পহেলা বৈশাখে রাজধানী ঢাকার রমনা পার্ক এলাকায় উৎসবের জনস্রোত বয়ে যায়। সারা দেশে এমন করে ঘটা করে বর্ষবরণ এখনও চালু না হলেও মোটামুটি পহেলা বৈশাখ নিয়ে জনসাধারণের মাঝে ক্রমান্বয়ে আগ্রহ বেড়ে চলেছে। এ উৎসবে যারা চালকের আসনে থাকেন, তাদের কর্মকান্ড ক্রমেই একটি বিশেষ সংস্কৃতির পক্ষে প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে। এর ইতিহাস এবং ক্রমবিবর্তন একটু তলিয়ে দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। বাংলাদেশে প্রাচীন কাল থেকে এতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনসমষ্টির সাথে অন্যান্য ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকেরা মিলেমিশে উৎসবের আনন্দে মেতেছে। কয়েক দশক আগেও নববর্ষ মূলত হালখাতা, গ্রামীণ বৈশাখী মেলা ও কৃষকের আনন্দ উৎসবের উপলক্ষ হিসেবে দেখা যেত। শহর জীবনে এটা ’৮০ দশক থেকে স্থান করে নেয়। শহরের মানুষ ক্রমশ যান্ত্রিক জীবনযাত্রায় হাপিয়ে ওঠে, পহেলা বৈশাখ যেন এতে তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে আনন্দের উপলক্ষ এনে দেয়। তাই রাজধানীসহ দেশের প্রধান শহরগুলোতে পহেলা বৈশাখ সাড়ম্বর আনন্দ-ফুর্তির উৎসব হয়ে উঠেছে।
এটি এখন বর্ষবরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রার হাত ধরে একটি ধর্মীয় উৎসবের দিকে রূপান্তরিত হতে চলেছে। ইতিহাসে দেখা যায়, সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বাংলায় বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহন করেন। সম্রাটের আদেশ অনুযায়ী সে সময়কার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর বছর ও আরবী হিজরী সালের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাঙলা সনের নিয়ম তৈরীর কাজ শুরু করেন। বাঙলা বছর নির্ধারন নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ের প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ই মার্চ বা ১১ ই মার্চ থেকে বাংলা সন গননা শুরু হয়। তবে পরীক্ষামূলক এই গননা পদ্ধতিকে কার্যকর ধরা হয় ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর তারিখ থেকে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহনের তারিখ থেকে। প্রথমে ফসলি সন বলা হলেও পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে। বৈশাখ মাসে এই আনন্দ উৎসব মূলত গ্রামীন জীবনে কৃষকের নববর্ষ উৎসব। এতে গ্রাম্য জীবনযাত্রায় একটি নতুন বছরকে অতিবাহিত করার প্রস্তুতি থাকে।
এ উপমহাদেশে প্রাচীন ভারতীয়রা ‘দোলপূর্ণিমায়’ নববর্ষ উদযাপন করত । তাতে আনন্দ উৎসবে একটা ধর্মীয় ভাব ছিল। আধুনিক নববর্ষ পালনের ইতিহাস খুঁজতে গিয়ে দেখা যায়, ১৯১৭ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্ত্তণ ও পূজার আয়োজন করা হয়েছিল। এরপরে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারীর প্রতিবাদে ১৯৬৫ সাল ( ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে) ছায়ানট নামের একটি সংগঠন রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ বর্ষবরণ উৎসব পালনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এসো হে বৈশাখ......এসো , এসো....গানের মাধ্যমে তারা স্বাগত জানাতে শুরু করে নতুন বছরকে। বাংলাদেশে ছায়ানট নামের সংগঠনটির হাত ধরে শহর কেন্দ্রিক বর্ষবরণের উৎসব বিস্তার লাভ করে। যা এখন বাংলাদেশের নগর সংস্কৃতিতে একটি জমকাল উৎসবে পরিনত হয়েছে। ১৯৭২ সালের পর থেকে রমনা বটমূলে বর্ষবরন জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৩ সালে একই ভাবে ভাল কিছু উদ্যোগ নেয়া হয় নববর্ষ পালনের জন্য।
