১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথের 'নৈবদ্য' কাব্যগ্রন্থে ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’ কবিতাটি প্রকাশিত হবার ৭৪ বছর পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ইন্দিরা গান্ধী সরকার ভারতে জরুরি আইন জারী করে গুরুজির এই কবিতাটি নিষিদ্ধ করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিংহ ঐতিহাসিক রাজ নারায়ণ মামলায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির অভিযোগে ছয় বছরের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেছিলেন।
এই রায়ের ১৩ দিন পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদকে দিয়ে ভারতীয় সংবিধানের ৩৫২ নং ধারা অনুযায়ী জরুরী অবস্থা ঘোষণা করিয়েছিলেন। যা ২১ মার্চ ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রায় দীর্ঘ ২১ মাস চালু ছিল। এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিংহ রায়বেরিলি লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হিসাবে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার খারিজ করে দিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক এই রায় ঘোষণার সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো- এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরোনোর দিনই গুজরাট বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল বেরিয়েছিল এবং তাতে কংগ্রেস পরাজিত হয়েছিল। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ইন্দিরা গান্ধীর শাসনামলের এই ২১ মাসকে ধরা হয় অন্ধকার যুগ। এই সময়ে ভারতের শিল্প-সংস্কৃতির ওপর নানান কিসিমের নিষেধাজ্ঞা ও অত্যাচার চালানো হয়েছিল। বহু নাট্যকর্মীর ওপর নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ডিসেম্বর মাসে নাট্যকার অমল রায়ের ওপর একদল সশস্ত্র গুণ্ডা আক্রমণ করেছিল। ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে পুলিশ খানাতল্লাশি চালিয়েছিল। ১৯৭৬ সালে বারাকপুরে নটতীর্থ ‘নিজবাসভূমে’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার সময় পুলিশি বাঁধার মুখে পরেছিল।
১৯৭৬ সালে নৈহাটিতে মুকুন্দদাস যাত্রাসমাজ শরৎচন্দ্রের ‘অভাগী স্বর্গ’ গল্পের পালারূপ অভিনয় করতে গেলে তাঁদের ওপর তখন আক্রমণ চালানো হয়েছিল। এভাবে তখন তারকেশ্বরে ‘হে রাজবিদ্রোহী’, হাওড়ার শিবপুরে ‘দিন আসবেই’, বসিরহাটে ‘লাসবিপণি’, শ্রীরামপুরে ‘রক্তের জোয়ারে শুনি’ প্রভৃতি নাটকগুলি মঞ্চস্থ করার সময় তাঁদের ওপর আক্রমণ চালানো হয়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধীর জরুরী অবস্থা চলাকালীন চলচ্চিত্র জগতও তখন প্রচণ্ড রকমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ওমপ্রকাশের 'আঁধি', চেতন আনন্দের 'অফিসার' ও 'সাহেব বাহাদুর', বি. এস. নাগির 'গোল্ডমেডেল' রাজনৈতিক চক্রান্তের বলি হয়েছিল। মনোমোহন দেশাইয়ের 'ধরমবীর' ও আর সিপ্পির 'শোলে'র রিলিজে তখন বাঁধা এসেছিল।
গুলজারের ছবি 'মৌসম'-এর বহু দৃশ্য অযৌক্তিকভাবে তখন কাটা হয়েছিল। এমনকি অমরজিৎ পিকচার্সের ছবির নাম ছিল ‘ইন্দিরা’। গল্পের নায়িকার নামে ছবি। কোনো রাজনীতি ছিল না তবুও এই ছবিটি তখন বাতিল করা হয়েছিল।
তবে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছিল অমৃত নাহাতা প্রযোজিত ‘কিসসা কুরসিকা’ ছবির বেলায়। ঐ ছবিটির সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য ১৯৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল ফিল্ম সেন্সর বোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছিল। ২৬ এপ্রিল সেন্সর বোর্ডের পরীক্ষক কমিটি ফিল্মটি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন এবং সার্টিফিকেট দানে তখন মতবিরোধ ঘটেছিল। শেষ পর্যন্ত ফিল্মটি আটক করা হয়েছিল এবং শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির ছোটছেলে সঞ্জয় গান্ধীর নির্দেশে এই ছবিটি তখন পুড়িয়ে ফেলে প্রমাণ লোপাট করা হয়েছিল।
