গীতিপ্রাণতায় কবিতার সুর
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
আল মাহমুদ মূলত একজন আধুনিক গীতিকবি। গীতপ্রবণতা তার শিরায় শিরায় বহমান। কবির গদ্য কবিতাও এই গীতলতা থেকে মুক্ত নয়। এমনকি তার যে কোনো গদ্য রচনায়ও এই গীতময়তা বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির থাকে। গত দুই দশক ধরে তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলে আসছেন—‘সবাইকে লিরিকে ফিরতে হবে’। তিনি নিজেও শেষাবধি লিরিকেই নিমজ্জিত। তার এই নিমজ্জমানতা কবিতায় নবপ্রাণ সঞ্চার করছে। ইদানিং তিনি গদ্যকবিতা খুবই কম লেখেন। দু’একটি লিখলেও সেগুলোর মধ্যে আগের মতোই গীতিপ্রবাহ অক্ষুণ্ন থাকে। বর্তমানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি পয়ার রচনা করে চলেছেন। বাংলা কবিতার হাজার বছরের মৌল প্রবণতাকে আল মাহমুদ তার প্রথম যৌবনেই স্বীকরণ করেছেন। নানা রকম আধুনিক প্রবণতার কোনোটাকে অস্বীকার না করেও লিরিকের বিজয় ঘোষণা করেন কবি আল মাহমুদ।
গত একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে কবির নতুন কবিতার বই—‘আমি সীমাহীন যেন—বা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো’। বইয়ের কবিতাগুলো ২০১২-১৩ সালেই লেখা। দু’একটি কবিতা এর আগে রচিত এবং এতদিন অগ্রন্থিত ছিল। বইয়ে মোট চল্লিশটি কবিতা আছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি কবিতায় শৈথিল্য ধরা পড়লেও অধিকাংশ কবিতায়ই রয়েছে টানটান উত্তেজনা। কবি দীর্ঘদিন ধরেই হাতে-কলমে লিখতে পারেন না, ডিকটেশন দিয়ে লেখান। চোখেও দেখতে পান না। ফলে যারা ডিকটেশন নেন তাদের ওপর কবিকে অনেকখানি নির্ভর করতে হয়। ডিকটেশন দিয়ে কবিতা লেখার মতো কঠিন কাজটি আল মাহমুদের পক্ষে অনেক সহজে করা সম্ভব হলেও যিনি ডিকটেশন নেন তিনি অভিজ্ঞ না হলে কবির কিছুটা সমস্যা হয়েই যায়। এরপরও আল মাহমুদ লিখে চলেছেন, লিখে যাচ্ছেন—এটাই বাংলা কবিতার পাঠকদের জন্য বিরাট সুখবর। এই পড়ন্ত বেলায়ও কবি যখন উচ্চারণ করেন—
‘ছায়ার পিছনে হাঁটি না তো আমি
মায়ার পিছনে হাঁটি না
পায়ের তলায় ঘাসের নরম
দেশটা শীতল পাটি না।’
কিংবা—
‘ঝরুক বৃষ্টি ঝাপসা দৃষ্টি
বাংলাদেশেরই মাটি তো
হাত দিয়ে ঘাঁটি লাগে পরিপাটি
আমার সোনার বাটি তো।’
[আমার সোনার বাটি তো]
—তখন পাঠক পুলকিত, চমত্কৃত না হয়ে পারেন না। পাঠককে আবারও স্বীকার করতে হবে—এ তো জীবন্ত কিংবদন্তি আল মাহমুদেরই উচ্চারণ। বইটিতে আল মাহমুদ তার জীবনের পড়ন্ত বেলার নানা ভাব-ভাবনাকে ভাষা দিয়েছেন—কবিতার ভাষা, লিরিকের ভাষা। বিশেষ করে অধিকাংশ কবিতায় বেজে উঠেছে বিদায়ের সুর আর প্রস্ফুটিত হয়েছে প্রেমের মুকুল। একটি কবিতায় কবি বলছেন—
কোন দিকে যে যাত্রা আমার
কোথায় অবসান
পথের মাঝে শুনতে পেলাম
অচিন পাখির গান
নাম ধরে কে ডাকছে আমায়
আয়রে কবি আয়
দিন ফুরালো সন্ধ্যা হলো
রাতের সীমানায়।
[হাত বাড়িয়ে দে]
এ কবিতায় কবি যেন বিদায় বাঁশিতে তুলেছেন। কবি তার সহধর্মিণীকে হারিয়েছেন বছর চারেক আগে। এ বইয়ের বেশ কিছু কবিতায় যেন সহধর্মিণীকে হারানোর বেদনা, তাকে আবার ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার আকুতি ফুটে উঠেছে। এ অবস্থায় কবির কবিতাগুলো পড়তে গেলে একটা ঘোর লাগা বিষাদও পাঠককে আচ্ছন্ন করতে পারে, বিশেষ করে কবি যখন বলেন—
কার কাঁধে যে হাত রেখে আজ একটুখানি বিরাম খুঁজি
বিরাম তো নয় ঘাম ঝরে যায় আমার পুঁজি
দিন ফুরালো সন্ধ্যা হলো ওগো আমার গৃহবাসী
ধরো আমায় কাঁপছে কথা ভালোবাসি।
ভালোবাসার জন্য আমি আর কতদূর হাঁটব বলো
পায়ের তলায় পথ ফুরালো
দেশের মাটি দুই হাতে আর কতদিন ঘাঁটব বলো
ইচ্ছে তো হয় কাদামাটির এমন দেশে
শষ্য গ্রহণ করব আমি বেলা শেষে।
(দিন ফুরালো সন্ধ্যা হলো)
কোনো অবস্থায়ই কবি তার জীবনাদর্শ, জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিস্মৃত হতে চান না। ফলে এ বইতে আমরা পাই অগ্নিপুরুষ ইসমাইল হোসেন শিরাজীকে নিয়ে একটি চমত্কার কবিতা। সেই সঙ্গে আছে ঊনসত্তরের শিক্ষা আন্দোলনের শহীদ আবদুল মালেককে নিয়েও একটি কবিতা। দু’টি কবিতাতেই কবি তার জীবনাদর্শ ও পূর্ব প্রজন্মকে দৃপ্ত, দীপ্ত উচ্চারণে উত্থাপন করেছেন।
বইটির ফ্ল্যাপে বলা হয়েছে—“...আল মাহমুদ বহু আগেই অকম্পিত কণ্ঠস্বরে উচ্চারণ করেছিলেন সেই অমোঘ সত্যবাণী : ‘পরাজিত হয় না কবিরা।’ সুতরাং আল মাহমুদ আছেন প্রায় সর্বব্যাপ্ত হয়ে—বাংলা কবিতায় আজও প্রতিদ্বন্দ্বীহীন অধীশ্বর তিনি! এজন্যই একমাত্র আল মাহমুদই বলতে পারেন : ‘আমি সীমাহীন যেনবা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো।’ সেই বটবৃক্ষের ছায়ায় রসগ্রাহী কাব্যামোদীদের সাদর আমন্ত্রণ।’
বইটির অপূর্ব প্রচ্ছদ এঁকেছেন শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।
আমি সীমাহীন যেনবা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো
আল মাহমুদ
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৩
প্রচ্ছদ : কাইয়ুম চৌধুরী
প্রকাশক : কামরুজ্জামান কাজল
নির্বাহী পরিচালক
চন্দ্রাবতী একাডেমী।
মূল্য : ১৫০ টাকা।
আহমদ বাসির
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন
J K and Our liberation war১৯৭১


জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ
২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ
কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন
নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।