১
ডিসেম্বরের ঢাকা শহর। ভোর অবধি হালকা কুয়াশার চাদর গায়ে জবুথবু বসে থাকে এ শহর। যেই না সকালের আলো ফোটে ভাল করে, অমনি চাদর উড়িয়ে ক্যাঁচকোঁচ কল-কজায় ঝাঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ঢাকা। রিকশার টুংটাং, গাড়ির বিকট হাইড্রোলিক ভেঁপু, নতুন দালানের কন্সট্রাকশন এর ঘটাং ঘটাং-সব যেন খাঁচা খুলে বেরিয়ে আসে। প্রিয় শহরের ঘুম ভাঙ্গার এই দৃশ্য অভিভূতের মত দেখছি। কারণ, দেশে থাকি না। বাস কিংবা প্রবাস সেই সুদূর জার্মানির মিউনিখ নগরে। দেশে এসেছি মাত্র গতকাল। জার্মানি-টু-বাংলাদেশ যাত্রা দৈর্ঘ্যে বেশ লম্বা। ট্রানজিট মিলিয়ে ষোলো-সতেরো ঘন্টার মামলা। সে রেশ কাটতে না কাটতেই রীতিমত হাইজ্যাক হয়ে বসে আছি নীল রঙের বিশাল হোন্ডা সিআর-ভি’র নরম গদিতে।
এই হাইজ্যাক-কর্মের মূল হোতা আমার বড় ভাই। সে আর তার বউ মিলে ষড়যন্ত্র করে এই ঝটিকা সফরের নিখুঁত ছক কেটে রেখেছে। দেশে আসা মাত্রই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে রওনা দেয়া হয় দূরে কোথাও। এক বার সেন্ট মার্টিন তো পরেরবার শ্রীমঙ্গল। অবশ্য এতে আপত্তির কিছু দেখি না। তাই কাঁধে বোঁচকা ফেলে বেড়িয়েছি নতুন এক ভ্রমনে।
এবারের গন্তব্য, সুন্দরবন। দেশের এক প্রান্তে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা পৃথিবীর দীর্ঘতম ম্যানগ্রোভ বন। যার ঝোলায় ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ-এর তকমা পর্যন্ত আছে। কিন্তু তাতে কি। মক্কার লোকে যেমন হজ্বে যায় না, তেমনি দেশে থাকতে ঢাকার বাইরে খুব একটা যাওয়া পড়ে নি। ঐ ছোটবেলায় শীতের ছুতিতে স্টিমার কি লঞ্চে করে চাঁদপুর ডিঙ্গিয়ে ঝালকাঠি। ব্যস, অতটুকুনই। অথচ রবীন্দ্রনাথ বাঙ্গালিকে কত শত বার পঁই পঁই করে বলে গেছেন ‘ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া’ যেন ধানের শিষে শিশিরবিন্দুর তালাশ করি। আজকে তাই রবি ঠাকুরের কথা রাখতেই সুন্দরবন নামের ঘাসের ডগায় শিশির খুঁজতে চলেছি। তাছাড়া, এই বড়বেলায় যখন বড় ভাইয়ের কল্যানে দেশটা ঘুরে দেখার সুযোগ মেলে, তখন ছোট মানুষের মতই মনের এধার থেকে ওধার অবধি আনন্দের কানাকানি পড়ে যায়।
ভাইয়া আর ঝুমু আপু সামনে নিজেদের ভেতর কথা বলছে। ঝুমু আপুকে আমি ভাবী বলি না। সেও আমাকে ননদ বলে মানতে নারাজ। কারণ, ননদ-ভাবী সম্পর্কের ভেতর কেমন একটা চিরায়ত বাংলার দা-কুমড়া ভাব আছে। ঠিক যেন জি বাংলা কিংবা স্টার জলসা চ্যানেলের কুটিল দুই রমনী। একজন কানে জবড়জং ঝুমকা কানের দুল পড়ে কই মাছ কাটছে, তো আরেকজন কাতান শাড়ি কোমরে পেঁচিয়ে খুন্তি হাতে কুমড়ার চচ্চড়ি নাড়ছে। এবং অকারনেই তাদের ভেতর গোল বেঁধে গেল। হাতে উঠে এল মাছ কাটার দাঁ, তো আর আরেকজনের হাতে বাকি আদ্ধেকটা চালকুমড়া। তুমুল এক গৃহযুদ্ধ। তাই দেখে এপার বাংলার মা-শাশুড়িরা হিপ হিপ হুর্ রে। সুতরাং, আমরা ও সব গোলমেলে টাইটেল এড়িয়ে চলি খুব সাবধানে।
যাহোক, খিদেটা ভালই পেয়ে বসেছে। পেছনে বসে আমরা চারজন উশখুশ করছি। এই চারজনের পরিচয় হল, ভাইয়ার দুই ছেলেমেয়ে রন আর রেন। তারা যথাক্রমে ক্লাস টু আর ক্লাস এইটে পড়ে। তাদের পাশে তাফসু মিয়াকে সাথে নিয়ে আমি। তাফসু মিয়া আমাদের ভেতর কনিষ্ঠ। তার বয়স সাড়ে সাত বছর। নয় বছরের রনের সাথে তার পিঠাপিঠি ভাব। দু’জন দু’জনকে পেলেই অল্প বয়সী বানরের মত খুনসুটিতে মজে যায়।
ওদিকে বানর মাতা এই আমার বয়স চল্লিশের দিকে উর্ধগতিতে ধাবমান। তবে আপাতত বয়সটা নিম্নগামী হয়ে ষোলোতে এসে ঠেকেছে। কারণ, রেনের বয়স পনেরো। তার পাশে বসলে বয়সের কোঠা থেকে এক-দেড় যুগ এমনি উবে যায়। মনের মিল বলে কথা। আপাতত, রেনের সাথে আলাপের প্রধান বিষয় খানাখাদ্য। এ মুহূর্তে আমাদের প্রধান চিন্তা, পথের ধারে কোন রেস্তোরাঁয় থামা হবে আর সেখানে বসে কি কি খাবো দাবো। বিফ নাকি মাটন? পরোটা খাবো নাকি নান রুটি। বাটার নান , নাকি গার্লিক নান। সাথে কফি নাকি মালাই চা? দুশ্চিন্তায় কপালে চার ভাঁজ।
রন আর তাফসু মিয়াও নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু, বাংলাদেশী স্কুল বনাম জার্মান স্কুলে হোমওয়ার্কের চাপ বিষয়ক তুলনামূলক বিশ্লেষন। তাফসু মিয়ার ইশকুল ভাল লাগে না। ক্লাসের পড়াশোনা তার কাছে তিতা করল্লা আর হোমওয়ার্ক হল চিরতার পানি। রনের অবশ্য এ ব্যাপারে ভিন্ন মত। ‘...কিন্তু আমার স্কুলে তো হোমওয়ার্ক খুব কম, তোমার স্কুল আসলে ভুয়া, বুঝলা...’। রনের কথা শুনে তাফসু মিয়া প্রায় কনভিন্সড। জার্মান স্কুল তাকে বেশি প্যারা দিলে সে সেখানকার পাট চুকিয়ে বাংলাদেশে চলে আসবে। নিউ ইস্কাটনের এ.জি. চার্চ-এ এসে ভর্তি হয়ে যাবে রনের ক্লাসে। কি আছে জীবনে।
তবে আমাদের গাল-গল্পে প্রায়ই লাগাম টানতে হচ্ছে। ভাইয়া-আপুর মুর্হুমুর্হু জরুরী ফোন আসছে। এরা দুইজনই ডাক্তার। ভাইয়া ইন্টারনাল মেডিসিনের ডাক্তার আর আপু অর্থোপেডিক্স-এর। শাহবাগের বারডেম হাসপাতাল তাদের ঠিকানা। দুই ডাক্তার এক যোগে ছুটি নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে শুনে হাসপাতাল আর চেম্বার মিলিয়ে তামাম রোগীমহল তাদেরকে হেরিকেন জ্বালিয়ে খুঁজছে। বেচারা দুইজন ফোনের ভেতরেই রোগীর সুগার কমিয়ে দিচ্ছে কিংবা ভাঙ্গা ঠ্যাঙ্গের ফলোআপ বাতলাচ্ছে। ডাক্তার জীবন, কঠিন জীবন।
কথায় কথায় সময় গড়িয়ে পথ পেড়িয়ে গিয়েছে অনেকটা। হঠাৎ অদ্ভূত রকমের মসৃন রাস্তায় উঠে খেয়াল হল, আরে রাস্তা কই। এ যে সেতু, পদ্মা সেতু! জানালার দুই পাশ থেকে অবারিত পদ্মা নদী ঢেউ তুলে সাক্ষী দিল, ‘হ্যাঁ পদ্মা সেতুই বটে, স্বাগতম তবে’। সেতুর মুখে টোল দিয়ে উঠে পড়লাম পিচ ঢালা ঝাঁ চকচকে সেতুপথে। কি তার লম্বা-চওড়া চেহারা, আর কি তার রাজকীয় গঠন। মনটা গর্বে ভরে গেল।
