১ দাদুর সোফা
ঘরে বসে হোম অফিস করে করে টোম হয়ে গেছি। ‘টোম’ জিনিসটা বোধহয় সেদ্ধ আলুর মত ভচকানো কিছু একটা হবে। সকাল থেকে বেজার মুখে টেবিল জড়িয়ে পড়ে থাকি, আর নড়ন চড়ন নেই। দিন শেষে ধড়মড়িয়ে দাঁড়ালে পুরানো জং ধরা যন্ত্রের মত হাড়-গোড়গুলো ক্যাঁচকোচ করে ওঠে।
এই টোম-দশা শুরু হয়েছে মিউনিখের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষনার পাট চুকিয়ে নতুন চাকরিতে ঢোকার পর থেকে। এ চাকরিতে আমার কাজ, ওষুধ কোম্পানি আর বায়োটেক ফার্মের হয়ে তাদের জন্যে রিপোর্ট লিখে দেয়া। নতুন ড্রাগ আর থেরাপি আবিষ্কার হলে শ‘খানেক রোগীর উপর পরখ করে দেখা হয় যে ওষুধে আসলে কাজ হয় কিনা, নাকি ক্রিয়ার চাইতে প্রতিক্রিয়ার পাল্লাই বেশি। যেমন, লাংস ক্যান্সারের থেরাপি নিয়ে রোগীর আবার লিভারের বারোটা বেজে গেল কিনা, এই সব খতিয়ান আর কি।
লেখালিখির কাজটা অফিসের হাউকাউয়ের চাইতে ঘরে বসে নিরিবিলিতেই ভাল হয়। তাছাড়া, অফিসটাও পড়েছে বেজায় দূরে। প্রায় ঢাকা-কুমিল্লা দূর। ঠেঙ্গিয়ে-ঠুঙ্গিয়ে যেতে-আসতে সাড়ে তিন-চার ঘন্টা উড়ে যায়। নিত্য নিত্য আপ-ডাউন তাই পোষায় না। সপ্তাহে বড়জোর একদিন অফিসমুখো হই। বাকিদিনগুলো নিঃশব্দ, নিঃসঙ্গ হোম অফিসে টোম হয়ে বসে কাজ করি।
এই একঘেয়েমি তাড়াতে সকালে কাজে বসার আগে মহল্লায় এক পাক হেঁটে আসি। আজকেও ভোরে উঠেই চটজলদি তৈরি হয়ে বাদামি ট্রেঞ্চকোটটা হাতে বেড়িয়ে পড়লাম। হেমন্তের শুরু। শিশিরে ঘাসের ডগা নুয়ে পড়েছে। গাছের পাতায় বিন্দু বিন্দু মুক্তা জল। বাতাসে তাজা ঘ্রান। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দ্রুত পা চালালাম। কিন্তু হাঁটবো কি করে। ফুটপাথ জুড়ে পুরানো খবরের কাগজ থেকে শুরু করে আলমারি, টিভি, ভ্যাক্যুম ক্লিনারের রাজত্ব চলছে। আজকে বোধহয় ‘ষ্প্যারম্যুল টাগ’। বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘বাতিল-মাল দিবস’। এক রকম জার্মান কালচার বলা যায়। তিন মাস অন্তর অন্তর লোকে যার যার অদরকারি আর পুরানো জিনিস সাজিয়ে রাখে ঘরের সামনে। কারো কিছু মনে ধরলে সে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ওয়ান ম্যান’স ট্র্যাশ, অ্যানাদার ম্যান’স ট্রেজার।
‘গুটেন মরগেন’। শুভ সকাল জানিয়ে এক গাল হাসি নিয়ে ভদ্রলোক পথ আগলে দাঁড়ালেন। বয়স নব্বই কি পঁচানব্বই অনায়াসে। এক মাথা ফিনিফিনে সাদা চুল। মায়া মায়া দাদু-দাদু চেহারা। মুচকি হেসে একটা ফিরতি ‘মরগেন’ জানিয়ে পাশ কাটিয়ে চলেই যাচ্ছিলাম। আবার ডাক পড়াতে নেহাৎ সৌজন্যতায় পড়ে থামতেই হল।
