somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সবুজ

২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ঝন্টু আর ময়না। এই ৯/১০ বছরের বালক বালিকার মধ্যে সখ্যতা বেশ। পাড়ায় এই দুটি চাচাতো ভাই বোনের মধ্যে যে সখ্যতা তা খুব কমই দেখা যায়। সারাদিন ছুটোছুটি আর জগতের সব খেলনা নিয়ে তাদের ব্যাস্ততার শেষ নেই। কালাম বেপারী ও সালাম বেপারী, দুই ভাইয়ের এই ছেলে মেয়ে দুটি ছোট থেকেই পিঠাপিঠি বড় হয়েছে। গ্রামেরই ও মাথায় যে প্রাইমারী স্কুল আছে ওখানেই দুজনের পড়াশোনা। সরকারী স্কুল বলেই যাওয়া হচ্ছে। তা না হলে টানাটানির সংসারে বাবা কালাম বেপারীর সাথেই নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া হত নদীতে। আর ময়না হয়তো শৈশবের কিছুদিন খেলাধুলায় কাটিয়ে মায়ের সাথে গেরস্থালী কাজে নেমে যেত। তবুও ভাগ্য এই পর্যন্ত ওদের পক্ষেই আছে বলা যায়। নামেমাত্র স্কুলে ভর্তি, প্রতিদিন আসা যাওয়া। এই আসা যাওয়ার মাঝেই যে এদের বিনোদনের শেষ নেই । কোনদিন মোল্লার বাগানের পেয়ারা, কোনদিন গোলদারদের বাগানের গাব, আবার ফরাজিদের গাছের আম না কুড়িয়ে এদের দিন যেত না। ছোট গাছ দেখে সুযোগ পেলে গাছে ঝন্টুর উঠতে লাগতো এক কি দুই মিনিট। নিচে দাড়িয়ে তা কুড়াতো ময়না। ভাগাভাগির ব্যাপারে সমানে সমান। তবে ঝন্টু যদি কোন রকমে টের পেত ময়না কোনভাবে দুই একটা সাবাড় করেছে তবে গাছের ওপর থেকেই চাপা স্বরে আওয়াজ আসতো “আমি কিন্তু দেখছি, তুই কয়টা খাইছস”। আর নিচে নেমে বাকিগুলোর মধ্যে ভাগাভাগি হত আঠার-বিশ। মাঝে মাঝে হয়ত ময়নাকে আবার পরে কিছুটা পুষিয়ে দিত ঝন্টু।
স্কুল থেকে ফিরেও তখন হয়তো দুজনের মধ্যে আর বাকি সময় কেটেছে বিলে খালে ঘরাঘুরি করে। ওদের মায়েরা এসব নিয়ে ভাবেনা। সাঁতার জানে ওরা। তাছাড়া গ্রামের সবাই ওদের চেনে, তাই হারিয়ে যাবার ভয় কখনই ওদের মায়েদের মনেই আসেনা। তাছাড়া সংসারের কাজকর্ম করেই দিন পার। অতো চিন্তা করার সময় কই। দিন শেষে বাড়ি ফিরবেই হয়তো কোনদিন ঘুঘুর ছানা নিয়ে। এসে আবার কোনদিন বড়শি নিয়ে বেরিয়ে পরত দুজন। মাছ ধরলে ভাগ টা সমান হয়না। তবে সেখানে ময়নার কোন আপত্তি থাকেনা। ময়নার মতে “” ভাইয়াই তো সব মাছ ধরে”।
সন্ধ্যা কুপি জ্বালানোর সাথে সাথে উচ্চস্বরে আওয়াজ পাওয়া যায় দু ঘর থেকেই। একটু পরেই দুই এক ঘা আওয়াজ আসে পিঠে কিল পরার সাথে সাথে ওদের মায়েদের গলার আওয়াজ শোনা যায় “কই ছিলি, কি করছিলি সারাদিন? অহন যে পড়তে পারস না? ”। কিছুক্ষণ চিৎকার করে কান্নাকাটি। তারপরে আবার চুপ। রাত ৮/৯ টা বাজতেই গভীর রাতের নিরবতা নেমে আসে বেপারী বাড়িতে।
