মাশুক ইবনে আনিস
প্রথম শ্রেণীর কবিরা ভাবগ্রাহী অথবা ভাবোন্মাদ, দ্বিতীয় শ্রেণীর কবিরা উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত। এরিস্টটল তাঁর কাব্যতত্ত্বের সপ্তদশ পরিচ্ছেদে কবির উন্মাদনার কথা স্বীকার করে বলেছেন ‘কবি কর্মের পেছনে থাকতে পারে অপার উন্মাদনা’। সক্রেটিসের জবানবন্দী গ্রন্থে প্লেটো সক্রেটিসের মুখে উচ্চারণ করেন ‘কবিরা লেখেন এক দৈব শক্তির সাহায্যে, দৈব শক্তি যেন কবির ওপর ভর করে; কোনো জ্ঞান নয়, কোনো বুদ্ধি নয়, এক অব্যাখ্যেয় প্রেরণায় কবিতার জন্ম।’ জিজ্ঞাসার ক্রমবর্ধন হতে পারে- আধুনিক কবিতা কতটুকু ভাবোন্মাদ অথবা কতটা ভাবগ্রাহী হলে কোনো রচনাকে কবিতা রূপে চিহ্নিত করা যেতে পারে এবং আধুনিক কবিতারূপে গৃহীত হতে পারে? কবিতা শুধু শান্তির জন্য নয়, কবিতা শুধু সুন্দরের জন্যও নয়; কবিতা আসলে অসুন্দরের জন্যেও। প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার এরিস্টটলের কাব্যচিন্তাকে আধুনিক বলে গ্রহণ করতে দ্বিধান্বিত নই, বা এ জন্য উত্তরাধুনিক রেখা চিহ্নসহ শিল্পের বিমানবীকীকরণত্ত্ব (ডি-হিউমেনিজম) বা ডি কস্ট্রাকশন তত্ত্বের প্রয়োজন পড়ে না। কারণ এরিস্টটলের মতে- সাহিত্য সত্য, আর সত্য থেকেই আনন্দের বিকাশ। কারণ সাহিত্য শুধু সুন্দরের নয়, অসুন্দরেরও অনুকরণ, অসুন্দরের অনুকরণও আনন্দ দেয়। কাব্যের সত্য সম্পর্কে কাব্যতত্ত্বের নবম অধ্যায়ে তিনি বলেছেন- ‘কাব্যের সত্য বিশ্বজনীন, তা কোনো বিশেষ সত্য নয়; বিশেষ সত্য ইতিহাসের, কারণ তা বিশেষ মানুষের কথা। এ জন্যই কাব্য যদিও দর্শন নয়, ইতিহাসের চেয়ে বেশি দার্শনিক বা তাৎপর্যপূর্ণ’ (অনুবাদ : শিশির কুমার দাশ)।
তৃতীয় বাংলার আধুনিক কবি ও কবিতা নিয়ে বাক্যব্যয় করার পূর্বে আমি আমার রেডব্রিজের বাড়িতে বসে সপ্রশ্ন শুধু গ্রিক নগরস্থ এরিস্টটলের বাড়ির দিকেই তাকাইনি, নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি পূর্ব-প্রকাশিত প্রবন্ধ/নিবন্ধসহ বিবিধ সংকলন ও গ্রন্থাবলিও। অনুল্লেখযোগ্য এসব রচনা বা গ্রন্থের কোথাও কোনো চিন্তা বা বুদ্ধির ব্যায়াম পরিলক্ষিত না-হওয়ায় জিজ্ঞাসা তৈরি হয়েছে- সংকলন সম্পাদকরা কি কোনো শৌর্য বীর্যহীন ভূমে বাস করছেন; পাঁচ/দশ হাজার বছর আগেকার কোনো মূর্খ-ভূমে? আতাউর রহমান মিলাদ সম্পাদিত ‘তৃতীয় বাংলার কবিতা’ গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য হলেও মৌলবাদ বিবর্জিত নয়। অন্যসব গ্রন্থে লেখকের ছবি, নাম-ঠিকানা, মোবাইল নাম্বার ও বংশপরিচয় ব্যতীত উল্লেখ করার মত কোনো কাঁচামাল অবিদ্যমান। ফিরে তাকিয়েছি, এখান থেকে প্রকাশিত লিটলম্যাগ ও বাণিজ্য কাগজের সাহিত্যপাতার দিকে। স্রোতচিহ্ন, ধীস্বর, আদি কাকতাড়ুয়া ইত্যাদি লিটলম্যাগ উল্লেখ করার মত হলেও বাণিজ্যিক কাগজের সাহিত্যপাতাকে শুধু কচিকাচার মেলাই মনে হয়নি, মনে হয়েছে কয়েক পৃষ্টা রঙিন আবর্জনা। স্মরণযোগ্য যে, শুধু ভাল ম্যাক-আপের মধ্য দিয়েই যারা দায়িত্ব সম্পাদন করেন তাঁরা সু-সম্পাদক নন, তাঁরা নিরঙ্কুশ কু-সম্পাদক।