ছাও পাওরা সব বিপুল উৎসাহে মুঠো ফোনের স্টপ ওয়াচ নিয়ে পড়ল। এই সেতুর দৈর্ঘ্য পাড়ি দিতে কত সময় লাগবে, সেটা মেপে ফেলতে হবে। স্টপ ওয়াচ চলছে তো চলছেই। কিন্তু সেতু আর ফুরোয় না। সকালের সোনা রোদে ঝিলিক তুলে পদ্মা নদীও তাল মিলিয়ে মুচকি হাসে। শেষ মেষ প্রায় ছয় কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে যখন আরেক প্রান্তে পৌঁছানো হল, ততক্ষনে স্টপ ওয়াচের কথা মনেই নেই কারো। তার বদলে গাড়ির স্পিকারে তুমুল ভল্যুমে ‘হাওয়া’ সিনেমার গান চলছে, ‘সাদা সাদা কালা কালা, রঙ জমেছে সাদা কালা...’।
গাড়ি থেকে নেমে আমরাও এক দফা তাজা হাওয়া খেয়ে নিলাম। যাত্রা বিরতি। হাইওয়ে রেস্তোরাঁয় পৌঁছে গেছি। গুগল ম্যাপ আমাদের অনেকটা পথ খামোখা ঘুরিয়ে এনেছে। খিদেয় সবার পেট চোঁ চোঁ। চোখ পর্যন্ত সরু হয়ে এসেছে। শুধু হাওয়াতে পেট ভরবে না। এবার এ্যায়সা দম দিয়ে কব্জি ডুবিয়ে খাবার পালা।
নান-পরোটায় রেস্তোরাঁর চওড়া টেবিল ঢেকে যেতে সময় লাগলো না। মাটনের ভুরভুরে ঘ্রানের সাথে বিফ কারির ঝাঁঝ মিলে ম ম করছে চারপাশ। ডিম ভাজিটাও বা বাদ যাবে কেন। একে একে থালাগুলো সাবড়ে দিতে সময় লাগলো না। কোল্ড ড্রিংক্সে ঘাউক ঢেকুর তুলে তৃপ্তি মিললো ষোলো আনা। ষোলোর উপরে আঠারো আনার লোভে মালাই চায়ের আবদার জানানো হল ওয়েটারের কাছে। বেচারাদের চাপাতির টিন ফুরিয়েছে। তাই কাগজের কাপে চড়ে এল ফেনিল কফি। বেশি দুধ আর আর বেশি চিনির ভারে মালাই চায়ের তুলনায় কম নয় সেই কফি। চোঁ করে টেনে উড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম সবাই।
আর মাত্র এক ঘন্টার পথ। কখনও মসৃন, কখনো উঁচুনিচু রাস্তা মাড়িয়ে, আর কখনো পথের ধারে দুমড়ে-মুচড়ে, উল্টে-ভচকিয়ে পড়ে থাকা বাস-ট্রাক-প্রাইভেট কারের ভুতুড়ে কঙ্কাল পাশ কাটিয়ে মোটামুটি নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলাম খুলনা শহর। সড়ক দুর্ঘটনা যে নিত্য দিনের ঘটনা, বুঝতে বাকি রইল না। এ পথে বেড়িয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো সবার কপালে জোটে না।
যাহোক, খুলনায় আগে আসি নি। আগ্রহ নিয়ে দেখছি জানালার বাইরেটা। ঢাকার মত ধূলি-ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা নয়। খুলনা বরং খোলামেলা, নির্ঝঞ্ঝাট এক শহর। বাতাসে এক ধরনের শুদ্ধতা ছড়ানো। ছোটবেলায় ঢাকাকে যেমন শান্ত, নিড়িবিলি দেখেছি, অনেকটা তেমন। গাড়ির চাইতে রিকশা আর অটো রিকশার আনাগোনাই বেশি। লোকজনের ভেতরও শহুরে তাড়া নেই। বরং স্বস্তিটাই যেন বেশি। অট্টালিকা আছে বটে, তবে আকাশ হঠিয়ে নয়। মাথার ওপরে সাদা মেঘেরা এখনও এ শহরে খেলে বেড়ায় অবলীলায়।
সব মিলিয়ে ‘কুল’ শহর খুলনাকে বড্ড ভাল লেগে গেল আমার আর তাফসু মিয়ার। বাকিরা অবশ্য এ শহরের নিয়মিত অতিথি। ঝুমু আপু খুলনার মেয়ে। তার পিছু পিছু প্রায়ই আসা হয় ভাইয়া আর রেন-রনের। আজকে তার সাথে জুটেছি আমরা আরো দু’জন। ঝুমু আপুর মামা বাড়িতে আজ রাতটা কাটিয়ে আগামীকাল রওনা আমাদের আসল গন্তব্য, সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে।
গাড়িটা মামার ফ্ল্যাট বাড়ির বাড়ি বারান্দায় ঢোকাতেই স্বয়ং মামা আর তার কলেজ পড়ুয়া ছেলে, আলভী হুড়মুড়িয়ে নেমে এসে আমাদের হাতের বোঁচকাগুলো ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। বোঝা গেল, মামাটা ঝুমু আপুর একার হলেও মামা বাড়ির আপ্যায়ন সবার জন্যে।
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দেখা গেল ডলি মামী হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। এই ডলি মামীর ব্যাপারে আমাদের খুব সাবধান করে দেয়া হয়েছে। এনার রান্নার হাত মারাত্মক দুর্দান্ত এবং উনি একবারে আট-দশ পদ রেঁধে লোকজনকে খাইয়ে মেরে ফেলতে পারলে বাঁচেন। এমন কুখ্যাতি শুনে দুপুরের ভাতের জন্যে আর তর সইছে না। যদিও মামীর ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে মিষ্টি মেয়ে মালিহা মুচকি হেসে ক্রমাগত মাথা নাড়ছে। তাদের আয়োজন নাকি খুব সামান্য, ‘মা আজকে রাঁধেই নি তেমন...’। পেছন থেকে ফিঁচেল হাসিতে দুষ্টু ছেলে আলভীও যোগ দিল। আমরা খুব আশ্বস্ত হলাম। এর মানে, আজকে হুলুস্থুল রকমের রান্না হয়েছে।
লাঞ্চের আগে হালকা চা-নাস্তার বেজায় ভারী পর্ব সেরে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। তবে পথে নয়, আকাশে। ডলি মামীর ছাদ বাগান দেখতে। সেখানে ফুলের গাছ, শিমের মাঁচা ইত্যাদি পাশে এক আশ্চর্য বস্তুর দেখা মিলল। তা হল, ছোট ছোট আকারের বনসাই গাছ। ‘বনসাই’ জাপানী শব্দ। গাছের ডাল ছেটে-ছুটে, তার বৃদ্ধিতে লাগাম পড়িয়ে বামন করে রাখার বিচিত্র শিল্প এই বনসাই। বিশাল বিশাল দেশি গাছগুলোকে অমন ক্ষুদ্র, মিনিয়েচার আকৃতিতে দেখে দারুন তাক লেগে গেল সবার। কোনো শিল্প-সমঝদার চোর এই দুর্লভ সংগ্রহের খোঁজ পেলে রোজ রাতে দালানের পাইপ বেয়ে হানা দিত নিশ্চিত। বনসাইগুলোর বাজার দর কত হবে কল্পনা করতে করতে লাঞ্চের সময় চলে এল। সিঁড়ির দিকে হল্লা করে পা বাড়ালো রন আর তাফসু মিয়া।
ইয়া বড় মাছের পেটি, পাঁচ রকমের সবজি আর চপ-কাবাব যোগে লাঞ্চটা হল সেই রকম পেটচুক্তি। তবে এ নাকি কিছুই না, রাতের আয়োজনই নাকি আসল-এরকম একটা হালকা ইশারা দেয়া হল। ‘বেশি খাইয়ে মেরে ফেলা’ কথাটার ভেতর মনে হয় কিছুটা হলেও সত্যতা আছে।
বিকেল গড়ানোর আগেই বেড়িয়ে পড়লাম আমরা। উদেশ্য, মিষ্টি কেনা। খুলনার মেয়ে ঝুমু আপু তার বাড়ি এসেছে অনেকদিন বাদে। যত মামা-খালা আছেন, সবার বাড়িতে ঢুঁ মেরে মিষ্টি দিয়ে আসা হবে-এই তার ইচ্ছা। অতএব, আমরা তার ইচ্ছেপূরনের সঙ্গী হলাম। আলভী আর মালিহা, দুই ভাইবোনও আমাদের সাথে আছে। গাল্প-গল্পে ফুটপাথ সরগরম করে চলছি সবাই।
