somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চোখের জলে (ছোটগল্প)

০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


১.
সুবর্ণা কে দেখলাম অনেক দিন পর। ঠিক কত দিন পর দেখলাম তা আন্দাজ করে দেখলাম প্রায় বছর দুয়েক পর। একটু মোটা হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। কলেজে এসেছে, ভাইভা এক্সাম দিতে। আমিও তাই এসেছি। আশ্চর্যজনক ভাবে ওর আমার অনেক কাজেই মিল ছিল! চোখের সানগ্লাস কপালের একটু ওপরে উঠিয়ে যখন হেঁটে আসছিল তখন মনে হচ্ছিল এক মেমসাহেব। আমাকে দূর থেকে দেখেই মুচকি হেসে সামনে এগিয়ে আসছিল, যখন তখন আশে পাশের অন্তত কয়েক জোড়া চোখে যে ঠিক কি ছিল বুঝতে মোটেও কষ্ট হয়নি।
“ভালো আছো, সোহেল ?”
“হু, তুমি কেমন আছ?”
“আমিও ভালো। তা তোমার ভাইভা এক্সাম তো আজকে ? ”
“হ্যা।”
“বসবো কোথায় ? বলতো ”
“ওই পাশের ক্লাস ফাঁকা আছে। ওখানে চল।” বলেই ওকে নিয়ে এগিয়ে গেলাম। পাশ থেকেই হাসানের ফিসফিস কণ্ঠ শোনা গেল, “মামা, তোমারই কপাল।যাও মামা যাও। ক্লাস ফাঁকা আছে”। একটু বিরক্ত হলেও খুব ভালো লাগছিল এই ভেবে যে কেউ কেউ আমাকে একটু হলেও হিংসা করে।
২.
অনার্সে ভর্তি হবার মাস তিনেক পর ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিল। মহসিন স্যারের কাছে একাউন্টিং, ফিন্যান্স পড়ার সময় একসাথেই, একই দিনেই আর একই বেঞ্চেই প্রথমবার বসেছিলাম। ভালো লেগেছিল। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই একসাথে বসা হত। উহু, কোন টান থেকে না। স্যারের কাছে সকালে পড়তে যাওয়ার সময় প্রায়ই আমার লেট হত । ফলাফল সবচেয়ে পেছনের বেঞ্চ ছিল আমার জন্য বরাদ্দ। তাছাড়া ফাঁকাও থাকত। কারন মেয়েরা সামনের দিকের বাম পাশের বেঞ্চে বসতো, আর তাতে সামনের দিকের বেঞ্চে চাপাচাপি করে হলেও সেখানে বসতে আগ্রহ ছিল ছেলেদের। যাই হোক, পড়তে যেতে যে শুধু আমার একার লেট হত তা না, সুবর্ণারও একই অবস্থা। প্রায় প্রতিদিন লেট। আর বসতেও হত প্রায় প্রতিদিনই একসাথে। বন্ধু মাহমুদ এটাকে ঠিক কি মনে করেছিল জানিনা, তবে একদিন আগে এসেও দেখি সামনের সিট খালি রেখে মাহমুদ পেছনের বেঞ্চে বসা। কিন্তু বেচারার কি কপাল, সেদিন সুবর্ণা পড়তেই আসেনি!
পড়া শেষে আমাকে জিজ্ঞেস করল “তুই কি জানতি, আজ সুবর্ণা আসবে না ?
” বললাম “না”। “তাহলে তুই আজ আগে আসলি, আর সুবর্ণা আজ আসলই না কেন ?”