এত মূর্খতা, মৌলবাদের মধ্যেও তৃতীয় বাংলায় মূল ধারার কবিতা চর্চা হচ্ছে- এ এক বিস্ময়কর বিষয়। ভাল লিখছেন এবং ইতোমধ্যে কবিখ্যাতি অর্জন করেছেন এবং যাদের মধ্যে ভাল-লেখার তীব্রতা উপস্থিত তাঁদেরকে নিয়ে এরকম একটি নামের তালিকা তৈরি হতে পারে কেতকী কুসারী ডাইসন, শামীম আজাদ, মুজিব ইরম, দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু, মাসুদা ভাট্টি, শাহ শামীম আহমদ, ফারুক আহমদ রনি, সুমন সুপান্থ, ওয়ালি মাহমুদ, আতাউর রহমান মিলাদ প্রমুখ।
অগ্রজ আরো যাদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখিত হতে পারে তাঁরা হলেনআব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী, কাদের মাহমুদ, অমরনাথ চক্রবর্তী, মাসুদ আহমদ, হিরন্ময় ভট্টাচার্য, সৈয়দ শাহীন, দেবব্রত চৌধুরী, সালেহা চৌধুরী প্রমুখ।
এ আলোচনায় কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কবির কবিতা নিয়ে অনুধ্যায়ী হতে চাই এবং তৎপূর্বে কবিদের নামের তালিকা বিষয়ে কিছু বাক্যব্যয় করতে চাই। হয়তো অনেকেই বিস্মিত হবেন- তৃতীয় বাংলার কবিদের নামের তালিকা আকৃতিতে এত ছোট কেন, যেখানে অন্যান্য লেখকরা প্রায় দেড়শতাধিক নামের সন্নিবেশন ঘটিয়েছেন? বলতে চাই- ঐ সব লেখকরা মূলত লিপিকার-এর দায়িত্ব পালন করেছেন, আর আমি দায়িত্বপালন করছি সমালোচকের। বলতে কুণ্ঠিত নই, ঐ সব লিপিকাররা যে শত শত নামের সমাবেশ ঘটিয়েছেন এর পেছনে যে বিষয়টি গূঢ়ভাবে কাজ করেছে, তা হল রাজনীতি। কূটিল রাজনীতি না বলে অপনীতিও বলা যেতে পারে। আর আমরা তো সকলেই জানি, জগতের অধিকাংশ অপনীতির পেছন যে চালিকা শক্তি তা হল, মৌলবাদ। কোনো মৌলবাদীর পক্ষে কবিতা রচনা অথবা সুস্থ সমালোচনা যে সম্ভব, এ আমার বোধের বাইরে। তাঁদের কবি-তালিকায়ও যে নোংরা রাজনীতি রয়েছে, তা সুস্পষ্ট; নতুবা বিলেতে বসবাসরত ছোট একটি কমিউনিটি হতে কী করে এত নামের সন্নিবেশন হয়! দৃশ্যত যা রাজনৈতিক দলের সদস্যদের তালিকার মত। স্মরণ করছি কবি ও কবিতা বিষয়ে হুমায়ূন আজাদ-এর বক্তব্যটি-‘আধুনিক বাঙলা কবিতা বিশ্বের অন্যান্য ভাষার আধুনিক কবিতার মতোই অভিনব ও বিস্ময়কর, এবং বিপর্যয়করও; তবে বিস্ময়ের মাত্রা বাঙলায় অনেক বেশি। আধুনিক বাঙলা কবিতার সাথে জড়িত একটি বিস্ময় হচ্ছে একই দশকে পাঁচজন মহৎ/প্রধান কবির জন্যে অপেক্ষা করতে হয়েছে শতাব্দীর পর শতাব্দী, তাই এক দশকে পাঁচজন মহৎ/প্রধান কবিদের তালিকাটি হবে এমন : বড়– চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, গোবিন্দ দাসপদাবলির পাঁচজন; মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, বিজয় গুপ্ত, ভারতচন্দ্র রায়মঙ্গলকাব্যের তিনজন; মাইকেল মধুসূদন দত্তমহাকাব্যের একজন; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোমান্টিক কবিতার একজন; এবং জীবনানন্দ দাশ, অমিয় চক্রবর্তী, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে আধুনিক কবিতার পাঁচজন।
পৃ. ৭; হুমায়ূন আজাদ সম্পাদিত আধুনিক বাঙলা কবিতা
