somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একজন ব্রাডম্যান

১১ ই এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৮:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৩০ সালে ভারতবর্ষের নৈনিতালে বেড়াতে এসেছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়ান টুরিস্ট। স্থানীয় এক ক্রিকেট দল তাকে আহবান জানালো প্রীতি এক ম্যাচে অংশ নেয়ার জন্যে আর টুরিস্ট ভদ্রলোক সে আহবান গ্রহণ করলেন সানন্দে। খেলতে নেমে কিন্তু প্রথম বলেই শুণ্য রানে আউট হয়ে গেলেন তিনি -
স্থানীয়রাও তাকে আর মনে রাখলো না। তারা ধরেই নিলো, এই লোক ক্রিকেট খেলতে পারেন না।

১৯৭১-৭২ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার সাথে খেলতে এলো অবশিষ্ট বিশ্ব-একাদশ। টনি গ্রেগ আর হিলটন আকারম্যান এসে পৌছলেন এডিলেডের বিমানবন্দরে। রিসিভ করতে এলেন সেই টুরিস্ট, যিনি এতদিনে বুড়ো হয়ে পড়েছেন। ক্রিকেট নিয়ে তার এটা-ওটা প্রশ্ন শুনে টনি বা আকারম্যানের কেউ একজন (কে, তা আসলে আজ পর্যন্ত কেউ স্বীকার করেননি ) প্রশ্ন করলেন, 'আপনি কি ক্রিকেট খেলতেন??'।
-'খেলতাম এককালে ...'।
-'আপনার নাম ??'
-'ডন ব্রাডম্যান' !!!

ভদ্রলোক কিন্তু ক্রিকেটটা সত্যিই মন্দ খেলতেন না। ২৩৪ ফার্স্টক্লাস ম্যাচে ৯৫.১৪ গড়ে ২৮০৬৭ রান এবং ৫২ টেস্ট ম্যাচের ক্যারিয়ারে ৬৯৯৬ রান। গড় মাত্র (!!) ৯৯.৯৪। ব্রাডম্যান, ব্রাডম্যান, স্যার ডোনাল্ড ব্রাডম্যান- পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান; সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ ও কি তিনিই নন ???


২৭ আগষ্ট,১৯০৮ সালে নিউ সাউথ ওয়েলসে জন্মানো এই ব্রাডম্যানের শৈশব কেটেছে বাড়ির পেছনের বারান্দায় একটা স্টাম্প দিয়ে ছোট্ট একটা গলফ বলকে ক্রমাগত পিটিয়ে গিয়ে। ক্রিকেট রুপকথার অংশ হয়ে যাওয়া এই ঘটনা জানেন সবাই, আমরা কেবল জানিনা কোন দৈবশক্তির যোগে এই অমানবিক মনসংযোগের ক্ষমতা তিনি করায়ত্ত করেছিলেন। সেবার ৩৬-৩৭ মৌসুমে এশেজ সিরিজের সময় এডিলেডে এক রাত্রিতে বসে অধিনায়ক ডন কিংবদন্তী স্পিনার বিল ও'রিলি এবং নেভিল কার্ডাসের সাথে সারা সন্ধ্যা আলোচনা করে কাটালেন কি করে বেঁধে রাখবেন ওয়ালী হ্যামন্ডকে সেই পরিকল্পনায়। রাত এগারোটায় বাড়ি ফেরবার সময় নাকি 'সামান্য কাজ আছে' বলে গাড়ি থেকে নেমে খানিক ঘুরে এলেন হাসপাতাল। পরদিন ঘোষিত হলো ব্রাডম্যানের শিশুর মৃত্যুসংবাদ। "স্যার ডন খেলার চেয়ে বড়"- অস্ট্রেলিয়ান প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রবার্ট মেঞ্জিস এই উক্তি করে ভুল করেননি ; কি বলেন??

