somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পতাকা দেখে বাড়ি চিনে মামুনকে হত্যা

০৯ ই মার্চ, ২০১৩ রাত ১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সাতক্ষীরা সহিংসতার নেতৃত্বে ছিলেন জামায়াত নেতা হাবিবুর রহমান, প্রশ্রয় দিয়েছেন আ. লীগ নেতা নজরুল ইসলাম। মিঠাপুকুরে হাজার হাজার মানুষ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়



সাতক্ষীরা শহরতলির কাশেমপুর এলাকায় এ বি এম মামুন হোসেনের বাড়িতে সেদিন উড়ছিল জাতীয় পতাকা। ওই পতাকা দেখে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বাড়িটি শনাক্ত করে তাণ্ডব চালায় এবং মামুনকে কুপিয়ে হত্যা করে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের হরতালের দিন শহরে বিক্ষোভ না করে শহরতলিতে এ হামলা এলাকাবাসীকে বিস্মিত করেছে। এ কারণে সাতক্ষীরা সিটি কলেজের শিক্ষক মামুনের বাড়িতে হামলা এবং তাঁকে হত্যা করার ঘটনাটিকে পরিকল্পিত মনে করছে এলাকাবাসী।
সিটি কলেজের শিক্ষক, স্থানীয় ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির নেতারা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধ, দেশ ও আওয়ামী লীগের প্রতি একনিষ্ঠ মামুন ছিলেন কট্টর জামায়াত-শিবিরবিরোধী। এ কারণে তিনি ঘাতকদের টার্গেটে পরিণত হন।
মামুনের স্বজনরা জানিয়েছেন, তাণ্ডবের সময় স্থানীয় প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের সহায়তা চেয়েও তাঁরা পাননি। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই দিন (২৮ ফেব্রুয়ারি) সাতক্ষীরা শহরে জামায়াত যে নাশকতা চালায়, তাতে নেতৃত্ব দেন দলের সাতক্ষীরা জেলা শাখার কর্মপরিষদ সদস্য মো. হাবিবুর রহমান। তাঁর বড় ভাই আওয়ামী লীগের সাতক্ষীরা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলা চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম।
অভিযোগ রয়েছে, নজরুল ইসলামের আশীর্বাদে ছোট ভাই জামায়াত নেতা হাবিবুর রহমান ফিংড়ী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বড় ভাই জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান; অন্যদিকে নিজে ইউপি চেয়ারম্যান এবং জামায়াতের নেতা- সব মিলিয়ে হাবিবুর রহমান হয়ে ওঠেন পরাক্রমশালী। আওয়ামী লীগের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে সাতক্ষীরা শহরতলির সার্কিট হাউস মোড়, কদমতলা ও শহরের পশ্চিমাংশের নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন হাবিবুর রহমান। এলাকার মাদক ব্যবসা, চোরাকারবারিদেরও অলিখিত পৃষ্ঠপোষক এই হাবিবুর।
তাণ্ডব ও মামুন হত্যাকাণ্ড : মামুনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌসী কালের কণ্ঠের কাছে সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, 'মামুন শিক্ষকতায় আসার পর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল না। ঘটনার দিন দোতলার ঘরে বসে সবাইকে নিয়ে ও টিভি দেখছিল। এমন সময় তাদের ওপর আক্রমণ হয়।' জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বৃষ্টির মতো ইট মারতে থাকে তাঁদের বাড়ির দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগে নিচতলায় আগুন ধরিয়ে দেয় তারা। হামলাকারীরা সংখ্যায় ছিল কয়েক হাজার। প্রায় সবার হাতে কোনো না কোনো অস্ত্র ছিল। তারা মামুনকে ডাকতে থাকে। ঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য হুংকার দিতে থাকে। তাদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তিনি মামুনকে জড়িয়ে রাখেন।
ফেরদৌসী বলেন, 'হামলাকারীরা বলতে থাকে, মামুনকে বাইরে আসতে বলেন, আমরা কিছু করব না। এর মধ্যে তারা বিদ্যুতের তারের মাধ্যমে ঘরের মধ্যে আগুন ঢুকিয়ে দেয়। নিচে গ্যাস সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটায়। ভয়ে ঘর থেকে মামুন বের হয়। ওকে পেয়ে খুনিরা উল্লাস করতে থাকে। নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর স্লোগান দিতে দিতে মামুনকে আঘাত করতে শুরু করে। ওর মাথা ফাটিয়ে দেয়। যার কাছে যা ছিল, তা দিয়েই ওকে আঘাত করছিল। দূরের মানুষগুলো ইট ছুড়ছিল। তাকে না মারার জন্য আমার পাঁচ বছরের শিশু বোনটি (মামুনের শ্যালিকা) অস্ত্রধারীদের পা ধরে মিনতি করে। তাকে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। বৃদ্ধ শ্বশুর এগিয়ে গেলে তাঁরও মাথা ফাটিয়ে দেয়। আঘাতে আঘাতে মামুনের শরীর দিয়ে রক্তস্রোত বইতে থাকে। মামুন বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে সামনের ছোট্ট ডোবায় লাফ দিয়ে পড়ে। সেখানে বৃষ্টির মতো ইট নিক্ষেপ করে খুনিরা।'
'নরপশুরা যাওয়ার সময় আমার গলার ও হাতের সোনার গয়না টেনেহিঁচড়ে খুলে নিয়ে যায়। ঘরের জিনিসপত্র লুটে নেয়', বলেন ফেরদৌসী। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'বাঁচার জন্য মামুন সেদিন বারবার পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল; কিন্তু কেউই সাড়া দেয়নি। মামুনকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেনি। সদর থানার ওসি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদককে বারবার অনুনয় করা হয়েছিল আমাদের রক্ষায় সাহায্য করার জন্য। কিন্তু কেউই ফিরেও তাকায়নি।'
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি সাতক্ষীরা শাখার নেতা আমিনা বিলকিস ময়না বলেন, 'মামুন নির্মূল কমিটির সদস্য ছিল। মৌলবাদবিরোধী সংগ্রামেও সে ছিল একনিষ্ঠ। সংগত কারণেই জামায়াত-শিবিরের টার্গেটে পরিণত হয় মামুন।'
সাতক্ষীরা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ আবু আহমেদ বলেন, 'মামুন এ কলেজে লেখাপড়া করেছে। এ কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিল। আবার এ কলেজেই শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিল। এটা জামায়াত-শিবিরের ঈর্ষার কারণ ছিল।'
ঘটনার আট দিন পরও প্রতিবেশীরা এ নিয়ে কোনো কথা বলতে চায় না। সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক। সেদিনের হামলার কথা মনে পড়লে তারা শিউরে ওঠে। এক শিশুর ভাষ্য, 'জামাতিগের বিশাল একটা মিছিল। উরা মিচিল নে (নিয়ে) টাউনের দিক যাচছিলো। হটাৎ মিচিল থেমি গেলো মামুনির বাড়ির সামনি। উরা সবাই বইললো, হ্যাঁ, এই তো জাতীয় পতাকা, এইডাই মামুনির বাড়ি। সাথি সাথি শুরু হয়ি গেলো ইট মারা আর ইট মারা। তারপর আগুন ধুরাই দেলে। মামুনির টেনি বের কুরে মেরে ফেললো।'
আ. লীগ নেতার বিরুদ্ধে প্রশ্রয়ের অভিযোগ : সাতক্ষীরার রাজনৈতিক মহল, পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শীসহ একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ওই দিন জামায়াত নেতা ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ফিংড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান দলের কর্মীদের উদ্দেশে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সব কিছু গুঁড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।
এলাকাবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, হরতালের দিন সহিংসতার উদ্দেশ্যে হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে সাতক্ষীরা শহরতলি, কদমতলা, ফিংড়ী ইউনিয়ন ও আশপাশের গ্রাম থেকে ভ্যান ও নছিমন ভাড়া করে লোকজন আনা হয় কদমতলা বাজারে। তারাই ওই দিন নাশকতা চালায়।
এত বড় তাণ্ডব ও হত্যাকাণ্ড চালানোর পরও হাবিবুর রহমানকে এখন পর্যন্ত পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। মামুন হত্যাকাণ্ডের পরদিন জানাজার সময় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা প্রশ্ন তোলে এবং ওসিকে প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা না দেওয়ায় সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান কর্মীদের তোপের মুখে পড়েন। পরে তিনি ঘোষণা দেন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ওই দিন নিহত সবার জন্য দোয়া চাওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলামকে সাধারণ কর্মীরা লাঞ্ছিত করেন।
আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম বলেন, 'হ্যাঁ, হাবিব আমার ছোট ভাই, তবে তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। সে জামায়াতের রাজনীতির সাথে যুক্ত। ভাই হওয়ায় অনেকে অনেক কথা বললেও তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।'
এ বিষয়ে জামায়াত নেতা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জয়দেব চৌধুরী বলেন, 'আসামিদের গ্রেপ্তারের জোর চেষ্টা চলছে। তারা গা ঢাকা দিয়েছে।'
উল্লেখ্য, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। ওই দিন জামায়াত সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচি দেয়। সেদিন জামায়াতের তাণ্ডবে সাতক্ষীরায় পাঁচজন নিহত হয়। ওই ঘটনায় পুলিশ, বিজিবি ও ক্ষতিগ্রস্তরা পৃথকভাবে পাঁচটি মামলা করেছেন। মামলায় হাবিবুর রহমানের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় ১৪ হাজার ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:১৯