উদ্ধৃতিটি উল্লেখের কারণ হল, তৃতীয় বাংলার লিপিকারদেরকে কবি ও কবিতা সম্পর্কে পরিমিতিবোধের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয়া। স্মরণ করতে চাই, এ আলোচনায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের সকলেরই এক বা একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং নিয়মিত লিখছেন। যাঁদের গ্রন্থ বের হয়নি তাঁদের নাম তালিকাভূক্ত করিনি কারণ বিচ্ছিন্ন পাঠ হতে একজন লেখক সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন দুস্কর হয়ে পড়ে। এ তালিকার বাইরে অনেকেই হয়তো ভাল লিখছেন; আমার তো মনে হয় তাঁরা তাঁদের কর্মের মধ্য দিয়ে তৃতীয় বাংলার কবি ও কবিতা সম্পর্কে আমার সিদ্ধান্ত/অনুসিদ্ধান্তগুলো শুধু ভুলই প্রমাণিত করবেন না, মহাকালে নয় নিকট-ভবিষ্যতেই আমাকে শূলদণ্ড দেবেন। যেহেতু নিজেও দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে কবিতার সঙ্গে নিরবিচ্ছিন্ন সংসার করছি, সেহেতু কোনো সু-কর্ম না হোক অনুপ্রেরণা দেবার নাম করে অতি-তরুণকে ধ্র“পদী কবি, যাদুবাস্তবতার কবি ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত করে বিভ্রান্ত করার মত দুস্কর্ম অন্তত আমাকে দিয়ে হবে না। তবে আমি দেখতে পাচ্ছি, আমার মৃত্যুর পরে তৃতীয় বাংলায় কবি জন্ম নিচ্ছেন শার্ল বোদলেয়ারের মত কবি, বিদ্যাপতি, জ্ঞানদাস, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, মালার্মে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ভিলিয়ের দ্যা লিজন আঁদ, উসম্যঁ, লোত্রেআমোঁ, গতিয়ের মত কবি।
আহা! আমি তো তাঁদের কবিতা পাঠ করতে পারবো না।
মৃত্যুর পরে কবিতা পাঠ সম্ভব হবে না বিধায় আজ সবাইকে নিয়ে পাঠ করতে চাই তৃতীয় বাংলার কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কবির কবিতা এবং তাঁদের সম্পর্কে কিছু কথাও তৈরি করা যেতে পারে বিভিন্ন প্রযত্নে।
শামীম আজাদ
সত্তর দশকের প্রান্তপ্রজন্মের কবি শামীম আজাদ-এর কবিতায় সহজেই খুঁজে পাওয়া যায় বাঁকফেরার অভিজ্ঞতা। ওম, জিওল জখমকাব্যগ্রন্থদ্বয়ের মধ্য দিয়ে শামীম আজাদকে আমরা নতুন করে আবিস্কার করতে পারি। ধীস্বর নামক উল্লেখযোগ্য সাহিত্য পত্রিকায় সম্প্রতি শামীম আজাদ-এর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে, যার অংশ বিশেষ উল্লেখ করছিকিছুটা হলেও তাঁকে উপলব্ধি করা যাবে:
‘জুলেখা নগরের কবি শামীম আজাদ অথবা কবিতা ও কার্তিক নদী’
‘ওম’ কাব্যগ্রন্থ পাঠশেষে প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক নয়কে এই অমৃতপুত্রী, আমাদের শীতার্ত পৃথিবীতে অলৌকিক ওম নিয়ে এসেছেন পাপ ও পূণ্য সহচরে?
দীর্ঘ আপেল বনে আমি শিলচর কৃষাণী
বিশ্বাস কবি দীর্ঘ ও রসময় জীবনপুকুরে
পাণের যোগৗতা রাখি যে কোনো বেলায়।
(আপেল বনে একা)
নিদ্রাঘুমে মৃত্তিকা জ্বলে
চুল ছিঁড়ে ওঠে ভ্রƒণের অঙ্কুর
(ওম)
সারা দীর্ঘরাত
আমাকে ছুঁয়ে যায় সাতরঙা হাত
(বেনিয়াসহকলা)
কেন কবিতা লেখেন? কবি হবার জন্য, জয়দা জামালপুর উন্মোচনের জন্য, করমচা অথবা কামরাঙা বাগান উন্মোচনের জন্য?