দুই পা এগোলেই একটা করে মিষ্টির দোকান চোখে পড়ছে। মজার ব্যাপার, তাদের সবকটার নাম প্রায় একই। ’সাতক্ষীরা ঘোষ ডেইরি’। সাইনবোর্ডের নিচে আবার মোটা করে লেখা, ‘আমাদের কোথাও কোনো শাখা নেই’। এক-আধটু উঁকি দিতে দেখা গেল, সবার দেয়ালে ফটো ফ্রেম টাঙ্গানো আর তাতে গাঁদা ফুলের মালা ঝুলছে। ছবির নিচে ছোট করে লেখাঃ ‘প্রোপ্রাইটর পরিতোষ ঘোষ’। নাম এক হলেও একেক দোকানের পরিতোষ বাবুর চেহারা একেক রকম। কারো মুখে চিলতে হাসি, কারো চোখে চশমা-আঁটা গাম্ভীর্য। সব মিষ্টির দোকানের একজন করে পারসোনাল পরিতোষ ঘোষ আছে দেখছি।
এই পরিতোষ-রহস্য ভেদ করা আমাদের মত মামুলি ঢাকার লোকের কম্ম নয়। সুতরাং, আমরা ও লাইনে না গিয়ে থরে থরে সাজিয়ে রাখা মিষ্টির থালা বরাবর লোভী মাছির মত তাকিয়ে রইলাম। রসগোল্লার পাশে কাঁচাগোল্লা স্তুপ করে রাখা। বুন্দিয়া লাড্ডুর ডানে কালোজামের থালা। স্পঞ্জ মিষ্টির বামে চমচমের সারি। নিচের তাকে গুড়ের সন্দেশ, তো ওপরের র্যাকে ছানার সন্দেশ। রস জবজবে জিলিপির অদূরেই মালাই চাপের বাটি চুপচাপ।
স্বাদ পরখের অজুহাতে কয়েক দোকানের মিষ্টি চেখেও দেখা হল। নাহ্, পরিতোষ বাবুরা ভিন্ন হলেও সব দোকানে মিষ্টির স্বাদ অভিন্ন রকমের দুর্দান্ত। মুখে দিলেই গলে যায়, এমন মখমলের মত মোলায়েম। সুতরাং, খুলনা শহরের সকল পরিতোষ ঘোষের স্বর্গলাভ কামনা পূর্বক মিষ্টির অর্ডার দেয়া শুরু হল।
ভাইয়া-আপুর বিল মেটাতে সময় লাগছে। আলভীটাও গেছে অটো রিকশা খুঁজতে। এই ফাঁকে রেন আর আমি চারপাশটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। স্কুল আর কয়েকটা স্টেশনারি দোকান ছাড়া খুব বেশি কাঠামো নেই এদিকটায়। রাস্তার ওধারের নতুন চুনকাম করা দেয়ালটায় নানান উক্তি-বানী লিখে চুনকামের নিকুচি করা হয়েছে। সময় কাটাতে আমরা আগ্রহ নিয়ে দেয়ালের বানী চিরন্তনীগুলো পড়া শুরু করলাম।
‘ভীরুরা মরার আগে বারে বারে মরে। সাহসীরা মৃত্যুর স্বাদ একবারই গ্রহণ করে’ - শেক্সপীয়ার। বানীর পাশেই ইলেকট্রিক কেতলির বিজ্ঞাপন আঁকা, ‘আজই কিনুন অমুক কেতলী। তিন মিনিটেই গরম পানি’। কালো চকচকে পেটমোটা কেতলীটা আধাআধি খালি। বাকি পানি বোধহয় শেক্সপীয়ারের সাহসীদের ওপর ঢেলে তাদেরকে আলুসেদ্ধ করে মারা হয়েছিল। তিন মিনিটেই গরম পানি কোনো ছেলেখেলা না।
পরের বানী আরো ইন্টারেস্টিং। ‘সত্যকে ভালবাসো, কিন্তু ভুলকে ক্ষমা কর। - ভলতেয়ার’। ভলতেয়ারের পাশেই যম দূতের মত দাঁড়িয়ে ইলেকট্রিক কেতলী। ভুলকে ক্ষমা না করলে তার জন্যে আছে তিন মিনিটেই গরম পানি। ফরাসী নবজাগরনের পথিকৃৎ ভলতেয়ার যদি ক্ষুনাক্ষরেও জানতেন যে শ’খানেক বছর পরে বাংলাদেশে তার বিখ্যাত উক্তিতে এভাবে ফুটন্ত গরম পানি ঠেলে দেয়া হবে, তাহলে লেখালিখি বাদ দিয়ে পরিতোষ বাবুর মিষ্টির দোকানের ময়রা বনে যেতেন নিশ্চিত।
আলভী চলে এসেছে অটো রিকশা খুঁজে নিয়ে। মিষ্টি হাতে ভাই-আপুও তৈরি। বাড়ি বাড়ি সেগুলো বিলিয়ে বিকেল গড়িয়ে এল। ফেরার পথে নিউমার্কেটে থামা হল। নিউমার্কেটে মানেই নস্টালজিয়া। ছোটবেলায় বাবা-মার হাত ধরে কত ঘুরে বেড়ানো হয়েছে ঢাকার নিউমার্কেটে। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝুমু আপুও সায় দিল, খুলনার এই সাজানো গোছানো নিউমার্কেটে তারও কত স্মৃতি আছে বাবার সাথে। আজকে সেই বাবারা কেউ নেই। রয়ে গেছে কন্যারা। নিউমার্কেটে আসলে সেই কন্যাদের সবার আগে তাদের বাবাদের কথা মনে পড়ে।
বড় চত্বরটা ঘিরে দোকানের সারি। লোকে কিনছে কম, আড্ডা দিচ্ছে বেশি। নিউমার্কেটের সফট আইসক্রিম নাকি বেশ বিখ্যাত। সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে সবার হাতে হাতে উঠে এল আইসক্রিমে কোন। দরাজ হাতে দশে নয় দিয়ে দেয়া যায় অনায়াসে। সূর্য ঘনিয়ে সন্ধ্যা তখন। আইসক্রিম ফুরালে ডুবন্ত সূর্যটাকে শূন্য কোনে পুরে ফেলা হল।
রন-তাফসু মিয়াকে বেলুন কিনে দেয়া হয়েছে। তারা ইচ্ছে করে সেগুলো ফাটিয়ে বিকট শব্দে পিনিক লাগিয়ে দিচ্ছে। আমাদের খিদেটাও ফুলে ফেঁপে বেলুনের আকার নিয়েছে। আইসক্রিমটা ছিল মিষ্টি স্টার্টার মাত্র। গোটাকতক ছবি খিঁচে ঢিমে তালে ফেরার পথ ধরলাম।
মামার বাসায় রাতের জবরদস্ত ডিনার ছাড়াও আর কিছু অপেক্ষা করছিল। এ বাড়ির আরেক সদস্য, যাকে সারাদিন দেখা যায় নি, সেই মৌসুমীকে দেখা গেল রাঙতা মোড়া অনেকগুলো বাক্স নিয়ে হাজির। মৌসুমী হল ডলি মামীর ছোট বোন। বিশ্ববিদ্যালয় ডিঙ্গিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে। খুব সম্ভবত সে তার এ মাসের বেতনের পুরোটা জলে বিকিয়ে দিয়ে এসেছে। ঢাকার মেহমানের জন্যে তার উপহারের ঝোলা থেকে জাদুর টুপির মত একে একে বেরোতে লাগলো ছোট-বড় সবার জন্যে কত কি। মুহূর্তেই রন একটা খেলনা জিপ গাড়ির গর্বিত মালিক বনে গেল। আর টিনের রিকশা পেয়ে তাফসু মিয়াও আত্মহারা। ঘোষণা দিয়ে ফেললো, সে বড় হয়ে জার্মানি ছেড়ে বাংলাদেশে এসে ক’খানা রিকশা কিনে ভাড়া খাটাবে। কতগুলো ঝলমলে রঙ্গীন রিকশার মহাজন হওয়াটা আপাতত তার ‘এইম ইন লাইফ’।
উপহার পর্ব শেষ হতে না হতে শুরু হল খাদ্যপর্ব। আয়োজনের পশরা দেখে শুকনো জার্মান রুটি চিবানো এই আধপেটা প্রবাসীর ভিমড়ি খাবার যোগাড়। শেষ কবে এত পদ একসাথে দেখেছি, মনে পড়ছে না। চিকেনের লাল রোস্ট আর সাদা কোর্মা দুটোই পাতে চড়ালাম। ডিমের মালাইকারিও লাফিয়ে উঠে এল আপনা থেকেই। আর খুলনার বিখ্যাত গলদা চিংড়ি এড়িয়ে যাওয়া তো রীতিমত ফৌজদারি অপরাধ। পোলাওয়ের ঢিবির পাশে নধর দুটো চিংড়ি বসালাম। তাই দেখে কাচ্চি বিরিয়ানির গামলাটা কেমন ভুরু কুঁচকে তাকালো। ‘আচ্ছা, খাচ্ছি, খাচ্ছি’ বলে তাকেও তুলে নিলাম এক হাতা। ধুর্, কে যে কবে লিখছিল, ‘মামী এল লাঠি নিয়ে, পালাই পালাই’। সেই লোকটাকে ধরতে পারলে আজকে টেবিলে বসিয়ে ডলি মামীর রান্না খাইয়ে তাবত মামী সমাজের দুর্নাম ঘুঁচিয়ে দিতাম।
