আগের পর্ব
বড় তীব্র রোদ উঠেছে আজকে৷ যদিও পড়ন্ত বিকেল, তবু রোদে পুড়ে যাচ্ছে চারিদিক৷ হয়তো প্রচণ্ড গরমের কারণেই কোনো মানুষ জন দেখা যাচ্ছে না৷ বিদ্যুতের তারের উপর কয়েকটা কাক বিরস মুখে ঝিম মেরে বসে আছে৷ পড়ন্ত বিকেলের সেই রোদের দিকে তাকিয়ে স্বপ্নটার কথা ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে পড়লো সে৷ জ্বরজারি হলে এমনিতে তার মনটা বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে৷ সবকিছু বড় বেশি অর্থহীন লাগে তখন৷ এই দৌড়াদৌড়ি, এই প্রতিযোগিতা, উপরে ওঠার জন্য, টিকে থাকার জন্য এই সংগ্রাম সব বড় অর্থহীন বলে মনে হয়৷ সবকিছু ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছে করে৷ অনেক দূরে, নিরিবিলি কোথাও৷ ইচ্ছে করে খুব সাধারণ একটা জীবন কাঁটাতে৷ খুব শান্ত, সাধারণ একটা জীবন৷ যে জীবনে দৌড়াদৌড়ি নেই, প্রতিযোগিতা নেই, উপরে ওঠার উত্তেজনা নেই৷ আছে শুধু শান্ত, মায়াবী স্নিগ্ধতা৷ খুব ভালোবাসার একজন মানুষ পাশে থাকবে শুধু৷ খুব ভালোবাসার মানুষ, যার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হবে, যত যাই হোক, বেঁচে থাকাটা সুন্দর! যাকে ঘিরে কেটে যাবে শান্ত, নিরিবিলি, স্নিগ্ধ সময়৷ জানালার পাশে বসে কড়া রোদের দিকে তাকিয়ে সেই জীবনের কথা ভাবতে ভাবতে রায়হানের মনটা উদাস হয়ে গেলো৷ সাথে ছেলেবেলার স্মৃতিগুলো মনে করে মনটা খারাপ হয়ে গেলো তার৷ কতটা সময় চলে গেছে জীবন থেকে? কতটা?
দু'হাতে মাথার চুলগুলো টেনে ধরলো সে৷ ভালোবাসার একজন মানুষ! শান্ত নিরিবিলি এক জীবন৷ হাহ! ভালোবাসার একজন মানুষও যে এলো না জীবনে! এতটা পথ চলে গেলো একলা, কেউ এলো না৷ এমন একজনও এলো না, যার মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, বেঁচে থাকাটা অর্থহীন নয়!
কেউ বলল না- ভালোবাসি!
অথচ কি তীব্র হাহাকার বুকের ভিতরে একটু ভালোবাসার জন্য! সেই হাহাকার নিয়ে শান্ত নিরিবিলি জীবন গড়া যে হয় না! বরং বুকের ভিতর জেগে ওঠে তীব্র অস্থিরতা৷
বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে টের পেলো, শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে৷ উঠে ঘরের মধ্যে দুর্বলভাবে একটু হাঁটলো সে৷ ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিংয়ে এসে ফ্রিজ খুলে পানির বোতল বের করে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খেলো৷ আবার রূমে ফিরে এসে টিভিটা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো৷
রিমোট হাতে নিয়ে চ্যানেল ঘুরানো শুরু করলো রায়হান৷ কোনো চ্যানেলে মন বসছে না৷ একের পর এক চ্যানেল পরিবর্তন করতে লাগলো সে৷ তাদের এই এলাকায় বায়ান্নটা চ্যানেল পাওয়া যায়৷ এক থেকে শুরু করে বায়ান্ন নাম্বার চ্যানেল পর্যন্ত গেলো, আবার বায়ান্ন থেকে শুরু করে এক৷ আবার এক থেকে বায়ান্ন৷ এই চলতে লাগলো অনেকক্ষণ ধরে৷ হঠাৎ একটা বাংলাদেশী বাংলা চ্যানেলে এসে থমকে গেলো সে৷
