ভার্সিটিতে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ার সময় আমি একটা কোচিং এ কিছুদিন ক্লাস নিয়েছিলাম। যায়গাটা আমার হল থেকে দূরে হওয়ায় ছেড়ে দিলাম হুট করে।
মাঝখানে যা হলো তা হচ্ছে, কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের একটা মেয়ের সাথে প্রেম হয়ে গেলো।
মেয়েটির নাম বৃষ্টি। ছাত্রীর সাথে প্রেম ব্যাপারটা
যে যেভাবেই নিক না কেনো,।আমরা দুজন সেসব নিয়ে মোটেই মাথা ঘামালাম না।
আমি কোচিং এ পড়ানো ছেড়ে।দিলেও রোজ
আমাদের দেখা হতো।সে এক অন্যরকম সময়।প্রতিটা দিনের আলাদা আলাদা রং। জীবনে প্রথম আলাদা রকমের অনুভূতিগুলো এসে ধরা দিতে লাগলো।
আমরা কত প্লেট ফুচকা খেলাম, বা কতবার চুমু খেলাম, এগুলো গল্পের অংশ না। অনেক ছোটো ছোটো খুনসুটিতেও জগতের শ্রেষ্ঠ আবেগের পানসিতে ভেসে
কোনো অজানালোকে হারিয়ে যাওয়া আমাদের নিত্যদিনের কাজ ছিলো।
এমনিই চলছিলো, যেমন চলে প্রতিটা ভালোবাসার সম্পর্কে। এমনিই চলতে পারতো সারাটা জীবন। কিন্তু বাস্তবতার এক নির্মমতা আছে। আমাদের সবাইকে তার মুখোমুখি হতে হয়। একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেখানে দ্বিধার স্থান নেই কোনো।
তিন মাস পর একদিন হটাত বৃষ্টি উধাও হয়ে গেলো। ওর মোবাইলটা বন্ধ। ওর বাসাও আমি চিনিনা। আমার ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল
পরীক্ষা চলছিলো। টেনশনে ঘুমও
আসেনা। পড়াও হচ্ছেনা। পরীক্ষার খাতায় যে মানুষ প্রেয়সীর মুখ ভাসতে দেখে,সেইরকম হ্যালুসিনেশন আমারও।হতে লাগলো। পরীক্ষা উচ্ছন্নে গেলো।
কোচিং এ এসে বৃষ্টির এক বান্ধবীকে পেলাম। সে বলল, এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি কোচিং এ
আসেনা। ও এইরকম প্রায়ই গুম হয়ে যায়। আবার অসুস্থও হতে পারে।
অসুস্থ হোক আর গুম যা-ই হোক, তাই
বলে আমার জীবন থেকেও গুম হয়ে
যাবে নাকি? আমার প্রেম এতো সস্তা?
আমি ওর কাছ থেকে বৃষ্টির বাসার ঠিকানাটা নিয়ে চলে এলাম। মাত্র এক সপ্তাহ, অথচ মনে হচ্ছে কতকাল বৃষ্টিকে দেখিনা! আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না। আমি বৃষ্টির বাসায় চলে এলাম।
এখানে দেখি এলাহি কান্ড! বিয়ে বাড়ির সাজসাজ রব। কার বিয়ে? বৃষ্টির না তো?
আমার আবার আরেক সমস্যা! যা ভাবি, তা-ই মিলে যায়! মনে প্রাণে চাচ্ছিলাম, আমার মনের ভাবনাটা যেনো না মিলে। বৃষ্টি এ কাজ কখনোই করবেনা। করতে পারেনা!
বাড়িভর্তি মানুষ, অথচ কেউ আমাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেসও করছেনা। আমিও কাউকে কিছু না বলেই আগন্তুকের মতো বৃষ্টিদের তিনতলার ফ্ল্যাটে চলে এলাম।
একজন মহিলাকে বললাম, বৃষ্টি আছে?
-আছে। তুমি কে?
-ও আমাকে চিনবে। ওকে একটু ডেকে দিবেন?
-আচ্ছা, তুমি বসো। আমি ডাকছি।
মহিলা কিছুটা অবাক ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন ভিতরে।
এখন একেরপর এক লোক এসে আমাকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, আপনি কে, কার কাছে এসেছেন?
আমি বললাম, বৃষ্টির কাছে।.অবশেষে বৃষ্টি এলো। সাথে সেই মহিলা এবং একজন মুরুব্বি পুরুষলোক। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,'বৃষ্টি, কেমন আছো?'
সে আমার দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। অন্যরাও ব্যাপারটা বুঝে নেবার চেষ্টা করছে। কনজারভেটিভ ফ্যামিলি বোঝাই যায়। মুরুব্বি লোকটা বৃষ্টিকে প্রশ্ন করল,'তুমি কি তাকে চেনো?'
