প্রথম দর্শনেই আমি মেয়েটির প্রেমে পড়তে পারলাম না কারণ, মেয়েটি আমার চেয়ে এক বছরের বড় তো হবেই, দুই হলেও অবাক হবনা।বয়সটা বড় সমস্যা না সমস্যা হল তিনি আমার খালাতো ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড। খালাতো ভাই যদি এই ব্যাপারটি জানতেন তবে তিনি ঐখাইনেই আমাকে পুড়িয়ে শিক কাবাব বানিয়ে খেতেন। হাজার হলেও শিক কাবাব তার ভীষণ প্রিয়। কিন্তু আমার মন দ্বিতীয় দর্শনেই তাকে ভালো না বেসে পারল না। ওহ এতই সুন্দরী মেয়েটা। কাজল কালো চোখ, পাতলা দুটি ঠোঁট সব মিলিয়ে কি যে মহিমা তা আমি বলে বোঝাতে পারব না।
খালাতো ভাই তাদের বাসা থেকে আমাকে নিয়ে যখন বের হলেন তখন প্রায় বিকেল। খালার চোখে নিজেকে ঠিক রাখার জন্যই মনেহয় আমাকে নিয়ে বের হওয়া। প্রায় দুই কিলো হাঁটার পর মেয়েটির সাথে দেখা হল আমাদের। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর একটা পার্কে গিয়ে পৌছালাম আমরা তিন জন। আমাকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে মেয়েটির সাথে ভাইয়া কোথায় যেন গেলেন। মিনিট পাঁচেক পর মেয়েটি এসে আমার পাশে বসলো। আমি খালাতো ভাইয়ের চেয়ে দুই তিন বছরের ছোট হলেও কি হবে একেবারে ছোট নই কিন্তু। অবশ্য যতই সময় যাচ্ছে ততোই মনে হচ্ছে মেয়েটি আমার চেয়ে ছোট। মেয়েটি আমার পাশে বসার পর বুকের ভিতর ঢোলের বাজনা শুরু হয়ে গেল। মেয়েটি এক কথায় অপূর্ব। একে কিছুতেই আপু ভাবা যায় না। জানিনা আমার মাথার ছিট ফুটো হয়ে গেছে কিনা। একটু একটু করে মেয়েটি আমার সাথে কথা বলা শুরু করল। কিন্তু আমি যা ভাবছি, তা হয়তো ও ভাবছে না। ছি! কি লজ্জার ব্যাপার।
-ওটা কি তোমার কাজিন?
-হু।
-দেখলে বোঝা যায়, তোমার চেহারার সাথে অনেক মিল আছে।
-আমার সাথে আমার কাজিনের মিল আছে জীবনেও শুনিনি। কিন্তু আমি ওকে বললাম," একেবারে ঠিক ধরেছ ,অনেকে বলে আমরা নাকি জমজ ভাই। তোমার বুঝে ফেলার ক্ষমতা অনেক বেশি।"
প্রশংসা করলে কোন মেয়ে যদি না গলে, তাকে মেয়ে বলা উচিত মনে হয় না। আর ও যেহেতু মেয়েই সেহেতু মোমের মত গলা শুরু করল। কিছুক্ষণ এর ভিতর আমাদের কথাবার্তা মজার পর্যায়ে যাচ্ছিল। আমি প্রাণপণে বল নিয়ে দৌড়াচ্ছিলাম। গোল আমাকে করতেই হবে কারণ অতিরিক্ত খেলোয়াড়দের হাতের একটি সেকেন্ডও মূল্যবান। ভাইয়া চলে আসার আগ পর্যন্তই আমার চান্স। বললাম,
ভাইয়া যে কোথায় গেল; গার্লফ্রেন্ডকে অন্য একটা ছেলের কাছে রেখে যাওয়া তো উচিত নয়।
-কেন? তোমার দ্বারা ক্ষতি হবার মত কিছু আছে নাকি?
