্ট চার্চ। স্টেট লাইব্রেরীটাও এখানে। চত্বরটা দারুণ প্রাণবন্ত। পরিবার নিয়ে ঘোরার জন্য এরচেয়ে ভালো জায়গা আর হতেই পারেনা।


রিজের রাস্তা ধরে সামান্য হাঁটলেই মল রোড। এই দুই জায়গার সংযোগস্থলের বেশ মজার একটা নাম আছে- স্ক্যান্ডাল পয়েন্ট। পেছনের ইতিহাসটাও বেশ মজার। ব্রিটিশ ভাইসরয়ের মেয়ে এক ইন্ডিয়ান মহারাজার সাথে পালিয়ে যাওয়ার স্ক্যান্ডালকে স্মরণ করে এই নামকরণ। ভালো খাবারের দোকান, পানশালা, শপিং-সবকিছুর জন্যই ওই এক জায়গা- মল রোড। স্থানীয় কেনাকাটার জিনিসের মাঝে আছে পোশাক,ফল, মাটির জিনিসপত্র এইসব।


হাঁটতে হাঁটতে মল রোড এক জায়গায় দুভাগে ভাগ হয়ে যায়- একটা উপরে উঠে যায় আরেকটা নীচের দিকে। আমরা নীচের দিকে রওনা দিলাম। একেবারে নিশ্চুপ জনপদ ধরে হেঁটে যেতে যেতে শীমলার প্রতি মুগ্ধতা বেড়েই চলেছিল। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে দিয়ে এসময় আজিম ‘পাহাড় থেকে পড়লে মানুষের কি হবে’ শীর্ষক এক থিওরী দিয়ে বসলো। এই থিওরীর জন্য পৃথিবী এখনো প্রস্তুত নয় বলে জিনিসটা আর বিস্তারিত বলছি না। হোটেলে ফেরার আগে ঢুকলাম ইন্ডিয়ান কফি হাউজে। জায়গাটার মধ্যে একটা ক্লাসি ভাব আছে। এখানে সবকিছুই একদম সময়ানুযায়ী হয়। আমরা কফি শেষ করার আগেই দেখলাম দোকান বন্ধের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।


ক্রাইস্ট চার্চ এবং রাতের শীমলা


রাতের খাবার সার্ভ করা হল। রুমের ফ্লোরেই প্লেট বিছিয়ে বসে পড়লাম। ভালো কিছুই আশা করেছিলাম, কিন্তু এতটা নয়! মেন্যুঃ মাখা মাখা খাসি, ডাল, সব্জি, চাপাতি, ভাত। ঝাঁপিয়ে পড়লাম রীতিমত। প্রতিটা খাবারই অসাধারণ! বিশেষ করে খাসির মাংসটা ইন্ডিয়ায় থাকাকালীন আমার খাওয়া সেরা খাবার...হ্যান্ডস ডাউন। পরে জানা গেল আমাদের জন্য এক বাঙ্গালী বাবুর্চিই এই স্পেশাল রান্না করেছে। লোকটার হাত বাঁধিয়ে রাখা উচিত ছিল। আমরা একেক রাউন্ড শেষ করি আর বেলাল ভাই নতুন চালান নিয়ে আসেন। খেতে খেতে ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছিলাম বারবার। একসময় বেলাল ভাইকে বলতেই হলো- ভাই, আর পারবো না। ভরপেটে কিছুক্ষণ জাবর কেটে ঘুমাতে গেলাম সবাই। ঘুম যে কতোটা ভালো হলো তা গ্রুপের 'পায়েস ঠাকুর' কে জিজ্ঞেস করে নিবেন।


ইন্ডিয়ায় যে খাবারটা সবচেয়ে বেশী উপভোগ করেছি সেটারই কোন ছবি তোলা হয়নি। তবু স্মৃতি রাখতে ২ মেগাপিক্সেল ক্যামেরায় খাবারের ধ্বংসাবশেষের ছবিটাই দিয়ে রাখি...


২২.০৭.১৪


সূর্যদয়ের আগেই ঘুম থেকে উঠলাম। জনপদ তখনো জেগে উঠে নি, কিন্তু বাঁদরের দল জেগে উঠেছে। এক শিশু বাঁদরের ছবি তুলতে গিয়ে মা বাঁদরের তাড়া খেয়ে বাঁদর-ফটোগ্রাফিতে ক্ষান্ত দিলাম। দূর আকাশে রংধনু, আরামদায়ক ঠান্ডা বাতাস, পূর্ব দিগন্তে উদিয়ময়ান সূর্য- সবকিছু মিলিয়ে সকালের রিজ এক অপার্থিব জায়গা! আগের রাতের রাস্তা ধরেই আবার হাঁটা শুরু হল। টাউন হল পার হয়ে আবারো সেই দুমুখো রাস্তায় এসে পড়লাম। এবার উপরের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। স্কুলের বাচ্চাদের ব্যাস্ততা শুরু হয়ে গেছে। কিছুদূর হাঁটার পর পড়লো কালিবাড়ী মন্দির। তারও সামনে আরেকটুখানি খোলা জায়গা রেলিং দিয়ে ঘেরা। দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে আরেকটু সময় পার করে ফিরতি পথ ধরলাম।


সকালের শীমলা। রিজ, ক্রাইস্ট চার্চ, স্টেস্টস লাইব্রেরী ও তার আশপাশ


হোটেলে ফিরেই আবার যাত্রার তোড়জোড় শুরু হল। বেলাল ভাইকে খুঁজলাম বখসিস দেয়ার জন্য। কিন্তু তার দেখা পেলাম না। এত সেবা করেও কোন বখসিস আশা করেনি লোকটা, ভাবতেই লোকটার প্রতি টানটা আরো বেড়ে গেল। কুফরি যাওয়ার প্ল্যান ছিল। কিন্তু আর দেরী করলে মানালী পৌঁছাতে বেশ দেরী হয়ে যাবে বলে সে প্ল্যান বাদ দিতে হল। ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে দেখি পুরা শহর মেঘে ঘোলাটে হয়ে আছে। তার মাঝেই পাহাড় বেয়ে নামা শুরু হল। শেষবারের মত শীমলার দিকে চোখ বুলিয়ে শপথ করলাম কোন একদিন ফিরে আসার।


বিদায় শীমলা



পাহাড়ের নীচে প্রথমবারের মত দেখা হল আমাদের ড্রাইভার রাহুল ভাইয়ের সাথে। কি? হিন্দি সিনেমার নায়কদের সবচেয়ে কমন নামের সাথে মিলে গেল? লোকটাকে দেখে প্রথমেই মাথায় যা আসলো তা হল the coolest man alive! ব্যাগ পেছনে ফেলে গাড়িতে চড়লাম সবাই। রাহুল ভাই অচেনা ভাষার স্থানীয় গান চালিয়ে দিলেন। সবমিলিয়ে এর চাইতে ভালো কিছু আর চাইতে পারতাম না। নাভিন পালকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলাম কথা রাখার জন্য, রাহুল ভাই লোকটা যথেষ্ট বন্ধুসুলভ। উত্তেজনায় চিৎকার-চেঁচামিচি করতে করতে চললাম দশ যুবা মানালীর পথে......সাথে আছে রাহুল ভাই, যাকে আজিম “স্রেফ বন্ধু” হিসেবে নিতে পারেনি...সেসব গল্প আরেকদিন...


*কিছু ছবি রাবা থেকে ধার করা
*মূল লেখা এখানে

এরপরের লেখাঃ ভারতভ্রমণঃ মানালী

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০১৫ রাত ৯:০৫
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×