ফলে নানাভাবে তখন চলচ্চিত্র জগৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। পাশাপাশি তখন দূরদর্শনে চলতি ছবিগুলি দেখানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নায়ক নায়িকাদের টিভিতে আসতে তখন বাধ্য করা হয়েছিল। সেন্সরনীতি চালু করে প্রডিউসারদের শত্রু হয়ে শ্রী শুক্লা তখন প্রথম শ্রেণীর নায়ক নায়িকা, পরিচালকদের গোলাম করে রাখতে চেয়েছিলেন।
তখন একটি অঘোষিত আইন জারি হয়েছিল এমন যে, যেকোনো শিল্পীকে মেক-আপ নিয়ে উপস্থিত হতে হবে। আর শিল্পীকে সই করতে হয়েছিল চুক্তিপত্রে। যারা বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের ছবি আর মুক্তি পায়নি।
তখনকার ইন্দিরা সরকার শুধুমাত্র ভারতের সংবাদপত্র, নাটক এবং চলচ্চিত্রের ওপরেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা জারি করেই ক্ষান্ত হননি। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গান, কবিতা, উপন্যাস, ছোটোগল্পের ওপরও তখন সেন্সর করা হয়েছিল।
তখন শঙ্খ ঘোষ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গাঙ্গুলী, দীপক মজুমদার, মণীশ ঘটক, কমলেশ সেন, শুভেন্দু শেখর মুখোপাধ্যায়, পান্নালাল মল্লিক, অঞ্জন কর, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, দীপক মজুমদার, গৌরকিশোর ঘোষ, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, বিদ্যুৎবরণ চক্রবর্তী, শম্ভু রক্ষিত প্রমুখের কবিতা, সমর সেনের গদ্য, কৃষ্ণ চক্রবর্তী ও সুখরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস, উদয় রায়ের গল্প প্রভৃতির পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান এবং কবিতার প্রচারেও তখন সেন্সর আরোপ করা হয়েছিল।
এমনকি তখন চলচ্চিত্রের বিশিষ্ট অভিনেতা ও জনপ্রিয় গায়ক কিশোর কুমারের হিন্দি ছবিতে কাজ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যুব কংগ্রেস আয়োজিত দিল্লির সংগীত সন্ধ্যায় কিশোর কুমার অংশগ্রহণ করেননি বলে তাঁর রেডিও প্রোগ্রামও তখন বাতিল করা হয়েছিল। এভাবে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার তখন সম্পূর্ণভাবে হরণ করেছিল।
এমনকি তখন বাণী ঠাকুরকে একবার একটা অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের একটা বর্ষার গান গাইতে দেওয়া হয়নি, কিন্তু কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই গানটিই জোর করে গেয়েছিলেন। এ থেকেই বোঝা যায় যে, তখন শিল্প-সংস্কৃতির ওপর শাসক দলের রোষ কতটা তীব্র ছিল। এমনকি সেই সময় রবীন্দ্রনাথের গান রেকর্ডিং-এর ওপরেও সেন্সর প্রথা চালু হয়েছিল এবং আকাশবাণী রবীন্দ্রনাথের কোন গান প্রচার করবে তারও সিদ্ধান্ত নিতেন আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ।
ইন্দিরা গান্ধী'র কংগ্রেস সরকারের সামনে প্রথম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল গুজরাতের নবনির্বাণ আন্দোলন। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বরে আহমেদাবাদের এলডি কলেজ অফ ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রেরা ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে ধর্মঘট করে। এক মাস পরেই গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করার দাবিতে বিক্ষোভ দেখায়। যা তখন নবনির্বাণ আন্দোলন নামে পরিচিতি পায়।