মেয়েটি খুব ভালো আর খুব হাসিখুশি। খুব পজিটিভ মাইন্ডের। এই সব কথা অন্য কাউক বললে এতক্ষণে আমাকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে সুন্দর একটা পালঙ্ক বানিয়ে ফেলত। এ মেয়েটা ওরকম না। এজন্যই মেয়েটাকে আমার এত ভালো লেগেছে। ঠিক এরকম হবে তা যেন আমি আগে থেকেই জানতাম।
আমি বললাম, আচ্ছা বলত মেয়েরা ফুটবল লীগ খেলেনা কেন?
-কি জানি!
-উহু, এগারটা মেয়ে কখনই একই ধরনের ড্রেস পড়তে চাইবে না তাই।
-এতা কোন ধরনের কথা বললা?
-একেবারে ভুল বললাম নাকি?
-তুমি একটা বড় ভুল করছ।
-কি ভুল?
-আমি তোমার ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড না।
-কি?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। খাইছে! গার্লফ্রেন্ড যদি না হয় তাইলে নিশ্চয়ই বউ। মাগো আমি এবার গেছি। অভ্যাসবশত ডান হাতটা মাথায় তুলে জিহবায় একটা কামড় বসালাম।
-কি হল? ওরকম করছ কেন? কোন প্রবলেম?
আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, না,না, মানে কিছু হয়নি, মানে ঝাল লেগেছে।
-কি? কিভাবে ঝাল লাগল?
-না, ঐ দুপুরে খেয়েছিলাম তো। ভীষণ ঝাল। খালামনি রান্না করতে করতে বলছিলেন এমন ঝাল খাওয়াব যে জীবনেও ভুলবি না। ঐ কথা হঠাৎ মনে পড়ল।
ধ্যাত! একটা প্রপার ব্যোম ও মারতে পারলাম না। ও হাসতে শুরু করল। "কি অদ্ভুত! পানি খাওয়া লাগবে নাকি?"
আমি অবাক চোখে চেয়ে বললাম, ওহ!হাউ কেয়ারিং!
-আবার কি হল?
-না না কিছুই হয়নি।
ভাইয়া তাহলে লুকিয়ে বিয়ে করেছে? আমি আর ঐ প্রসঙ্গ তুলতে চাইলাম না।
-ও, তোমার ভাইয়া তার গার্লফ্রেন্ড কে নিয়ে ঘুরতে গেছে।
-তাহলে তুমি কে?
-আমি? আমি হচ্ছি তোমার ভাইয়া আর ভাবির লাভ কো-অরডিনেটর।
-ও-- য়া --ও ।
আমার বুক থেকে বড়সড় একটা পাথর নেমে গেল। যাক বাবা, মান সম্মানটা বাঁচল। এইবার তাহলে চান্সটা নেওয়া যায়।
-এত অবাক হওয়ার কি আছে?
-হুম, তাইতো অবাক হওয়ার তো কিছু নেই। কে অবাক হয়েছে?
-বাঃরে! তুমিই তো।
-বাহ! আমার সম্পর্কে তো ভালই বুঝতে পেরেছ। ১৯ টা বছর ধরে নিজের সাথে বাস করলাম তবু বুঝতে পারলাম না। আর তুমি মাত্র কয়েক ঘণ্টায় বুঝে ফেললে? বাহ! বাহ! তোমাকে দিয়েই হবে।
-কি হবে?
-এতখানি বুঝলা আর এইটুকু বুঝলা না? গাধা কি আর সাধে বলি?
-কি? এই ছোড়া দেখ তুমি কিন্তু আমারে অপমান করতেছ!
-কে অপমান করছে?
-কে আবার তুমি!
-আমি?? ও মাই গড! আমি!!!
-হ্যাঁ তুমি।
আমি বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম।
-কি হল? উঠে দাঁড়ালে যে?
-তোমার সাথে আর পারা গেল না।
-দোষ তোমারই ।
-ঠিক এইজন্যই তো বলি ১৯ টা বছর ধরে নিজের সাথে বাস করলাম তবু দোষটা বুঝতে পারলাম না। আর তুমি মাত্র কয়েক ঘণ্টায়! ওহ!তোমাকে দিয়েই হবে।
-আবার ইয়ার্কি হচ্ছে?