হত্যাকে হত্যা করার জন্য।
কাকে হত্যা করতে চান আপনি? বৃক্ষ, বনস্পদ, নদীনালা, রাষ্ট্র, চোর, ডাকাত ইদ্যাদি?
ব্রহ্মপুত্রনদী দ্বি-খণ্ডিত করে হত্যা করতে চাই ঈশ্বর, যে আজন্ম রক্ত-মাংসের অতীত, যে জড় ও জীবাকাঙ্খার প্রতিনিধিত্ব করে।
আপনার কবিতায় অবিদিতিকরণ দূর্লক্ষ্য নয়। যেমন- চান্দের রুহানী...আপনি কি সতর্কভাবে একজন প্রকরণবাদী (ঝঢ়বপরভরবৎ)?
ল্যা গ্যুইস্তিক জেনেরাল, স্যুসুর বা নোয়াম চমস্কির পূর্বেও পৃথিবীতে কবিতা ছিল এবং অনুসন্ধিৎসু হলে কবিতায় অবিদিতিকরণ লক্ষ্য করা যাবে। তবে প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারেকবিতা কি কোনো কালকেন্দ্রিক ভাষাচর্চার মাধ্যম? মুরাকভস্কি যেমন বলেনসাহিত্য হল চিহ্নতাত্ত্বিক ব্যাপার আর আমি বলি সাহিত্য হল ঘড়ঃযরহমহবংং এবং এ থেকেই আমরা একটুকরো সৌন্দর্য্য স্পর্শ করতে পারি।
উল্লেখ করতে চাই রামান ইয়াকবসন এর বাক্যতত্ত্বের বিষয়টিবাক্য হল দ্বিপ্রান্তিক সংগঠন। কাব্যিক ভূমিকা চয়নের দিক থেকে শুরু করে সমন্বয়ের দিকে সদৃশ্যতার নীতিকে তুলে ধরে। সদৃশ্যতা বাক্যিক ক্রমের গাঠনিক কলা প্রকরণে উন্নীত হয়।
নতুন কী লিখছেন?
নতুন কিছু লিখছি না। নদী নির্মাণ করছি। কামরুপ কামাখ্যা হতে ঐ নদী গৌহাটী গ্রাম ধরে নয়াবন্দরের দিকে উড়ে যাচ্ছে। আমি আপাতত নদী খনন করছি এবং জলকে শাসন করতে চাইছি।
এ আলোচনাটি প্রকাশের অব্যবহিত পরে ‘জিওল জখম’ গ্রন্থটি প্রকাশ পায়। ‘ভোঁ ভোঁ শবের বিছানায়/পরাজিত মানুষেরা মাছি হয়ে যায়’গ্রন্থের শুরুতেই শামীম আজাদ এরকম দার্শনিক বাণী-বন্ধনা করেন মহাকালের মানুষের জন্য। জিওল জখম-এর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা হতে একটি মাত্র কবিতা পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে চাই; সেই সঙ্গে এ-কবির দীর্ঘ পথচলা সনাক্তকরণের জন্য তাঁর গ্রন্থ তালিকাও সংযুক্ত করছি।
কোমল কঙ্কাল
এখানেই, পাখির ছায়ার নিচে
ঘ্রাণ ছিলো
চিনিচূড় চম্পা
রজবের চাঁদ আর রাজা শাইল স্বাদ
তুষের লাস্যে উড়েছিল সেতু
তপস্যার তীর,
ঝিনুক জঠরে
একবিন্দু হলেও শক্তি শুদ্ধাচার আর
শংকর প্রজাতির চিত্রা হরিণীর ছাল।
কিন্তু
দুধের ঐ নহর ছাড়া
বাদবাকি সবই ছিলো মেদ।
গ্রন্থাবলী : ওম, স্পর্শের অপেক্ষা, ভালোবাসার কবিতা, জিওল জখম, হে যুবক তোমার ভবিষ্যৎ, জন্মান্ধ জুপিটার (কবিতা), মধ্যবিত্ত বদলে যাচ্ছে, বিলেতের কথা (রচনা), শীর্ণ শুকতারা, আরও একজন (উপন্যাস), দুই রমনীর মধ্য সময়, লাইফ অব মি: আজিজ (গল্প)
দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু
ত্রিকালদর্শী কবি দেলোয়ার হোসেন মঞ্জুকে শুধু মহিশূরের তুঙ্গভদ্রা নদেই ভ্রমণ করতে দেখি না, প্রাগজ্যোতিষপুর থেকে তাঁকে উড়ে যেতে দেখি চৌথা আসমানে। তাঁর আংরা ভূমে শুধুই মখমলের পাখি ওড়ে না; নিরন্তর ওড়ে রঙিন অনু আর হবিগঞ্জী পরী। পৃথিবী মৃত্যুর পরে পৃথিবীর ধড় রেখে যেতে চান লালনের বুকে। তাঁর কবিতা অতি সহজে ব্যাখ্যাত হবার নয় এজন্যে যে, তাঁর সৃষ্টি কর্মে রয়েছে অজস্র বিন্দু, উপবিন্দু; ফলে পাঠককেও অগ্রসর হতে হয় তাঁর বোধের সহযাত্রী হওয়ার জন্যে। তাঁর কবিতায় লক্ষ্য করা যায়- বাইনারী অপজিশন, ট্রাংকুইলিটি, মরবিডিটি, ডি-হিউমেনিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম, ডি-কষ্ট্রাকশন, ডি-ফিমিলারিটি সহ ভাব ও ভাষা ও চিন্তারাজ্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রশ্মিগুলি। তাঁর কবিতার মেলাংকলি, ট্রাংকুইলিটি শুধু উল্লেখযোগ্যই নয়, বিস্ময়কর।
উল্লেখ করতে চাই উল্লেখযোগ্য কয়েকটি চরণ :
মাদারিপুরের স্তনের দিকে ধাবমান সিদ্ধিরগঞ্জ
বাতাসে ব্লেড উড়ছে
বাতাসে ব্লেড উড়ছে...(ফিতা)
ভস্মবৎ
জল ও স্থলের নির্যাস আপনি তো পূণ্যবান
আমি শুধু তাঁবেদারি করি
পূতপবিত্র শয়তান। (পবিত্র শয়তান)
শীতার্তদিনে
হেসে ওঠো কুকুর ও হাস্নাহেনা
বিষুব অঞ্চলে
মোম-বৃক্ষের ছায়া পড়ে আছে।
পীথ-বর্ণ পথে
গৃহে ফিরবনা আর
প্রেমিক, প্রজাতন্ত্রী চিরকাল
দাঁড়িয়েছি সমুদ্রতীরে
লোমশূন্য গাছের স্মৃতি। (প্রেমিক প্রজাতন্ত্রী)
নদীতে হেলান দিয়ে বসে আছি...
জলরন্ধ্রে ধনুক বেঁকে যাচ্ছে...
তরুণ কবিদের ধনুক ও মেরুদণ্ড বেঁকে যাচ্ছে জলে...
নদীতে হেলান দিয়ে বসে আছি ... (অরণ্যের উদর হতে)
কবিতার কাছে নতজানু একমাত্র দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু-ই লিখতে পারেন :
উদ্যত ছুরির নীচে শির ও সাঁসি হেসে ওঠে...
উদগ্র উন্মাদ হেঁটে যাই
কোনো এক নিজাম নগরে একা। ...
পিতা দাঁড়িয়েছি বিরাণ ভূমিতে
অমৃত পুত্রী হে
আমায় ক্ষমা কর পুত্র
আমৃত্যু নিরক্ষর আমি
বায়ূবক্ষে কী করে লিখি
কবিতা ও জলের হরফ (কবিতা জলের হরফ)
উল্লিখিত সবগুলো চরণই সাপ ও সূর্যমুখী গ্রন্থ থেকে নেয়া। প্রকাশিত হয়েছে বইমেলা ২০০৮-এ, যা ইতোমধ্যে উভয়বঙ্গে বহুলপঠিত ও বহুল আলোচিত। তাঁর মৌলিক ময়ূর গ্রন্থটি বাংলা কবিতার ইতিহাসে চিহ্নতৈরিকারী এ জন্যে যে, উপমা-ভাবনার জলাবদ্ধতা তচনচ করে অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে, চিরপরিচিত বিষয়কে অপরিচিত করে এবং অশ্রুতকে শ্রুতির কাছাকাছি নিয়ে আসে। মৌলিক ময়ূর যে তাঁর হাতেই রচিত হবে সে ইঙ্গিতই তিনি দিয়েছিলেন প্রায় দেড় যুগ আগে, ‘মৃত কুসুমের গান’ রচনার মাধ্যমে :
মাটি-পচা মাংস পাহাড়
হাওয়ার হাহাশ্বাস দমকা দমকা
বনুয়া ভোরে মাটির নাভী জ্বলে
পুড়ে টিকটিকি- ঈশ্বর ঈশ্বর
সমূলে অন্ধপ্রজাপতিদল
অভিযাত্রীদল জ্যোতির্ময় নাচে (ইস্পাতের গোলাপ)
... এ আমার ঘোর
সজ্ঞানে নৃত্যরত আলো, আবর্জনা ...
