শার্লক হোমস রাজনীতিবিদগণ ও কয়েকটি বিলম্বিত নোট লেখাটিতে ফেসবুকে এক বন্ধুর মন্তব্যের উত্তরে কিছু কথা বলেছিলাম। ওখানে বেশ সংক্ষিপ্ত আকারে বলতে হয়, কমেন্টের স্পেসগুলো খুব সংক্ষিপ্ত সময়ে শেষ হয়ে যায়। কয়েক কিস্তিতে লিখতে হয়। তাই বিস্তারিত বলা হয়ে উঠে না। বলেছিলাম, ব্লগে বিস্তারিত কিছু বলার চেষ্টা করবো। তারো আগে, বিডিআর বিদ্রোহ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমার এক বন্ধু আমাকে বলেছিল, কন্সপিরেসি থিওরি যদিও কোন কাজের কথা নয়, এবং যদিও একটি ঘটনা কে ঘটিয়েছে সেটি সাংবাদিকীয় আলোচনার বিষয় এবং এই আলোচনার চেয়ে কেন ঘটেছে এবং এর ফলাফল কী হতে পারে এইসবের পর্যালোচনাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, এই বিডিআর বিদ্রোহ ঘটনাটির বিষয়ে স্রেফ এর ফলাফল নিয়ে আলোচনা করেই ক্ষান্ত হবার অবকাশ নেই। এটি একই সাথে ইন্টালিজেন্সের গুরুতর তদন্তের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এটি খুবই জরুরী।
যাই হোক, বন্ধুর সেই কমেন্টের সূত্রে, আমার পর্যবেক্ষণের ক্ষুদ্র কিছু নোট এখানে তুলে ধরছি। এটি নিয়ে আমি ব্লগারদের সাথে মত বিনিময় করতে ইচ্ছুক। তারা তাদের মতামত জানিয়ে আমার পর্যবেক্ষণগুলির বিশ্লেষণ করুন, সেটি আমি আগ্রহভরেই আশা করছি।
সরকার এবং রাষ্ট্র
আমার বন্ধু এবং প্রতিবেশীদের মধ্যে বেশ কিছু আওয়ামীলীগ সমর্থক এবং কর্মী রয়েছে তাদের সাথে আমার কথাবার্তা হয়েছে এ নিয়ে। আমি বুঝতে চেয়েছি একজন সর্বনিম্ন স্থরের আওয়ামীলীগ কর্মীর এই বিষয়ে চিন্তা কী। মজার ব্যাপার হলো তারা সবাই তাদের নেত্রী এবং অন্যান্যদের মতো করেই, মানে মাঠের ভাষায়, আমার সাথে কথা বলেছে। বলেছে সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র। আমি খুব ভেবে দেখেছি, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো খুব ভালভাবেই 'সরকার' চেনে, যেটি মূলত দল-ঘনিষ্ট, কিন্তু রাষ্ট্র ব্যাপারটারে মূলত চেনেই না, অথবা চেনবার প্রয়োজন অনুভব করে না। তাই যে কোন ঘটনাকেই সরকারের সমস্যায় রিডিয়ুস করে ফেলে, রাষ্ট্রের গভীরতর সংকটমুহূর্তেও।
আইনি বিচারের শোরগোল এবং অপরাপর
আমরা কি ইচ্ছে করেই এটিরে স্রেফ আইনি বিচারের প্রশ্নে রিডিয়ুস করে ফেলছি, যাতে এর অপরাপর বিবেচনাগুলোরে পাশ কাটানো যায়? দেখা যায়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিডিআর বিদ্রোহে নিহত সেনাকর্মকর্তাদের স্ত্রীগণকে প্রায় প্রতিদিনই একটি করে চেক বিলোচ্ছেন, হত্যাকাণ্ডের যথোপযুক্ত শাস্তির কথা বলছেন, আর বিডিআর জওয়ানগণ হাসপাতালে গিয়ে মারা যাচ্ছেন এবং এইভাবেই বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনাটিরে স্রেফ একটি হত্যাকাণ্ড আর তার আইনি বিচারের প্রশ্ন এবং ক্ষতিগ্রস্থদের ভিতরকার একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীকে ক্ষতিপুরণ দেওয়ার প্রশ্ন হিশেবে দাঁড় করিয়ে দিতে চাচ্ছেন। তাহলে প্রশ্ন হবে, অপরাপর বিবেচনাগুলোরে পাশ কাটানোর চেষ্টা কেন?