সেই সময়ে গুজরাতে চলছে মুখ্যমন্ত্রী চিমনভাই প্যাটেলের মুখ্যমন্ত্রীত্বে কংগ্রেসের শাসন। এই সরকার দুর্নীতির সরকার বলে তখন কুখ্যাত হয়েছিল। ছাত্রদের আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে। ক্ষোভের ফলে তখন পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ, বাস পোড়ানো এবং সরকারি অফিস ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছিল। এমন পরস্থিতিতে গুজরাতে সরকার ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হয়ছিল।
এরপর গুজরাতের ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে এমন আন্দোলন দানা বাধে বিহারেও। ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করলে দ্রুত তা বিহারের বর্ষীয়ান নেতা তথা স্বাধীনতা সংগ্রামী ৭১ বছরের জয়প্রকাশ নারায়ণের (জেপি) নেতৃত্বে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিহার। তবে গুজরাতের মতো বিহারে রাষ্ট্রপতি শাসনে যেতে চাননি ইন্দিরা গান্ধী।
দেশময় জয়প্রকাশের আন্দোলনের প্রভাব দেখেই ইন্দিরাকে ঠেলে দিয়েছিল জরুরি অবস্থা জারি করার দিকে। ১৯৭৪ সালের জুন মাসে পাটনার রাস্তায় জেপি-র নেতৃত্বে বিরাট মিছিল ডাক দিয়েছিল এই সরকারকে উৎখাতের। যে বিরোধীরা ১৯৭১ সালের ভোটে ইন্দিরার জনপ্রিয়তার কাছে উড়ে গিয়েছিল, তারাই যেন ফের জয়প্রকাশের ওপর ভর করে উঠে আসতে থাকে সেই সময়।
পাশাপাশি তখন প্রভাব ফেলেছিল রেল ধর্মঘট। বিহারের আন্দোলনে দেশ যখন জ্বলে উঠছে তখনই আবার ভারত দেখল রেল ধর্মঘটে কেমন করে স্তব্ধ করে দেওয়া হলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। যার নেতৃত্বে ছিলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ। ১৯৭৪ সালের মে মাসে তাদের ধর্মঘটের জেরে থেমে গিয়েছিল যাত্রীবাহী এবং পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল। চারপাশের বিরোধী দল, ছাত্র শ্রমিক ইউনিয়নের বিক্ষোভের পাশাপাশি ইন্দিরা গান্ধীকে সেই সময় দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল সোসালিস্ট নেতা রাজ নারায়ণ।
১৯৭১ সালে রায়বেরেলি লোকসভা কেন্দ্র থেকে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ইন্দিরার জয় হয়েছিল অভিযোগ তুলে মামলা করেছিলেন রাজ নারায়ণ ৷ দেশের সেই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ১৯৭৫-এর ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরিয়েছিল। মূলত এই রায়ে রাজ নারায়ণের আনা মামলায় ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং ৬ বছরের জন্য সংসদীয় রাজনীতি থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।
এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার সুযোগ ছিল। ফলে সুপ্রিম কোর্টে ইন্দিরা গান্ধী আবেদন করায় ২৪ জুন এই রায়ের শর্ত সাপেক্ষে স্থগিতাদেশ দেয় আদালত। তিনি সংসদে যেতে পারবেন তবে কোনও বিষয়ে তখন ভোট দিতে পারবেন না।
সেই সময় অবশ্য অনেক কংগ্রেস নেতাই চেয়েছিলেন ইন্দিরা পদত্যাগ করুন। কিন্তু সে পথে না গিয়ে পরের দিন অর্ডিন্যান্স খসড়া করে জরুরী অবস্থা জারি করার দিকে এগিয়ে যান প্রিয়দর্শনী ইন্দিরা গান্ধী। ফলস্বরূপ পরবর্তী নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর দল কংগ্রেস জনতা দলের কাছে হেরে যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো স্বৈরাচারী সরকার কোনোদিন টিকতে পারেনি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি হলো এই যে, যুগে যুগে শাসকদের মধ্যে একই ধরনের স্বৈরাচারী আচরণ বারবার ফিরে আসে।
---------------------
২৪ ডিসেম্বর ২০২১
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০২১ দুপুর ১২:৫৪