খাদ্যরস ৩
ডিসেম্বরের ইউরোপিয়ান শীতটা হাড়ে হুল ফুটিয়ে বসেছে। থেকে থেকে এলোপাথাড়ি তুষার পড়ছে। হাতমোজা, কানটুপিতেও হি হি কাঁপুনি থামছে না। এই মুহূর্তে জাঁকানো শীতের একটা হাঁকানো গরম সমাধান দরকার। খিদেও পেয়েছে জব্বর। ঘরে ফিরে এক থালা ভাত-মাছ উড়িয়ে দেয়া যায়। তবে বাঙ্গালি খানায় শীত কমে না, শুধু আলসেমিটাই বাড়ে। তাই বুদ্ধি করে বাড়ির রাস্তা না ধরে আটান্ন নম্বর বাসে চেপে বসলাম। কয়েকটা স্টপ পরেই ঝুপ করে নেমে পড়তে হবে। মোড়ের কাছে সবুজ নিয়ন সাইনবোর্ডটা চোখে পড়তেই লাল বোতামটা টিপে দিলাম। বাস হুমবল্টষ্ট্রাসে-তে এসে কড়া ব্রেক তুলে থেমে গেল। ক্যাঁচ করে অটোমেটিক দরজা সিসিম ফাঁক হতেই চল্লিশ চোরের মত হুড়মুড়িয়ে নামলাম এক পাল যাত্রী। বেরিয়েই এতগুলো লোক দুর্দাড় এদিক সেদিক মিলিয়ে গেল। শহুরে লোকের বড্ড তাড়া।
সিগনালের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি হুমবল্টষ্ট্রাসের রাস্তায়। বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার ফন হুমবল্ট-এর নামে নাম এ পথের। জ্ঞানী লোকের কদর করে জার্মান মহল্লার রাস্তাঘাটের নাম রাখা এদের পুরানো স্বভাব। তবে হুমবল্ট সাহেব যদি জানতেন তার নামের রাস্তার এপাশে সুবিশাল এক অ্যাডাল্ট শপ আর তাতে টাঙ্গানো নানা রগরগে ছবি ঝুলছে, আর আরেকপাশে রাশিয়ান মদের খুচরো দোকান, তাহলে কতটা খুশি হতেন বলা মুশকিল।
সিগনাল সবুজ হতেই আস্তে ধীরে এগুলাম ওপারের নিয়ন সাইনবোর্ড বরাবর। এমাথা-ওমাথা জুড়ে বড় করে লেখা ‘Vollmundig’। এই মাথামুন্ডু নামের খাস জার্মান উচ্চারন আসলে, ‘ফলমুন্ডিশ’। সারাজীবন ফক্সওয়াগন গাড়িকে ভক্সওয়াগন আর ‘হুমবল্ট’ সাহেবকে ‘হামবল্ট’ বলে আসা এই অধমের সুকঠিন জার্মান উচ্চারন বাগে আনতে বেগ পেতে হয় বই কি। উচ্চারনটা বা ‘ফলমুন্ডিগ’ও হতে পারে। আর বাংলা মানেটাও ঠিকঠাক মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। তবে ইংরেজিতে বোধহয় ‘wholeheartedly' হবে। মানে যাই হোক, পেটচুক্তি একদফা খাওয়া হলেই হল।