‘বলছিলাম, এই সোফাটা নেবে নাকি? নতুন বাসার জন্যে?’।
মিউনিখের কোলাহল ছাড়িয়ে দূরের এই শহরতলীতে এসেছি কিছু দিন হল। সারি সারি টালির বাড়ি পাশাপাশি। পাড়ার সবাই সবাইকে চেহারায় চেনে মোটামুটি। তাছাড়া, একদম খাস জার্মান সাদা মহল্লায় কালোকুলো একটা বোঁচা-নেকো মেয়েকে আলাদা করে চোখে লাগে। তাছাড়া বোঁচা-নেকোর উষ্কখুষ্কো চেহারায় হালকা করে লেখা আছে, ‘কেউ একখানা মজবুত কিসিমের সোফা সাধিলে কাল বিলম্ব না করিয়ে লইয়া লইবো’।
তার বদলে সলজ্জে দাদুকে বললাম, 'সোফা টাইপের কিছু একটা কিনে ফেলেছি। ও জিনিসের আর দরকার নেই, ধন্যবাদ’।
‘তাহলে কি এই ফোল্ডিং চেয়ার দু’টো নেবে? বিকালে বারান্দায় বসে আয়েশ করে একটু চা-কফি খেতে?’।
প্রায় নতুনের মত ফোল্ডিং চেয়ার দেখে সামান্য লোভ হল। কিন্তু চেয়ার বগলে ঘরে ফিরতে হলে হেমন্তের এই মিষ্টি সকালটাই মাটি। তাছাড়া বাড়তি আসবাবে আগ্রহ নেই। ঘর বলতে গেলে গড়ের মাঠের মত খালি। চাইলে ফুটবল খেলা যায়। তাই এবারও মাথা নেড়ে অপারগতা জানালাম।
‘ওহ্, নেবে না। আমি আরো ঘর থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করছি, বুঝলে, খক্ খক্...।’
গলা খাঁকড়ি শুনে বুঝে গেলাম, লম্বা গল্প শুরু হল বলে। চট্ করে কেটে না পড়লে এই মাকড়শা দাদুর গল্পের জালে আটকে যাবো মাছির মতন।
‘এ্যা, ইয়ে, অফিস, মানে হোম অফিস শুরু করতে হবে তো, আসি তাহলে এখন, হ্যাঁ?’। একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে বাড়ির রাস্তা মাপলাম প্রায়।
‘ওহ্, কাল সন্ধ্যায় লোক লাগিয়ে সব ফুটপাথে নামালাম। কেউ কিছু না নিলে কি হবে এখন?’। দাদুর আপন মনের বিড়বিড় কানে আসতেই পা থমকে গেল আবার।
‘চিন্তা করবেন না, সন্ধ্যায় কমলা ট্রাকগুলো বাড়তি জিনিসপাতি ঠিক তুলে নেবে দেখবেন’। কমলা ট্রাক মানে জাম্বো সাইজের ময়লার গাড়ি। বাতিল-মাল দিবসে তাদের বাড়তি টহল থাকে।
‘বুঝলে, বছরখানেক হল আমার ফ্রাউ (মিসেস) ওপারে চলে গেল। আমিও বা আর কদ্দিন। আজ ক’মাস শরীরটা ভাল যাচ্ছে না একদম। তাই তৈরি হচ্ছে আর কি, খক্ খক্...’।
এবারের গলা খাঁকড়িতে সটকে পড়ার চেষ্টা করলাম না। চুপচাপ শুনতে থাকলাম।
‘আরাম-কেদারা, বইয়ের শোকেস, পুরানো কফি মেশিন, কত বড় লিস্টি। কার্পেটের ধুলায় ইদানীং কাশি বাড়ে, আর টিভি দেখলে মাথা ধরে। তাই বিদায় দিচ্ছি এদেরকেও’। দাদু আপনমনে বকেই চলছে।