বিডিআরের নাম পরিবর্তন, পোশাকে বিবমিষা এবং আনন্দ বন্দনা
বিডিআরের নাম পরিবর্তন বিষয়টারে আমার পূর্বের লেখাটিতে সেনাবাহিনীর একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠির প্রতিশোধস্পৃহা কিনা প্রশ্ন করেছিলাম, এখন সেই প্রশ্নটিকে আরো বড়ো জায়গায় স্থাপন করতে ইচ্ছুক আমি। নিছক সেনাবাহিনীর প্রতিশোধস্পৃহা দিয়ে এটিরে প্রশ্ন করা বেকুবি হবে, এটির সাথে সেনাবাহিনী এবং বিডিআরকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবার ঘটনা, তার সম্ভাব্য ফলাফল, বেনিফিসিয়ারী এবং সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে তার বিবেচনাটাই আলোচনায় আনা বেশী জরুরী। বিডিআর ডিসিপ্লিনের নতুন প্রধান মেজর জেনারেল মঈনুল হোসেন গত কয়েকদিন আগ থেকে বেশ কিছু বিপদজনক এবং প্রশ্নবিদ্ধ করা যায় এমন তৎপরতা দেখিয়েছেন, কথা বলেছেন। একটি দেশের একটি নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান এমন তৎপরতা দেখালে তার তৎপরতাগুলোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন করা ফরজ হয়ে যায়। পিলখানা ঘটনায় ভগ্ন বিধ্বস্ত একটি বাহিনীর রেসকিউ মিশন সময়ের একজন প্রধান হিশেবে তার দায়িত্ব ছিল বিডিআর জোয়ানদের ভগ্ন মনোবল ফিরিয়ে আনা, সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীদের নৈতিক সাহসকে উদ্বুদ্ধ করা, ভেঙে যাওয়া ডিসিপ্লিন পুন:প্রতিষ্ঠা করা। বিশেষত যখন এটি সেই বাহিনী, যারা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমান্ত শত্রুকে মোকাবেলা করে, প্রাণ দেয় এবং সীমান্ত ও দেশকে নির্ঘুম পাহারা দিয়ে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করে। বাংলাদেশের ডিসিপ্লিন্ড বাহিনীগুলোর মধ্যে বিডিআরই হলো একমাত্র বাহিনী যাদের ভিতরে ঐতিহাসিকভাবে এবং ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই দেশপ্রেম নামে একটি বিষয় স্পিরিট হিশেবে প্রতি মুহূর্তে জারি ছিল, সীমান্ত শত্রুর সাথে মোকাবেলার সময়, রাষ্ট্রের সীমান্তকে রক্ষা করার ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিয়ে, জীবন দিয়ে, যা তারা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করে। তাহলে এখন এই জরুরী মুহূর্তে আসুন জেনারেল সাহেবের বাক্য এবং তৎপরতাগুলোকে আমরা একটু খেয়াল করি। প্রথমেই তিনি জোয়ানদের উদ্দেশ্য করে বলছেন, বিডিআরের পোশাক পরে এবং এই বাহিনীর সদস্য হিশেবে তাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। তারপরে যখন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ নিহত বিডিআর মহাপরিচালক জেনারেল শাকিলকে মরণোত্তর সম্মাননা দেবার কথা ঘোষণা দিল, তার জন্য বিনয়ে নুয়ে গিয়ে এই নতুন বিডিআর প্রধান ভারতের পুরষ্কারে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেছেন, ভারত বিডিআর বিদ্রোহের মুহূর্তে চাইলেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারত, কিন্তু তারা তা করেন নাই। অতপর তিনি বলছেন, বিডিআরের পোশাকে আমাদের সহকর্মীদের রক্তের দাগ লেগে আছে। এই পোশাক পরে আমরা আমাদের সহকর্মীদের আত্মাকে অপমাণ করতে পারবো না। (এইসব ন্যাকামোর মানে কী?) অবশেষে, পার্শ্ববর্তী দেশে গিয়ে, বিডিআর পুনর্গঠনে বিএসএফের সহযোগিতা কামনা করেছেন তিনি, এবং ঘোষণা দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী কোন কর্মকাণ্ড হতে দেবো না’। লক্ষণীয়, সংসদে প্রধানমন্ত্রীও একই ঘোষণা দিয়েছেন। এবং বাস্তবিক অর্থেই এখন বিডিআর বিদ্রোহে একটি প্রতিবেশী দেশের সম্পৃক্ততা এবং বেনিফিশিয়ারী হবার বিষয়ে যে কোন অভিযোগ সরকার কর্তৃক অসহনীয়ভাবে দমন করা হচ্ছে। এ সংক্রান্ত লিফলেট হাতে হিজবুত তাহরীর নামে সংগঠনের কর্মীদের গ্রেফতার দ্রষ্টব্য।