১৯৮৯ সালে বৈশাখী মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে এক ধাপ বাড়তি ছোয়া পায় বাংলা নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠান। তবে বর্ষবরণ উপলে আনন্দ শোভাযাত্রা চারুকলায় ১৯৮৯ সালে শুরু হলেও এর ইতিহাস আরো কয়েক বছরের পুরানো। ১৯৮৬ সালে চারুপীঠ নামের একটি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলে আনন্দ শোভযাত্রার আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে সেই শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রার উদ্যোক্তাদের একজন মাহবুব জামাল শামীম মাস্টার্স ডিগ্রি নিতে পরে ঢাকার চারুকলায় চলে আসেন। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা। ১৯৯৬ সাল থেকে চারুকলার এই আনন্দ শোভাযাত্রা মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবে নাম লাভ করে।
১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ এর আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিার্থী, শিক-শিকিা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীসহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকর্ডসহ মিছিলটি নাচে গানে মাতিয়ে তোলে। ১৯৯২ সালের আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রং-বেরংয়ের পোশাক পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি।
১৯৯৩ সালে ‘১৪০০ সাল উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাট্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ুর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। নববর্ষ উপলে এতে যোগ হয় নতুন মাত্রা। মোদ্দা কথা ১৯৬৭ সালের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালন করা হয়নি। এরপর থেকে প্রতিবছরই বাড়তে থাকে পহেলা বৈশাখ বরণের সাড়ম্বরতা।
বর্ষ বরণের নগর কেন্দ্রিক এ উৎসবে শহরের পথে-প্রান্তরে লাল-সাদা-কমলার বন্যা, সুতি শাড়ি-পাঞ্জাবি, নারীর কপালে লাল-সবুজ টিপ, ব্যবসালয়ে, প্রিয় ঠিকানায় গাঁদার কারুকাজ চোখে পড়ে আর লাল প্রচ্ছদের হালখাতার উত্সব, পুরনো বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা, প্রিয় মানুষটির পাশাপাশি উদ্দেশ্যহীন হেঁটে চলা। আয়োজনের তালিকায় থাকে লোকজ প্রান্তিক সংস্কৃতির সাথে অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠানের মোড়কে হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান। এদিনে নতুন হুল্লোড়ে, আশ্বাসে ফের উন্মেলিত হবে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, অতুল প্রসাদ, লালনের মানস দর্শন। বর্ষবরণের চিরায়ত সংস্কৃতির আধার খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রমনা পার্ক সাজ-সয্যায় জমকাল হওয়ার সাথে রাজধানীর বিভিন্ন শিাপ্রতিষ্ঠান, কাব, পার্কের সৌন্দর্য বর্ধন করা হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা উপলক্ষে চারুকলায় বিশেষ গুরুত্বের সাথে সরা চিত্র আকাঁ হয়। গোল পোড়ামাটির উত্তল মাটির থালায় আঁকা রীতিকেই সরা বলে। ইতিহাসে দেখা যায়, হিন্দু ধর্মের পঞ্চকল্যাণী পটের বংশাবলীর মধ্য থেকে উঠে এসেছে লক্ষ্মীসরা। এ অঙ্কণরীতিও