-আরে ধ্যাত তোমারে ক্রেডিট দিচ্ছি। নিলে নাও, নইলে পরে পাবে না।
-অ্যাঁহ! অমন ক্রেডিট আমার দরকার নাই।
আমি মুখ গোমড়া করে কিছুক্ষণ বসে থাকলাম।সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এসেছে। এর সাথে আর দেখা হবে কিনা সন্দেহ! ফোন নাম্বার টা নেওয়া যায় কিনা! আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।
-কি হল? এত মন খারাপ করছ কেন? আমি কি খুব কষ্ট দিলাম?
-না, সেজন্য না।
-তাহলে?
-তোমার সাথে বোধহয় আর দেখা হবেনা।
-এইজন্যই এত মন খারাপ?
-হুম! তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। খুবই ভাল। এত ভালো কাউকে কখন লাগেনি।
-ও তাই নাকি?
-হুম!তবেআপু হিসেবে নয়।
ঢোক গিলে অবশেষে কথাটা বলে ফেললাম।
-মানে?
গাছ থেকে পাকা আম নিচে পড়লে তার চেহারা যেমন হয় ওর চেহারাটা ঠিক সেরকম হয়ে গেল। আমি আশা করছিলাম কয়েকটা চড় থাপ্পড় মুখের উপর পড়তে পারে। তাই আগে ভাগেই চোখ বন্ধ করে ফেললাম। নিজের অপমান নিজে না দেখাই ভাল। কয়েক মুহূর্ত কিছুই ঘটল না। আস্তে আস্তে চোখ খুললাম। দেখি মেয়েটি অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আমি আমতা আমতা করে বললাম, "খুব খারাপ কিছু বলে ফেললাম নাকি? সরি!"
-তোমার মোবাইলটা এদিকে দাও।
আমি আঁতকে উঠলাম। খাইছে! এবার মনেহয় ভাইয়াকে কল করবে। আমি গেছি। আমি কল্পনায় দেখতে পাচ্ছি আমার রানটা আস্ত কাবাব বানান হচ্ছে। রাধুনি গুঁড়া মশলা দিয়ে। বাছাই করা ঝালের গুড়া। নিচে ভয়ঙ্কর আগুন। "ওহ নো"
-কি হল? মোষের মত চেঁচাচ্ছ কেন? বললাম না মোবাইল টা দিতে।
একবার ভাবছি উঠে দৌড় দেব কিনা। নাহ! তাহলে তো ভাইয়াকে বলে দেবে। ভয়ে মোবাইলটা ওর হাতে দিলাম। ও মোবাইল নিয়ে কিছুক্ষণ চাপাচাপি করল।তারপর ভাইয়াকে কল করে চলে আসতে বলল। কোন সাইন্টিস্ট বলেছে মানুষের শরীরে ৭০ ভাগ পানি? আমি শিওর আমার শরীরে এখন একভাগও পানি নেই। নইলে গলাটা এত শুকনা মনে হবে কেন? ও মোবাইলটা আমার হাতে দিয়ে একটু হেসে বলল, ব্যাস কাজ হয়ে গেছে।
আমি মনে মনে ভাবলাম মানুষ এত নির্দয় হতে পারে? এযাত্রায় বেঁচে গেলে আর না। কোনও মতে বললাম,
-জি আপু। হয়ে গেছে।
আমার অবস্থা দেখে ও ফিক করে হেসে ফেললো।
-ঠেলায় পড়ে আপুও বলে ফেললা? শোন, অবস্থা বুঝে ট্রাই করবা। আসেপাশে লোকজন থাকলে ট্রাই না। পারফেক্ট টাইম রাত ১২ টা।
-কি যে বল? আর জীবনে কোনদিনও ট্রাই করবনা। এই দুই হাতে কান ধরছি।
ও কি বলেছে খেয়ালই করলাম না। আসলে এত ভয় পেয়েছিলাম। ঠিক এই মুহূর্তেই ভাইয়া আসল। "কিরে কান ধরে বসে আছিস যে?"