“তার আমি কি জানি” বলেই মুচকি মুচকি হাসছিলাম।
শুধু মাহমুদ না, জাকির, নাইম , হাসান, শফিক, মাধবী সহ অনেকেই আমাদের একসাথে পেছনে বসা নিয়ে হাসতো আর অনেক কথা বলতো। তবে তা আমার সামনে, সুবর্ণা এসব জানতেও পারেনি। ওদের সন্দেহ, আমার সাথে সুবর্ণার ইয়ে চলছে। কিন্তু বোঝাতেই পারিনি, এসব কিছুই নেই।
অবশ্য ওদের দোষ দেয়া যায়না। প্রায় প্রতিদিনই একসাথে বসা, শুধুমাত্র আমার সাথেই ফোন নাম্বার শেয়ার করা, আমাকেই এটা সেটার কথা বলা, এরকম অনেক বিষয় আছে যেগুলোর ঠিক কারন খুঁজে পেতাম না। এমনকি ওর ডাক নাম যে পান্না, সেটা কেবল আমিই জানতাম। একদিন ওর কানের রিং খুলে যখন আমার হাতে দিল তখনও সবার চোখে এটা পড়েছে । একদিন এক ভুলের কারণে সন্দেহ আরও বেড়ে গেল ওদের। স্যারের কাছে আগের ব্যাচ পড়া শেষ না হতেই আমরা অনেকেই পাশের রুমে ওয়েট করছিলাম। তখন কি মনে করে, আমার ব্যাগের পকেট থেকে চিরুনি বের করে, ওর ওড়নার সামনের দিকে যে গ্লাস লাগানো ছিল, সেখানে তাকিয়ে মাথা আঁচড়াতে শুরু করলাম। যখন মাথা আঁচড়ানো শেষ, তখন দেখি বন্ধুদের সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। এমনকি চোখ বড়বড় করে সুবর্ণাও তাকিয়েছিল। যখন বুঝলাম, তখন মাথা নিচু করা ছাড়া আর উপায় ছিল না। ও কিচ্ছু বলেনি। তবে বন্ধুদের মধ্যে এ নিয়ে যে বিস্তর রসালো আলাপ হয়েছিল, তা শুনেছি। তবে আমি যতই অস্বীকার করি না কেন, ওদের প্রশ্নের উত্তরও আমি পাইনি। জানিনা আমারই কি এমন গুণ , আর ওদেরই কি এমন দোষ ! একদিন সেলিম সুবর্ণার সাথে কথা বলবে বলে আমার কাছ থেকে ফোন নাম্বার নিল। বেচার দুই মিনিট কথা বলার পরে ফোন যখন রাখল, তারপরেই আমার কাছে সুবর্ণার ফোন এল । “তুমি সেলিম কে আমার ফোন নাম্বার দিয়েছ।”
“হ্যা”
“কেন দিয়েছ ?”
“সেলিম তোমার সাথে কথা বলতে চাইল তাই। ”
“আর কাউকে দিবানা। দরকার হলে আমিই দেব।” বলেই লাইন টা কেটে দিল। সেলিম কে বলার পর সেলিম এ কথা সবাইকে বলে দেয়াতে, এখন সবাই হান্ড্রেড পারসেন্ট নিশ্চিত হয়ে গেল , সোহেল আর সুবর্ণা ইয়ে করে! আর সুবর্ণা যা বলতো আমিও তাই শুনতাম। একদিন রোদের মধ্যে তিন ঘণ্টা দাড় করিয়ে রেখে কই যে গেল বুঝলাম না। তবে যখন এল তখনও আমি ঠায় দাঁড়ানো। ও আসছিল, সাথে ওর আরেক বান্ধবী, হাতে পেপসির বোতল। মাথায় সানগ্লাসটা উঠিয়ে রেখে গটগট করে যখন হেঁটে আসছিল ঠিক তখন কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়েছিল, সামনে এসে আমাকে হাতের পেপসির বোতল সেধে বলল “নাও, খাও”।
“না, আমি খাবনা। তুমিই খাও। ”
“আরে আমি বোতলে মুখ লাগাইনি।” বলেই হাসছিল। মনেমনে তখন ভাবছিলাম, মুখ লাগাইলেই ভালো হইত। এই পেপসিতে আমার গলা ভিজবে না। ঠিক সেদিনই প্রথম সুবর্ণার প্রতি আমার এই অনুভূতি হয়েছিল কেন জানিনা। তবে এটুকু জানি, কোথায় যেন ওর সাথে একটা টান ছিল , যার অদৃশ্য বাঁধনে একসাথেই কিছুদিন কেটেছিল আমাদের।
অনার্সের থার্ড ইয়ার থেকেই ওর সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ। কেন হল ? তাও জানিনা। তবে মহসিন স্যারের কাছ থেকে চলে আসা , আর মাঝখানে আমি অসুস্থ হয়ে কয়েকমাস বাড়িতে থাকা, আবার মোবাইল হারিয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো পরপর এমন ভাবেই ঘটেছে যে, সে থেকেই যোগাযোগ বন্ধ। এমনিতে দু পক্ষ থেকেই ফোনের যোগাযোগ আগে থেকেই একটু কমে এসেছিল।তারপর এক সময় বন্ধ। এরপর থেকে প্রতি বছর এক্সাম ছাড়া ওর সাথে আর দেখা হয়নি।
৩.
