১
মিউনিখ শহরের এক্কেবারে পেটের ভেতর থাকি। ঢাকার মত হ্যাপেনিং সিটি না হলেও লোকজনের ভিড়ভাট্টা আর দোকানপাটের জম্পেশ পশরায় বেশ শরগরম লাগে। বেশ কিছু বছর গ্যোথেপ্লাৎজ জায়গায় আছি বলে চারপাশটাও হাতের তালুর মত চেনা হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি চিনেছি রেস্তোরাঁগুলো। তেমনি একটা রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছি।
সাইনবোর্ড দেখে ক্ষীন সন্দেহ হচ্ছে। রেস্তোরাঁর নাম, ‘টেংরি টাগ“। নাম পড়ে টেংরি ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দেয়া জাতীয় বাংলা হুমকি মনে পড়ছে। হেঁশেল থেকে ভেসে আসা ঝাঁঝালো মাংসের ঘ্রান খুব বেশি কিছু আর ভাবতে দিল না। হ্যাঁচকা টানে ভেতরে ডেকে খালি এক টেবিলে বসিয়ে দিল, ল্যাও ঠেলা। সাথে সাথেই তুর্কি মতন এক ওয়েটার এসে মেন্যু দিয়ে গেল। কিন্তু সেটা পড়ার মত সুযোগ পেলাম না। পাশের টেবিলে বসা চাইনিজ ছেলেমেয়ে দু’জন চপস্টিকে পেঁচিয়ে লম্বা নুডুলসগুলো এমন ফোঁৎ করে টান দিল যে আপনা থেকেই ঘাড় ঘুড়ে গেল সেদিক পানে।
এক প্লেট উপচে পড়া মোটা মোটা কেঁচোর মত স্বাস্থ্যবান প্রতিটা নুডুলস। কিন্তু গা গুলিয়ে ওঠার বদলে রসুনে ভাজা রোস্টেড বিফের ঘ্রান প্রানটা জুড়িয়ে দিল। সবুজ পেঁয়াজ পাতা, লাল ক্যাপসিকাম আর সাদা তিলের দানা দিয়ে গার্নিশ করে সাজানো বিশাল থালা থেকে চোখ সরানো দায়। এই ভুরুভুরে বাসনাটাই হাঁ করে বাইরে দাঁড়ানো আমাকে হাইজ্যাক করে রেস্তোরাঁয় এনে জিম্মি করে ফেলেছে। সুতরাং, দেরি না করে ওয়েটারকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে আসলাম। সেও খুশি মনে লিখে নিল হাতের কাগজটায়। ‘দশ মিনিটের ভেতরেই আসছে গেব্রাটেন নুডুলস’। নাম শুনে হতাশ হলাম। জার্মানে ‘গেব্রাটেন’ মানে তো ‘ভাজা’ বা ‘ফ্রাইড’। এমন রাজকীয় খানার আর নাম খুঁজে পেল না। নিদেনপক্ষে ‘হট বিফ নুডুলস’ টাইপ খিদে জাগানো নাম দিলেও তো হত। টেবিলে আঙুল ঠুকে বসে রইলাম হট বিফ ওরফে কেঁচো নুডুলসের অপেক্ষায়। ঠান্ডা কোকের বোতলটা অস্থির বিজ বিজ বুদ্বুদ তুলে খিদেটা আরো পাগলাটে রকম বাড়িয়ে দিল যেন।
দেয়ালে সুফী গানের আসরের ছবি টাঙ্গানো। ফেজটুপি পড়া দরবেশদের ঘুর্নিনাচের দৃশ্যও ঝুলছে আরেক দেয়ালে। এককোনে কায়দা করে লটকানো স্ক্রিনে তুর্কি রিয়েলিটি শো চলছে। সেখানে তুর্কি নাচনের তুফান মেল ছুটিয়েছে এক প্রতিযোগী বেচারা। আর এসবই পুরোপুরি উপেক্ষা করে গপগপ খেতে ব্যস্ত লোকজন। যার নব্বই ভাগই চাইনিজ। এতক্ষনে বুঝলাম ব্যাপারটা। টেংরি টাগ আসলে একটা উইঘুর রেস্তোরাঁ। বহু শত বছর আগে চিন দেশে গিয়ে বসত গড়া তুর্কিশ এক গোষ্ঠী এই উইঘুর। জাতে মুসলমান। কিন্তু আবার বংশ পরম্পরায় চাইনিজ। তাই তুর্কির পাশে চাইনিজে সমানতালে তুবড়ি ছোটাতে ওস্তাদ। আর হাত ঘুরিয়ে চাইনিজ নুডুলসের সাথে তুর্কি তরিকা মিশিয়ে এমন জব্বর রানতে জানে যে তার জন্যে রান্নার জগতে তাদের আলাদা খ্যাতি আছে। এসব শুধু শুনেছিই। আজকে তাহলে পরখ করে সত্য যাচাই করে নেয়া যাক।
