কথাটা খুব সম্ভবত স্পাইডারম্যান এর কোন এক মুভি থেকে নেয়া "উইথ গ্রেইট পাওয়ার কামস উইথ গ্রেইট রেসপনসিবিলিটি"। আপনি চাইলে গ্রেইট শব্দটির জায়গায় একটি শূন্যস্থান বসিয়ে নিতে পারেন আর তাতে জুড়ে দিতে পারেন নানান শব্দঃ
"উইথ গ্রেইট পাওয়ার নলেজ উইথ গ্রেইট রেসপনসিবিলিটি" অথবা "উইথ গ্রেইট পাওয়ার নলেজ উইথ গ্রেইট রেসপনসিবিলিটি"। গল্প দিয়েই শুরু করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর এপ্লাইড স্ট্যাট ডিপার্টমেন্ট থেকে পাশ করা আমার এক বন্ধু। আমরা তখনও দেশে যাযাবর এর মত ঘুরে বেড়াই, আর তখন তার কানাডার কোন এক বিশ্ববিদ্যালয় এ মাস্টার্স এ ফান্ড হয়ে যায়। নতুন দেশ, নতুন জায়গা - কিন্তু সুবিধা ছিল একটাই সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশী লোকজনের সংখ্যা ভালই, অন্তত দূরবীন দিয়ে কাউকে খুজতে হবে না। আমরা ওর যাওয়ার আগেই বলাবলি করছিলাম, আরে এয়ারপোর্টে নামার পর ত তোর আর কোন চিন্তা নাই। কেউ না কেউ ত আসবেই তোরে পিক করতে, তোর বাসা পর্যন্ত তোকে পৌছে দিবে। ঘটনাক্রমে কেউ ই ওকে নিতে আসে নি, শেষ পর্যন্ত তাকে একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিজের ভাড়া করা নতুন বাসা খুজে বের করতে হয়েছিল।
গল্প দুইঃ আমার বিশ্ববিদ্যালয় এর কোন এক জুনিয়র, ইউ এস এ এর যেই বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়তে এসেছে - সেইখানে বাংলাদেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয় এর কোন এক ডিপার্টমেন্ট এর সতেরো জন ছাত্র আছেন। মানুষ যখন কোন নতুন জায়গায় যায়, সে স্বভাবত ধরেই নেয় সে যদি সেই জায়গায় তার স্বদেশী কাউকে পায় তাহলে অন্তত কথা বলার মানুষ ত পাওয়া যাবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সেই ছেলেটিকে এখন কথা বলার মানুষ পাওয়ার জন্য রীতিমত সংগ্রাম করতে হয়। কোন প্রোগ্রাম, কোন কিছু হলে কোনটাতেই তাকে ডাকা হয় না। কী কারণে তার সাথে এইরকম অসামাজিক আচরণ করা হচ্ছে তা আমার জানা নেই, বোধকরি সে অন্য বিশ্ববিদ্যালয় এর বলে তাকে সবাই একটু ছোট করে দেখতেই ভালবাসে।
গল্প তিনঃ এই গল্পটি আমার। আমার ইউ এস এ এর প্রথম দুই বছরের জীবন অস্বাভাবিক রকম সুন্দর এবং ভালো ছিল। আমি যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম মাস্টার্স এর জন্য সেইখানের বাকী বাংলাদেশী লোকজন অসাধারণ রকম ভালো ছিলেন। এক বড় ভাই আমার বাসা নিজে দায়িত্ব নিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলেন। আমি আসার পর এক সপ্তাহ কোন রান্না করতে হয়নি। বাংলাদেশ থেকে আসার আগে সময় এর অভাবে ড্রাইভিং শেখা হয় নি। এক ভাই আমাকে নিজে সময় করে ড্রাইভিং শিখিয়েছিলেন। এমনকি পরবর্তীতে তার গাড়ীর একটা চাবিও আমাকে দিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে আমার প্রয়োজন হলে আমি তার গাড়ি ব্যাবহার করতে পারে।