তীব্র তাপদাহ চলছে : আমরা কি মানবিক হতে পেরেছি ???



আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে আছি,
আমাদেরও যার যার অবস্হান থেকে করণীয় ছিল অনেক ।
বলা হয়ে থাকে গাছ না কেটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যবহারে বংশের পরিচয় নয় ব্যক্তিক পরিচয়।

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৫

১ম ধাপঃ

দৈনন্দিন জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথে দেখা হয়। মানুষের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য আসলেই লুকিয়ে রাখে। এভাবেই চলাফেরা করে। মানুষের আভিজাত্য বৈশিষ্ট্য তার বৈশিষ্ট্য। সময়ের সাথে সাথে কেউ কেউ সম্পূর্ণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মহিলা আম্পায়ার, কিছু খেলোয়ারদের নারী বিদ্বেষী মনোভাব লুকানো যায় নি

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯



গত বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক ও মোহামেডানের ম্যাচে আম্পায়ার হিসেবে ছিলেন সাথিরা জাকির জেসি। অভিযোগ উঠেছে, লিগে দুইয়ে থাকা মোহামেডান ও পাঁচে থাকা প্রাইমের মধ্যকার ম্যাচে নারী আম্পায়ার... ...বাকিটুকু পড়ুন

জানা আপুর আপডেট

লিখেছেন আরাফআহনাফ, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭

জানা আপুর কোন আপডেট পাচ্ছি না অনেকদিন!
কেমন আছেন তিনি - জানলে কেউ কী জানবেন -প্লিজ?
প্রিয় আপুর জন্য অজস্র শুভ কামনা।



বি:দ্র:
নেটে খুঁজে পেলাম এই লিন্ক টা - সবার প্রোফাইল... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×