কি যেন একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে, মনে হয় বাচ্চাদের নিয়ে কোনো অনুষ্ঠান, কারণ অনেকগুলি পিচ্চি পাচ্চা দেখা যাচ্ছে৷ অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা করছে ভারী সুন্দর একটি মেয়ে৷ রায়হান খুব অবাক দৃষ্টিতে মেয়েটিকে দেখলো৷ আশ্চর্য সুন্দর মেয়েটি! তাকে দেখতে ঠিক যেন দেবীর মত লাগছে! রায়হানের খুব অদ্ভুত লাগতে লাগলো৷ আশ্চর্য একটা অনুভূতি হচ্ছে তার, যেমনটা তার খুব বেশি হয় না! কেমন যেন একটা ব্যথা হতে লাগলো বুকের মাঝে৷ আবার একই সাথে একটা আশ্চর্য ভালোলাগায় ভরে গেলো মনটা! কি সুন্দর মেয়েটি, আর কি কোমল, মায়ামাখা তার মুখ! মুখটার মধ্যে অপূর্ব একটা শান্ত কোমলতা মিশে আছে৷ সে দীর্ঘাঙ্গী৷ মুখটা লম্বাটে ধরণের৷ পাতলা, লম্বা নাক৷ ভরাট দু'টি ঠোঁট৷ পিঠের মাঝামাঝি পর্যন্ত লম্বা চুল, কপালে একটা ছোট্ট কালো টিপ৷ চোখ দু'টোয় মিশে আছে আশ্চর্য মায়াবী স্নিগ্ধতা৷ কিন্তু এসব কিছুই ছাপিয়ে মুখটায় ফুটে আছে একটা অপূর্ব পরিমিতিবোধ, মর্যাদাবোধ৷ রায়হান মুগ্ধ অবাক দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো৷
তবে মেয়েটির কথা শুনে সে অবাক হলো আরো বেশি৷ অপূর্ব সুন্দর কণ্ঠ মেয়েটির! এত সুন্দর মিষ্টি কণ্ঠ সে প্রায় শোনেইনি বলতে গেলে! আর তার কথা বলার ভঙ্গি এমন, এত সুন্দর, সে কথা বলছে যেন একটা শিল্প তৈরি হচ্ছে! রায়হান অনেকটা সম্মোহিতের মত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো৷ তার বুকের ভিতর স্পষ্টতই কষ্ট হতে লাগলো৷ বহুদিন তার এমন অনুভূতি হয়নি৷ আর টিভি পর্দায় কাউকে দেখে তার সাধারণত এরকম অনুভূতি হয় না, তা সে যেরকমই হোক না কেন৷ তবে এই মেয়েটিকে দেখে হচ্ছে কেন?
রায়হান টিভি থেকে একবারের জন্যও চোখ ফেরালো না, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টে৷ তার মাথায় ইতিমধ্যেই একটা পরিকল্পনা ঘোরা শুরু করেছে৷ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে পরিকল্পনাটা নিয়ে ভাবতে লাগলো৷ একটুপর অনুষ্ঠানটায় বিজ্ঞাপন বিরতি দিলো৷ বিজ্ঞাপন দেখানো শুরু হতেই তাড়াতাড়ি করে পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা তুলে নিলো সে৷ মিলন কাজ করে তার মিডিয়া টিমেই৷ সে থাকেও রায়হানের বাসার কাছাকাছি৷ ফোন করে তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় চলে আসতে বলল রায়হান৷
মিলন পৌঁছে গেলো কয়েক মিনিটের মধ্যেই৷ টিভিতে তখন মেয়েটি কথা বলছে৷ রায়হান তন্ময়ের মত দেখছিলো৷ বেল বাজতেই সে মিলনকে ঘরে নিয়ে এসে টিভির মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, “মিলন, এই মেয়েটিকে দ্যাখো৷ এই মেয়েটি সম্পর্কে খোঁজ বের করতে হবে৷ পারবে?”