পরের দিন আবার একই কাজ। এই চক্রেই বেশ ভালোভাবেই কাটে ওদের দিন। তবে ওদের সমবয়সী কলিম, সামসু, আঙ্গুরি , লাইলি সামাদ নামের আরও যে কয়েকটি ছেলে মেয়ে আছে তাদের সাথে ওদের চলাফেরা থাকেলও ঝন্টু আর ময়না নিজেদের নিয়েই বেশি খুশি থাকে। ফলে সারাদিন কিছুটা সময় ওদের সাথে কাটালেও বাকি সময় এই দুটি ভাইবোনের ব্যস্ততার শেষ নেই। গ্রীষ্ম, বর্ষা শীত ওদের কাছে কিছুই না।
শীতে গাছের বড়ই, আর ঝরা পাতা কুড়াতে ওদের ওদের ভুল হয়না। আর তাই প্রতিদিন এই ভাই-বোন দুটির হাতে আরও দেখা যায় ঝাড়ু আর ছোট ঝাকা। কোনদিন রেইনট্রি, আবার কোনদিন মেহগনি গাছের পাতা কুড়িয়ে দুইজনে দুই ঝাকা পাতা মাথায় নিয়ে ঘরে ফেরে। এরই মাঝে কোন বড়ই গাছ পেলেই অন্তত ঢিল না ছুড়ে আর কাঁচাপাকা দুই চারটা বড়ই না নিয়ে এরা ফিরবে না।
এরই মাঝে একদিন এই দুই ভাই বোনের মধ্যে বিশাল ঝগড়া বেধে গেল। ঝগড়ার বিষয় খুবই সামান্য নয়। মেহগনি গাছের পাতা। ঝন্টু ছোট একটা মেহগনি গাছের পাতা শুকনা দেখে। আর তাই গাছে চড়ে ডাল ঝুলিয়ে পাতা ফেলেছে। একটু পরেই কুড়িয়ে নিয়ে যাবে, এই ভেবে সে অন্য দিকে গেল। কিন্তু এই ফাকেই ময়না ঐ পাতা কুড়িয়ে তার ঝাকায় ভরে ফেলেছে। ঝন্টু পাতা না পেয়ে ময়নাকে জিজ্ঞাসা করতেই জেনে গেল ঐ পাতা এখন ময়নার দখলে। আর কি। শুরু হয়ে গেল এদের ঝগড়া। একসময় ঝন্টু ময়নাকে খামচি দিয়ে বসলো। হাতের বড় বড় নখ। ওমনি আচরের দাগ হয়ে গেল হাতে। কাঁদতে কাঁদতে ময়না যখন বাড়ি ফিরল এই নিয়ে দুই জা এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল ঝগড়া।
ময়নার মা চেচিয়ে যখন বলল , “কি রাক্ষইস্যা পোলা। খামচাইয়া গায়ের মাংস খাবলাইয়া নিছে” ওমনি ঝন্টুর মায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল। চিৎকার চেঁচামেচিতে একসময় এমন অবস্থা যে আশে পাশের দুই এক বাড়ির মহিলা পুরুষ জড়ো হয়ে গেল। কেউ দাড়িয়ে এদের কথা শুনে হাসছে আবার কেউবা থামানোর চেষ্টা করছে। তবুও থামাতে চাইলেই তো আর সহজে থামেনা। এদিকে ঝন্টু বাড়িতে এসেই যখন দেখল এই অবস্থা তখন দৌড়ে পালাতে গিয়েও আর পালাতে পারল না ওর মায়ের হাত থেকে। “তোরে কে কইছিল ঐ মাইয়ারে লইয়া পাতা কুড়াইতে যাইতে ? ক্যান তুই আমার দিয়া আইজ ঝগড়া করাইলি ?” এই বলে ধুম ধাম কয়েক ঘা যখন ঝন্টুর পিঠে দিল আর ঝন্টু যখন কাঁদতে কাঁদতে বলছিল “আর মাইরেন না। আর জামুনা ওরে লইয়া। ”, তখনি ময়নার কান্না আর ওর মায়ের চিৎকার থেমে গেল । দেখে কেন জানি ময়নার খুব খারাপ লাগছে। ময়নার মায়েরও একটু খারাপ লাগছে । এভাবেই এই পাতা নিয়ে ঝগড়া এক সময় থামল ঠিকই। তবে এই ভাইবোন দুটির ওপর রেশ রয়ে গেল।