বাদশাহী ভোজনের সাইড-ইফেক্ট হিসেবে চোখের পাতা ঢুলুঢুলু করছে। কুমিরের হা-এর সমান কতগুলো প্রমান সাইজের হাই তুলে দিনটার ইতি টানলাম আমরা। ভোরে উঠতে হবে কালকে। নদীর ঘাটে রিভার ক্রুজ অপেক্ষা করবে আমাদের জন্যে। টপাটপ লঞ্চে চড়ে বসতে হবে সময়মাফিক।
ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে ঘুমের তোড়জোড় শুরু হল। ডলি মামী এক ফাঁকে এসে জানতে চাইল, ‘সকালের ব্রেকফাস্টে গরমাগরম পরোটা চলবে নাকি ক’খানা ফুলকো লুচি?’। জবাবে আমরা অস্ফুট এক ধরনের আওয়াজ তুললাম, যার মানে হ্যাঁ-ও না আবার না-ও না, কিংবা দু’টোই। একবারে খালি পেটে কে কবে অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়েছে। তাছাড়া, এ তো শুধু একপেশে ঘুরে বেড়ানো নয়। এ হল, আধেক ভ্রমন, আধেক ভোজন।
২
ছিমছাম দোতলা লঞ্চ। যাত্রী আমরা সব মিলিয়ে জনা বিশ-পঁচিশেক। আর কিছু আন্ডাবাচ্চা আছে। এরা বিপদজনক ভঙ্গিতে লঞ্চের রেলিং ধরে বাদুড়ের মত উল্টে ঝুলে আছে। তা নিয়ে অবশ্য তাদের বাবা-মার খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। পড়ে গেলে তো ঝপাৎ শব্দ হবেই। তাতেই বোঝা যাবে আছে না গেছে। বাদুড়দের দেখাদেখি আমাদের বাঁদর দু’জনও রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে। তাফসু মিয়া তার আদুল পেটটায় ভর দিয়ে প্রায় উবু হয়ে নদী দেখছে। মুরুব্বি সেজে বড় ভাই রন সাবধান করে দিল এক চোট, ‘তাফসু, অমন করে ঝুঁকলে কিন্তু তুমি পড়ে যাবে টুপ্ করে’। বলে সে নিজেও মারাত্মক রকম ঝুঁকে দেখালো। অবস্থা বেগতিক দেখে রেন আর আমি ছুটে গেলাম। দু’জনকে ‘তিন মিনিটেই গরম পানি’ থেরাপি দিতেই কাজ হল। তারা সুবোধ বালকের মত মাঝ ডেকে চলে এল।
মুশকিল হল, আমাদের রিভার ক্রুজ রিভারে ভাসছে, কিন্তু চলছে না। কারন, ভুল করে একই কেবিন দুই পার্টির কাছে বুকিং দেয়া হয়েছে। এই দুই পার্টির এক পার্টি হলাম আমরা। যদিও ব্যাপারটা ট্যুর ম্যানেজার আর লঞ্চের লোকের হাতে ছেড়ে দিয়ে ডেকে বসে কফি টানছি। তবে চোখে-মুখে সামান্য টেনশন। ব্যাপার বুঝে ঝুমু আপু আশ্বস্ত করলো, ‘আরে, একদম খারাপ আর কি হবে। বড়জোড় বুকিং মানি ফেরত নিয়ে খুলনা ফিরে যাব। তারপর চুইঝালের কোনো রেস্তোরাঁয় ঢুকে ইচ্ছেমত খেয়ে মনের ঝাল মিটিয়ে ঢাকা রওনা দেবো’। চুইঝালের কথা শুনে আমাদের চোখ পিটপিট করতে লাগলো। ঝুমু আপুর টোপ আমরা ক্ষুধার্ত মাছের মত গিলে চুপ হয়ে বসে রইলাম।
ম্যানেজার গোছের শুকনো মত লোকটা একটু পর পর দৌড়ে এসে অভয় দিয়ে যাচ্ছে, ’আর দশ মিনিট, স্যার। মামলা ক্লোজ করে চাবি বুঝিয়ে দিচ্ছি’। বেচারা অভয় দেবে কি, নিজেই ভয়ে অস্থির। অতি বেকায়দার একান-ওকান নার্ভাস হাসিতে তাকে উন্মাদ পত্রিকার ক্যারিক্যাচারের মত লাগছে। বাহারি প্রিন্স কোট গায়ে চাপানো লোকটার নামও প্রিন্স। আজকে দ্রুত মামলা ক্লোজ না হলে চাকরি খুইয়ে প্রিন্স থেকে এক ধাপে পপার হওয়া বোধহয় কেউ আটকাতে পারবে না।
অবশেষে দুপুর বারোটা বাজিয়ে মুশকিল আসান হল। প্রিন্স তার প্রিন্স কোটের ইজ্জত বজায় রেখে হাঁপ ছেড়ে বিদায় নিল। রূপসা নদীতে ঢেউ তুলে ধীর লয়ে এগিয়ে চলল আমাদের জলযান। সাথে একটা পাতি জলযানও আছে। পাড়ে নামার জন্যে ছোট নৌকা। ঢেউয়ের তালে সেটাও দুলছে দুলকি চালে।
রূপসা নদী এক বিখ্যাত নদী। এর পানি ঘোলাটে ধূসর। জীবনানন্দ দাশ এই ঘোলা জল নিয়ে লিখেছেন, ‘রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক শাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায়...’। জীবনানন্দের কথা সত্য করে দিয়ে ক’খানা ডিঙ্গি নৌকা উদয় হল মাঝ নদী ফুঁড়ে। তাদের পালে সেলাইয়ের ছোট-বড় তাপ্পি বহুদূর থেকে থেকে চোখে পড়ে। ছেড়া পালের হাল ধরা মাঝির বয়সও নেহায়েত অল্প। জীবনবাবুর পঙক্তিরা এখানে বড্ড জীবন্ত।
মাইক হাতে আমাদের ট্যুর গাইড, বছর পঁচিশের অনিক ছেলেটা এসে জানিয়ে দিল, এখনই লাঞ্চ দিয়ে দেবে। আর বিকাল চারটায় যেন তৈরি থাকি আমাদের প্রথম স্টপেজ ‘করমজল’ পয়েন্টে নামার জন্যে। প্রত্যেকের কেবিনে থাকা লাইফ জ্যাকেট পড়ে ট্রলারে উঠতে হবে। নইলে তাকে নেয়া হবে না। ঠন্ করে মাইক নামিয়ে ঘোষণা শেষ করতেই মাছের দোপেয়াজার দুর্বার ঘ্রান আমাদের ছোট্ট লঞ্চের পুরো ডেক দখল করে জাঁকিয়ে বসল। সাদা ভাতের ট্রে থেকে একরাশ ধোঁয়া ওঠা শুভ্রতা তাতে আরো মুগ্ধতা জুড়ে দিল যেন। চুইঝালের রেজালার ঘ্রান এসে প্রজাপতির মত পাখনা মেলার আগেই দেখা গেল আমরা থালা হাতে সটান উঠে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আহ্, চুইঝাল খাওয়া হচ্ছে তাহলে আজকে।
মাছের শেষ কাটা চিবিয়ে এক কাপ রঙ চা হাতে নিয়ে উদাস বসে আছি সবাই। করমজল পৌঁছাতে আর মাত্র চৌদ্দ কিলোমিটার বাকি। এমন সময় দৃশ্যপটে ভেসে উঠল রামপাল। রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সুউচ্চ চিমনি দিয়ে ভকভকে ধোঁয়া বিষাক্ত সাপের মত এঁকে বেঁকে রওনা দিয়েছে সুন্দরবনের দিকে। বছর ঘুরে কয়লার চালানও চলবে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে। তারপর একসময় হয়তো সবার জান্তে কিংবা অজান্তেই কয়লার গুড়ো আর সালফারে মরা মাছেরা ভেসে উঠবে সাদা চোখে নিরব প্রতিবাদ জানিয়ে। পেট ফুলে ঢোল মৃত বকের দল ঢেউ ধরে নির্বাক বয়ে যাবে। শ্বাসমূলে বিষ ঢুকে গাছেরা নীল হয়ে নুয়ে পড়বে। ভাবতেই সবার মন খারাপ হয়ে এল।