মহাকালের কান্না করে মৌলিক ময়ূর (মৌলিক ময়ূর)
আজন্ম জলজ তারা
জাল-ভর্তি ঈশ্বর আসেন
মৎস্যের সমান।
জলের আকৃতি সর্বশক্তিমান
পুকুরে
পুকুরে
পূর্ণিমার চন্দ্র ডুবে যায় ...
মনস্তাপে নৃত্যরত কংক্রিটের ডানা, প্রকৃতি।
হাড্ডি-ভাঙ্গা শব্দের দামে
কবি ও কাবিল তারা দুই ভাই
বৃক্ষ রুয়ে যায় সূর্যোলোকে।
এই ধুলা
রক্তাক্ত পর্বন মূর্তমান
লোহার নালিয়া ক্ষেত, এ শহর
উপচে পড়ে মৃত্যুর সমান। (কংক্রিটের ডানা)
দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু’র গ্রন্থাবলী : ইস্পাতের গোলাপ, ঈসা পাখি বেদনা ফোটে মরিয়ম বনে, মৌলিক ময়ূর, নীল কাব্যের বয়াত, সাপ ও সূর্যমুখী, বিদ্যুতের বাগান, হে রৌদ্র হে উজ্জ্বল অট্টহাসি, দণ্ডিত কবুতর (কবিতা), কাফের, জ্যোৎøার বেড়াল (উপন্যাস), হিরামন পুরুষ, তুলসিপত্র, চন্দ্রের চাবুক, মানুষ ডায়েরি লিখতে জানে রাজহাঁস জানে না, মখরমপুরে...(রচনা)
মুজিব ইরম
মুজিব ইরম নব্বই দশকের আলোচিত কবি এবং সনাক্তযোগ্য কবিএকথাগুলোর পাশে উচ্চারিত হতে পারে : মুজিব ইরম আমাদের কবি। ‘আমাদের কবি’এ-উক্তিটি অনেক সরল হলেও অর্থ বহুবিধ। উপচে-পড়া আবেগ আর আবহমান গ্রাম-বাংলার দৃশ্যপট এবং সংস্কার নিয়ে মুজিব ইরম শুধু উজ্জ্বল কবিই নন, আমাদের প্রাণের কবি।
তোমরা আমার দেখেছো নি কেউ তারে
জ্যৈষ্ঠ গেল, আষাঢ় মাসের গাঙে নয়া পানি
কয়দিন পরে ইরিধানে ঘরভর্তি হবে
একা আমি দেখি কেমনে নাও দৌড়ানি।
(ইতা আমি লিখে রাখি)
আমার আকিকায় এসেছিলো কেমন পড়শী?
জন্মদিনের মুগ্ধতা মেখেছিলো কেমন মেমান?
চটির মোরগ কেটেছিলো কোন রসিক রমণী?
কোন নাপিত এসে কেটেছিলো পরথম চুল?
শুভ সেই চুল কোন বালিশে তুমি রেখেছিলে মা?
সে-বালিশে মুগ্ধতা কিছু আছে নিশ্চয়?
হায়, আমারও একদা তবে জন্মদিন হয়!
(ইরমকথা/৭)
মুজিব ইরমের কবিতায় বিশেষ অঞ্চলের শব্দের উপস্থিতি লক্ষণীয়। সম্ভবত মুজিব ইরমই একমাত্র কবি, আধুনিক কবি, যার হাতে আমাদের আটপৌরে শব্দগুলো নতুন করে প্রাণ লাভ করল।
তাইরে আমি কেমনে বুঝাই, ও দয়াময়
আইনাউরি বাড়ায় জ্বালা, বান্ধা পড়ে মন
রসিক জনে কেবল জানে এই জ্বালার কারণ
ফুটবে যদি রাঙা তোষ, আসবে কেনো ভয়, ও দয়াময়...
কালিয়ানা এ তাইরে আমি কী করে আজ মনমাজারে রাখি
ছাতিম-ছায়া কিছুটা হায় রইল বাকি
কী যে এমন রঙতামাশা বয়স হলে বাড়ে
তাইরে আমি অধিক বলিউমাফোটা লাগে
হাওয়ার ঘরে কুটুম থাকে, বাসে অনুনয়, ও দয়াময়...