১৯ বছর বয়েসে ফার্স্টক্লাস অভিষেকের পর নিউ সাউথ ওয়েলসের হয়ে ব্যাট হাতে ম্যাচের পর ম্যাচ পারফর্ম করে যাচ্ছিলেন 'বাউরালের বিস্ময়-বালক', অবশেষে সুযোগ এলো জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামার। ডাক পেলেন ২৮-২৯ মৌসুমের সফরকারী ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টের দলে। ব্রিসবেনের সে টেস্টে অস্ট্রেলিয়া পরাজিত হলো ৬৭৫ রানে। ডন করলেন দু ইনিংসে ১৮ এবং ১। বাদ পড়লেন দ্বিতীয় টেস্টের দল থেকে- সেই প্রথম এবং সেই শেষ। তৃতীয় টেস্টের দলে ডাক পেয়ে করলেন ৭৯ এবং ১১২। শুরু হলো ব্রাডম্যান যুগ। ব্রাডম্যান মানে নিষ্ঠুর, ব্রাডম্যান মানে নির্দয়, ব্রাডম্যান ছিলেন- খুনী।


ডনের ক্লান্তি বলতে কিছু নেই, তিনি নিরাবেগ। অন্য 'ভালো' ব্যাটসম্যানেরা যেখানে ৫০ রান করলেই আত্নতুষ্টিতে ভোগে সেখানে স্যার ডন ১৫০ এর আগে নাকি ব্যাটই তুলতেন না। প্রতি ৩ ইনিংসে ১টি করে সেঞ্চুরি, ১২টি ডাবল সেঞ্চুরি, ২টি ট্রিপল সেঞ্চুরি - কেবল পরিসংখ্যানই যথেষ্ট স্যার ডনের গ্রেটনেস বোঝাতে। (ভালো কথা,এহেন স্যার ডনের টেস্ট ক্যারিয়ারে ছয়ের মার ক'টি বলুনতো ? মাত্র ৬ টি !!)। জ্যাক ফিংগল্টন অযথাই বলেননি,"যে কোনো বল,এমনকি ওয়াইড
বল পর্যন্ত ফস্কালেই ডনকে আঊট দিতে হবে। " ! ! !


স্যার ডনের কথা বলতে হলে বলতেই হয় 'বডিলাইন সিরিজের' কথা। ১৯৩০ এর সিরিজে ৭ ইনিংসে স্যার ডন রান তুললেন ৯৭৪। এশেজ ফিরিয়ে আনতে ডগলাস জার্ডিনের নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ড হ্যারল্ড লারউডের গতির সাহায্যে আশ্রয় নিলো 'বডিলাইন' নামক অপকৌশলের। ক্রিকেট ইতিহাস এর তুল্য বিতর্কিত কিছু আর দেখেনি কখনো...। কল্পনা করুন, লারউডের রানআপের প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে সাথে এমসিসি'র ৩৩ হাজার ক্ষুদ্ধ দর্শক চ্যাঁচাচ্ছে- "বাস্টার্ড ! বাস্টার্ড !"। স্যার ডনকে এই অপকৌশলে দমাতে পেরেছিলেন বটে জার্ডিন, এই সিরিজে তার রানের গড় ছিলো মাত্র ৫৬.১৪ !!


ডনের ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে ছায়া ফেলতে এলো ২য় বিশ্বযুদ্ধ। প্রলয়ঙ্করী এই যুদ্ধ কি আরো অনেক কিছুর সাথে নিয়ে গেছে ডনের যাদু ?? সবার মতই এই সংশয় নিয়ে ৪৬-৪৭ এর সিরিজে ব্যাট করতে নামলেন ডন। ২৮ রানে ভোসের বলে স্লিপে আইকিন যা নিলেন , ডন বলেন তা ছিলো বাম্প ক্যাচ- যদি ও ইংরেজদের দাবি আম্পায়ার বোরউইকের এই ভুল সিদ্ধান্তেই ডন করেছিলেন ১৮৭- যা তার আত্ববিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়ে ইংরেজদের পোড়ালো ২য় বিশ্বযুদ্ধের পরে ও ।