ধোঁয়া ওঠা থালা টেবিলে সন্তর্পনে নামিয়ে চওড়া এক হাসি দিল শেফ। ‘এ আমার হাতে বানানো নুডুলস। খেয়ে কিন্তু বলতে হবে কেমন হয়েছে’। ভাঙ্গা ভাঙ্গা জার্মানে কথাগুলো বলে বিদায় নিল ষাঁট ছুঁই ছুঁই ভদ্রলোক। মাথা নেড়ে বাধ্য মেয়ের মত সায় দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম কাটাচামচ বাগিয়ে।
ক্যারামেলের মিষ্টি স্বাদ আসছে জুলিয়ান করে কাটা পেঁয়াজের বাদামি টুকরোগুলো থেকে। ঝাঁজটা জোরসে নাকে টেনে নিতেই মাথার ভেতরে পাকিয়ে থাকা চিন্তার জটলাগুলো কোথায় যেন ছিতকে পড়লো। দুনিয়াবি দুশ্চিন্তা সব মস্তিষ্কের দূর কোথরে আটকে রেখে রোস্টেড বিফ সমেত নুডুলস মুখে পুড়ে ফেললাম খুব আয়েশে। সাথে সাথেই টক-ঝাল-নোনা-মিঠার বিচিত্র এক জগত খুলে গেল হুট করে। সয়া সস আর ওয়েস্টার সসের কড়া যুগলবন্দীটা বেশ জমেছে। নুডুলস রসে টইটুম্বুর। আর লাল মরিচের অবাধ আনাগোনা প্লেট জুড়ে। দাঁতে পড়া মাত্র চোখে পানি চলে এল। ঝালে আর আবেগে, একসাথে। এই জার্মান দেশের, ম্যাটমেটে আলুনি খানাখাদ্য খেয়ে ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে থাকি সারাক্ষন। দেশি কায়দায় টেলে ভাজা মরিচের মচমচে সাক্ষাতে মনটা তাই ঝাকুনি দিয়ে উঠল চনমনিয়ে।
নাহ্, উইঘুররা দেখছি জাত রাঁধুনী। এমন গুনী জাতটাকে কিনা চীন সরকার খুব জ্বালাচ্ছে। নানান দমন-পীড়ন এই উইঘুরদের উপরে। আর না পেরে কেউ কেউ দেশ ছেড়েছে। এই রেস্তোরাঁর লোকজনেরও হয়তো একই কাহিনী। আহারে, ভাগ্য।
‘আর কিছু লাগবে নাকি?’। ওয়াটারের প্রশ্নে খালি প্লেট দেখে বোকা বনলাম। এই না এক পাহাড়া নুডুলস ছিল থালায়। সুরুৎ সুরুৎ টেনে সব নামিয়ে দিলাম কখন। ‘তো এক কাপ চা হয়ে যাক আমাদের তরফ থেকে?’। চায়ের নিমন্ত্রনটা সাদরে নিলাম। মুহূর্তেই চমৎকার স্বছ কাঁচের গ্লাসে চা চলে এল। টিউলিপ ফুলের মত দেখতে চায়ের কাপের তুর্কি বা উইঘুর নাম ইঞ্চে বেল্লি (ince belli) আর বাংলায় সরু কোমর। একবার ইস্তাম্বুল যাওয়া হয়েছিল। তখন দেখেছিলাম, ঘরেবাইরে, মহল্লার মোড়ে, লোকজনের হাত চিকন কোমরে। দিন-রাত এরা চা খায়। বাপ-দাদার চা-খোর স্বভাবটা উইঘুররা ধরে রেখেছে ভাল মতই।
হেঁশেলে মাথা ঢুকিয়ে শেফকে একটা দরাজ ধন্যবাদ দিতে ভুললাম না। ‘এমন খানা এ শহরে আর খাই নি। আপনার হাতে জাদু আছে নির্ঘাত’। শেফ লোকটার চওড়া হাসি চওড়াতর হল, ‘তাহলে আবার আসা চাই, ঠিক আছে?’। ফিরতি হাসিতে সায় দিয়ে বিল চুকিয়ে বেড়িয়ে এলাম।
বাইরে আশপাশের অফিসের লোকজন লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে। ডোনার কাবাব কিনতে এসেছে। জার্মানদের প্রিয় ফাস্টফুড। সব তুর্কি আর উইঘুর রেস্তোরাঁর সবচেয়ে চালু আইটেম। বেচারারা জানলোও না এখানে গেব্রাটেন নুডুলস বলে বেহেশতি এক খানা আছে। অবশ্য ঝালের চোটে জার্মানরা যে কান্না জুড়ে দেবে, তাতে দিনে দুপুরে এই গ্যোথেপ্লাৎজ্যের রাস্তায় আরেক রাইন নদী বইবে। কি কাজ তাতে। পকেটে হাত পুরে শিস্ দেয়ার একটা হালকা চেষ্টা চালাতে চালাতে ঘরের পথে চললাম। ছিমছাপ একটা ইটালিয়ান বেকারি দেখা যাচ্ছে। থামবো নাকি ওখানটায়? (চলবে)
-ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার, মিউনিখ, জার্মানি।