এখন বিষয়টি আজ যদি চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ব্যাখ্যা না করেন, তাহলে এই স্থগিত আদেশ নিয়ে ফুল বেঞ্জে আবার হয়তো উভয় পক্ষের বিতর্ক করতে হবে। সেই বিতর্কের শেষে আবার হয়তো কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ের উপর রিভিউ আদেশ আসবে। সেই রিভিউ করতে আরো সময় লাগবে। তারপর যদি রিভিউ আদেশেও কাদের মোল্লার ফাঁসি'র আদেশ আসে, তাহলে সেই নির্দেশ আবার কারা কর্তৃপক্ষের কাছে যাবে। তখনো কাদের মোল্লার পক্ষে আরেকটি শেষ সুযোগ থাকবে। সেটি হল মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর ক্ষমা প্রার্থণার আবেদন করা। আর আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে যদি কাদের মোল্লা ফাঁসির রায় পাল্টাতে পারেন, তাহলে বুঝতে হবে দেশে আইন ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। কতিপয় লোক এটা নিয়ে একটা তামাশা করছেন।
কাদের মোল্লার আইনজীবীদের উচিত ছিল সরকার পক্ষের আইনজীবীদের উপস্থিত রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা। সেটি তারা করেনি। তাহলে সেই দায়টি তারা চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের দিকেই রাখছেন। এ বিষয়ে এখন চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন। যদি আমরা আইনের শাসনের প্রতি আস্থা রাখতে চাই, আমার বিশ্বাস, চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন সেই সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাটি জানিয়ে এই কুয়াশাচ্ছন্ন ধোয়াশা বিষয়টির নিস্পত্তি করবেন।
পাশাপাশি আমাদের সবার জানার জন্যেই এটি আরো পরিস্কার করা প্রয়োজন যে, প্রধান বিচারপতি'র অনুমতি ছাড়া কি চেম্বার বিচারপতি এভাবে সরকারি পক্ষের আইনজীবীদের অনুপস্থিতিতে শুধুমাত্র আসামী পক্ষের আইনজীবীদের নিয়ে আদালত বসিয়ে কোনো আদেশ দিতে পারেন কিনা? যদি পারেন, তাহলে কাদের মোল্লা'র ফাঁসির আদেশ নিয়ে আরো অনেক আইনি জটিলতা তৈরি করাই এই স্থগিত আদেশের কোনো অভিপ্রায় কিনা তাও একটি প্রশ্ন।
ওদিকে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদণ্ড স্থগিত রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি পাঠিয়েছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনার নাভি পিল্লাই। এর আগে সোমবার জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের স্বাধীন দুই বিশেষজ্ঞ গাব্রিয়েলা নাউল ও ক্রিস্টফ হেইন্স এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। প্রশ্ন হল, জাতিসংঘ মানবাধিকারের নামে এখন যে কাজটি করতে এতো বেশি তৎপর, ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষকে নির্বাচারে হত্যা করা সময়, তিন লাখ মা বোনকে সম্ভ্রম হানির সময়, সারা বাংলাদেশে হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নি সংযোগের সময় এই জাতিসংঘ তখন কোন গুহায় লুকিয়ে ছিল? এই জাতিসংঘের তখন ৩০ লাখ হত্যার সময় মানবাধিকার কোথায় ঘুমিয়ে ছিল? তিন লাখ মা বোনকে ধর্ষণের সময় এই জাতিসংঘ কেন নিশ্চুপ ছিল?
