জুন মাসের মঙ্গলবারের এক সন্ধ্যা। হিউস্টন এর এক রেস্তোরাঁয় পাঁচ জন ডাক্তার চিন্তিত মুখে বসে আছেন। জার্মানিতে একটি খাদ্যবাহিত জীবাণুর আক্রমণে বেশ কিছু মানুষ জীবন হারিয়েছে আর শত শত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ডাক্তারদের চিন্তার বিষয় কি করবেন তাঁরা যদি এই ঘটনা হিউস্টনে ও ঘটে? কোন রোগী যদি এরকম অজানা জীবাণুর ইনফেকশন নিয়ে আসে আর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, কি করার আছে তাঁদের!
সেই রাতে ঐ ডাক্তারদের একজন, জেমস এম মুসের যিনি মেথডিস্ট হাসপাতাল এর প্যাথলজি এবং জেনমিক মেডিসিন এর চেয়ারম্যান, খবর পেলেন তাঁর এক রোগী এমন একটা রোগে মারা গেছে যার লক্ষণ অনেকটা অ্যান্থ্রাক্স এর মতো। কি করবেন তিনি! তিনি ভাবলেন এটা কি সত্যি অ্যান্থ্রাক্স ছিল? যদি অ্যান্থ্রাক্স হয় তবে কি জীবাণুটি জেনেটিকালি ইঞ্জিনিয়ার্ড। কতটা ভয়ানক হতে পারে সে? ডাক্তার মুসের অনুধাবন করলেন উত্তর আসতে পারে যদি শুধুমাত্র ঐ প্রাণঘাতীর সম্পূর্ণ জিনের বৈশিষ্ট্য জানা যায়। আর এটাই ছিল অণুজীববিজ্ঞানের নতুন দিনের সূচনা। ডাক্তার মুসের আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা আণবিক রোগ তত্তের একটা দারুন দিক নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা আঁটলেন- জিন সিকোয়েন্সিং।
সর্বপ্রথম ব্যাকটেরিয়ার জিন সিকোয়েন্সিং করা হয় ১৯৯৫ সালে, সময় লেগেছিল ১৩ মাস। আর এখনকার বিজ্ঞানীরা একটি ব্যাকটেরিয়ার সম্পূর্ণ জিন সিকোয়েন্স করতে সময় নেন কয়েক দিন এবং কখনো কখনো একদিন মাত্র। খরচ মাত্র হাজার ডলার যেটা প্রথম দিকে ছিল মিলিয়ন ডলার। গত ১৭ বছরে ১৫৪৫ প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার জিনের ইতিহাস জানা গেছে এবং আরও ৪৮০০ প্রজাতির উপর কাজ চলছে। জানা গেছে ২৬৭৫ প্রজাতির ভাইরাসের জিন এর রহস্য যাদের অধিকাংশ হল ফ্লু আর এইডস এর ভাইরাস। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল এর অধ্যাপক ডঃ ম্যাথু বলেন “এটা অণুজীববিজ্ঞানের চেহারা পাল্টে দিয়েছে”। “রোগের মানচিত্র” নাম দিয়ে অণুজীববিজ্ঞানীরা এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেছেন। তাঁরা রোগীর ক্লিনিক্যাল নমুনা সংগ্রহ করে নমুনায় উপস্থিত সকল জীবাণুর জিন সিকোয়েন্স করেন এবং বুঝতে পারেন কোন জীবাণু কত প্রকট ভাবে নমুনায় উপস্থিত। এভাবে বের করা হচ্ছে “রোগের মানচিত্র” আর একটা প্রাণঘাতী ভাইরাস অথবা একটা ওষুধ প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ার আগেই সাবধান হওয়া সম্ভব।
