নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীর ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে গোপনে সংগঠিত হচ্ছে। হিযুবত তাহরীরের যুগ্ম সমন্বয়কারী কাজি মোরশেদুল হকের নেতৃত্বে শীর্ষ ৯ জঙ্গি নেতা বর্তমানে এ সংগঠন পরিচালনা করছে। এ সংগঠনের আরও কার্যক্রম সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা তদন্তে নেমেছে। তারা হিযবুত তাহরীর বিস্তার, প্রচারণা ও গোপন নেটওয়ার্কের খোঁজে নানা বেশে কাজ করছে। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, নিষিদ্ধ এ জঙ্গি সংগঠনটি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নানা বেশে অবস্থান নিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা সরকারবিরোধী উস্কানিমূলক লিফলেট, পোস্টার এবং হঠাৎ করে রাস্তায় ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করছে। এসব কারণে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে গত ২ সপ্তাহ ধরে একটি গোয়েন্দা সংস্থা হিযবুত তাহরীর সংগঠনের গোপন কার্যক্রম নিয়ে ব্যাপক তদন্ত শুরু করেছে।
সূত্র মতে, হিযবুত তাহরীরের ঢাকা বিভাগীয় সমন্বয়কারী কাজি মোরশেদুল হক ও মিডিয়া শাখার প্রধান মোস্তফা মিনহাজসহ ৯ শীর্ষ জঙ্গি রাজধানীকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে তারা কিভাবে সদস্য সংগ্রহ করছে, কারা তাদের মূল অর্থ যোগানদাতা ও নেতৃত্বে রয়েছে_ এসব তথ্য সরকারের কাছে না থাকায় গোয়েন্দারা তা সংগ্রহ করতে মাঠে নেমেছে। এছাড়াও নিষিদ্ধ হওয়ার পরও হিযবুত তাহরীর লিফলেট ও পোস্টার ছাপিয়ে তা ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করছে। কোন্ কোন্ প্রেসে তারা লিফলেট ও পোস্টার ছাপায় তা বের করার জন্য গোয়েন্দারা রাজধানীর আরামবাগ, ফকিরাপুল, শাহজাহানপুর, বাংলাবাজার, উত্তরা, গুলশান, কাঁটাবনসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত ছাপাখানাগুলোতে নজরদারি শুরু করেছে।
সূত্র মতে, রাজধানীর কাঁটাবন, এলিফ্যান্ট রোড, নিউমার্কেট, উত্তরা, বনানীসহ ঢাকার বাইরে সাভার, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা অবস্থান নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এছাড়াও হিযবুত তাহরীর চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় গোপনে সংগঠিত হচ্ছে। তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনগুলোকেও সরকারবিরোধী আন্দোলন ও খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় উস্কানি দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে এ জঙ্গি সংগঠন তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এছাড়াও চট্টগ্রামের কুমিরা এলাকার গভীর অরণ্যে এ জঙ্গি সংগঠনের ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে। সেখানে মহিউদ্দিন নামে এক জঙ্গি তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ওই এলাকায় জামায়াত সমর্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা তাদের সহযোগিতা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। চট্টগ্রামের চকবাজারে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা অবস্থান নিয়ে সংগঠন পরিচালনা করছে।
হিযবুত তাহরীর নিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে 'সংবাদ'কে জানান, গত ২ সপ্তাহ ধরে হিযবুত তাহরীরের বিস্তারসহ সব কিছু নিয়ে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। তদন্ত শেষ হলে সরকারের উচ্চপর্যায়ে হিযবুত তাহরীর নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন দেয়া হবে। তদন্ত শেষ হতে আরও সময় লাগবে।
এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর সরকার হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করার পর সংগঠনটির বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ফার্মগেটের আইবিএ টিচার্স কোয়ার্টারে কার্যত নজরবন্দি রয়েছেন। সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে সরকার তার সব ধরনের ব্যাংক একাউন্টও ফ্রিজ করে রেখেছে। মহিউদ্দিনের বাসভবন ঘিরে সবসময় পুলিশ ও গোয়েন্দারা নজরদারি করছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও জোনের উপপুলিশ কমিশনার চৌধুরী মঞ্জুরুল কবীর গতকাল রাতে 'সংবাদ'কে জানান, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের প্রধান সমন্বয়কারী মহিউদ্দিন ফার্মগেটের আইবিএ টিচার্স কোয়ার্টারেই বসবাস করছেন। তাকে বন্দি বা নজরবন্দি করে রাখা হয়নি। তবে তিনি নিষিদ্ধ সংগঠনের প্রধান হওয়ায় পুলিশ তার কার্যক্রম নজরদারি করছে বলে পুলিশের ওই কর্মকর্তা জানান।
বাংলাদেশে যেভাবে হিযবুত তাহরীরের উত্থান : ২০০০ সালে প্রাথমিকভাবে হিযবুত তাহরীর নেতাকর্মীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'লিবারেটেড ইয়ুথ' ব্যানারে তাদের জঙ্গি কার্যক্রম শুরু করে। এ ব্যানারে সংগঠনটি ২০০৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে একটি সেমিনারের প্রস্তুতি নেয়। তবে ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর বাধার কারণে ওই সময়ে তারা নির্ধারিত সেমিনার আয়োজন করতে পারেনি। ২০০৪ সালে সিলেটে প্রথমে হিযবুত তাহরীরের লিফলেটসহ ১০ জঙ্গিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে ২০০৬ সালের প্রথমে তারা 'ছাত্রমুক্তি' নামে একটি ছাত্র সংগঠন গঠন করে। ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে ফিলিস্তিনে মুসলমানদের ওপর হামলার প্রতিবাদে প্রকাশ্য জঙ্গি মিছিল করে। এরপর থেকে মাঝে মধ্যেই হিযবুত তাহরীর খেলাফত আন্দোলনের নামে মিছিল ও লিফলেট বিতরণ করে আসছিল। ২০০৭ সালের শুরুর দিকে 'ছাত্রীদের বোরকাপরা ও যৌন কেলেঙ্কারি' এ দুটি ইস্যুতে 'ছাত্রমুক্তি' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য কর্মসূচি পালন করে। এর মাধ্যমেই তারা মিডিয়ার লাইমলাইটে আসে। মূলত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেই এ জঙ্গি সংগঠনটি বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিস্তার লাভ করে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।