somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড়পা (ছোটগল্প)

০৯ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১.
বাসায় খুশির আমেজ লেগেছে। তবুও সবাই ব্যাস্ত। এটা কিনতে কেউ শপিঙে, ওটা আনতে কেউ ওখানে। সবাই খুব ব্যস্ত, তবুও কারও মধ্যেই ক্লান্তির ছাপ বলতে কিছু নেই। গ্রাম থেকে দাদা দাদু, ফুপুরা এসেছেন। রাতুলের বাবা আর ওর ছোট চাচার দম ফেলার সময় টুকু নেই। চার দিন বাদেই রিনির বিয়ে। রিনি বিয়ের পাত্রী ঠিকই, তবুও ঘরের কাজে এতটুকু বিরাম নেই ওর। শুধু কাজ নেউ রাতুলের। নেই বললে ভুল হবে। যে কাজ ওকে দেয়া হয়, তা শেষ হতে সময় লাগেনা। বাকি সময় ফ্রি। দুই ভাই বোনের মধ্যে ওই ছোট । ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। রিনি ওর চার বছরের বড়। তবুও সবাই ওকে ছোট বলে তাই ওর বিস্তর আপত্তি। “আমি এখনও ছোট হই কিভাবে ?” এই নিয়ে মাঝে দুই একবার মায়ের সাথে তর্কও বেধে যায় রাতুলের।
ক’দিন থেকে বাসায় এতো মানুষ , তবুও হঠাৎ করেই নিজেকে খুব একা একা লাগছে রাতুলের। আপার বিয়ে, খুশি হবে ওই সবচেয়ে বেশি। অথচ এই কদিন থেকেই ওর কেবলই মনে হতে থাকলো, “আপার বিয়ে আর কিছুদিন পড়ে হলেই তো ভালো হয়। কি এমন হল যে এখনই বিয়ে দিতে হবে। দেশে কি সুমন ভাই একাই কি সেরা নাকি ? খুঁজলে অরকম হাজারটা সুমন ভাই পাওয়া যাবে। তবুও বাবা, আপাকে কেন যে বিয়ে দিতে উঠে পরে লেগেছে কে জানে। আর মা তো খুশিতে আটখানা। সারাদিন সুমন ভাইর গুণকীর্তন করে করেই শেষ, মনে হয় আপা যেন, সুমন ভাইর কাছে কিছুই না। যত্তোসব !” এদিকে রিনির বিয়ে হয়ে গেলে, ও যে একা একা কি করে কাটাবে তাই ভাবতে পারছেনা। এমিনিতেই সারাদিন বাসায় না থাকলেও, এখন কেবলি মনে হতে থাকলো, “যদি কোন রকমে আপার বিয়েটা আর কিছু দেরীতে হত, তবে এখন থেকে যতক্ষণ সময় পারা যায়, আপার সাথেই থাকবে ও।”
কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না রাতুল। ঘুরেফিরে বাসায় ফিরেই রিনির রুমের দিকে ছুটল রাতুল। রিনি তখন ঘর গোছাতে ব্যস্ত। তবুও রাতুলকে আড়চোখে রুমে ঢুকতে দেখেই বুঝল, কিছু বলবে ও। কিছুক্ষণ চুপ করে রিনির কাজ দেখছে আর ভাবছে “আপা এতো কাজ শিখল কবে!” রিনিও আপন মনে কাজ করছে ।
“কিরে, কি ব্যাপার?” কাজের ফাঁকেই জিজ্ঞাসা করল রিনি।
“কিছু না” ছোট জবাব রাতুলের। রিনি বুঝল, রাতুল কিছু বলবে। রাতুল যতই বলুক, কিছু না হলে রাতুল ওর কাছে আসবে এমন না।
“টাকা লাগবে ? টেবিলের নিচে রাখা আছে। ওখান থেকে নে।”
“তোর কাছে টাকা চাইতে এসেছে কে ?” শুকনা গলায় জবাব দিল রাতুল।
“বাব্বাহ, একেবারে বড়লোক হয়ে গেলি নাকি ?” বলেই রাতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে আবারও বলল “কিছু বলার থাকলে বল।”
এরমধ্যে পাশের বাসার তুলি এলো ওদের বাসায়। ক্লাস নাইনে পড়ে। “রিনি আপু, রিনি আপু” বলে ডাকতে ডাকতে, রিনির রুমে ঢুকতে গিয়ে রাতুলকে দেখে খানিকটা লজ্জা পেল তুলি। আড়চোখে রিনি তুলির এই অবস্থা দেখে যা বোঝার বুঝে নিল। ক,দিন থেকেই রাতুল আর তুলির এই ব্যাপারটা খেয়াল করছে রিনি। তবুও কিছু না বলে মুচকি মুচকি হাসছিল রিনি। তুলি রুমে না ঢুকে দরজার পাশ থেকে দাড়িয়ে বলল “রিনি আপু, তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে। পরে বলবো” বলেই দ্রুত চলে গেল । রাতুল একনজর শুধু দেখল তুলিকে। তুলি চলে যেতেই রিনি বলে উঠলো “ কিরে, তুলি চলে গেল কেন?” সাথে সাথেই রাতুল বলে উঠলো “তার আমি কি জানি ?”