হিম হিম ঠান্ডাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাল্লা ঠেলে ভেতরে সেঁধিয়ে গেলাম। উনুনের উষ্ণ ঘ্রানে নিমেষেই চাঙ্গা লাগছে। রেস্তোরাঁর ভেতরটা খোলামেলা। বসার জায়গা আছে বেশ। তবে মেন্যুর ধরন ফাস্ট ফুড ধাঁচের। লোকে এসে দাঁড়িয়ে থেকে ডোনার কাবাব আর ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিয়ে যায়। বসে খাবার সময় নেই। আমার অবশ্য সময়ের অভাব নেই। হাত-পা ছড়িয়ে, গা এলিয়ে বসে আয়েশ করা যাবে আজকে।
‘আরে, অনেক দিন পর যে? কি খবর?’। ভাল মানুষ চেহারার ষাঁট ছুঁই ছুঁই টকটকে ফর্সা লোকটা খুশি খুশি গলায় বলে উঠল।
‘হ্যাঁ, সব ভাল। মিউনিখ ছেড়ে দূরে বাসা নিয়েছি। তাই আর আসা হয় না। কিন্তু আজকে মন টানলো, চলে এলাম। আপনি ভাল তো?’। খুব পরিচিতের মত আলাপ জুড়ে দিতে সময় লাগলো না। ‘ আর আপনার ফ্রাউ ভাল আছে তো?...’।
বলতে না বলতেই মালিক হেঁশেল বরাবর হাঁক ডাক জুড়ে দিল। ‘এ্যাই,কই তুমি? এদিকে একবার দেখো কে এসেছে’। বউ বেচারা তড়িঘড়ি উদয় হল ওপাশ থেকে। ‘আরে, তুমি যে? ইশ্, এত্ত দিন পর!!’। ভদ্রমহিলার অনুযোগের সুরটা অকৃত্রিম, আন্তরিক।
রেস্তোরাঁয় আর জনা দুই খদ্দের আছে। তারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। এই কালোপনা মেয়ের জন্যে মিয়া-বিবির এত ব্যস্ততা তাদের মাথায় ঢুকছে না।
‘মেয়েটার পড়াশোনা কেমন চলছে? ল’ নিয়ে পড়ছে তো, তাই না? উকিল হতে আর কদ্দুর বাকি?’। অতি পরিচিতের মত প্রশ্ন ছুড়লাম।
মেয়ের কথায় বাবার মুখে গর্বের হাসি ফুটলো, ‘আর বলো না, সামনে পরীক্ষা। নাকে-মুখে পড়ছে সারাক্ষন।, তা তুমি কি খাবে, ফরমায়েশ কর। গরম গরম বানিয়ে দেই।‘
‘এই রেস্তোরাঁর সিগনেচার বিফ বার্গার ছাড়া আর কি। কিন্তু ঝাল বেশি করে‘।
‘আলবত। তোমার ঝালের ধরন আমাদের খুব জানা। এখন ফ্রিজ থেকে একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক নামিয়ে আরাম করে বসো তো‘।
বাধ্য মেয়ের মত সেদিকে পা বাড়ালাম।
‘পাওলানার’ নামে বিয়ারের একটা লোকাল ব্র্যান্ড আছে মিউনিখে। পুরো জার্মানিতে খুব নাম। তিতকুটে বিয়ারের বাইরে তারা ‘স্পেৎজি’ নামের নন-অ্যালকোহলিক এক অতি সুমিষ্ট সোডা বানায়। মিউনিখের বাইরে খুব একটা মেলে না এই মহার্ঘ্য। খেলে মনে হয়, আহা কি খেলুম। একই সাথে কোক আর ফান্টার মিষ্টি ঝাঁঝালো স্বাদ। সে স্বাদে কোক-ফান্টার বাইরেও আর কিছু আছে। খুব চেনা, তবু অচেনা। সেটা যে কি, ভাবতে ভাবতে বোতল ফুরিয়ে যায়।
হাতের স্পেৎজি অর্ধেকে এসে ঠেকেছে। এ বোতল উড়িয়ে আরেকটা নেবো নাকি?
