somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোলাপ রঙে বিদায়

১৮ ই মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



উতপ্ত দুপুর, ছাতা মাথায় মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে বাসস্ট্যান্ডে। হালকা বেগুনি রঙের জামায় তাকে দারুন মিষ্টি লাগছে। কাঁধের কলেজ ব্যাগটা বুকে জড়িয়ে তিন নাম্বার বাসে উঠে গেল।

প্রতিদিন এখানেই দাঁড়িয়ে থাকি একনজর দেখবো বলে। দূরে দাঁড়িয়ে কখনো চোখ দেখি আবার কখনো তার হাতের আঙুল। বেশ চিকন আর লম্বা আঙুলগুলো তর্জনী আঙুলে একটা আংটি পরে, খুব সুন্দর নেইলপালিশ দেয়া। মেয়েটিকে আমার ভীষণ ভালো লাগে।

আমি জানি, আমাদের প্রেম হবে একদিন, খুব সুন্দর প্রেম হবে। একসঙ্গে বেড়াতে যাবো, রিকশায় চড়ে গল্প করবো, বিকেলের নরম আলোয় তাকে দেখবো আর মনে হবে, আমার পৃথিবীটাও আমাদের প্রেমের রঙে রাঙিয়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রেম মানেই কি কেবল সুন্দর মুহূর্ত? আমরা ঝগড়াও করবো, অভিমান হবে, সে রাগ করে বাসস্ট্যান্ডে আমাকে একা রেখেই চলে যাবে। আমি দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়া দেখবো, সে কি ফিরে আসবে নাকি অভিমান করে চলে যাবে?

আমরা হানিফ মামার টং দোকানে বসে কড়া লিকারে লাল চায়ের আড্ডায় হারিয়ে যাবো। ও যখন ক্লাস শেষ করে বাসায় ফিরবে আমরা একসঙ্গে হাঁটবো লাল ইটের পথ ধরে। রাস্তায় হঠাৎ বৃষ্টি এলে ছাতার নিচে একটু কাছাকাছি আসবো। আর কোনো একদিন, হয়তো খুব সাধারণ কোনো দিনে, সে আমার দিকে তাকিয়ে বলবে,

-"তুমি কেন এত দেরি করলে?"

আমি দেরি করিনি, মেয়েটিই হয়তো আগেভাগেই ঠিক করে রেখেছিল এই প্রশ্নটা করবে। আমি ওকে বলবো-

''তোমাকে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে আমার ভাল লাগে তাই দেরি করে আসলাম।"

এই কথা শুনে সে অনেক রাগ করবে আর বলবে-

''অপেক্ষা করতে আমার ভাল লাগে না। কাল থেকে আমার আগেই চলে আসবে''

আমি বলবো -'

''আচ্ছা কাল থেকে তোমাকে অপেক্ষায় থাকতে হবে না।''

আজও প্রতিদিনের মতোই বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় ছাতা, গায়ে নীল রঙা জামা, কাঁধের ব্যাগটা বুকের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছে। তিন নাম্বার বাস এলেই উঠে যাবে, জানি।

কিন্তু আজ আমি এক পা এগিয়ে গেছি। হাতের মধ্যে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো, তাতে শুধু একটা লাইন লিখেছি—

"তোমাকে ৫১টা গোলাপ দিয়ে বলতে চাই ভালবাসি"

বাস আসার ঠিক আগমুহূর্তে কাগজটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। চোখ তুলে তাকাল। প্রথমবার! তারপর সোজা বাসে উঠে গেলো। কাগজটা ওরব হাতেই রয়ে আছে। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম, যেমন প্রতিদিন থাকি। কিন্তু আজ আমার বুকের ভেতর কিছু একটা অদ্ভুতভাবে কাঁপছে। কাগজটা কি রেখবে নাকি ফেলে দিবে?

সেদিনের পর থেকে প্রতিদিনই অপেক্ষা করি। কিছু একটা হবে, হয়তো একটু ইঙ্গিত দিবে , হয়তো আমায় দেখে একটু হাসবে...

পরদিন মেয়েটি ঠিক আগের মতোই, মাথায় ছাতা, কাঁধে ব্যাগ, হালকা কাঁচা হলুদ রঙা জামায় তাকে দারুন লাগছে। চোখে কাজল ও ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিকে তাকে অনেক পরীর মত লাগছে। বাস ওর সামনে এসে থামলো সে উঠে গেল। আমি দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম।

তারপরের দিন, আরেকটা দুপুর। আজ আমি আরেকটু সাহসী। তিন নাম্বার বাস আসার মুহূর্তে একটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে কি আমার দিকে একটু করে দেখল। এক ঝলক চোখে চোখ পড়েছিল মনে হলো। আমি শিউরে উঠলাম, মেয়েটি আজ এক সেকেন্ডের জন্য আমার দিকে তাকিয়েছে, খুব হালকা একটা হাসি দিয়েছে। যেন বৃষ্টি নামার আগের সেই হালকা বাতাস, যেন নিঃশব্দে ফুটে ওঠা একটা কলি। তারপর প্রতিদিনের মত বাসে উঠে গেল আমি দাঁড়িয়ে রইলাম কিন্তু আমার পৃথিবী আজ অন্য দিনের চেয়ে একদমই আলাদা আমার চারপাশ যেন লাল-নীল-বেগুনি রঙে রাঙিয়ে যাচ্ছে।