সম্বিত ফিরে এল, ট্যুর গাইড, অনিকের হাঁকডাকে। নিয়ন কমলা লাইফ জ্যাকেট পরে তৈরি হয়ে একে একে সবাই নৌকায় চেপে বসলাম। মাঝি বৈঠা ফেললো ছপাৎ। টলমল করতে করতে আমরা এগোলাম করমজলের জল কেটে। এই জল আর রূপসার জল নেই। এ নদীর নাম পশুর নদী। সুন্দরবনের নিজস্ব নদী।
করমজল জায়গাটা আসলে সুন্দরবনের সদর দরজার মতন। উঁকি দিলে বনের উঠান দেখা যায় বটে, কিন্তু অন্দরের দেখা মেলে না। সিনেমার প্রিভিউয়ের মত আর কি। বনপথে কাঠের তক্তা বিছিয়ে বানানো হয়েছে সাঁকোর ট্রেইল। পা রাখতেই ক্যাঁচকোঁচ আর্তনাদ করে উঠছে। এই শব্দে বাঘ নিজেই কানে তুলা গুঁজে পালিয়ে কুল পাবে না। তবে ভাঙ্গা কাঠের ফোঁকরে পড়ে বেমক্কা পা আটকে গেলে আর বাঘ মামা ঘ্যাকাৎ কামড়ে ঠ্যাং নিয়ে ভোঁ দৌড় দিলে আপত্তি জানানোর সময়টুকুও মিলবে না।
সাঁকোর দুই পাশে সুন্দরী, বাইন, কেওড়া আর পশুর গাছের শ্বাসমূল লোনা কাদা ফুঁড়ে আকাশপানে চাইছে। এক-আধটা লাল কাঁকড়া খুব সাবধানে উঁকি দিয়েই আবার দ্রুত গর্তে সেঁধিয়ে উধাও। পিচ্ছিল কাদামাটিতে মাড-স্কিপার নামের মাছগুলো হুটোপুটিতে ব্যস্ত। এরা উভচর। মাথার ওপরে ছোট্ট কালো পুঁতির মত চোখ। গাল আর গলার নিচে এই একটুখানি পাখনা অনেকটা হাতের মত দেখায়। সব মিলিয়ে মজার এক কার্টুনিশ চেহারা। তাদের কয়েকজনকে দেখা গেল লেজে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। যেন শহুরে আগুন্তকদের এক পলক দেখতে চাইছে। তারপর আর লেজে কুলালো না। উল্টে গিয়ে একে অন্যের গায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। মাড-স্কিপারদের স্টান্টবাজি দেখে আমরা হেসেই খুন।
আধা ঘন্টা হাঁটার পর আমরা পৌঁছালাম করমজলের কুমির আর হরিন প্রজনন কেন্দ্রে। জায়গাটায় চিড়িয়াখানা চিড়িয়াখানা ভাব প্রকট। বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হরিনের খামার। হরিণের পাল খেয়ে দেয়ে নাদুস নুদুস খোলতাই চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কুমিরের বাসায় উঁকি দিতেই দেখা গেল কুমির ছানা উপুর হয়ে শুয়ে ঘুম। কান পাতলে তাদের নাক ডাকার শব্দও মিলতে পারে। কাছিমদেরও দেখা গেল বেজায় অলস জীবন। কিন্তু আমাদের আর আলসেমি করার উপায় নেই। সূর্য ডুবি ডুবি করছে। তাছাড়া ছোট ছোট বুনো মশা কামড়াতে শুরু করেছে।
লঞ্চে ফিরতে না ফিরতেই সন্ধ্যার নাস্তার ডাক পড়লো। গরমাগরম সবজি পাকোড়ার মচমচে স্বাদে আর চা-কফির টাটকা সুবাসে শীতের সন্ধ্যাটা কুসুম কুসুম আমেজে ছেয়ে গেল। আমরা হাত-পা ছড়িয়ে বসে আগুন গরম পাকোড়াগুলো গপাগপ খেয়ে নাক দিয়ে ড্রাগনের মত ধোঁয়া ছাড়তে লাগলাম।
একটু পরেই মাইকে ভেসে এল আগামীকালের ভ্রমনসূচী। গাইড ট্যুর এক নিঃশ্বাসে বলে গেল, ‘সকালে কটকা, দুপুরে ডিমের চর, বিকালে কচিখালি আর সন্ধ্যায় টাইগার পয়েন্ট। কালকে বহুত হাঁটাহাঁটি আছে। সেইমত পোশাক পড়ে নেবেন। আর ভাল হয় আজকে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলে। ভোরে নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়বো‘।
ডিনারের পাট চুকতেই সুবোধ বালকের মত আমরা ডেক ছেড়ে কেবিনে ফিরে গেলাম হাই তুলতে তুলতে। এত যে হাঁটাবে কালকে, তা সকালে কি খেতে দেবে, তাই ভাবছি। জম্পেশ কিছু না হলে কিন্তু খেলবো না। তবে কালকে যে আসল সুন্দরবনের দেখা মিলবে, তার আঁচ পাওয়া গেল ভালোভাবেই।
৩
ফুরুফুরে মেজাজে লঞ্চের ডেকে উঠে এলাম সবাই। ভোর হয়েছে, কিন্তু আলো তেমন ফোটে নি। কয়েকটা কাক কা কা ডানা ঝাপটিয়ে কুয়াশা ফুড়ে উড়ে গেল। কাকভোর বোধহয় একেই বলে। কাল সারা রাত আরো একশো কিলোমিটার নদী বয়ে আজ আমরা সুন্দরবনের আরো গহীনে পৌঁছে গেছি। পৌঁছে যে সত্যিই গেছি, তার নমুনা হিসেবে খুব কাছ দিয়ে চকচকে টাকওয়ালা এক জাম্বো সাইজ মদনটাক উড়ে গেল সাঁই করে। ছড়ানো দুই পাখা মিলিয়ে দশ-বারো ফিট তো হবেই। এই বিচিত্রদর্শন পাখিকে গাঁওগেরামেও দেখা যায় না।
বিরল চিড়িয়া দেখে বিস্ময় কাটতে না কাটতেই এক ঝাঁক ডলফিন ঝপাৎ করে শূন্যে উড়ে আবার নদীর অতলে মিলিয়ে গেল। কোথা থেকে তীক্ষ্ণ চিল চিৎকার শুনে নদী ছেড়ে আকাশ পানে চাইতেই দেখি এক জোড়া শঙ্খ চিল চক্কর দিতে দিতে খুব ঝগড়া জুড়েছে। এই ঝগড়ায় কান না দিয়ে সাদা বকের দল এক ঠ্যাঙে উদাস দাঁড়িয়ে দূরের ঐ বড় গাছটার সব ক’টা ডালপালা জুড়ে। পাশের গাছেই বানর দলের প্রবল লম্ফঝম্ফেও তাদের ধ্যান ভাঙ্গছে না। শুধু নদীর পাড়ে বেড়াতে আসা হরিণের পাল খুব বিরক্তি নিয়ে মাথা নাড়ছে।
কাছেই কালোপনা একটা পানকৌড়ি মাছের খোঁজে টুপ করে ডুব দিল নদীতে। তার শুধু লিকলিকে পা দুটোই ভাসছে উল্টো হয়ে। বাকি শরীর পানির নিচে। আগুনরঙা কমলা এক মাছরাঙ্গা নিরাসক্ত আধবোজা চোখে পানকৌড়ির কান্ড দেখছে। মাছরাঙ্গা বাবাজির নিজের পেটে যে মাছ ঘচ ঘচ করছে, তা আর বলতে। চারপাশে এত প্রানের উচ্ছ্বাসে আমরা মুগ্ধ, অভিভূত হয়ে গেলাম।
মুর্হুমুর্হু ক্লিক ক্লিক শব্দে দৃশ্যগুলো ক্যামেরাবন্দী হয়ে যাচ্ছে। ভাইয়া তার নাইকন ক্যামেরায় জুম লেন্স লাগিয়ে লঞ্চের এমাথা ওমাথা ছুটোছুটি করে ছবি তুলছে। তার মনে তিরতিরে আনন্দ। আর সব দিন রোগীকে আলতো করে শুধাতে হয়, ‘জি, আপনার সমস্যাটা খুলে বলেন’। রোগীও অতি উৎসাহে সমস্যার ফর্দ মেলে ধরে, ‘স্যার, খালি শরীল চিবায়, কামড়ায়, আর মাঝে মাঝে বাইন মারে’। চিবানো, কামড়ানো আর বাইন মারাকে খুব সাবধানে মেডিকেলের পরিভাষায় অনুবাদ করে তার সাথে রোগীর ফাস্টিং সুগার আর হাই ব্লাড প্রেশারের সমীকরণ মিলিয়ে চিকিৎসা বাতলাতে হচ্ছে না আজকে। তাই বেশ ফুর্তি ফুর্তি লাগছে।