আজ এতদিন পরে মাস্টার্সের ভাইভা এক্সামের সময় যখন আবার দেখা হল, সেই সুবর্ণাকেই পেলাম, যাকে হারিয়েছিলাম চার বছর আগে।
সামনা সামনি বসলাম ওর। ঠিক কি বলা যেতে পারে বুঝতে পারছিলাম না। জড়তা ভেঙ্গে দিল ও নিজেই।
“কি অবস্থা তোমার ? সবকিছু ঠিকঠাক চলছে তো ”
“হ্যা। তোমার কি খবর ? ”
“ভালো। বিয়ে করেছি ছয়মাস হল। ” হাসতে হাসতে বলল। আমি যেন একটু চমকিত হলাম ! মুখ ফসকে বেরিয়েই এল “বিয়ে করেছ!”
“হুমম। আর কত দেরি করবো বলো ? এরেঞ্জ ম্যারেজ । হঠাৎ করেই হয়েছে কাউকে জানাতে পারিনি। ও এসিস্ট্যান্ট কমিশনার। এখন চিটাগাং কাস্টমে আছে”।
“খুবই ভালো। তোমার উপযুক্ত পাত্রই পেয়েছ। ”! ” বললাম।
“ একমিনিট, তোমাকে দেখাচ্ছি। ” বলেই হাতের মোবাইলটা চাপতে লাগলো।
এর মধ্যেই বন্ধু জাহিদ এসে হাজির। এসে পাশেই বসলো। সুবর্ণা তখন হাতের মোবাইলের এক ফোল্ডারে রাখা কিছু ছবি বের করে মোবাইল টা আমার হাতে দিয়ে বলল “দেখত। কেমন লাগছে ? ” বলেই পাশে বসে থাকা জাহিদকে দেখিয়ে বলল “সোহেল, ছবি কিন্তু তুমি একাই দেখবে। জাহিদ কে দেখাবে না। ” বলে হাসছিল। তবে জাহিদও ওই দলের, যারা কিনা আমার আর সুবর্ণাকে নিয়ে রসে সিক্ত হয়েছিল। তাই কিছু মনে করলো না, হাসতে হাসতে চলে যেতে বলছিল “যা খুশি দেখ। আমরা বাইরে আছি। কিছু লাগলে বলিস।”। সুবর্ণা শুনেছে, তবে এসব নিয়ে পাত্তা দেবার মত মেয়ে না। তাই কিছু বললও না।
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখি, ওর সাথে ওর হাজবেন্ডের একসাথে তোলা অনেক ছবি ছবি। কত রঙে, কত ঢঙে। দুই একটা খুবই পার্সোনাল বলা চলে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও ভাবলেসহীন। আমি দেখতেই থাকলাম, তবে একটু খারাপ লাগছিল। কেন ? ঠিক জানিনা।
এভাবে ঘণ্টাখানেক সময় চলে যাবার পরে আমাদের ভাইভার সময় যখন হয়ে গেল, তখন জাহিদ ডাক দিল। উঠলাম দুজনেই। একনজর তাকালাম ওর দিকে। চোখে সামান্য জল দেখতে পেলাম। সাথে সাথে মাথা নিচু করে ফেলল ও । আড়াল করার চেষ্টা করছে হয়তো। ক্লাসরুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বুঝতে পারলাম সুবর্ণাকে বুঝতে আমার এতো দেরি হল যে, শেষ বেলায় মুখের হাসি না, চোখের জলই পুরুস্কার পেলাম।


সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:১৩
৬টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×