‘উ উ...তুমি সব শেষ করে ফেললে কিন্তু আমি কানবো’।
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নকল ফ্যাঁচ কান্নার উৎস বরাবর তাকালাম। বছর সাতেকের ছেলেটাকে যে সাথে নিয়ে এসেছি, বেমালুম ভুলে গেছি। কোল্ড ড্রিঙ্ক সমেত দিল্ ঠান্ডা করতে মশগুল থাকার সাইড ইফেক্ট।
‘মা, তুমি কি মাঝে মাঝে ভুলে যাওয়া যে তোমার সাথে একটা ছোট বাচ্চা আছে?’।
চোঁ চোঁ বোতল টানা থামিয়ে বাকিটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে ধামাচাপার সুরে বললাম, ‘কি যে বল, ভুলে যাবো কেন। নাও বাবা, খাও’।
নাহ্, আরেক বোতল স্পেৎজি দরকার। ছোট বাচ্চাদের পানীয়তে ভাগ বসানো উচিত না। তারা এক ঢোক মুখে পুরে আদ্ধেকটা গিলে বাকি আদ্ধেকটা আবার বোতলে বা গ্লাসে ফেরত দেয়। কুলিকুচি স্টাইলে চলে তাদের পান-পর্ব। লালা আর খাবারের কনা মিশে পানীয়ের ঘনত্ব সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে অতি ভয়ানক হেমলক বিষ হয়ে যায়। শুধুমাত্র মরুভূমির ধূ ধূ প্রান্তরে জান বাঁচানোর জন্যে এই বস্তু খাওয়া যেতে পারে। নচেৎ নহে।
রেস্তোরাঁর মালিক আর মালকিনই সর্বেসর্বা। জামাই ওয়েটার আর ক্যাশিয়ার, বউ শেফ। মাংসের প্যাটিসের ভাজা ঘ্রান ছুটিয়ে দুই থালায় উড়ে এল দুই জাম্বো সাইজের বার্গার। মাঝ বরারব কেটে সেখানে মচমচে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইগুলো জায়গা করে দেয়া হয়েছে।
‘কিন্তু ফ্রাই তো অর্ডার করি নি...’।
‘এটা আমার অর্ডার ধরে নাও। অন দা হাউস, ওকে?’। দরাজ হাসিতে একান-ওকান ওয়েটারের।
ওকে’র বিপরীতে বিরাট এক ‘দাঙ্কেশ্যোন’ শুনিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে প্লেট টেনে নিলাম কাছে।
সবুজ সালাদ পাতার সাথে লাল টমেটোর তাজা টুকরো ভাব জমিয়েছে জব্বর। গোল গোল পেঁয়াজের রিং আয়েশি ভঙ্গিতে শুয়ে আছে নরম রুটির তাকিয়ায় বিছানা পেতে। গলন্ত পনিরের সোনালি আস্তরনের আড়ালে জলপাইয়ের টুকরোগুলো পিটপিটিয়ে চাইছে অলস চোখে।
চোখ বুজে এক কামড় বসিয়ে দিলাম হালুম করে। উনুনের গরম তাওয়ায় এপিঠ ওপিঠ ঝলসানো মাংসের চাকতিটা যে বাসনা ছুটেছে, তার কাছে গুচি-শ্যানেল ফেল মারবে। এ ঘ্রান ছোট শিশিতে ভরে কেন লোকে বাজারে ছাড়ে না। ফল্মুন্ডিশ ব্রান্ডের বার্গার ফ্লেবারের পারফিউম মেখে যেই তরুনী একবার পথ দিয়ে হেঁটে যাবে, তার চারপাশে ছেলেপেলেরা সব পা হড়কে পড়ে থাকবে।
‘খেতে ঠিকঠাক হয়েছে তো?’। দারুন বিজনেস আইডিয়ার বেলুনে পিন ফুটিয়ে জানতে চাইলো রেস্তোরাঁর মালিক ভদ্রলোক।
দু’গালে বিশাল দুটো টুকরো পুরে কথা কইবার অবস্থা নেই। তাই সজোরে মাথা নেড়ে বার দুই ‘ঘোৎ’ জাতীয় শব্দ তুলে জানিয়ে দিলাম, ‘লা জওয়াব’।
জবাবে খুশি হয়ে সে কোল্ড ড্রিঙ্কসের আলমারি থেকে আরেক বোতল স্পেৎজি এনে হাজির করলো। বটল ওপেনারে ধাতব ছিপি ফটাশ খুলে কোন দিকে দৌড় দিল কে জানে। ঝাঁঝালো ফেনা তোলা সোডা ওয়াটার বোতল ডিঙ্গিয়ে দুর্বার বেড়িয়ে আসতে চাইল। চুমুকে গলা ভিজিয়ে আদ্র চোখে কৃতজ্ঞ চাইলাম। এ লোক নির্ঘাৎ টেলিপ্যাথি জানে।