খানিক বাদে ক্যামেরা নামিয়ে রাখতে হল। সকালের নাস্তার ডাক পড়েছে। ভুনা খিচুড়ির পাশে চাক চাক গোল করে কাটা বেগুন ভাজাগুলো দেখে আমাদের চোখ-গোল অবস্থা। নদীর বাতাস যেন আমাদের খিদের পালে আরো হাওয়া তুলে দিল। রাক্ষস-খোক্ষসের মত খিচুড়ির থালায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। তারপর ডবল টি-ব্যাগ চুবিয়ে কড়া এক কাপ চা মেরে দিয়ে খানিকক্ষন ঝিম ধরে থেকে জিরিয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়া পরিশ্রমের কাজ। বিশ্রাম নেয়া তাই অতি আবশ্যক।
মিনিট দশেকের ভেতর নাকি ডাঙ্গায় নামবো। চটজলদি কেবিনের গিয়ে তৈরি হয়ে এলাম। পায়ে রাবারের স্যান্ডেল-চপ্পল, গায়ে ঢোলা টি-শার্ট, আর পরনে কুচকানো-ভচকানো ট্রাউজার। পিঠে ব্যাগপ্যাকটা না থাকলে বোঝার উপায় নেই যে সুন্দরবন অভিযানে যাচ্ছি নাকি বেলা করে ঘুম থেকে উঠে দাঁত মাজতে রওনা দিয়েছি। কিন্তু আমরা তো আর জিম করবেট নই যে কুমায়ূনের মানুষখেকো মারতে খাকি স্যুট-বুট পরে বন্দুক কাঁধে বেরোবো।
খাকি পোশাক পরা অবশ্য একজন সাথে আছে। সে আমাদের ফরেস্ট গার্ড। দলের গানম্যান। দলের আগে আগে সে যাবে বন্দুক উঁচিয়ে। বিপদ দেখলে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আপদ বিদায়ের চেষ্টা করবে। এই বিপদের নাম আসলে বাঘ। যেখানে যাচ্ছি, সে জায়গাটার নাম কটকা। নামটা ফটকা ফটকা শোনালেও এখানে বাঘ আছে। এবং ভাল রকমই আছে। রিভার ক্রুজের গাইড কথাটা বেশ পঁইপঁই করে বলেছে। মুশকিল হল, এরকম ট্রিপে গার্ড থাকে দুই জন করে। দলের সামনে একজন আর পেছনে একজন। দ্বিতীয়জনকে এর আগের ট্যুরে বাঘ মামা হজম করে ফেলেছে কিনা কে জানে।
ডিঙ্গি নৌকাটা কটকার তীরে ভিড়তেই সবাই সভয়ে দলের একমাত্র গানম্যানের পেছনে লাইন করে দাঁড়িয়ে গেল। লাইনের লেজের অংশে পড়লাম আমরা। আমাদের ভরসা গাইড অনিক মিয়া। বাঘ তাড়ানো তো দূরের কথা, বানর খেদানোর জন্যে একটা ভাঙ্গা কঞ্চিও নেই তার হাতে। তবে আশার কথা, গতকালের মত আজকেও সবার দুহাতে দু’টো করে জাম্বুরা সাইজের কমলা ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। দুর্ধর্ষ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের বিপরীতে একমাত্র ব্রহ্মাস্ত্র এই সিলেটি কমলা। মনে মনে প্রমাদ গুনতে গুনতে পা বাড়ালাম।
চোখা চোখা শ্বাসমূল ডিঙ্গিয়ে আর হাঁটু অবধি ফার্নের ঝোপ সরিয়ে এগোতে হচ্ছে এখন। একটু যে ঢিমেতালে আয়েশ করে হেলেদুলে চলবো, তার উপায় নেই। গাইড আর গানম্যান প্রচুর হ্যাট হ্যাট করছে। তাদের তাড়ায় রীতিমত তিরিং বিরিং কুচকাওয়াজের ওপরে আছি আমরা। ক’হাত দূরেই ঘন জঙ্গল। এই দিনের বেলাতেও সেখানে ঘোট পাকানো অন্ধকার। কেন যেন মনে হল, সেখান থেকে অনেকগুলো জ্বলজ্বলে চোখ এদিক পানেই চেয়ে আছে। মানুষের দলের কোনটার হাড় কচি, কোনটার বুড়ো হাড়, তার একটা নিরব হিসেবনিকেশ চলছে। হালকা একটা গা কাটা দিয়ে উঠল, বাবা গো।
এই পথ ধরে কয়েক কিলোমিটার হাঁটলেই নাকি কটকা সৈকত। স্থানীয়রা বলে জামতলা বিচ।
জামতলা বিচে পৌঁছে যেতে সময় লাগলো না বেশি। চোখের সামনে হুট করে ভেসে উঠলো বঙ্গোপসাগর। বনের সবুজ আর সাগরের নীলের এমন আশ্চর্য সমাহারে বিস্ময়ে হোঁচট খেতে হল। ইচ্ছে হল এক লাফে সাগরে ডুব মেরে আসি। তবে পানিতে নামার জো নেই। চোরাবালির জন্যে কুখ্যাত এই জামতলা। আবার ডাঙ্গার বেশি গভীরে বনের দিকেও যাওয়া যাবে না।
হাজার বারণ মেনে নিয়ে আমরা যে যার মত অলস হাঁটছি তীর ধরে। এখানে ওখানে গাছের গুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরকে ভাস্কর্য বলে ভুল হতে চায়। যেন কোনো শিল্পী অতি যত্নে তাদের গড়ে রেখে গেছে। পায়ের নিচে সৈকত জুড়ে কাঁকড়াদের আলপনা। ঠিক যেন নকশীকাঁথার ফোঁড় তুলেছে বালুর জমিনে। জামতলা দেখছি শিল্পীদের আস্তানা। এই জায়গাটার না জামতলা না হয়ে আরেকটু কাব্যিক হলে বেশি মানাতো। এই যেমন নকশীর পাড় বা এরকম কিছু। জামতলা নামটা কেমন যেন বাসস্ট্যান্ড বাসস্ট্যান্ড শোনায়। ফিরে যাবার হাঁকডাকে বেশিক্ষন এই শিল্পকলা দর্শন করা গেল না। আবার লেফট-রাইট কুচকাওয়াজ ধরলাম।
মাঝপথে হঠাৎ বিনে মেঘে আকাশ ডাকলো, গুরুম গুরুম। ডাকটা শুনে কেমন যেন পেটের ভেতর পাক দিয়ে উঠলো। লাইনের পেছন থেকে গাইড চাপা স্বরে বলল, ‘কেউ জোরে কথা বলবেন না। আর খবরদার দলছুট হবেন না...’। সতর্কবার্তা শেষ না হতেই আবার ভেসে এল চাপা গর্জন, ‘হালুউউউম, হালুউউম...’। গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গিয়ে ব্রেকফাস্টের খিচুড়ি-বেগুনভাজা হজম হয়ে গেল নিমিষেই। রেন আর আমি পাশাপাশি হাঁটছিলাম। হালুম ডাকে আমরা জমে ভূত। আজকে বাঘে খেলে আগস্ট মাসে চল্লিশ বছরের জন্মদিনটা আর করা হবে না আমার। আর ক্লাস এইট পড়ুয়া রেনের আফসোস, সামনে জাতীয় গনিত অলিম্পিয়াড। সিলেকশন টেস্টটা বুঝি আর দেয়া গেল না।
ভাইয়া আর ঝুমু আপু অভয় দিল, ‘এই বাঘ কমপক্ষে এক-দেড় কিলোমিটার দূরে। দৌড়ে আসতেও তো সময় লাগবে’। তাতে আমাদের ভয়ের বরফ গললো না। কারন, শব্দটা আসছে ঠিক পাশের বন থেকে। কিলোমিটারের বদলে বাঘ মামা বোধহয় পাতার আড়ালে কয়েক মিটার দূরেই আছে। হাতে বাঘনাশী ব্রমাস্ত্র সিলেটি কমলাও নেই। খেয়ে ফেলা হয়েছে কখন। সুতরাং, ঝেড়ে দৌড় দেবার ইচ্ছেটাকে বহু কষ্টে দমিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেললাম জোরসে হেইয়ো।
পুরো দলের কাউকে বাঘের লাঞ্চ না বানিয়েই আমরা নৌকায় চেপে বসলাম। এই যাত্রা বিরতিহীন। পরের স্টপেজ শরণখোলা রেঞ্জ। ঢেউ কেটে নৌকা এগিয়ে চললো ছলাৎ ছলাৎ।