মুদ্রার দুই পিঠের গল্পই এখানে বলা। তবে বেশিরভাগ জায়গায় মুদ্রার অন্য পিঠের গল্পই বেশি শুনতে হয়। দেশ থেকে একটা ছেলে কিংবা মেয়ে যখন আসে, তখন তার অন্তত এইটুকু ভরসা থাকে যেইখানে সে যাচ্ছে সেইখানে পরিচিত কেউ থাকলে টুকটাক সাহায্য, খানিক সহানুভূতি, কদাচিত গল্প করার একজন সংগী হয়ত পাওয়া যাবে। কিন্তু কেবল নিজের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে না আসার অপরাধে, কাউকে যদি রীতিমত একঘরে টাইপ করে রাখা হয় সেইটা রীতিমত একরকম অসামাজিক আচরণ এর মধ্যেই পড়ে। এইখানে কেউ আপনার বাসায় এসে প্রতিদিন একবেলা ভাত খেতে চায় না, কেউ বলে না ভাই আমাকে আজকে বাইরে খাওয়ান। সবাই চায় একটা সুন্দর পরিবেশ, যেইখানে সে সবার সাথে মিশতে পারবে। হোক সে কোন অখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা, কোন খারাপ স্কুল কলেজ থেকে পাশ করে আসা ছেলে, হোক সে দেখতে ক্ষ্যাত, আনস্মার্ট, ইন্ট্রোভার্ট ইত্যাদি কিন্তু সে যখন এখানে আসে সবার আগে তার পরিচয় একজন বাংলাদেশী, তার সাথে যারা অসামাজিক আচরণ করেন তাদেরও প্রথম পরিচয় এইখানে বাংলাদেশী। আপনি যেই পথ পাড়ি দিয়ে এইখানে এসেছেন, সে সেই একই পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে।
মুদ্রার দ্বিতীয় পিঠও আমার খুব ভালভাবে দেখা হয়ে গিয়েছে। পরবর্তীতে আমি যখন অন্য বিশ্ববিদ্যালয় এ পি এইচ ডি এর জন্য মুভ করি তখন আমি জানতাম সেইখানের বাংলাদেশী কমিউনিটি অনেক বড়। অন্তত আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে আমি ধারণা করে নিয়েছিলাম সেই জায়গার মানুষগুলাও হয়ত অসাধারণ হবে। কিন্তু এইবার ত মুদ্রার দ্বিতীয় পিঠ দেখার পালা, বাসা ঠিক করার ব্যাপারে যখন কারও কোনরকম সাহায্য পাওয়া গেল না, সবাই যখন অনলাইনের লিঙ্ক ধরিয়ে দিচ্ছিল তখনই খানিকটা আচ করতে পেরেছিলাম, আসিতেছি দূর্দিন। যাই হোক সবাই ব্যস্ত থাকতেই পারে, আর দুই বছর ধরে এইখানে আছি। আমারই হয়ত আর একটু স্মার্ট হওয়া উচিত এইভেবে নিজেকে স্বান্তনা দিলাম। নতুন জায়গায় আসার পর থেকে আমি কেবল একজন বড় ভাই ছাড়া আর কারও সাহায্য পাইনি। সাহায্য পাওয়া ত দূরের কথা, একজন নতুন বাংলাদেশী আসলে আগে হোক পরে হোক সবাই জানে। আমার নিজ ডিপার্টমেন্টেই অনেক বাংলাদেশি ছিলেন, কিন্তু কেউ আমার সাথে কোনদিন কথা বলতে আসেন নি। তাও না হয় বাদ দিলাম - বাস স্ট্যান্ড কিংবা লিফট এ ইন্ডিয়ান বাংলাদেশি একসাথে থাকলে চেহারা দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু যখন আমাকে বাংলা কথা বলতে দেখে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে থাকা কোন বাংলাদেশী আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অন্য দিকে সরে দাড়ান তখন অসামাজিক আপনিই হয়ে যান, আমি না। যখন ঈদ এর মত সময়ে আমার আশেপাশে থাকা বাংলাদেশী কেউ এড়িয়ে যান, যদি বাসায় ডেকে এনে এক প্লেট সেমাই খাওয়াতে হবে এই ভেবে, তখন অসামাজিক আপনি, আমি কিন্তু না। আমার টেক্সাসে থাকা বন্ধুকে ফোনে বলছিলাম আমার অভিজ্ঞতার কথা , একটাই কথা সে বলেছিল, দোস্ত এক প্লেট সেমাই, কিংবা এক গ্লাস পানি খাওয়ানোর জন্য চাকরী ত আর করা লাগে না, মন থাকা লাগে; সেই মনটাই অনেকের নাই।
ফিরে যাই শুরুর সেই কথায় "উইথ গ্রেইট পাওয়ার কামস উইথ গ্রেট রেসপনসিবিলিটি"; আপনি যখন বড় তখন সবাই আপনার কাছ থেকে ভাল কিছুই আশা করে। কিন্তু আমরা নিজেরা এমন সব কাজ করি যেইখানে আমাদের কর্মকান্ড দেখে মানুষজন আমাদের গায়ে অসামাজিক এর ট্যাগ টা লাগিয়ে দেয়। শেষমেষ একটাই কথা, অহংকার দিন শেষে আপনাকে কখনই ভাল কিছু এনে দিবে না; মানুষের বিনয়ই মানুষকে বড় করে।