বেশ উপজীব্য। লক্ষ্মীপুজো উপলে ধানের শিষ, কলমী, পদ্ম, প্যাঁচাসহ লক্ষ্মী আঁকা হলেও কৃষ্ণরাধা বা দুর্গামূর্তি আঁকা সরা বাজারে আজও পাওয়া যায়। সরার প্রান্তে এক আঙুলপরিমাণ এক রংএর, বিশেষ করে লাল রংএর পাড় এঁকে মূল দেবচিত্রের সঙ্গে নানবিধ নকশার প্রতিমা আর কয়েকজন সহচরীরও মূর্তিও আঁকার প্রবণতা রয়েছে। এলাকা অনুযায়ী তিন-পাঁচ-সাত পুতলি প্রভৃতি মোটিফের পুতলির সংখ্যা বাড়ে বা কমে। নদিয়া জেলার তাহেরপুর, নবদ্বীপে এখন উত্তর ২৪ পরগণার দত্তফুলিয়া অঞ্চলে লক্ষ্মীসরা তৈরি আর আঁকা হয়।
প্রাচীন কালে এখনকার মত ফটো ছিলনা, ভাস্কর্য ও মুর্তি নির্মাণও ছিল সীমাবদ্ধ। তাই সাধারণ লোকদের মুর্তির উপর ভরসা না করে লক্ষ্মীর পটচিত্রকে ঘরে বসিয়েই পূজা ও লৌকিক নানা ক্রিয়া কর্ম করা হত। এটি একটি পোড়া মাটির সাধারণ সরা বিশেষ। চাকতির মত একটি উত্তল পিঠে রঙ দিয়ে লক্ষ্মী দেবীর ছবি হাতে আঁকা হয়। তবে লক্ষ্মীর পটে শুধু লক্ষ্মীর ছবিই থাকে না, সেখানে আরো দেব দেবীর সমাবেশ থাকে। যেমন কোন কোন সরাতে লক্ষ্মী দেবী পরিবৃতা থাকেন পরিচারিকাদের দ্বারা, পাশে নারায়ন। আবার কোনো কোনোটাতে স্বামী নারায়ন সহ লক্ষ্মী, কৃষ্ণ, রাধা ও নারায়ন। এমনকি লক্ষ্মীর অবতাররূপিনী দূর্গার চিত্রও দেখা যায়। দেবী দূর্গা এখানে লক্ষ্মীর মাতারূপে আবির্ভূতা।
সরা শিল্পীরা প্রথমে মাটি ছেনে মাটির তালকে হাতের দুতালুর চাপে রুটির মত গোল আকৃতি দেন এর নাম চরা কাটা। এবার ঐ সরা আকৃতির তালকে কেনো পকা সরার ওপরে রেখে জলমাটির(ঘোলা) তরল মিশ্রণে ভেজানো পাতলা ন্যাকড়ার সাহায্যে মসৃণ করা হয়। এবারে কিছুণ ছায়ায় রেখে সেটিকে শোকানো হয়। এরপর ভাটিতে পোড়ানোর জন্য যায় এই সরা। লক্ষ্মী সরার ওপর যেসব চিত্র আঁকা হয় নবদুর্গা, পাঁচপুতুল রাধাকৃষ্ণ, দুইপুতুল লক্ষ্মীনারায়ণ, এক লক্ষ্মী, তিন লক্ষ্মী, পাঁচ পুতুল ময়ূর প্রভৃতি। বাংলার কোন কোন ঘরে বিশেষ করে হিন্দু অব্রাহ্মণ শ্রেণীর লোকেরা শারদ পূর্ণিমা তিথিতে রাতে লক্ষ্মীর পট বসিয়ে পূজা করতেন। এ দেশে মোটামুটিভাবে চার রকমের লক্ষ্মীর সরা পাওয়া যায়- ঢাকাই সরা, ফরিদপুরী সরা, সুরেশ্বরী সরা ও গণকী সরা। ঢাকাই সরার উৎপত্তি ঢাকা জেলায়। এ সরার কিনারা কিছুটা উঁচু করা। লক্ষ্মী নারায়ন এ সরায় মুখোমুখি দাঁড়ানো থাকে। তাঁদের হাতে ধরা থাকে ধানের শীষ। রতœভান্ডার ও পেঁচা থাকে লক্ষ্মীর পায়ের কাছে।
বাংলাদেশের ঢাকাই সরা বা ফরিদপুরের সরার নিজস্ব আঁকার পদ্ধতি রয়েছে। ঢাকাই সরার দেবদেবী আঁকার নিচের দিকে থাকে একটি নাওএর প্রতিমা আর ফরিদপুরের সরাতে দেবদেবীরা সাধারণতঃ একটি চৌখুপির মধ্যে থাকেন। ফরিদপুরী সরার কিনারা উঁচু নয়। সুরেশ্বরী সরার গোলাকার তলটি পাঁচটি প্যানেলে ভাগ করা হয়। মাঝের প্যানেলে আঁকা হয় লক্ষ্মী দেবীর মুর্তি। গণকী হল হিন্দু সমাজের একবারে নিম্নস্তরের লোকদের ব্যবহার্য সরা। এ সরার পটভূমিতে লাল ও সরার কিনারায় কালো রঙ থাকে। এ পটের প্রধান দেবী দূর্গা ও তাঁর পরিবার, নীচের প্যানেলে লক্ষ্মী ও তাঁর বাহন প্যাঁচা। ফরিদপুরের সুরেশ্বরী সরার উপরিঅংশে সপরিবারে মহিসাসুরমর্দিনীর ছবি আঁকা হয়, আর নিচে সবাহন লক্ষ্মীমূর্তি থাকে। চারুকলার সরাতে ছাত্রছাত্রীরা প্রাচীন রীতির সাথে পোস্টার কালারে হাতি, বাঘের মুখে বকের ঠোঁট, মাছ, ঘোড়া, গ্রামীণ বধূ, ময়ূর, নৌকা, মাছ ইত্যাদি এঁকে থাকে।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১২ বিকাল ৩:০০