শরণখোলার এদিকটা বেশ খোলামেলা। ঘন বন থেকে দূরে জায়গাটা। উঁচু উঁচু গাছের ফাঁকে রোদ খেলে যাচ্ছে অকাতরে। আমরা গা ছাড়া দিয়ে ঘুরে ঘুরে গাছগাছালি পাখপাখালি দেখতে লাগলাম। এক ফাঁকে আমাদের গাইড অনিক মিয়া তড়তড়িয়ে গাছে উঠে কতগুলো পাতাবহুল ডাল কেটে জড়ো করে কিসের যেন তোড়জোড় করছে। বনের ভেতর আগুন জ্বালিয়ে দেবে না তো। কিন্তু না, দেখা গেল, কচি পাতার লোভে আস্তে আস্তে এক-দুই-তিন, ভিড় করে প্রায় গোটা পনেরো হরিন এসে গোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চিত্তির বিত্তির ফুটকি আঁকা চিত্রা হরিণের পাল এত কাছ থেকে দেখতে পেয়ে সবার ভেতর বেশ একটা উত্তেজনা কাজ করছে।
কাছেই বিরাট এক ভাম সাইজের বানর বেজার মুখে বসে আছে। হরিণের প্রতি সবার আগ্রহ দেখে তার হালকা জ্বলুনি লাগছে। এমন সময়ে কে বা কারা তাকে একটা আস্ত কমলা ছুড়ে দিল। সেও চার-ছক্কা ধরার ভঙ্গিতে সেটা লুফে নিল। তার পরের দৃশ্য দেখে আমাদের চোয়াল ঝুলে গেল। বানর মশাই স্বচ্ছ পানির সরু নালায় বাসন মাজার স্টাইলে কমলাটা খুব এক চোট কচলে ধুয়ে নিল। তারপর খুব সন্তর্পনে সেটাকে ছিলে নিয়ে একটা একটা কোয়া গালে পুরতে লাগলো। হরিণ ফেলে আমরা বানর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। রনের বুদ্ধিতে বানর বরাবর দ্বিতীয় কমলা ছুড়ে দিয়েছে আমাদের তাফসু মিয়া। এবং ক্যাচ! এবার হরিণের পাল সরু চোখে তাকাচ্ছে এদিক পানে। তাদের ‘ফিফটিন মিনিটস অফ ফেইম’ শেষ। আর বানরের শুরু।
শরনখোলার সবুজ সময়টা ভালই কাটলো। তারপর লঞ্চে ফিরে গিয়ে চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে কাকের ছানার মত হাঁ করে বসে থাকলাম, কখন এরা খেতে দেবে। পেটের অতল থেকে বাঘের ডাকের মতই চাপা গর্জন শোনা যাচ্ছে, ‘গ্রাউল, গ্রাউউউল...’।
অবস্থা সঙ্গীন বুঝে নিয়ে তড়িঘড়ি করে টেবিল লাগালো বয়-বাবুর্চি। উফ্, পারশে মাছের দোপেঁয়াজা যা রেঁধেছে না। তাজা মাছের স্বাদই আলাদা। ভাজা পেঁয়াজ গলে গিয়ে মারাত্মক এক ঝোল হয়েছে । সাদা ভাতের সাথে লাল ঝোল মাখিয়ে গালে পুরতেই বেহেশতি আরামে চোখ বুজে এল। আর কাঁচা মরিচে দুটো জব্বর কামড় বসাতেই বোজা চোখ তড়াক করে খুলে গেল জাহান্নামী ঝালে।
একটু পরেই নড়ে চড়ে বসতে হল। আবার ডাক পড়েছে। এবার গন্তব্য, ডিমের চর। বঙ্গোপসাগেরের বুকে জেগে ওঠা ছোট্ট একটা চর। এ চরেও বন আছে। আর বন মানেই মামার বাড়ি। অতএব, আরেক দফা পাখি পড়া পড়ানো হল যেন বনের দিকে কেউ না যায়। চরের তীরে বেড়িয়েই যেন ক্ষান্ত দেই সবাই।
নৌকায় চাপলাম আমরা। কালকে যেমন সবাই লাইফ জ্যাকেট পড়ে ভোম্বল হয়ে বসেছিল, আজকে তাদের অনেকেই সাহসী হয়ে গেছে। অনেকগুলো লাইফ জ্যাকেট তাই লাইফলেস হয়ে নৌকার গলুইয়ের কাছে পড়ে আছে।
ঘাটে নৌকা ভিড়তেই সবাই দুদ্দাড় করে নেমে বনের ভেতর মিলিয়ে গেল। ‘বনের দিকে যাবেন না, প্লিজ’-এই অনুরোধ দু’পয়সা পাত্তা পেল না। আমরা অবশ্য বনে না গিয়ে পাড়ের দিকে গেলাম। রন-রেন-তাফসু মিয়া নিয়ে বিপুল উৎসাহে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়লো ঝুমু আপু আর ভাইয়া। আর আমি এদিকে কম কাঁকড়া আছে এমন জায়গা খুঁজে পা ছড়িয়ে বসে নাইকন ক্যামেরা আর মুঠোফোনগুলো পাহারা দিতে লাগলাম।
দুপুরের রোদে সাগরের ঢেউ চিকচিক করছে কাঁচা সোনার মত। আর সেই ঢেউ এসে আছড়ে ভাঙছে ডিমের চরের ঝিকিমিকি রুপালি তীরে। তীরের কাছেই কাশবনের সাদা ঝাড়। কাশফুলগুলোকে দূর থেকে যেন ঠিক হাওয়াই মিঠাই লাগছে।
সমুদ্রের পানিতে সাঁতারের মজাই আলাদা। হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে সবাই সমুদ্রের পানি গরম করে ফেলছে। অনেক্ষন হয়ে গেল, কারো উঠে আসার নাম নেই। হঠাৎ আমাদের ফরেস্ট গার্ডকে পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। পাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে সে বেজায় চ্যাঁচাতে লাগলো, ‘আপনেরা উইঠা আসেন, পানিতে কুমির আছে। বলতে খিয়াল ছিল না। আসেন তাড়াতাড়ি...’। হুশিয়ারি মাটিতে পড়ার আগেই সবাই হাঁচড়ে পাঁচড়ে তীরে এসে হাঁপাতে লাগলো। সুন্দরবনে এসে দেখি ভাল মুশকিলে পড়া গেলে। ডাঙ্গায় বাঘ, তো জলে কুমির। যার কথা জানাতে আমাদের ফরেস্ট গার্ডের ‘খিয়াল’ ছিল না।
সারা গায়ে বালি মেখে ভূত হয়ে লঞ্চে ফিরে এলাম। কিন্তু ফ্রেশ হয়ে নেবার ফুসরত মিলল না। বলা হল, আধা ঘন্টার ভেতর চা-নাস্তা খেয়ে আবার নাকি রওনা দেবো আরেকখানে। সুতরাং আমরা বালু চিকচিকে ভেজা চেহারা নিয়েই ডেকের হাওয়ায় শুকোতে লাগলাম।
এক ফাঁকে নিচ থেকে ঘুরে এসে রেন জানালো, সে নিচের হেঁশেলে উঁকি মেরে এসেছে। সেখানে নাকি বিপুল পরিমান ইনস্ট্যান্ট নুডুলস সেদ্ধ হচ্ছে। পাশে সবজি কুচির স্তুপ। বিকালের নাস্তাটা কল্পনা করে নিতে বেগ পেতে হল না। ভেজিটেবল ফ্রাইড নুডুলস। আহ্! পাঁচ মিনিটেই ছোট ছোট মেলামাইনের প্লেটে ঝুরঝুরে নুডুলস চলে এল গরমাগরম। মচমচে খাদ্যবস্তুটা কচকচ চিবিয়ে খেয়ে গা এলিয়ে দিলাম চেয়ারের হাতলে। হাতি টানা দিলেও এখন কোথাও যাব না আমরা।
কিন্তু পরের দৃশ্যেই দেখা গেল নৌকার পাটাতনে জবুথবু হয়ে বসে আছি। ঝুমু আপুর মত শক্তপোক্ত মানুষও কাঁধের ব্যাগটা বালিশ বানিয়ে আধশোয়া। তার সাথে আবার এক মহিলা যাত্রী গল্প জুড়ে দিয়েছে। ‘এই যে আফা জিরাইতাছেন, আফনে কি এই জাহাজে কাজ করেন?’। ঝুমু আপু একটা দুর্বোধ্য ‘হুম’ করলো জবাবে। মহিলা এবার নিশ্চিত হয়ে গেল সে যে এই জাহাজের খালাসী গোছের কেউ। কিংবা রান্নার কাজটাজ করে বোধহয়। প্রশ্ন চলছেই, ‘তা, কদ্দিন এই জাহাজে, কাজকাম কিরম লাগে...’। ঝুমু আপু হালকা গলায় ধোঁয়াটে সব উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। হাজের রাঁধুনি-খালাসীর কাল্পনিক চাকরিটা বোধহয় তার ভালই লাগছে। হাঁড়ের ডাক্তারি তো অনেক হল। আর কত।
