somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ একজন পাইলটের জীবনকথা।

১৭ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ৯:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


এক

পাইলট। তাকে কিশোরও বলা চলে না আবার যুবক বললেও ঠিক হবে না, এই দুইয়ের মাঝামাঝি। বাবা মা শখ করে নাম রেখেছিল পাইলট, ছেলে একদিন বড় হয়ে বৈমানিক হবে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সে ঠিকই পাইলট তবে তিনচাকার যান রিকশার। প্রতিদিন ভার্সিটির বাইরে রিকশা নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে দেখা যেতো পাইলটকে। প্রায় প্রতিদিনি পাইলটের রিকশায় বাড়ি ফেরা হতো। আমি ওর কোন কালের মামা সেইটা আমিও জানি না, ও নিজেও জানেনা। প্রথম দিন থেকেই আমাকে মামা বলে সম্বোধন করে আসছে। পাইলটের সাথে ভাড়া নিয়ে কখনো দরদাম করতে হয়নি, ওর একটাই কথা, “ মামা, আপনে যা খুশি দিয়েন, না দিলে নাই, আপনে আমার রিকশায় উঠেন এইটাই আমার জন্যে অনেক।“ নিজের দায়িত্ববোধ থেকেই ওকে ন্যায্য ভাড়ার থেকে বেশী দেয়া হতো। পাইলটের সাথে রিকশায় ভ্রমনে দারুন মজার সব অভিজ্ঞতা ছিল। দুইজন দেশ-বিদেশ, রাজনীতি, প্রেম ভালোবাসা এসব নিয়ে গল্প করতে করতে সময় পার করতাম। আমি যাই বলাতাম পাইলট তাতেই নির্দ্বিধায় সমর্থন দিত। ছোট বেলায় ক্লাস ফাইভ পাশ করেছে পাইলট। একদিন পাশের বাড়ির আমিনাকে থাপ্পর দিয়ে একটা দাঁত ফেলে দেয়। বাবার কাছে বিচার আসবে সেই ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসে ঢাকা শহরে। দক্ষিন কমলাপুরের রশিদ মিস্ত্রির কাছ থেকে আশি টাকা রোজ রিকশা নিয়ে কর্মজীবন শুরু করে। এখন রিকশা নিজের। যখন খুশি রিকশা চালায়, যখন খুশি ঘুরে বেড়ায়।



দুই

সপ্তাহে চার দিন আমার ভার্সিটির সামনে দাড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে পাইলট। আমার প্রতি এত টান কিসের সেটা আমার মাথায় ঢুকত না। শুধু বলতো, “মামা শিক্ষিত মানুষ ছারা কাউরে রিকশায় উঠাইতে মন চায় না, একজন শিক্ষিত মানুষ পেছনে বইসা থাকলে আমারও দুই একটু জ্ঞান আসবে।“ মুগ্ধ হতাম পাইলটের কথায়। মানুষের জ্ঞান আহরণের তেষ্টা কতখানি প্রখর হলে এসব কথা বলে, পাইলট সত্যিই একটা চিজ। মাঝে মাঝে আমি আর পাইলট রাজনীতি নিয়ে ভীষণ আলোচনা জমিয়ে দিতাম। আমি মন্ত্রী এমপিদের টেনে রাস্তায় নামাতাম আর পাইলট কিল ঘুষি লাথি শুরু করতো। ব্যাপক মজার এক অভিজ্ঞতা। কখনো মন খারাপ থাকলে ঠিকই পাইলট বুঝে নিত। আমার মন ভালো করার জন্যে রসাত্মক কথা বলতো। পাইলটের একটা বদঅভ্যেস ছিল খুব জোড়ে রিকশা টানতো। এত বারন করতাম শুনতই না। একদিনের কথা না বললেই নয়, আমি বাসায় ফিরছিলাম পাইলটের রিকশায়। সেদিনও জোড়ে রিকশা চালাচ্ছে, আমি বললাম,” পাইলট আসতে টানো, সামনে দেইখা চালাও।“ পাইলট সবগুলা দাত বের করে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “ মামা টেনশন নিয়েন না, আমি আছি না”; সেই মুহূর্তে সামনে এক ক্যাবের সাথে দিলো বাঁধিয়ে। আমি উপুর হয়ে পরে গেলাম রিকশা থেকে।



তিন

ক্লাসের ফারিয়া কে নিয়ে একদিন পাইলটের রিকশায় গেলাম নীলক্ষেত। এই ফারিয়া মেয়েটা এমন সব রোম্যান্টিক বিরক্তিকর কথা বলে যে মাঝে মাঝে মাথা ধরে যায়। রিকশায় বসে সে হাওয়ায় ভাসতে চায়। পাইলট আবার মুচকি মুচকি হাসে। ফারিয়াকে নীলক্ষেতে নামিয়ে দিয়ে বাসায় রওনা হলাম। পাইলট বলে,” মামা, এই আপা আপনের উপরে পাল্টি খাইছে মনে হয়। আমি সিউর।“ পাইলট কে বুঝিয়ে বললাম তেমন কিছু নয়, ও শুধুই আমার ব্যাচমেট। পাইলট মানতে নারাজ, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে নাকি বন্ধু হতে পারে না। কিছু একটা থাকে। শীলাও নাকি পাইলটকে এমন সব কথা বলে। শীলা নাকি ওর জানে জিগার, প্রান পরান, কইজার টুকরা । ওর আর শীলার গল্প শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যেতো। শীলাকে নিয়ে ঘুরতে বেরুলে পাইলট নিজের রিকশা চালায় না, অন্যের রিকশায় চড়ে দুজনে ঘুরে বেড়ায়। একদিন নাকি পাইলট শীলাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। রিকশা ঠিক করতে যেয়ে দেখে পেছনে শীলা নাই। পরে জানতে পারে সেই রিকশাওয়ালা ছিল শীলার বাবা। পাইলটের নাকি মেয়ে প্যাসেঞ্জার বেশী। কলেজ ভার্সিটির আপাদের নিয়ে রিকশা টানা নাকি রিকশাওয়ালাদের অন্যরকম রেপুটেশনের ব্যাপার। একবার ইডেনের এক আপা নাকি ভ্যালেন্টাইনস ডে তে ওকে একটা লাল গোলাপ দিয়েছিল। মেয়েটাকে গোলাপ দিয়েছিল তার এক প্রেমিক, সেটা পাইলটের হাতে ধরিয়ে দিয়ে নাকি দেখা করতে গেছে আরেক প্রেমিকের সাথে। এই নিয়ে হাসাহাসি চলতো আমাদের। মাঝে মাঝে পাশের রিকশার মেয়ে যাত্রী দেখলে বলে উঠত,” মামা, সাইজ দেখছেন? কি বানাইছে!” আমি যখন কড়া দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতাম বেক্কেলের মত একটা হাসি দিয়ে বলত, “ আমিতো রিকশাটার কথা বলছি, নতুন নামাইছে।“