কালিয়ানা এ তাইরে আমি কেমনে বুঝাই
ও দয়াময় মনরে আমারকী করে আজ নিরঞ্জনে থাকি!
(বাইলপদ্য ১)
মুজিব ইরম ভাল করেই জানেন শব্দের রঙ, বর্ণ, গন্ধসহ বিস্তৃতি। তাই তাঁর লেখায় শব্দ প্রয়োগেও থাকে ব্যাপক পরিমিতিবোধ।
কে আর লিখবে বলো চিঠি প্রযত্মে তোমার!
আলইর দোকানে কি আজো পাওয়া যায় ভুল না আমায়? এমন রঙিন পাতাকী করে পাঠাই আয় সদ্যজাগা মন!
আজো কি কামালপুরে শব্দ ওঠে তোমার নামের? যে-পিওন দ্রুত তালে টুকে যায় কর্তব্যের ঢেউসে কি জানে, তোমার হাতের লেখা ঝলকে ওঠে সহসা সকালে?
ডাকঘরে বেলা যায়। বাইন্যার দোকানে কি সেই গহনা-পুস্তক আজো প্রহর ঘনায়? এতো নক্সা, এতো সোনালি চন্দনডাকের অপেক্ষা করে স্বর্ণের দোকানে কেনো দুপুর কাটাই!
লাইনে দাঁড়িয়ে আছিও পিওন, একবার নাম ধরে ডাকো, বলো ঠিকানা-সাকিন, বলো এসেছে বেয়ারিং চিঠি...ডাকমাসুল দিতে গিয়ে জেব থেকে বের করে আনি হরিণ যুগল!
বি. দ্র : সোভিয়েত পত্রিকা কেটে যে তোমাকে করে দিতো অনিন্দ্য মলাটতার বই কেনো আজ ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়?
(বেয়ারিং চিঠি/লালবই)
মুজিব ইরম প্রণীত গ্রন্থাবলী : মুজিব ইরম ভনে শোনে কাব্যবান ( ১৯৯৬), ইরমকথা (১৯৯৯), ইরমকথার পরের কথা (২০০১), উত্তরবিরহচরিত (২০০৩), সাং নালিহুরী (২০০৪), ইতা আমি লিখে রাখি (২০০৫), শ্রী (২০০৮), এক যে ছিলো শীত ও অন্যান্য গপ (১৯৯৯)।
আউটবই : বারকি (২০০৩), মায়াপীর (২০০৪), বাগিচাবাজার (২০০৫) ।
প্রকাশিতব্য : লালবই, আদিপুস্তক, বাওফোটা, আমি কেনো হারিয়ে ফেলে কান্না করি না, যে জীবন কবিতার।
বিশেষ সংযোজন :
বিলেতে কবিতা-চর্চার পাশাপাশি ছড়া-চর্চাও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শাহাদাত করীম, রব্বানী চৌধুরী, দিলু নাসের, রেজুয়ান মারুফ, আহমদ ময়েজকে মূল ধারার ছড়াকার হিসেবে নিঃসন্দেহে গ্রহণ করা যায়। এ আলোচনায় স্বতঃস্ফূর্ত ও সক্রিয় দুই ছড়াকার দিলু নাসের ও আহমদ ময়েজ-এর ছড়া খতিয়ে দেখতে চাই।
দিলু নাসের
দিলু নাসের সম্পর্কে সুভাষ মুখ্যোপধ্যায় বলেছিলেন‘দিলুর ছড়ায় বাংলা ছড়ায়।’ তিনি ঘোষণা দেন :
ধর্মের নামে যারা
করে শয়তানি
তারা তো মানুষ নয়
ইতর প্রাণী।
ধর্মকে নিয়ে যারা
করে বেচাকেনা
ঈশ্বর তাহাদের
ক্ষমা করবে না। (বিষকামড়)
পৃথিবীতে যত শোষিত মানুষ
আমি তাহাদের পক্ষে
আমার কলম সদা জাগ্রত
দিন বদলের লক্ষ্যে। (বিশ্বগ্রাম)
শেষোক্ত চরণগুলি পশ্চিম বঙ্গে গীত হয়েছে পল্লব ঘোষের কণ্ঠে। বিপুল জনপ্রিয়তাও পেয়েছে। দিলু নাসের সম্পর্কে কবি দিলওয়ার সঠিক মন্তব্যটিই করেন :
দিলু নাসের আসছে লাখে লাখে
নদী মাতৃক দেশের বাঁকে বাঁকে।
দিলু নাসের জিজ্ঞাসা তৈরি করেন :
বিশ্বতে হানাহানি
বল আজ কে নেভায়
শান্তির সভা তাই
হয় রোজ জেনেভায়!