কচিখালিতে যখন ভিড়লাম, তখন বিকালের সূর্যটাও আমাদের মত ক্লান্তিতে ঢলে পড়তে চাইছে। আবছায়া একটা কুয়াশা সুযোগ বুঝে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। হঠাৎ কুয়াশা কেটে অতিকায় দু’টো বজরা ভেসে উঠল। তাদের কাঠের কাঠামো মিশিকালো। এগুলো আসলে বাওয়ালীদের নৌকা। শুকনো গোলপাতা কেটে তুজ করে নিয়ে যাচ্ছে নৌকায়। তাই দিয়ে হবে ঘরের ছাউনি কিংবা ভাতের চুলার জ্বালানি।
পথটা ভীষন পিচ্ছিল। কাদায় মাখামাখি হয়ে কচিখালির ভেতর দিয়ে টাইগার পয়েন্ট-এ যাচ্ছি আমরা। সাথের গাইড আমাদের টাইগার পয়েন্টের নামকরনের সার্থকতা উপর সবক দিয়ে দিয়েছে। সুন্দরবন কোনো বোটানিকাল গার্ডেন নয়। এর পুরোটাই বাঘের রাজত্ব, ইত্যাদি। তবে এখানে ওখানে বাওয়ালদের আনাগোনা আর হাঁকডাকে জায়গাটা সরব। আমরা চপ্পল ফটফটিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছি তাদের ব্যস্ততা।
দলের ভেতর থেকে কে যেন প্রশ্ন ছুড়লো, ‘এই যে ভাই, আপনারা বাঘ টাঘ দেখসেন কখনো?’। স্বাস্থ্যবান, পেশিবহুল এক বাওয়াল মাথায় এক আঁটি গোলপাতা তুলতে তুলতে সহাস্যে জবাব দিল, ‘বাঘ কি দেখোন লাগে নাকি আমাগো, শুনলেই তো হয়। তখন ফট্ কইরা তফাতে চইলা যাই’। বোঝা গেল এখানে বাঘ চলে ডালে ডালে আর বাওয়াল-মাওয়াল চলে পাতায় পাতায়। যে যার সাধ্যমত চোখাচোখি এড়িয়ে বাঁচে।
গাছেরা এখানে নিজের খেয়াল খুশিমত বেড়ে উঠে আকাশ ছুঁয়েছে। ঘাস-ঝোঁপ-ঝাড় মিলে জংলী চেহারা সবখানে। চারপাশে কাদামাটির বুনো ঘ্রান। গোধূলি লগ্নে ঘরে ফেরা পাখিদের কুহুতানে কচিখালীর প্রান্তর ভীষন সরব আর মুখর।
টাইগার পয়েন্টে চলে এসেছি। একদিনে দুইবার বাঘের সাক্ষাৎ গানিতিক প্রোবাবিলিটির সাথে যায় না। অথচ গনিতকে কাঁচকলা দেখিয়ে, গায়ের রোম দাঁড় করিয়ে, সাঁঝের বাতাস কেটে কানে এলো, ‘গরর..গররর...’। কুলকুল একটা ঠান্ডা ঘাম ছুটে গেল সবার। চুপচাপ ভদ্রলোকের মত অতি দ্রুত পা চালিয়ে পাড়ের দিকে চললাম। জ্যান্ত ফিরতে পারাটা জরুরি। কারণ, রাতে বার্বিকিউ আছে।
ঘন্টাখানেক পর। লঞ্চের ডেকে ঝলসানো মুরগির রান চিবোতে চিবোতে আজকের মত অ্যাডভেঞ্চারের লাগাম টানলাম। গনগনে কয়লায় কোরাল মাছ বার্বিকিউ হচ্ছে। গালের ভেতর মুরগির তন্দুরী টিক্কা মিলিয়ে যেতেই পাতে উঠে এল মাছের টুকরো। রসালো কালো-সোনালি জেল্লা ছাড়ছে টুকরোগুলো। মাছের সাথে ফ্রাইড রাইস নাকি পরোটা নেবো, ভেবে না পেয়ে পরখ করা হল দু’টোই। গবগব্ চলতে লাগলো বার্বিকিউ ভোজন।
পরের দিন ধূমায়িত ছোলার ডাল আর হিম হিম ঠান্ডা সুজির হালুয়ার সাথে ক’খানা রুটি মেরে দিয়ে আমরা চললাম হারবাড়ীয়ার উদ্দেশ্যে। হারবাড়ীয়া জায়গাটা চাঁদপাই রেঞ্জে পড়েছে। কাঠের সাঁকোর ট্রেইল দেখিয়ে আমাদের বলা হল ট্রেইলের নিচেই নাকি একটা বাঘের চলাচল। সে এই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। আর আমরা অতিথি মাত্র। সুতরাং, গলা তুলে চ্যাঁওভ্যাঁও একদম বারন। শুধু শুধু বাঘের কান চুলকে দিয়ে কি লাভ। খুব সন্তর্পনে পা বাড়ালাম। গহীন বনে পাতার ফোঁকর গলে সকালের রোদটা সিধ কেটে চুরি করে ঢুকে পড়ছে। আলো-ছায়ায় বেশ একটা ডোরাকাটা পরিবেশ। নিঃশব্দে বাঘ উদয় হলে আলাদা করে বোঝার উপায় নেই।
বাঘের বদলে দেখা মিললো বাঘের পায়ের ছাপ। গোল গোল থাবা। বিড়ালের থাবার মতই। শুধু এই বিড়ালটা একটু সাইজে বড়, এই যা। ছাপগুলো ভীষন তাজা। এই বুঝি মিনিট খানেক আগেও সে এই পথে হেঁটে গেছে। আবিষ্কার হল ছোট ছোট আরো কতগুলো ছাপ। বড় ছাপের পেছন পেছনে চলে গেছে। বাঘের ছানা নির্ঘাৎ। আশংকা সত্যি করে দিয়ে আমাদের গানম্যান উদাস গলায় জানালো, ‘ঐ গাছের কোটরে বাঘে ছাও দিসে মাসখানেক হইল’। ছানা হতে তো অন্তত দুইটা বাঘ দরকার। তবে যে বললো, এখানে একটা মাত্র বাঘ? ভুতুড়ে রকমের গাছের কোটরটা দেখে মনে হল এখানে খালি বাঘ কেন, ডাইনি-পেত্নীও থাকতে পারে।
পায়ে পায়ে ট্রেইল ফুরিয়ে এল। আরেক প্রান্তে এসে আমরা হতভম্ব। বিশাল এক গোলপুকুর আর তাতে শত শত শাপলা ফুটে আছে। গোলাপি আভায় চোখে ধাঁধাঁ লেগে যাচ্ছে যেন। পুকুড়পাড়ে এক কোনায় সাদা মার্বেলের এক টুকরো ফলক চোখে পড়লো। খোদাই করে লেখা, ‘বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্মরনে বন্যপ্রাণীদের জন্যে পানীয় জলের পুকুর, হারবাড়ীয়া’। জানা গেল এই পুকুরে পানি খেতে বাঘ আসে প্রায়ই। কখনো বা শ্লথ গতিতে সাঁতার কাটে। রাজকীয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল। শৌর্য-বীর্যের এমন যুগলবন্দী আর কোথায় মিলবে।
আমাদের নাতিদীর্ঘ ভ্রমন মোটামুটি গুটিয়ে এসেছে। নৌকা দাঁড়িয়ে আমাদের অপেক্ষায়। সবাই এখনও ফিরে আসে নি। এই ফাঁকে কচি ডাব দিয়ে গলা ভেজানো হল। ডাবের শ্বাস খাবার লোভে বানর পরিবারগুলো কাঁধে কোলে ছানা নিয়ে ছোঁকছোঁক করছে। একটু বেখেয়াল হলেই ছোঁ মারতে চাইছে। শুধু ডাবের দিকেই তাদের নজর না। ঝুমু আপুর সানগ্লাস পর্যন্ত হাইজ্যাক হয়ে যেত আরেকটু হলেই। এই বানরের সংগ্রহে কয়টা রে-ব্যান আর গুচি ব্র্যান্ডের চশমা আছে কে জানে। কড়া রোদ উঠলে হয়তো ডাব হাতে আয়েশ করে শুয়ে থাকে সানগ্লাস চোখে।
সবাইকে তুলে নৌকার মুখ ঘুরিয়ে নেয়া হয়েছে। এই ক’দিন জলে-জঙ্গলে কাটিয়ে আর ডাঙ্গায় ফিরে যেতে মন চাইছে না। তবুও ডাঙ্গার লোক আমরা ফিরে চললাম আমাদের নিজস্ব ইঠ-কাঠের জঙ্গলে। মৃদুমন্দ বাতাস বয়ে গিয়ে গোলপাতার ঝাড় নড়ে উঠল। যেন হাত নেড়ে বিদায় জানালো আমাদের। (সমাপ্ত)
ডঃ রিম সাবরিনা জাহান সরকার
মিউনিখ, জার্মানি
ছবি সৌজন্যে, ডাঃ রোনে সুজন ক্লোদ সরকার
বি.দ্র. লেখাটি এর আগে লাইফস্টাইল ম্যাগাজিন পোর্টাল, 'হালফ্যাশন'-এ প্রকাশিত হয়েছিল
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মার্চ, ২০২৩ রাত ১:০১