অন্য অনেক কিছুর মতই টেস্ট ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত শুণ্যটিও স্যার ডনের। ৪৮ এর ওভালে শেষ টেস্টে নরম্যান ইয়ার্ডলির নেতৃত্বাধীন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যাট করতে নামার সময় ব্যাটিং গড় ১০০ করতে স্যার ডনের প্রয়োজন ছিলো মাত্র ৪ রানের, এরিক হলিস নামের অখ্যাত এক লেগ
স্পিনার তাকে পোড়ালেন হতাশায়। জীবনে একবার মাত্র হিট আউট হয়েছিলেন স্যার ডন,যা হয়েছিলেন লালা অমরনাথের বলে (যার পুত্র মহিন্দর অমরনাথ ছিলেন বাংলাদেশ দলের প্রথম বিদেশী কোচ।)। ডন জীবনে একবার-ই স্টাম্পড হয়েছিলেন; মজার ব্যাপার হচ্ছে উইকেট ভেঙ্গেছিলেন এক বাঙ্গালী - প্রবীর মিত্র !!

৯২ বছর বয়সে জীবনের সেঞ্চুরি পুরোবার আগেই ব্রাডম্যান মারা গেলেন ২৫ ফেব্রুয়ারী,২০০১। তার আগে ১৯৪৯ সালে অর্জন করলেন সম্মানসুচক 'নাইটহুড'।


ক্যারিয়ারের মধ্যগগণে যদি ২য় বিশ্বযুদ্ধটা না হতো; কোন সীমায় পৌছতেন তবে স্যার ডন ?? জানা নেই, কেবল এটুকু জানি - ২য় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময়কার who's whoতে স্যার ডন সম্বন্ধে লেখা হয়েছিলো ২১ লাইন, যা হিটলারের চেয়ে মাত্র ৮ লাইন কম এবং স্টালিনের চেয়ে ১৭ লাইন বেশী !!!
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪০


ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫….(৭)

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৭

ষষ্ঠ পর্বের লিঙ্কঃ মায়াময় স্মৃতি, পবিত্র হজ্জ্ব- ২০২৫-….(৬)

০৬ জুন ২০২৫ তারিখে সূর্যোদয়ের পরে পরেই আমাদেরকে বাসে করে আরাফাতের ময়দানে নিয়ে আসা হলো। এই দিনটি বছরের পবিত্রতম দিন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাঙ্গাইল শাড়িঃ অবশেষে মিললো ইউনস্কর স্বীকৃতি

লিখেছেন কিরকুট, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:৫৭



চারিদিকে যে পরিমান দুঃসংবাদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এর মধ্যে নতুন এক গৌরবময় অধ্যায়ের সূচনা হলো বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের তাতের শাড়ি এর জন্য, ইউনেস্কো এই প্রাচীন হ্যান্ডলুম বুননের শিল্পকে Intangible Cultural... ...বাকিটুকু পড়ুন

আধা রাজাকারি পোষ্ট ......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৬


আমি স্বাধীন বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার কাছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের তুলনা—এসব নিয়ে কোনো আবেগ বা নস্টালজিয়া নেই। আমি জন্মগতভাবেই স্বাধীন দেশের নাগরিক, কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা কেন ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন রাখেনি?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:২০



কারণ, কোল্ডওয়ারের সেই যুগে (১৯৭১সাল ), আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলো; ইন্দিরা বাংলাদেশে সৈন্য রেখে বিশ্বের বড় শক্তিগুলোর সাথে বিতন্ডায় জড়াতে চাহেনি।

ব্লগে নতুন পাগলের উদ্ভব ঘটেছে;... ...বাকিটুকু পড়ুন

×