নতুন বিডিআর নেতৃত্বের এইসব তৎপরতার পর, আমরা এই পিলখানার ঘটনা, সেনাবাহিনীকে বিডিআরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে খোদ সেনাসদস্যদের একটি শ্রেণীকে দিয়ে বিডিআর এর বিরুদ্ধে বিদ্বেষ এবং ঘৃণা ছড়ানো, বিডিআর বিলুপ্তির ঘোষণা, বিডিআর ডিসিপ্লিনকে বিএসএফ এর সহযোগিতায় পুনর্গঠনের প্রস্তাব, এবং ‘বাংলাদেশের মাটিতে ভারতবিরোধী কোন কর্মকাণ্ড হতে দেবো না’- এই ঘোষণাকে কোন কোন ধরণের প্রশ্ন করতে পারি? বিডিআরকে ইতিহাস থেকে মুছে দেওয়ার চেষ্টাগুলোর সাথে মুক্তিযুদ্ধে বিডিআরের তিন জন বীর শ্রেষ্ঠ, রৌমারীর যুদ্ধসহ অসংখ্য ঘটনা কি ইতিহাসে আগের মত থাকবে? মুক্তিযুদ্ধে বিডিআরের অবদানকে আমরা নতুন কোনভাবে ইতিহাসে পড়ব?
প্রথম আলো
সেই সাথে বাংলাদেশে সংবাদ মাধ্যমগুলোর জায়ান্ট প্রথম আলোর তৎপরতাকেও আমরা প্রশ্ন করেছিলাম এর আগে। পিলখানার ঘটনার পরমুহূর্তেই, বাংলাদেশের ভূমি যে সবসময় প্রতিবেশী দেশের সাতটি প্রাদেশিক রাজ্যের স্বাধিকারকামী লড়াকুদের সাহায্যার্থে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, এবং এর পিছনে বিগত সরকারগুলোর সমর্থন ছিল, এই ব্যাপারটি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল এই পত্রিকা। বলেছিলাম, বাংলাদেশের সরকার, সামরিক বাহিনী, জনগণ, সর্বোপরি রাষ্ট্রের জন্য এই ভয়াবহ পাজলড এবং সংকটমুহূর্তে প্রথম আলোর এই দশ ট্রাক অস্ত্রের কামান কোনদিকে দাগান হয়েছে?
জেএমবি ফোবিয়া এবং ক্রিকেট
এবং জেএমবি ফোবিয়া। একজন মন্ত্রীর এফবিআইএর সাথে বৈঠকের পরই মিডিয়া, মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখেও 'জেএমবি' বোল ফুটল। যদিও আমরা চুপ করে আছি তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য, বিশেষ গ্রুপগুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে জেএমবি এবং অন্য কিছু ইসলামপন্থি দলের সম্পৃক্ততা প্রমাণের জন্য। আমরা না বলার আগেই, প্রণব মুখার্জি ঘোষণা করেছে মুম্বাই ঘটনা, বাংলাদেশে বিডিআর বিদ্রোহ এবং পাকিস্তানে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটদলের উপর হামলা একই শত্রুর কাজ। মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তানে ক্রিকেটদলের উপর হামলা ঘটার পরপরই বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বাংলাদেশে পাকিস্তানী ক্রিকেটদলের সফর সাময়িকভাবে স্থগিত করেছিল। আমি ক্রিকেট বুঝি না, না বুঝার কারণে এ বিষয়ে খবর রাখি না বললেই চলে। কিন্তু তখন এর রাজনীতিটা আমি অনুমান করতে পেরেছিলাম। আমার তখনই যে সন্দেহ হয়েছিল সেটি কয়েকদিন পর বিসিবি পাকিস্তানী ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফরে নিষেধাজ্ঞা জারী করার ঘোষণা দিয়ে সত্য প্রমাণিত করল। রাজনীতিটা খুব সহজ, কারু না বুঝার কথা নয়। পাকিস্তানকে সব দিক দিয়ে ভঙ্গুর করে রাখতে পারলেও ক্রিকেট বিশ্বে পাকিস্তানের একটি ব্রাণ্ড ইমেজ আছে, যেটি ভাঙ্গার চেষ্টা পাকিস্তানের সাথে নিরন্তর কনফ্রন্টেশনে থাকা ভারত নিজের পররাষ্ট্রনীতি হিশেবে চাইতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশের সরকার কোন আগ্রহে ভারতের সেই পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়ন করবে?
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই নভেম্বর, ২০০৯ দুপুর ১:৫০