আসলে জাতিসংঘ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ছদ্মবেশী চামচা। ১৯৭১ সালে আমেরিকা সুস্পষ্টভাবে পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে ছিল। এখনো তারা সেই একই পক্ষে নানাভাবে সক্রিয় আছে। জাতিসংঘের ছদ্মাবরণে আসলে আমেরিকা এই খেলাটি খেলছে। আর সেই খেলায় তাদের শরিক বিএনপি এবং পাকিস্তান সকল মাল মশলা যোগান দিচ্ছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে আমেরিকা বাংলাদেশকে নামমাত্র স্বীকৃতি দিলেও ১৯৭১ সালের সেই পরাজয়ের গ্লানি তারা এখনো ভোলেনি। জামায়াতে ইসলামী এবং যুদ্ধাপরাধীদের কেউ সেই দোষ এখনো সরাসরি স্বীকার করেনি। ১৯৭১ সালে তাদের যেরকম কার্যকলাপ ছিল এখনো ঠিক একই রকম জ্বালাও পোড়াও খুনের চরিত্র একটুকুও বদলায়নি। গতকাল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হবে শুধুমাত্র এই খবর ছড়িয়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে জামায়াত-শিবিরের দুশমনরা যেভাবে জ্বালাও পোড়াও হামলা করেছে, তা থেকে এটাও সুস্পষ্ট যে, তারা দোষ স্বীকার তো করবেই না, বরং এই বিচারও তারা মানে না।
আর তাদের সঙ্গে এই কাজে প্রধান ইন্ধনদাতা তো দেশের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি। যারা মুখে মুক্তিযুদ্ধের কথা বললেও তারা আসলে জামায়াতের আরেকটি আধুনিক ভার্সান। বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা খন্দকার মাহবুব হোসেন এখন কাদের মোল্লার আইনজীবী। তাদের মধ্যে ১৯৭১ সালেও কোনো বিরোধ ছিল না, ২০১৩ সালে এসেও কোনো মতভেদ নেই। তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সরাসরি বিপক্ষের একটি দল। কিন্তু নানা পরিচয়ে তারা বাংলাদেশে নানাভাবে বিস্তার করেছে। কর্নেল তাহেরের সামরিক আদালতে বিচারের সময় জেনারেল জিয়া কতোটা সময় নিয়েছিলেন? দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার নাম করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী এই প্রতিশক্তিকে কেন বিচারের নামে এতো সময় দেয়া হচ্ছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নুরেমবার্গ আদালতে মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় তো এতো সুযোগ সুবিধা তাদের দেওয়া হয়নি? টোকিও আদালতে তো যুদ্ধাপরাধীদের ওতো সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়নি? কম্বোডিয়া, বসনিয়া, এমনকি ইরাকে স্বয়ং সাদ্দাম হোসেনের বিচারে তো এতো সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়নি? তাহলে স্বীকৃত স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তিকে কেন বাংলাদেশে এতো সুযোগ সুবিধা দিয়ে বিচার করতে হবে?
যদি আইনের ফাঁক গলিয়ে কাদের মোল্লা খালাস পেয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আর কোনো আস্থা থাকবে না। তখন অনেক কিছুই ঘটবে। আরেকটি মুক্তিযুদ্ধের কথা যে বলা হয়, সেটি সত্যি সত্যিই তখন শুরু হবে। আর পরাজিত শক্তির সমূলে নিপাত না হওয়া পর্যন্ত সেই যুদ্ধটি বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম করবে বলেই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সোভিয়েত রাশিয়ায় বিপ্লবের পরে পরাজিত শক্তিকে মহামতি লেনিন বাঁচার সুযোগ দেননি। কিউবার বিপ্লবের পর মহামতি ফিডেল পরাজিত শক্তিকে আর কোনো সুযোগ দেননি। ভিয়েতনামে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পরে মহামতি হো চি মিন পরাজিত শক্তিকে আর কোনো সুযোগ দেননি। এমন কি চীনে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পরে পরাজিত শক্তিকে আর বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। আর বাংলাদেশে পরাজিত শক্তিরা শুধু রেহাই-ই পায়নি, তারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। জেনারেল জিয়ার নির্দেশে তারা নাগরিকত্ব ফিরে পেয়েছে। খালেদা জিয়া তাদেরকে মন্ত্রী বানিয়ে দেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেছেন। আর বিএনপি এখনো সেই পরাজিত শক্তিকে মাঠে নিয়ে সারা দেশে সহিংস ধ্বংসলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। আর আওয়ামী লীগ এখনো বিচারের নামে তাদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধার অযুহাত করছে। যুদ্ধাপরাধী পরাজিত শক্তির বাংলাদেশে বসবাসের কোনো সুযোগ নাই। এটাকে যারাই যেভাবে রাজনৈতিক অযুহাত তুলে সুযোগ করে দেবে, নতুন প্রজন্মকে সেইসব পক্ষকে তীলে তীলে চিনে রাখতে হবে।