দিলু নাসের প্রত্যক্ষ করেন :
জমির আলীর একটি ছেলে
লন্ডনেতে বাস করে
তাই তো ছেলে পাঠায় দেশে
লক্ষা টাকা মাস পরে।
জমির আলী ভাবেন ছেলে
বিলেত টাকার চাষ করে
কিন্তু ছেলে পাঠায় টাকা
জীবনটারে নাশ করে।
দিলু নাসেরই (সামান্য হাস্যপ্রবণ হলেও) সঠিক বিষয়টি লিখতে পারেন :
লন্ডনে আমাদের নিউ জেনারেশনে
খুব মন দিয়েছেন
হিজাবের ফ্যাশনে।
চুল ঢাকা থাকে আর বাকি সব টাইট
রাস্তায় প্রেমিকেরে গালে দেয় বাইট।
দিলু নাসের-এর ছড়া নিয়ে লিখেছেন আব্দুল গাফফার চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপধ্যায়, এম আর আখতার মুকুল থেকে শুরু করে সালেহা চৌধুরী, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মুহাম্মদ নূরুল হুদা প্রমূখ। কিন্তু তারা যে লিখেছেন সেটা আমার কাছে বড় কথা নয়। বড় কথাটি হল, জিজ্ঞাসা তৈরি করাকেন লিখেছেন? আমার তো মনে হয়, তাঁর লেখা সাধারণ পাঠক থেকে শুরু করে বোদ্ধাদের কাছেও উপেক্ষিত হবার নয়।
দিলু নাসের-এর গ্রন্থাবলী : বিষ কামড়, বিশ্বগ্রাম, মুজিব নামের অর্থ, ছন্দে ছড়ায় বাংলাদেশের ইতিহাস, সময়ের ছড়া, দিলু নাসের-এর বাছাই ছড়া (ছড়া), পূর্ব পুরুষ (গল্প), আবু জাহেলের প্রত্যাবর্তন, অল গেইট (উপন্যাস), দিলুনাসের গীতি (গান)
আহমদ ময়েজ
ছড়াকার আহমদ ময়েজ-এর ছড়াগ্রন্থ দু’টি- কেউ করো না মানা, একমুঠো রোদ্দুর। তাঁর ছড়ায় অন্ত্যমিল, ছন্দের নিপুণ প্রয়োগ, শব্দ চয়ন চোখে পড়ার মতো। তবে এটিও চোখে পড়ার মতো- কেউ করো না মানা ছড়াগ্রন্থটির ফ্ল্যাপ লিখে দিয়েছেন সাপ্তাহিক বিক্রম পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাসুদ মজুমদার। আমার জানা মতে, মাসুদ মজুমদার ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। আমি মনে করি, ময়েজ-মূল্যায়ন আরো শুদ্ধ হত যদি তাঁর সম্পর্কে লিখতেন অগ্রজ কোনো কবি বা ছড়াকার। যা হোক, ময়েজ-এর ছড়ায় কিন্তু সত্য ভাষণটিই উচ্চারিত হয় :
রাজাকার আজ ডানে নয় শুধু
রাজাকার আজ বামেও
রাজার প্রীতি মিশিয়া রয়েছে
বিন্দু বিন্দু ঘামেও।
রাজাকার শুধু খুঁজিয়া মরেছো
অহেতুক সারা বঙ্গে
রাজাকার দেখো তোমারই বন্ধু
নিত্য নতুন ঢংগে।
রাজাকার আছে বাহিরে এবং
রাজাকার আছে ঘরমে
রাজাকার প্রীতি মিশিয়া রয়েছে
হাড্ডি মজ্জা চর্মে ।
(কেউ কর না মানা/২৩)
প্রতিশ্রুতিশীল এই ছড়াকারের কাছ থেকে আমরা আরো রকমারি ছড়া আশা করি।
------------------------------------------------------------------------------
সৌজন্যে:
আদি কাকতাড়ুয়া
নবরূপে ২য় বর্ষ ২য় সংখ্যা ॥ জুলাই ২০০৯ ॥ ১লা প্রকাশ ১৯৯১ ॥
সম্পাদক : মাশুক ইবনে আনিস ॥ প্রচ্ছদ : উত্তম সেন ॥ যোগাযোগ : [email protected] / 8 BABBACOMBE GARDEN, REDBRIDGE, ILFOD, ESSEX, IG4 5LY, UK.
-----------------------------------------------------------------------------