‘মা, তোমার নাকে সস। তোমাকে সার্কাসের ক্লাউনের মত লাগছে, হি হি...’।
ছেলের সাথে রেস্তোরাঁ মালিক আর তার মালকিন বউও হেসে উঠলো। এরা দু’জন সামনে দাঁড়িয়ে আগ্রহ নিয়ে বার্গার-ভক্ষন দেখছে। হঠাৎ একটা রহস্য বোঝা গেল। এই রুটি, এই মাংসের প্যাটি আর যত রসদ, সেতো আর দশখানে খুব পাওয়া যায়। কিন্তু আজ, এখানে, একটা সিক্রেট ইনগ্রেডিয়েন্ট মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এই গোপন মশলার নাম, ভালবাসা। কোথাকার কোন বাংলাদেশের মেয়ের জন্যে এত মমতা এরা না করলেও পারতো। দুটো নির্মল হাসিমুখের সামনে খুব আড়ষ্ট লাগছে এই মুহূর্তে।
বাইরে ট্রাফিক সিগনালের হলুদ বাতি জ্বলছে। ভেতরে ফলমুন্ডিগ রেস্তোরাতেও যেন সময় বইছে খুব ধীরে। ডিসেম্বরের হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসা শীতের বনামে এই উষ্ণ আয়োজন খুব দরকার ছিল। রসালো রুটির টইটুম্বুর পেটে কামড় পড়ে তার আকৃতি ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। সেই সাথে ছোট হয়ে আসছে জাগতিক যত সমস্যা আর দুশ্চিন্তারা।
আস্তে ধীরে খাদ্য-পর্ব গুটিয়ে বিল চুকিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
‘দেশে যাচ্ছি, সামনে কিছুদিন দোকানে আসলে পাবে না’।
প্রায় নিশ্চিত সুরে বললাম, ‘আফগানিস্তানে যাচ্ছেন? তা, কোন শহরে?’।
আমরা তো আফগান নই। ইরাক থেকে এসেছিলাম এই জার্মান দেশে। তারপর ঊনচল্লিশ বছর কেটে গেছে। ফেরা আর হয় নি...‘। উদাস শোনালো তার স্বর।
ঊনচল্লিশ বছর পর স্বদেশে ফেরা লোককে কি বলতে হয়, জানা নেই। তাই আর কিছু খুঁজে না পেয়ে আবার বেমানান জিজ্ঞেস করলাম, ‘তা, কোন শহরে?’।
‘বাগদাদ। বাগাদাদে জন্ম আমার।‘
মনে মনে হিসাব কষলাম। সাল ২০২২ থেকে ঊনচল্লিশ বিয়োগ দিলে দাঁড়ায় ১৯৮৩ সাল। তার মানে সেই ইরাক-ইরানের যুদ্ধের সময় দেশ ছেড়ে আসা হয়েছিল তার। নিশ্চয়ই শরনার্থী হিসেবে। এদেশের কৃষ্টি-কালচার-ভাষা শিখে আবার একটা নতুন জীবনের তাগিদে টাইগ্রিস নদীর তীর ঘেঁষা বাগদাদ শহর ক্রমে ক্রমে সরে গেছে বহুদূরে। এত বছরের অভিমানী দূরত্ব মানচিত্রের হাজার মাইল-কিলোমিটারের চেয়েও যে বেশি।
‘হুউউমম...’। কি বলবো, বুঝতে না পারা আমার একপেশে প্রতিক্রিয়া।
হালকা মেজাজটা ফিরিয়ে আনতে ওপাশ থেকে তরল রসিকতা ভেসে এল, ‘বাংলাদেশের সব মেয়েরা কি তোমার মত সুন্দর আর তোমার মত করেই হাসে নাকি?’।
জবাবে আবলুশ কাঠের মত মিশিকালো বঙ্গকন্যা তার কুলা কান দুলিয়ে, মূলা দাঁত খেলিয়ে পটল-চোখে দুষ্টু হেসে বললো, ‘ঠিক ঠিক, একদম ঠিক...‘।
ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার,
মিউনিখ, জার্মানি।
২২ বি.দ্র. লেখাটি ১৮ ডিসেম্বর, ২০২২ তারিখে হালফ্যাশন ম্যাগাজিন-এ প্রকাশিত হয়েছে। লিঙ্কঃ https://www.haal.fashion/food/3s0mch9u6y
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০২২ ভোর ৪:৫৭