‘ফট্ করে আজ-কাল-পরশু পটল তুলতে পারি, বুঝলে না? তখন আবার আমার ছেলেটা বিপদে পড়বে। আরেক শহর থেকে এসে এই আবর্জনার পাহাড় নামাতে হবে ঘর থেকে। হয় নিজেকে, নয়তো পয়সা দিয়ে লোক খাটিয়ে। বেচারা ঝামেলায় পড়ে যাবে। তাই কাজটা এগিয়ে রাখছি, বুঝলে। বুদ্ধিটা কেমন বলো তো তুমি, হাহা’...।
এই জার্মান দাদুর দারুন বুদ্ধির বনামে নিদারুন হতবুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। অদ্ভূত এক ভ্রমনের প্রস্তুতি নিতে থাকা মানুষের কাছ থেকে চাইলেই সরে যাওয়া যায় না।
মনে পড়লো, কোরিয়ান একটা সিরিজ আছে, ‘মুভ টু হেভেন’। মৃত মানুষের মাল-সামাল যত্ন করে সরিয়ে নেয় পেশাদার লোক। এদের বলে ট্রমা ক্লিনার। আজকের দাদু নিজেই নিজের ট্রমা ক্লিনার হয়ে আখের গুছিয়ে রাখছেন। পার্থিব যত ইট-কাঠ-আসবাবের সাথে বোঝাপড়া চুকিয়ে-মিটিয়ে দিচ্ছেন এক ধাক্কায়।
খুব সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে ফিরে চললাম, ‘শ্যোনেনটাগ নখ্, শুভ দিন তাহলে’।
‘হ্যাঁ, যাও যাও, তোমার তো আবার হোম অফিস আছে। আচ্ছা, চামড়ার স্যুটকেসটা কি নামাতে ভুলে গেলাম, পঁই পঁই করে বললাম ছোকরাটাকে, ধুর্...’।
বাড়ি ফেরার তাড়ার কাছে বুড়োর বিড়বিড় ক্রমশ অস্ফুট হয়ে আসতে থাকলো।
২ ম্যাক্সিমিলিয়ানের গোলাপ
সকাল থেকে কুঁজো হয়ে বসে আছি কম্পিউটারের সামনে। বেলা বারোটা বাজিয়ে আড়মোড়া ভাংলাম। অবিকল ডাল ভাঙ্গার মত মড়াৎ করে উঠলো হাড়গোড়। মেরুন্দন্ডের বাটি একটা-দুটো নড়ে গেছে নির্ঘাত। এই হল হোম অফিসের ডার্ক সাইড। নাহ্, একটু হাওয়া খেয়ে আসা যাক।
জুতো গলিয়ে পায়ে পায়ে বেড়িয়ে এলাম। ভর দুপুরের রোদ যেন তাতে বিরাট খুশি হয়ে চোখ ঝলসে দিল। প্রায় অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে হাঁটা ধরলাম। ট্রেনে হুইসেল কানে আসতে ঠাহর হল, রেল লাইনের সমান্তরালে নুড়ি বিছানো পথটা ধরে এগোচ্ছি। দুই পাশে সবুজ ঝোপ আর উঁচু উঁচু গাছ। ভোরের দিকে লোকে এখানে দৌড়াতে আসে। কেউ বা মর্নিং ওয়াকে বেরোয়। রাস্তার গাড়িঘোড়ার প্যাঁ পোঁ পৌঁছায় না বলে এই নুড়ি পথের নিড়িবিলিতে বেশ লাগে। তবে মাঝ দুপুরে দেখছি লোকের আনাগোনা একদম শূন্য। হঠাৎ ভূতে এসে ঘাড় মটকে দিয়ে চলে যেতে পারে অনায়াসে, এতই নীরব। শুধু কোন গাছে একটা কাঠঠোকরা ঠুক্ ঠুক্ কাঠ ঢুকে যাচ্ছে আপন মনে।