মিলন টিভির দিকে তাকিয়ে একবার মেয়েটিকে দেখে বলল, “রায়হান ভাই আমি উনাকে চিনি৷”
রায়হান বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো, “চেনো? কি রকম চেনো?”
“উনার নাম অহনা রহমান৷ খুব ভালো গান করেন উনি৷”
“আচ্ছা...?! কিন্তু তুমি কি ব্যক্তিগতভাবে চেনো?”
“না ব্যক্তিগতভাবে চিনি না৷” একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বলল মিলন৷ “টিভিতেই দেখেছি আগে৷ একটা অনুষ্ঠানে উনাকে গান গাইতে দেখেছিলাম৷ রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইছিলেন৷ খুব ভালো গান উনি৷”
“তাই নাকি? আর কি করে সে?”
“আমি আসলে ঠিক জানি না৷ উনাকে আমি একদিনই দেখছিলাম, আমার উনার কথা মনে আছে কারণ উনার গাওয়াটা আমার খুব ভালো লেগেছিলো৷”
রায়হানের উত্তেজনা লাগছিলো৷ এই মেয়েটিই কি ঠিক মানুষ? এর জন্যই কি অপেক্ষা করে আছে সে?
অস্থির বোধ করতে লাগলো সে৷ বিছানার কোনায় এসে পা নামিয়ে বসলো৷ দু'হাতে মাথার চুল টেনে ধরে ভাবতে লাগলো৷ একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করার ইচ্ছে তার অনেকদিনের৷ অনুষ্ঠানটার অনেক কিছুই তার পরিকল্পনা করা আছে, কিন্তু উপস্থাপনা করার জন্য পছন্দসই মানুষ সে খুঁজে পাচ্ছে না৷ সে ঠিক এই মেয়েটির মত একজনকে খুঁজছে, যার কথা বলাটা একটা শিল্প৷ তার মন বলছিলো এই মেয়েটিই ঠিক মানুষ৷ সে রাজি হলে অনুষ্ঠানটা শুরু করা যায়৷
“মিলন,” মুখ তুলে বলল রায়হান, “তুমি মেয়েটি সম্পর্কে খোঁজ নাও৷ কি কি অনুষ্ঠান সে করেছে সবগুলোর ভিডিও জোগাড় করো৷ সে কোথায় থাকে বের করো৷ তার ফোন নম্বর জোগাড় করো৷ পারবে না?”
“কেন পারবো না?” মিলন হেসে বলল৷ “আপনি কি উনাকে অভিনয়ে আনার কথা ভাবছেন?”
“অভিনয়?” রায়হান একটু থমকে বলল, “নাহ, আমি অভিনয়ের কথা ভাবছি না৷ আমার অন্য একটা প্ল্যান আছে৷ বলব, তবে তুমি আগে ওর সম্পর্কে তথ্য বের কর৷”
“আচ্ছা ঠিক আছে৷”
মিলন চলে যেতে রায়হান আবার টিভি পর্দায় অহনার দিকে তাকালো৷ মেয়েটি অদ্ভুতভাবে বাচ্চাগুলোর সাথে মিশে গেছে, যেন সে নিজেও একটা বাচ্চা! তার মধ্যে কোনো জড়তা নেই, কোনো অহংবোধ নেই৷ তার অপূর্ব কোমলতা নিয়ে একদম ছেলেমানুষের মতই সে বাচ্চাগুলোর দলে ভিড়ে গেছে৷ বাচ্চাগুলোও তার সাথে মিশছে যেন সে তাদেরই সমবয়সী! তার নামটাও সুন্দর৷ অহনা, মানে ঊষা, ভোরের প্রথম আলো৷ বাহ, চমৎকার! অহনার মুখের দিকে তাকিয়ে রায়হানের বুকটা ভালোলাগায় ভরে উঠলো৷ এতদিনে কি সে ঠিক মানুষটা খুঁজে পেয়েছে? তার চোখ চক চক করতে লাগলো উত্তেজনায়৷
(চলবে)