পরের দিন ঝন্টু আর ময়নাকে একসাথে কোথাও দেখা গেলো না। একা একাই স্কুলে যাওয়া আর একা একাই ফেরা। পাতা কুড়ানো , বড়ই খাওয়া বন্ধ। সারাদিন ঝন্টু এদিক সেদিক ঘুরে বেরায় আর ময়নাও ওর মায়ের সাথে থাকে। কিন্তু ওদের মায়ের জানতেও পারছে না এই দুটি ভাই বোনের মনের ভেতরের অবস্থা। ঝন্টু যাই করুক, কিন্তু একটু পর পরই ময়নার কথা মনে পড়তে লাগলো। আর ময়নাও পুতুল খেলে ঠিকই কিন্তু ভাইয়ার কথা বারবার মনে হতে লাগলো “ক্যান যে নালিশ দিতে গেলাম?” এই ভাবতে ভাবতে হাতের ওপর আঁচড়ের দিকে তাকিয়ে দেখল , একটু খানিই তো। নালিশ না দিলে তো আইজ বড়ই খাইতে পারতাম।
এই করে দুইটা দিন পার হয়ে গেল। তৃতীয় দিন দেখা গেল ঝন্টুকে। বাড়িতেই আছে। একটু পর পর ময়নাদের ঘরের দিকে উঁকিঝুকি দিতে লাগলো। ময়নাও দেখেছে ওকে। কিন্তু সে চুপচাপ পুতুল নিয়ে খেলছে। এদিকে ঝন্টু ওর চাচীর ভয়ে ও ঘরের সামনে যেতেই সাহস পাচ্ছে না। কি করবে। কোথা থেকে লাটিম একটা নিয়ে এসে উঠোনে ঘোরানোর চেষ্টা করছে। আর একটু পর পর তাকাচ্ছে।
হঠাৎ চাচিকে দেখা গেল পুকুরের দিকে যাচ্ছে , ওমনি দৌড়ে চলে গেল ময়নাদের ঘরের দিকে। গিয়ে দেখছে ময়না বারান্দায় বসে পুতুল খেলছে আর কাঁচাপাকা বড়ই খাচ্ছে।
“কি রে ময়না যাবি?”
“কই?”
“ফরাজিগো বাগানে বাদাম গাছের পাতা ঝরছে।” তারপর দুই হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল “এত বড় বড় এক একটা পাতা। যাবি কুড়াইতে?”
ময়নাও সাথে সাথে আশেপাশে একনজর চোখবুলিয়ে বলল “হ, যামু”
“তাইলে ল। এহনি যাই”
“তুই যা , আমি আইতাছি”
এই বলে ময়না ঘরের ভেতরে গেল আর ঝন্টু একটা ঝাড়ু আর ঝাকা নিয়ে বাড়ির একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো। একটু পরেই দেখা গেল ময়না কে। হাতে ঝাড়ু আর আর একটা ঝাকা। তাড়াতাড়ি ঝন্টুর দিকে এগিয়ে যেতেই ঝন্টুর গলার আওয়াজ শোনা গেল “তাড়াতাড়ি ল।” বলেই দুই ভাইবোন দিল ছুট।
পেছন থেকে ময়নার মায়ের গলার আওয়াজ শোনা গেল “ও ময়না। কই গেলিরে মা ?”
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১:৩৮
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×