চার

একবার দুই দিন পাইলটের কোন দেখা নেই। ভাবলাম অসুখ করেছে হয়ত। তৃতীয় দিনে দেখলাম মন খারাপ করে ভার্সিটির গেইটে বসে আছে। “ কিরে পাইলট, তোর মন খারাপ কেন?”

- আর কইয়েন না মামা, এই মাইয়া মানুষ জীবনে বিশ্বাস কইরেন না
- কেন? ছ্যকা খাইছিস নাকি?
- কি কমু কন, এই ছেমরির লাইগা কত কি করলাম, ছেমরি শেষে যাইয়া বিয়া বসছে হারুইন্নার লগে। হারুইন্না কি করে জানেন মামা?
- না জানি না, কি করে?
- হালায় মাইনষের রিকশা ভাড়ায় চালায়। কয় টেকা থাকে কন? আর আমার নিজের রিকশা, সবই আমার। এই ছেমরি কি বুইঝা বুইড়া ছাগলটারে বিয়া করলো?
- ওহ, এই কথা, এতে মন খারাপের কি আছে, আরেকটা আসবে।
- আর কইয়েন না মামা, এই চাপ্টার খতম, দুইদিন নাখালপাড়ায় গাঁজা টানছি। সব দুঃখ শেষ। ভাবতাছি এইবার বিলকিসের লগে চান্স লমু। বিলকিস বড় ভালো মাইয়া। আমারে আবার লাইক করে। এইবার প্রেম পিরিতি না, ডাইরেক্ট একশন বিয়া কইরা ফালামু ভাবতাছি। মামা, একটা কথা কমু?
- হুম বলো।
- এই দুইদিন আপনেরে অনেক মিস করছি।

এই যাবত তিনটা প্রেমের প্রত্নতাত্নিক রহস্য পেয়েছি পাইলটের। বিলকিস চতুর্থ হতে যাচ্ছে। নিন্মবিত্ত প্রেমকথা শুনতে খারাপ লাগতো না। প্রতিটা মানুষের জীবনে নিজের কিছু স্বপ্ন, আশা, ভালোবাসা থাকে। নিন্মবিত্ত এসব মানুষের সাথে খুব আপন হয়ে না মিশলে বুঝাই যায়না জীবনের কত রূপ কত রঙ।


পাঁচ

প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেলো পাইলটের কোন দেখা নেই। ভাবলাম বিলকিসের সাথে হয়ত কোন কাহিনী হয়েছে আবার, তাই হয়ত গাঁজা খেয়ে নাখালপাড়ায় পরে আছে। আরো এক সপ্তাহ কেটে গেলো। বুঝতে পারছিলাম না কি হলো পাইলটের। যে ছেলে দুইদিন আমাকে না দেখলে তৃতীয়দিন ছুটে আসে, সেই ছেলের দুই সপ্তাহ কোন খবর নেই। একবার টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে সপ্তাহখানেক ঘরে পরে ছিলাম। পাইলট ভার্সিটিতে আমাকে না পেয়ে চলে এসেছিল বাসায়। এই ছেলের তো এমন করার কথা না। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছিল পাইলটের জন্য, চলে গেলাম নাখালপাড়া রেললাইনের বস্তিতে। সরোয়ার মিয়ার কাছে জানলাম পাইলট আর নেই। দুই সপ্তাহ আগে বাসের নিচে রিকশা সহ চাপা পরে স্পটেই মারা গেছে। সহ্য করতে পারছিলাম না। এমন হাস্যোজ্বল একটা ছেলে এভাবে চলে গেলো? এমন করুণ মৃত্যু কেন পাইলটের হবে?


যখনি কোন রিকশাওয়ালা মামা বলে ডাকতো কেমন যেন অপরিচিত মনে হতো। পাইলটের মত করে কেউ কেন ডাকে না? ঢাকা শহরের হাজারো রিকশা চালকের মাঝে খুজতাম পাইলটকে। হয়ত দেখা যাবে পেছন থেকে এসে চমকে দিয়ে বলবে, “ মামা রিকশায় উঠেন” , কিন্তু কখনো হয়নি এমন। তবুও আমি আশায় থাকতাম পাইলট আসবে। আমার স্বপ্নে প্রায়ই পাইলট এসে দেখা দিয়ে যেতো। বলতো,

“ মামা, ঘুম থেকে উঠেন। রিকশা নিচে রাইখা আসছি।“

ছবিঃ নিজের এ্যালবাম থেকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ৯:৫০
৫৪টি মন্তব্য ৫২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×