হঠাৎ ঝোপের পাশে লাল মত কিছু একটায় চোখ আটকে গেল। এগোতেই ছোট্ট একটা কাঠের ফলক ভেসে উঠল। ফ্যাকাসে হয়ে আসা লাল গোলাপ গুঁজে রাখা তাতে। ঘাস সরিয়ে আরেকটু কাছে যেতেই কাঠের ফলক যেন এপিটাফ হয়ে ধরা দিল। কালো স্লেট পাথরে ইটালিক হরফে নাম লেখা, ‘ম্যাক্সিমিলিয়ান ফ্রুওয়াল্ড’। পাশেই ধূসর ছবি। এলোচুলের এক সুশ্রী কিশোর। ধারালো চিবুকে অপ্রস্তুত হাসি। ছবি তোলার সময়ে ‘সে চিজ’ বললে যেমন আড়ষ্ট হাসি ফুটে ওঠে। ছবিটা বোধহয় খুব শীতকালে তোলা। ম্যাক্সিমিলিয়ানের গায়ে ফারকোট চাপানো। ভর দুপুরের কড়া রোদে স্লেটে আঁকা ছেলেটাকে আশ্চর্য রকমের জীবন্ত দেখাতে থাকে।
রেল লাইনের পাশে এই এপিটাফ এল কি করে, কিইবা তার ইতিহাস, কিছুই জানার উপায় নেই। কিন্তু কৌতূহল পিছু ছাড়ছে না। মন্ত্রমুগ্ধের মত খুটিয়ে দেখছি। ‘জন্ম ২০ আগস্ট, ২০০০, মৃত্য ১৯ এপ্রিল ২০১৭’। পড়ে আর চোখ সরছে না। ম্যাক্সিমিলিয়ান আর আমার জন্মদিন একই দিনে। বিশে আগস্ট। কি বিচিত্র কাকতাল।
২০১৭ সালের সেই ১৯ এপ্রিল ম্যাক্সিমিলিয়ানের ভাগ্যে ঠিক কি ঘটেছিল, কে জানে। রেল লাইন ধরে কি সে ইচ্ছে করে হেঁটে যাচ্ছিলো, নাকি কোনো দুর্ঘটনা। যাই ঘটুক, সেই থেকে তার বয়স আটকে আছে ষোলোতে। বেঁচে থাকলে আজকে তেইশের টগবগে তরুণ হয়তো এই পথেই আসতো-যেতো যেত কানে হেডফোন লাগিয়ে চুপচাপ কিংবা বন্ধুদের সাথে হই হই শোরগোল তুলে। ম্যাক্সিমিলিয়ানের হঠাৎ থেমে যাওয়া অল্প জীবনটুকু আচমকাই যেন প্রান ফিরে পেল কল্পনার জল্পনায়।
কাঠের ফলকের সামনে রাখা মোমবাতি আর ফুলের টব। কেউ বা কারা যেন প্রায়ই আসে এখানে। ঝরে পড়া গোলাপ বদলে দিয়ে যায়, মোমবাতিতে আলো জ্বেলে যায়। একটা দুটো পাথর রেখে যায় সযত্নে। পাথরগুলোতে হাতে আঁকা আল্পনা। রঙ্গীন নকশা দু’দিন আগের বৃষ্টিতে ধুয়ে যায় নি। তার মানে কেউ এসেছিলো আজ কি গতকালকেই।
আধবুনো এই ঝোঁপ-জঙ্গলে দাঁড়িয়েছিলাম কতক্ষন, কে জানে। সম্বিত ফিরতেই আস্তে আস্তে সচল হতে হল। অফিসের কাজ বাড়িতে বসে অপেক্ষায় আছে ফুরোবার আশায়। শেষবারের মত ম্যাক্সিমিলিয়ানের এপিটাফে চোখ বুলালাম। সেখানে লেখা, ‘Fliag, Maxi, fliag‘। ‘উড়ে যাও, ম্যাক্সি, ওড়ো’।
শুনশান দুপুর ভেঙ্গে একটা ঝলমলে লাল-কালো কাঠঠোকরা উড়ে গেল ডানা ঝাঁপটে।
---
মিউনিখ, জার্মানি
ছবি কৃতজ্ঞতা, লেখক,
বি.দ্র লেখাটি এর আগে 'হাল ফ্যাশন' পোর্টালে প্রকাশ পেয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে অক্টোবর, ২০২৩ বিকাল ৩:৩৩