আমি আজ দাঁড়িয়ে থাকিনি, তার জন্য অপেক্ষা করছিলাম কিন্তু আজ সে এলো না। প্রতিদিনের মতোই তিন নাম্বার বাস আসে আবার চলে যায় কিন্তু সে আজ নেই। খুব খারাপ লাগছিলো। কষ্ট পাচ্ছিলাম খুব। দিনটি খুব কষ্টে পার করলাম।

আজ বাসস্ট্যান্ড এসেছে। কাঁদে কালো রঙের ব্যাগ হাতে ছাতা, কমলা রঙের জামায় খুব মায়াবী লাগছে। ভীষন মিষ্টি দেখতে লাগছে। সে আজ আমার দিকে তাকাচ্ছে না আর সে কখনো তাকিয়ে দেখেও না, কিন্তু আমি জানি, সে বুঝতে পারছে—আমি এখানেই আছি।কিন্তু এমন ভান করছে যেন আমায় সে দেখেইনি। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম৷ হুট করে হাতে গুজে দিলো একটা কাগজ। খাতা থেকে ছিঁড়ে নেওয়া ছোট্ট একটা টুকরো। সে বাসে উঠে চলে গেলো। কাগজটা খুলে দেখলাম তাতে শুধু চারটি শব্দ—

"গোলাপ ছাড়া আসবে না?"

আমার খুশীর সীমা থাকলো না। অবশেষে দিনটি এলো। তাহলে সেদিন আমার সেই চিরকুটটা সে দেখেছিল। আমি কাল ৫১টা লাল গোলাপ নিয়ে তার সামনে দাঁড়াবো।


বাসস্ট্যান্ডে আমি দাঁড়িয়ে আছি, হাতে ৫১টা লাল গোলাপ। সে আসবে। আজ একটু দেরি করেছে, হয়তো ইচ্ছে করেই। হয়তো একটু লুকোচুরি খেলতে চাইছে আমার সঙ্গে। আমি অপেক্ষা করছি।

তিন নাম্বার বাসটা দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। এলো না এখনও ঐ তো দূরে দেখা যাচ্ছে, সে রাস্তার ধার ঘেষে হেটে আসছে। দেখতে পেলো বাস চলে এসেছে তাই সে ছাতাটা একটু নামিয়ে ধরল জোরে হেঁটে এগিয়ে আসছে বাস ধরার জন্য। ঠিক তখনই পেছন থেকে একটা ট্রাকের বিকট শব্দে হর্ন বাজল। সবকিছু খুব দ্রুত ঘটল।

সে একটু দৌড়ে এগিয়ে এলো বাসটা ধরতে, হঠাৎ পা পিছলে গেল রাস্তার ভেজা ধুলোয়, শরীরটা কেমন যেন বাঁকিয়ে পড়ে গেল ট্রাকটা ওর উপর দিয়ে চলে গেল।

শব্দ হলো না, চিৎকার হলো না, কিছুই না। পৃথিবী থমকে গেল।

বাসের যাত্রীরা হুড়োহুড়ি করে নেমে এল, রাস্তায় এক মুহূর্তের জন্য নেমে এল নীরব হয়ে গেলো। কালো মেঘে ঢেকে গেলো পুরো আকাশ। আমি দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক আগের জায়গায়। আমার হাতে এখনো ৫১টা লাল গোলাপ। আমি তার নিথর দেহের পাশে এগিয়ে যাই বসি ওর পারে। ধীরে গোলাপগুচ্ছটা তার পাশে রাখি। কয়েকটি গোলাপ পড়ে যায় রক্তে, লাল হয়ে যায় আরো লাল। এম্বুল্যান্স আসে তাকে নিয়ে যায় আমিও যাই হাসপাতালে সেই এম্বুলেন্সে চড়ে। গোলাপগুলো রাস্তায় পরে রইলো। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলো। আমি অপেক্ষায় থাকি বাহিরে। ডাক্তার বের হলো অনেকক্ষন পর উনার চোখে মুখে নিরবতা। শেষ চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলো না। আমি ফ্লোরে বসে পরলাম যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পরলো। আমার বমি হলো খুব যেন রক্ত বমি চোখে কিছুই দেখছি না সব ঘোলাটে লাগছে। চারিদিকে অন্ধকার নেমে এলো।

আজ বাসস্ট্যান্ডে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। কেউ অপেক্ষা করছে না। কেউ আর তিন নাম্বার বাসে উঠবে না।
আমার গোলাপ আর দেওয়া হলো না। আমি দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ একটা মৃদু বাতাস এল, খুব হালকা, ঠিক যেমন সেদিন ছিল, যেদিন সে প্রথমবার আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। তিন নাম্বার বাস এলো আমি তাকিয়ে রইলাম একবারও চোখের পলক না ফেলে...

আমি জানি, সে কোথাও যায়নি। হয়তো এখানেই আছে, এই বাসস্ট্যান্ডেই দাঁড়িয়ে আছে, অন্য কোনো সুন্দর বিকেলে অপেক্ষায় অথবা ৫১টা লাল গোলাপের অপেক্ষায়...
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:২৭
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×