যদি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গঠন করার মানসে সত্যি সত্যিই আমরা গড়ে তুলতে চাই, তাহলে পরাজিত শক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের আপোষের সুযোগ নাই। এই সুযোগ নিয়ে বিগত ৪২ বছরে পরাজিত অপশক্তি অনেক শক্তভাবেই আবার ঘাঁটি গেড়েছে। সেই ঘাঁটি উৎপাটনের জন্য এখনই লড়াই প্রয়োজন। মিঠে কথায় আর লোক দেখানো বিচারের তালবাহানার নামে সেই আসল কাজটি কেউ সম্পন্ন করছে না। যদি আমরা পরাজিত অপশক্তিকে সুযোগ দেই তাহলেও তাদের আচরণে কোনো পরিবর্তন বিগত ৪২ বছরে হয়নি বরং তারা আবার মাথা উচু করে শক্তভাবেই দাঁড়িয়েছে।
এখন বাংলাদেশের মানুষকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোন পথে যাবে? তারা কি পরাজিত অপশক্তিকে নিয়ে একসঙ্গে হিংসার সহ অবস্থান করবে? নাকি তাদের পাকিস্তান ফেরত পাঠাবে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নানা পর্যায়ে নানাভাবে সময় ক্ষেপণ তাদের একটি কৌশল। আগামী নির্বাচনে তারা যে কোনো ভাবে বিএনপি'র নের্তৃত্বে ক্ষমতায় আসলে এই বিচার প্রক্রিয়া তারা বন্ধ করে দেবে। তখন বরং স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে বাংলাদেশে অবস্থান করাটাই অত্যন্ত কঠিন হয়ে যাবে। কারণ তারা হত্যার রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। বঙ্গবন্ধু'র মত তারা সবাইকে তখন হত্যা করবে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেট হামলাও একই সূত্রে গাঁথা। এটিকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করার সুযোগ নাই। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের কথা শুধু কথায় নয় সরাসরি সেই কাজটি করতে হবে। করতে হবে কঠোর হাতে। সেখানে দয়া দাক্ষিণ্যের কোনো সুযোগ নাই। কাদের মোল্লা'র ছেলের বক্তব্য যারা টেলিভিশনে দেখেছেন, সেই বক্তব্যে কি ছিল? তারা ক্ষমা চাইবে না। বরং ইসলামী আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে তারা একটি ইসলামী রাষ্ট্র বানাতে বদ্ধ পরিকর। কাদের মোল্লার ছেলে তো মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্মগ্রহন করেনি। তার বাংলাদেশের প্রতি আস্থা থাকার কথা ছিল। নতুন প্রজন্ম হিসেবে তারও বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা ছিল। ৩০ লাখ শহীদের আত্মার প্রতি সম্মান দেখানোর কথা ছিল। তিন লাখ মা-বোনের ইজ্জ্বতের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের কথা ছিল। কিন্তু সে পরাজিত অপশক্তির সেই পুরানো ভাষায়ই কথা বলছে। তাদের চারিত্রিক কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলাদেশকে তারা স্বীকার করে না এটাই আসল কথা।
এখন কাদের মোল্লার রায় নিয়ে চেম্বার আদালত কি করে সেজন্য আরো হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু ৪২ বছর অপেক্ষা করে যে জাতি'র ঘুম ভাঙেনি, সেই জাতি কিভাবে এই অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে সেখানেও কিছু কিন্তু রয়ে যায়!!
সোজাকথা, আমরা বাংলাদেশে কোনো স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত অপশক্তির উপস্থিতি আর দেখতে চাই না। কাদের মোল্লা'র ফাঁসি হবে, বাংলার মাটিতেই সেই ফাঁসি হবে। হয়তো আইনের ফাঁক গলিয়ে কিছুটা সময় ক্ষেপণ করা যাবে। কিন্তু বাংলার মাটি এখন কাদের মোল্লা'র ফাঁসি ছাড়া আর কিছুই মেনে নেবে না। এটাই আসল কথা। জয় বাংলা। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।।।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ সকাল ৯:৩৪