“তুই কিছু জানিস না ? খুব চালাক মনে করিস নিজেকে, তাইনা ? আমি কিচ্ছু বুঝিনা?” বলেই রিনি ভাইর দিকে তাকিয়ে হেসে দিল।
“তুই ঘোড়ার ডিম বুঝিস” ফোঁসফোঁস করে উঠলো রাতুল ।
“তুলিকে বিয়ে করবি? আব্বুকে বলবো ?” হাসতে হাসতে বলল রিনি।
“আপা, খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু। যা তুই, এখনই সুমন ভাইদের বাসায় চলে যা।” রেগে গেল রাতুল।
“তাহলে খুব সুবিধাই হবে তাইনারে ? কেউ কিচ্ছু জানবে না। ” মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল আবারও।
এবার আর রাতুল পারল না। বিছানা থেকে বালিশটা ছুরে ফেলে দিয়েই রুম থেকে বেড়িয়ে গেল ।
২.
দুইদিন হল ক্লাসে যাচ্ছে না রাতুল। বাসায় এই পরিবেশ রেখে কার ক্লাস করতে ভালো লাগে ? তাছাড়া কালকেই রিনির বিয়ে। রাতটুকুই শধু বাকি। সবকিছুই মোটামুটি আয়োজন করা শেষ। গ্রাম থেকে আরও যে মেহমানরা এসেছে তাতে বাসায় তিল ধরার ঠাই নেই। কেউ কেউ আবার রফিক চাচার বাসায় উঠেছে। সারাদিন ঘুরেফিরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে, বাসায় ঠিক কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না রাতুল। রিনির রুমের দিকে উঁকি দিতেই দেখল কাজিনরা সবাই খাটের ওপর বসে রিনি কে নিয়ে গল্প করতে ব্যস্ত। এতো ভিড়ের মাঝে রাতুল কেন যেন নিজেকে একা একা ভাবছে । রাতুলকে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে রিনিই আগে বলে উঠলো “কিরে কিছু বলবি ?” চুপ করে রইল রাতুল। “কিরে কিছু বলছিস না যে ?” খানিকটা ধমকের সুরেই বলে উঠলো রিনি। রুমে একটু চুপ করে থেকে রাতুল বলে উঠলো “আপা, তোর কি সত্যি সত্যিই বিয়ে ? ” প্রশ্ন শুনেই সবাই রাতুলের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, সাথে রিনিও । কারও মুখে কোন কথা আসছে না। রিনি অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রাতুলের দিকে। “তুই কি বিয়ের পরে, সাথে সাথেই সুমন ভাইদের বাসায় চলে যাবি?ওই বাসায় না গিয়ে, তাকে নিয়ে আমাদের বাসায় থাকতে পারিস না? ” আবারও জিজ্ঞাসা করল রাতুল। রিনি এবার আর সত্যি চুপ করে থাকতে পারল না। খাট থেকে নেমে রাতুলকে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিল রিনি। রাতুলও কাদছে। নীরবে। “না, আমি যাবো না। না, আমি যাবো না । ” কাঁদতে কাঁদতেই কোন রকমে রিনি বলছে রিনি। কান্নার আওয়াজ শুনে পাশের রুম থেকে ছুটে এল মা আর ফুপু সহ সবাই। দু ভাইবোন কে এভাবে কাঁদতে দেখে সবাই বুঝে নিলেনে কি হয়েছে। রাতুলের মা, ছেলের সাথে সাথে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কাঁদতে লাগলেন। কোন রকমে সবাই তাদেরকে শান্ত করতে চেষ্টা করছিল। এগিয়ে এলো রাতুলের ছোট ফুপু। এসে রাতুলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল “বিয়ে হলে কি তোর আপা পর হয়ে যাবে ? না। তুই তো একটা ভাইও পাবি। তোরই তো লাভ। রিনি দুইদিন পরপর চলে আসবে।” যতই সবাই বোঝাক, রিনিকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল রাতুল, চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো “না, আপা কোথাও যেতে পারবে না, আপা কোথাও যেতে পারবে না ”
৩.
চিৎকার শুনে মাঝ রাতে পাশের রুম থেকে ছুটে এলো রাতুলের বাবা মা। এসে দেখল, ঘুমের ঘোরে শক্ত করে কোলবালিশটা জড়িয়ে ধরে রাতুল চিৎকার করে বলছে ““না, আপা কোথাও যেতে পারবে না”। কোন রকমে ছেলেকে, হাত দিয়ে নাড়া দিতেই চোখ মেলে তাকাল রাতুল। উঠে বসলো ও। কিছুটা হতভম্ভ হয়ে রইল । ওর বাবা এক গ্লাস পানি এনে রাতুলের মুখের কাছে ধরতেই ঢকঢক করে গ্লাসের পানি শেষ করে ফেলল।পাশে বসে রাতুলের মাথাটা কাঁধে রেখে কিছুক্ষণ বসে রইল, ওর মা। বসে আছে ওর বাবাও। তাকিয়ে আছে খাটের পাশে, টেবিলের ওপর রাখা ফটোফ্রেমটার দিকে। প্রায় ১০ বছর আগের এই ছবিটাই এখন রিনির একমাত্র স্মৃতি। তখন রাতুলের বয়স ছিল ছয়, আর রিনির ছিল দশ।

সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৮
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×