বৃষ্টি কিছু বলছেনা। ঘরে পিনপতন নিরবতা। এখন যদি বৃষ্টি বলে,'না, চিনিনা।'
তাহলে কিল-ঘুষি মনে হয় একটাও মাটিতে পড়বেনা। সেসব আমি সয়ে নিতে পারবো। কিন্তু বৃষ্টি যদি আমাকে না চেনার ভান করে, তাহলে সে অপমান আমি সহ্য করতে পারবো না। হার্টএটাক বা স্ট্রোক কিভাবে হয়, আমি জানিনা। অমন কিছু একটা হয়ে মরে গেলেও অবান্তর কিছু হবে না।
বৃষ্টি নিরবতা ভেঙে বলল,'উনাকে আমি চিনি। আমার কোচিং এর স্যার। কেমন আছেন স্যার?'
হায়রে!! এটা তুমি কী বললে বৃষ্টি? এর চেয়ে তুমি আমাকে না চিনলেই ভালো হতো! আমি মরে গেলেই ভালো হতো!
বৃষ্টি আবার বলল,'স্যার আপনি এসেছেন ভালো হয়েছে। আজকে আমার গায়ে হলুদ। কালকে বিয়ে।'
আহা! মনে হচ্ছে যেনো আমার সাথেই বিয়ে। সানাই বেজে উঠলো যেনো কোথাও!
সবাই আমাকে খাতির করতে লাগলো। মুরুব্বি বলল,'বৃষ্টির তো কোনো ভাই নেই, তাই কোনো কাজ ঠিকমতো দেখার লোক নেই।তুমি থাকো বাবা!'
অ্যাঁ!!! ভাই??? ধুরররররর... চিন্তায় পড়ে গেলাম, এতো মানুষের সামনে আমি আমার ভালোবাসার কথা বলে দিবো? তাহলে একটা ঝামেলা হবে, আর বৃষ্টির ওই বিয়েটা ভেঙেও যেতে পারে! তাহলে কী বৃষ্টি আমার হয়ে যাবে? নাকি চুপিসারে কেটে পড়বো অভিমানী প্রেমিকের মতো?
অতৃপ্ত প্রেমের দহন বুকে বয়ে বেড়াবো সারাজীবন? অথচ, ও আমাদের ভালোবাসাকে এভাবে অস্বীকার করলো? কী এমন হতো, যদি বলতো,' আমাকে সে ভালোবাসে?'
ও আমাকে বলেনি তো কী হয়েছে, আমি আমার প্রত্যাখ্যান এভাবে মেনে নিতে পারি না।
আমি আমার অন্তরের কথা বললাম,
আমি তোমাকে ভালোবাসি বৃষ্টি। তুমিও আমাকে ভালোবাসো। তবু বলতে ভয় পাচ্ছো। কিছু ব্যাপারে মনে অস্পষ্টতা থাকলে চলে না। দ্বিধা
থাকলে ভালোবাসা যায়না।
তুমি হয়তো আজকের পর আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবে। আমার ভালোবাসা চিরন্তন।
আমার ভালোবাসা কোনোদিনও হারিয়ে যাবেনা। ভালো থেকো।
আমি চলে এলাম। জীবন তো থেমে থাকেনা। অবিরাম স্রোতস্বিনী ধারার মতো আমার জীবনও বয়ে চলল নানানরকম বাঁকে।
গল্পটা এখানেই শেষ হলে পারতো। কিন্তু গল্পটা মনে হয়, ঠিক এখানেই শুরু হলো।
সাত বছর পার হয়ে গেছে। আমি
সিলেটের একটা কলেজে লেকচারারের চাকরি নিয়ে এসেছি কিছুদিন হলো।
একদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আমি হেঁটে কলেজে যাচ্ছি। এমন সময় দেখি একটা ফুটফুটে বছর পাঁচেকের ছেলে গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বের করে বৃষ্টি স্পর্শ করছে। পাশেই ছেলেটির মা বকুনি দিয়ে হাত ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে জানালা লাগিয়ে দিতে লাগল।
ছেলেটির মা আর কেউ না,বৃষ্টি। সে আমাকে দেখতে পেয়েছে। খুব পরিচিত কাউকে দেখেও অবজ্ঞা করার এক বিরল ক্ষমতা আছে মেয়েদের। বৃষ্টির এ ক্ষমতা যথার্থই আছে আমি জানি।
গাড়িটা আমার খুব কাছ দিয়ে চলে গেলো। তবু আমি দেখেছি, তার চোখ যে সামান্য চমকে উঠেছিলো আমাকে দেখতে পেয়ে। অথবা চমকায়নি একটুও, ওর আভিজাত্যের চমক দেখে আমিই ভুল ভেবেছি। ও নিশ্চই আমাকে
ভুলে গেছে।
ঠিকআছে, কথা দিলাম, আমিও তোমাকে ভুলে যাবো বৃষ্টি। তুমি সুখে থেকো।
গল্পটা এখানেও শেষ হলে পারতো।
কিন্তু না, গল্পটা এখানেই শুরু। সে এক অন্যরকম গল্প। আরেকদিন বলব। অথবা কোনোদিন বলা হবে না। যে গল্প হয়তো কোনোদিন কেউ জানতেও পারবেনা। হারিয়ে যাবে নিস্তব্ধতার অাড়ালে!
লিখাঃরিশান মাহমুদ রোহান