আমাদের গ্রামে একটি গল্প প্রচলিত আছে। গল্পটি হলো কোন ভাই যখন তার বোনের শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে যায় এবং বোনকে যখন জিজ্ঞেস করে কেমন আছো? বোনটি তখন উত্তরে বলে-
‘‘রান্ধি বালা রান্ধি আমি
ঢহি ভরা ভাত-
খাই বালা খাই আমি
ঢহি পুছা ভাত-
মায়েরে গিয়া কইয়্যো
বড়ই সুহে আছি-
সন্দি বেতের মাইর খাইয়া
ঘর দীঘালে নাচি।
গাঁয়ের মুরুবিবদের কাছে শোনা শ্লোকের আকারে কথাগুলোর মধ্যে আমি নারী নির্যাতনের সুস্পষ্ট ছবি খুঁজে পাই যা অত্যন্ত হৃদয় বিদারক।
কবি জসীম উদ্দীন তার কবর কবিতায় লিখেছেন-
‘‘এইখানে তোর বুজির কবর পরীর মতন মেয়ে
বিয়ে দিয়েছিনু কাজীদের ঘরে বুনিয়াদী ঘর পেয়ে।
এত আদরের বুজিরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে
হাতেতে যদিও না মারিত শত যে মারিত ঠোঁটে।
কবি জসীম উদ্দীনের এই কবিতাতে রয়েছে আমাদের দেশের নারীরা কতটুকু মানসিক নির্যাতনের শিকার তার প্রতিফলন বর্তমানে নারীর উপর এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, যৌতুকের কারণে হত্যা করা, কথায় কথায় তালাক দেয়া এসব নির্যাতনের পাশাপাশি মানসিক নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। আজ আমি নারীর উপর মানসিক নির্যাতনের দিকটিই তুলে ধরতে চাই। আমি মনে করি নারীর মানসিক নির্যাতনের বিষয়টি যতটা আমাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা ছিল ততটা হয়নি। কলকাতা, দিল্লী, মুম্বাই বেঙ্গালোর ও চেন্নাইতে এক হাজার চাকরীরত নারীকে নিয়ে করা সমীক্ষায় দেখা গেছে বিয়ের পর ৩৮ শতাংশ মেয়েকে শারীরিক নির্যাতন ও ৭২ শতাংশ মেয়ে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। ভারতের চেয়ে আমাদের দেশের নারীর এই চিত্রটি আমি আরো করুণ মনে করি।
একজন নারী শারীরিক মানসিক নির্যাতনের শিকার পরিবারের পুরুষ দ্বারাও হতে পারেন এমনকি নারীর দ্বারাও হতে পারেন। আর এ ধরনের নারী এবং পুরুষকে আমি বলতে চাই নেগেটিভ নারী ও নেগেটিভ পুরুষ। যেমন ধরুন আপনার কন্যা কিংবা বোনকে একদিন পরের ঘরে তুলে দিতে হবে। আর এ প্রক্রিয়াটি সম্ভব হয় বিয়ের মাধ্যমে। এ বিয়েকেই কেন্দ্র করে গড়ে উঠে যত ছলচাতুরী আর মিথ্যার বেসাতি। আজকাল বায়োডাটার মাধ্যমে পাত্রপাত্রী নির্বাচন করা হয়। মেয়ের পরিবারের ক্ষেত্রে এ ছলচাতুরী খুব কম হয়ে থাকে। ছেলের পরিবার থেকে এ ছলচাতুরীর দৌরাত্ম্য খুব বেশি। বায়োডাটায় মিথ্যা ডিগ্রী সাজিয়ে B.B.A, M.B.A লিখে পাত্রীর পরিবারের সামনে আকর্ষণীয় করে তোলে। আমাদের সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে ছেলের সার্টিফিকেট দেখার নিয়ম নেই। যার কারণে অনেক বিএ. এম.এ ডিগ্রীধারী মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট কিংবা কোন ডিগ্রীধারী নয় এমন ছেলের বউ হয়ে নিজেকে বলি দিতে হয়। আমরা জানি শুধু গ্রামের মেয়েরাই এসব প্রতারণার শিকার হয়ে থাকে কিন্তু না বর্তমানে শহুরে শিক্ষিত মেয়েরাও এ ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছে। আমরা মনে করছি নারীরা শিক্ষিত হলেই নারী নির্যাতন কমে যাবে, তারা প্রতারণার হাত থেকে বাঁচবে। কিন্তু আজকাল শিক্ষিত নারীর উপর শারীরিক ও মানসিক দুধরনের নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। শিক্ষিত নারীর ব্যক্তিত্ব ও মেধাকে নেগেটিভ নারী ও নেগেটিভ পুরুষ হিংসার চোখে দেখছে। বর্তমানে আরেকটি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে আমাদের নারীরা। সেটা হচ্ছে বিদেশ থেকে আসা কোন পরিবার তার ছেলের জন্য তড়িঘড়ি করে মেয়ে দেখে বিয়ে করিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেক্ষেত্রে বেশীর ভাগই দেখা যায় বিয়ের সময় তাদের দেয়া তথ্যের সাথে পরবর্তীতে কোন মিল নেই। এ ক্ষেত্রে বিয়ে হওয়া মেয়েটিকে পড়তে হয় পাতানো ফাঁদে। এইভাবে একটি পরিবারের কুচক্রী পুরুষ ও নারীর দ্বারা আমরা নারীরাই নির্যাতিত হচ্ছি।
কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘‘মুনাফিক নারী ও মুনাফিক পুরুষ সকলেই পরস্পরের সাথী ও সহযোগী। তারা অন্যায় কাজের প্ররোচনা দেয় এবং ভাল ও ন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে এবং কল্যাণকর কাজ থেকে নিজেদের হাত ফিরিয়ে রাখে।
পরিবারে সমাজে এ কাজগুলো অনেকে ইসলামী জ্ঞান না থাকার ফলে করছে। আবার লেবাসধারী ইসলাম যাদের মধ্যে রয়েছে তারাও করছে।
‘‘পৃথিবীতে যা কিছু সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।
জাতীয় কবির এই সুন্দর উক্তিটির সূত্র ধরে বলতে পারি একজন নারী ও একজন পুরুষের সুন্দর সহাবস্থানের মাধ্যমে গড়ে ওঠে একটি পরিবার। এই পরিবারের পুরুষের যেমন রয়েছে তার অধিকার পাওয়ার স্বাধীনতা তেমনি রয়েছে একজন নারীরও। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়- যে কোন নারী বৈধ পন্থায় পুরুষের মতই ব্যক্তিগতভাবে সম্পত্তির মালিক হতে পারে। বিবাহ অনুষ্ঠানের সময় স্বামী তার স্ত্রীকে মোহরানা প্রদানে আইনত বাধ্য। স্ত্রীর সমস্ত ব্যয়ভার স্বামীকেই বহন করতে হয় বাধ্যতামূলকভাবেই। স্ত্রীর ব্যক্তিগত কোন সম্পত্তি থাকলে তাতে হস্তক্ষেপ করার অধিকার স্বামীর নাই। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় স্ত্রীর উপার্জনের টাকাকে স্ত্রী নিজের টাকা বলে দাবী করতে পারে না। যদি কেউ কখনো করে তাহলে তার উপর স্বামী, শ্বাশুড়ী, ননদ থেকে নানা ধরনের আক্রমণ শুরু হয়ে যায়।
ইসলামী শরীয়তে পুরুষ যেমন স্বাধীন সত্তা, নারীও তেমন স্বাধীন সত্তা। একজন পুরুষ যেমন স্বাধীনভাবে তার প্রতিপক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারে, সম্পত্তি উপার্জন ও ক্রয় বিক্রয় করতে পারে, আর্থিক লেনদেন করতে পারে তেমনি একজন নারী উক্ত কাজগুলো করতে পারে। এক্ষেত্রে স্বামী বা পিতার সম্মতির প্রয়োজন হয় না।
অজ্ঞানেই হোক আর সজ্ঞানেই হোক একজন নারীর প্রতি নেগেটিভ আচরণ নারী নির্যাতনের মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলছে। এসব বোধ থেকে যদি আমরা নারীরা সচেতন ও সহনশীল না হই তাহলে আমাদের নারীরা দিন দিন নির্যাতিত হতেই থাকবে। একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীর প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। পুরুষের পাশাপাশি একজন নারীকেও তার নেগেটিভ মনমানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। তবেই আমাদের সংসার থেকে, সমাজ থেকে, রাষ্ট্র থেকে নারী নির্যাতন রোধ করা সম্ভব হবে।
-মোহছেনা পারভীন আনিস