-না ভাইয়া, আসলে কান দুটো গরম মনে হচ্ছিল।
যাবার আগে ওর দিকে একবারও তাকাবার সাহস পেলাম না। কিছুক্ষণ পর রাস্তা দিয়ে ভাইয়ার সাথে হাঁটছিলাম। মোবাইলটার স্ক্রিনে হঠাৎ চোখ পড়ল। দেখি ওর নাম্বার সেভ করা। মনে হল, এত সুখ কখনো পাইনি। ইয়াহু বলে লাফিয়ে উঠলাম।
-কিরে এত খুশি কেন?
-না, ভাইয়া বাংলালিংকের অফার এসেছে তাই। এয়ারটেলে আজকাল বাংলালিংকের অফার আসে নাকি?
-কই? এয়ারটেল ইউজ করতেছি নাকি?ও আমিও ভাবছিলাম, এয়ারটেলে বাংলালিংকের অফার আসে কিভাবে? একেবারে আস্ত রামছাগল। চাপা মারার জায়গা পাওনা?
-নিজেকে রামছাগল বললি? হা হা।
-কই? আমাকে বললাম নাকি? আমি তো আমার বন্ধুকে বললাম। ও ব্যাটা একটা আস্ত চাপাবাজ।
-ও তাই নাকি?
-হুম......... দিব্যি।
চাপা মেরে নিজেরই হাসি লাগছিল। রাজনীতিবিদ হলে এক বছরেই অ্যাডমিরাল জেনারেল আলাদীন হয়ে যেতাম।
রাত ১২ টা ০১ মিনিটে ওর কাছে কল করলাম।
-কি ব্যাপার ভাইয়া? কেমন আছ?
-ফোন নাম্বারটা কি আপু হিসেবে দিলে নাকি?
-তা কি? ভাবি হিসেবে চাও নাকি?
শোনামাত্রই আমার শিক কাবাবের কথা মনে পড়ল।
-না, না আপু হিসেবে দিলেই হবে। তোমার সাথে কথা বলতে পারলেই হবে।
-তোমার কান ঠাণ্ডা হইছে তো?
আমি মনে মনে ভাবলাম, হাউ কেয়ারিং! এরকমই তো চাই...
-১৯ টা বছর ধরে নিজের সাথে বাস করলাম......
- তবু কান ঠাণ্ডা হল কিনা বুঝতে পারনি, না?
-এবসলিউটলি!! কিন্তু তুমি বুঝলা কিভাবে?
-তুমি এই কথাটা কয়বার বলেছ জানো?
-না, জানিনা তো। তুমি নিশ্চয়ই জানো। কিভাবে জানলে?
-কারণ, আমাকে দিয়েই হবে।
আমরা দুজনেই হা হা করে হেসে উঠলাম। এভাবেই শুরু হল আমাদের পথচলা।
হঠাৎ, একদিন দেখি আমি ওর সাথে মোবাইলে কথা বলছি। আমি বললাম,
-তুমি আমাকে সত্যি ভালবাসো তো?
-হ্যাঁ,বাসি।
-কখন আমাকে ছেড়ে যাবেনা তো?
-না, আমি শুধু তোমার। আমি মনে মনে ভাবলাম, হাউ কেয়ারিং!
খানিকক্ষণ পর দৃশ্যপট চেঞ্জ হল। বাপার কি? সব অবাস্তব লাগছে কেন? দেখি, ও দৌড়াচ্ছে। আমি ওকে ধরার জন্য দৌড় শুরু করলাম।তারপর হঠাৎ দুজনে জলপ্রপাত বেয়ে পড়া শুরু করলাম।
নাহ! স্বপ্নে কি কোনও মেয়েকে ধরা জায়? একটু পরে ঘুম ভাঙলে হয়তো ধরা যেত। ওকে পেলাম না শুধু এই জন্যই। ওর পুরো অস্তিত্বটাই ছিল আমার স্বপ্ন। আজও ভাবি, হাউ কেয়ারিং! বলি, ১৯ টা বছর ধরে নিজের সাথে বাস করলাম তবুও নিজেকে বুঝতে পারলাম না। শুধু দ্বিতীয় দর্শনের অপেক্ষায় রইলাম............।