অন্যদিকে রোগের উৎপত্তি কোথায় সেটা ও বুঝা সম্ভব জীবাণুর জিন সিকোয়েন্স করে। চতুর্দশ শতকে ইউরোপ এ অভিশাপ হয়ে এসেছিলো “কালো মৃত্যু”। অণুজীববিজ্ঞানীরা আজকের বুবনিক প্লেগ এর সাথে ঐ “কালো মৃত্যু”র মিল খুঁজে পান আর সর্বশেষ জানা গেলো ঐ ভয়াবহ রোগের জন্ম চীন দেশে, আজ থেকে ৩০০০ বছর আগে। কিভাবে সম্ভব হয়েছে? সিকোয়েন্স দেখে।
ফিরে আসি ডঃ মুসের এর কথায়। তাঁর সেই রোগীর বয়স ছিল ৩৯। বাস করতো হিউস্টন থেকে ৭৫ মাইল দুরের এক গ্রামে। বাড়িতে কাজ করার সময় হঠাৎ তার দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। কাশির সাথে রক্তবমি শুরু হয়। রক্তচাপ ভয়াবহ রকমের কমে যায় আর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। ডাক্তাররা তাকে চতুর্থ প্রজন্মের এন্টিবাইওটিক দেন। হিউস্টন এর মেথডিস্ট হাসপাতাল এ ভর্তির ২ দিন পর লোকটি মারা যায়। ময়নাতদন্তের সময় ডাক্তাররা অ্যান্থ্রাক্স এর জীবাণু খুঁজতে থাকে এবং তার ফুসফুসে অ্যান্থ্রাক্স এর জীবাণুর মতো দেখতে লম্বা লম্বা ব্যাকটেরিয়া পেয়েও যায়। জীবাণু গুলো ল্যাবে এনে কালচার করা হল। তখন ডঃ মুসের ভাবলেন এদের জিন এর সিকোয়েন্স করবেন। মাত্র কয়েকদিনের মাথায় ডঃ মুসের তাঁর উত্তর পেয়ে যান। ওরা অ্যান্থ্রাক্স এর জীবাণু নয়। তাদের জাত ভাই। অ্যান্থ্রাক্স এর জীবাণু হল ব্যাসিলাস আন্থ্রাসিস আর ঐ ঘাতকরা ছিল ব্যাসিলাস সিরিয়াস।
কিছুদিন আগে হাইতি তে ঘটে যাওয়া কলেরার মহামারির প্রসঙ্গে আসি। ভুমিকম্পের পর ভয়াবহ কলেরা ছড়িয়ে পড়ে হাইতিতে। হার্ভার্ড এর ডঃ ম্যাথু ভেবে কুল পাচ্ছিলেন না কেন এই আকস্মিক মহামারী কারণ বিগত ১০০ বছরে হাইতিতে কেউ কলেরা দেখেনি। রোগীদের ক্লিনিক্যাল নমুনা থেকে পাওয়া কলেরার জীবাণুর জিন সিকোয়েন্স করা হল। এরপর সেই সিকোয়েন্স মিলিয়ে দেখা হল দুনিয়ার অন্য জায়গার কলেরার জীবাণুর জিনের সাথে। ল্যাটিন আমেরিকা বা আফ্রিকা নয়, ঐ জীবাণুর সাথে মিলে গেলো এশিয়ার কলেরার জীবাণুর জিন। অণুজীববিজ্ঞানীরা উপসংহার টানলেন – কলেরার মহামারীর জন্য ভূমিকম্প পরোক্ষভাবে দায়ী। ভুমিকম্পের পর দক্ষিণ এশিয়া থেকে যাওয়া সেচ্ছাসেবীরা বহন করে নিয়ে যায় ঐ কলেরার জীবাণু আর ছড়িয়ে পড়ে হাইতি জুড়ে। আর এভাবেই নতুন প্রজন্মের জীবাণু শিকারিরা আজ আরও অনেক বেশী নিখুঁত আর নির্ভুল নিশানা তাক করছেন।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১২ রাত ১২:৩৪